কিছু গল্প আমরা আমাদের কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করি। বাস্তব জগতের গল্পগুলোকে হারানোর জন্য। সেগুলোকে রূপকথা বলা হয় । আর কিছু গল্প বাস্তব। তাদের জন্ম আমাদের এই চিরচেনা পৃথিবীতে। কিন্তু তারা হার মানায় আমাদের সকল কল্পনাকে। হার মানায় রূপকথাকে। আজকের গল্পটা তেমনই এক গল্প। সে গল্পের একজন নায়ক আছে। আর সে নায়ক রূপকথার নায়কদের মতোই। অসম্ভব হ্যান্ডসাম। কিন্তু তাকে হিরো বলছি কেন? তিনি কি রূপকথার গল্পের মতই কোন রাজকন্যাকে দৈত্যের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন?
না, আমাদের হিরো তেমন কিছু করেননি, বরং এর চেয়ে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। উৎসর্গ করেছেন জীবনের প্রায় সবকিছু।
তিনি একজন আরব। বাস করতেন মক্কায়। আরবের সবথেকে দামী আর স্টাইলিশ ড্রেস পরতেন। সবথেকে সেরা আতর ব্যবহার করতেন। বড়লোকের সন্তান। সে সময়কার সবচেয়ে স্টাইলিশ জুতা থাকতো তাঁর পায়ে। তখনকার যুগে ইয়ামেনী জুতা ছিলো সারা বিশ্বে বিখ্যাত। আর যুবকের পায়ে থাকতো ইয়ামেনী জুতার মধ্যেও সবচেয়ে দামী জোড়াটি। যুবকের নাম মুসআব ইবন উমাইর। উষর আরবকে কেউ জাগাতে পারেনি। রোমক-পার্সী কেউ না। সপ্তম শতাব্দীর সেই সময়টা ছিলো ইতিহাসের অন্ধকারময় সময়। এমন সময়ে আরবভূমি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের ছোঁয়ায় জেগে উঠলো। এর প্রভাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারলেন না মুসআব ইবন উমাইর।
মক্কায় মুহাম্মাদ ﷺ নামের একজন সকল দেব-দেবীর উপাসনা ছেড়ে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করা শুরু করলেন। মুসআব চিন্তা করলেন বিষয়টা তলিয়ে দেখা দরকার। ইতোমধ্যেই তিনি খবর পেলেন মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর সঙ্গীরা কুরাইশদের অত্যাচার থেকে বেঁচে আলোচনা করার জন্য মক্কার উপকণ্ঠে আরকাম নামের একজন বিশ্বস্ত সাহাবীর বাড়িতে মিলিত হচ্ছেন। এটা সেই বিখ্যাত দারুল আরকাম যেখান থেকে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ গোপনে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। সাক্ষাৎ করতেন তাঁর সাহাবীদের সাথে। কৌতুহলী মুসআব তাঁর কৌতুহল মেটাবার জন্য এ বাড়িটিতে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। মুসআব এমন এক বরকতময় সন্ধ্যায় সেখানে উপস্থিত হলেন যে, তিনি দারুল আরকামে উপস্থিত হতে না হতেই রাসূলুল্লাহ্ ﷺ -এর উপর নতুন ওহী নাযিল হলো। তিনি দেখলেন, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ সেই ওহীখানা তিলাওয়াত করে উপস্থিত সকলকে শুনালেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে আল্লাহ্র সেই কালাম শুনলো।
তিলাওয়াতকৃত কুরআনের বাণীর তীব্র আকর্ষণ মুসআবের মন-প্রাণ কে ভীষণভাবে নাড়া দিলো। ইতোমধ্যে মুসআব (রাঃ), রাসুলুল্লাহ্ ﷺ এর সামনে এসে পড়েছেন। তিনি মুসআব( রাঃ) -কে স্বাগত জানালেন এবং তাঁর একটি বরকতময় পবিত্র হাত মুসআবের বুকের ওপর রাখলেন। মুসআব (রাঃ) যেন দারুন এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়লেন। মুসআবের অন্তর ভীষণ উত্তেজনায় আপ্লুত হলো। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন তার পরবর্তী জীবনের প্রাণ-প্রিয় নেতার কাছ থেকে।
সেই মহান নেতা, যাঁর মুখের নির্দেশে শিষ্যরা সাগরে ঝাঁপ দিতেও দ্বিধা করতেন না। তাঁর নির্দেশের মোকাবিলায় সবকিছুই তুচ্ছ। অকাতরে বিলিয়ে দিতেন প্রাণ। প্রাণপ্রিয় মাকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করলেন মুসআব (রাঃ)। তাঁর মা চেষ্টা করলেন ছেলেকে কড়া পাহারায় বন্দী করে রাখতে। কিন্তু যার হৃদয় রাসূল (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, তাকে কে বন্দী করবে? বন্দীদশা থেকে পালালেন তিনি। প্রাণপ্রিয় মাকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করলেন মুসআব।
গন্তব্য এবার আফ্রিকার দিকে। জীবনের এক নতুন অধ্যায় তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আবিসিনিয়ায়। সে অধ্যায় সংগ্রামের। সে অধ্যায় চরমতম দারিদ্র্যের, যা তাঁর উজ্জ্বল ত্বককে বিবর্ণ করে দিয়েছিলো। স্টাইলিশ ড্রেস পরতে অভ্যস্ত মুসাআব খুশি মনে পরিধান করলেন বস্তার মতো পোশাক!
আবিসিনিয়া থেকে মুসআব আবার একদিন মক্কায় ফিরে এলেন। তিনি মক্কার পথে হেঁটে চলেছেন আর লোকজন কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে নতুন মুসআবকে দেখছে। এতে তিনি নিজেও কিছুটা পুলকিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, লোকজন দেখুক যে মুসআব একসময় জাহিলিয়্যাতের চরম ভোগ-বিলাসে জীবন কাটিয়েছে সে মুসআব এ নয়; এ তো দ্বীন-ইসলামের এক নগণ্য খাদেম!
তাঁর মা খুনাইসও খবর পেলেন ছেলে ফিরে এসেছে। দীর্ঘদিন পর মা আর ছেলের দেখা হলো। দু’জনেই আবেগাপ্লুত ছিলেন। খুনাইস আশা করেছিলেন ছেলে মুহাম্মাদের ﷺ প্রচার করা ‘অদ্ভুত’ বিশ্বাস ত্যাগ করে ফিরে এসেছে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি বুঝলেন তাঁর এই ধারণা ভুল। ক্রোধে তিনি ফেটে পড়লেন। মুসআবকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তিনি শেষ চেষ্টা করবেন বলে স্থির করলেন । তিনি ছেলেকে আবার বন্দী করে বেঁধে ফেলার জন্য ভৃত্যদেরকে আদেশ করলেন। মুসআব মায়ের সকল অত্যাচার কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিয়েছিলেন সবসময়। কিন্তু এবার তিনি মাকে শপথ করে বললেন, কেউ যদি তাঁকে বন্দী করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের সবাইকে তিনি হত্যা করবেন। খুনাইস জানতেন তাঁর ছেলে কখনও অনর্থক কথা বলে না। তার উপর তাঁর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তাও তাঁকে অবাক করেছিলো।
মা আর সন্তানের বিচ্ছেদ ধীরে ধীরে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো যদিও দু’জন দু’জনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। মা-পুত্র দু’জনই এহেন পরিণতি মেনে নিতে পারছিলেন না, কিন্তু এর মাধ্যমে ঈমানের উপর মুসআবের এবং কুফরের উপর খুনাইসের অটল দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। খুনাইস, মুসআবের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মুসআব (রাঃ) পরিবারের বিশাল ঐশ্বর্য আর বিত্তের উত্তরাধিকারী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলেন। দু’জনের শেষ দেখায় খুনাইস বললেন, “যে পথে তুমি পা বাড়িয়েছো, তুমি সে পথেই চলে যাও। তবে জেনে রাখো, আজ থেকে আমি আর তোমার মা নই।”
এতো কর্কশ কথা শুনেও মুসআব ঘাবড়ে গেলেন না। রেগেও গেলেন না। বরং শান্ত কণ্ঠে বললেন, “মা, আপনাকে আমি জানি আর আমি ভালোবাসি আপনাকে। আমি আপনাকে ‘আশহাদু আল্-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু-এ সাক্ষ্য দেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।”
“আকাশের ছুটন্ত তারকার শপথ! আমার অন্তর, চিন্তাশক্তি যদি লোপও পেয়ে যায়, তবুও আমি তোমার এ দ্বীন গ্রহণ করবো না।” তাঁর মা জবাব দিলেন।
মুসআব আবার ঘর ছাড়লেন। পেছনে ফেলে এলেন বিপুল ঐশ্বর্য আর বিলাসিতার জীবন। আরবে যে-ই তাঁর এ অবস্থার কথা শুনতো, ভীষণ অবাক হয়ে ভাবতো এটাও কীভাবে সম্ভব!
বাড়ি-ঘর ছাড়া মুসআব ঘুরে বেড়ান মদীনার পথে পথে। ইবনে হিশামের বর্ণনায় বলা আছে, অনাহারে অর্ধাহারে অপুষ্টিতে তাঁর গায়ের চামড়া এমনভাবে উঠে গিয়েছিলো যেমন সাপ তার খোলস পরিবর্তন করে।
একদিন মুসআব রাসুলুল্লাহ্ ﷺ এর কাছে এলেন যেখানে রাসুলুল্লাহ্ ﷺ কে ঘিরে মুসলিমদের একটি দল বসে ছিলো। দূর থেকে মুসআবকে আসতে দেখে উপস্থিত লোকদের দৃষ্টি নত হয়ে গেলো। দলের অনেকেই কেঁদে ফেললেন। কারণ মুসআবের পরনে ছিলো তালি দেওয়া একটি জীর্ণ জুব্বা।
ইসলাম-পূর্ব মুসআবের ছবি তাঁদের হৃদয়ে ভেসে উঠলো। এই কি সেই মুসআব! একদিন যার গায়ে থাকতো আরবের সবচেয়ে দামী পোশাক, আরবের বিলাসিতা আর সৌন্দর্যের মডেল ছিলো সে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ ﷺ মুসআবের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হলেন। তাঁর দিকে চেয়ে স্মিত হেসে উপস্থিত সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এ মুসআবকে আমি মক্কায় তার বাবা-মার সাথে দেখেছি। তারা ওকে খুব যত্ন করতেন এবং তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সবকিছুই করেছেন। কুরাইশদের মধ্যে কোনো যুবকই তার মতো ছিলো না। এরপর এ সমস্ত কিছু সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করে এসেছে এবং নিজেকে সে রাসূলের কাজে নিবেদিত করেছে।”
বদর যুদ্ধে বন্দীদের মধ্যে একজন বন্দীর নাম ছিলো আবু আজিজ ইবনে উমাইর। এ আবু আজিজ ছিলন মুসআব ইবনে উমাইরের ভাই। যুদ্ধবন্দী থাকাকালীন সময়কার কথা আবু আজিজ পরে বর্ণনা করেন-
“বন্দী থাকা অবস্থায় আমি একদল আনসারের দায়িত্বে ছিলাম। তারা যখনই খেতে বসছিলো, তখনই আমাকেও রুটি এবং খেজুর খেতে দিচ্ছিলো। এ ছিলো রাসূলের ﷺ নির্দেশ পালন, যে নির্দেশে তিনি তাদেরকে আমাদের সাথে ভালো আচরণ করতে বলেছিলেন। আমার ভাই মুসআব একসময় আমার পাশ দিয়ে গেলেন এবং আনসারদের যে ব্যক্তিটি আমার বন্দীত্বের দায়িত্বে ছিলো তাকে বললেন, ‘একে শক্ত করে বাঁধো। এর মা হলেন একজন অত্যন্ত সম্পদশালী মহিলা এবং তিনি এর বিনিময়ে প্রচুর মুক্তিপণ দিতে সক্ষম।’”
আবু আজিজ যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে মুসআবের দিকে ফিরে তিনি বললেন, “আপনি আমার ভাই আর আমার ব্যাপারে এটা আপনার কেমন নির্দেশ!”
“তিনি হলেন আমার ভাই, তুমি নও।”, সাথের আনসার সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন মুসআব।
এতো ইস্পাত দৃঢ়তা থাকার পরেও মুসআব কি ভাবতে পেরেছিলেন অন্তিম মুহূর্তে এমন ব্যাথা সইতে হবে তাঁকে?
ওহুদের প্রান্তর। খুনী মরুভূমির সূর্য যেন আগুন ঢালছে। চারদিকে তরবারীর ঝঙ্কার। কিছু সঙ্গীর ভুলে প্রাণপ্রিয় নেতার জীবন শঙ্কার মুখে। কী করবেন মুসআব?
হ্যাঁ, এটাই একমাত্র পথ। তাঁর চেহারা যে অনেকটা রাসূল ﷺ এর মতোই। নেকড়ের মতো চিত্কার করতে শুরু করলেন মক্কার ধনীর দুলাল সেই সুদর্শন যুবক। যাতে শত্রুরা তাঁকে মুহাম্মাদ ﷺ ভেবে ভুল করে। সব আঘাত তিনি সহ্য করতে পারেন। মাকে ত্যাগ করে আফ্রিকায় পাড়ি জমাতে পারেন, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু নেতার দেহে একটি আঘাত তাঁর সহ্যের বাইরে। তাঁর চিৎকারে মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহীর দিকে মুশরিকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো এবং তারা প্রথমে এ পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত করে পরবর্তী লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিলো। একজন মুশরিক সেনা তাঁর ওপর আক্রমণ করলো। একহাতে মুসলিম বাহিনীর পতাকা আর অন্য হাতে তরবারী নিয়ে তিনি প্রচণ্ড বেগে লড়াই করতে থাকেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে এক অশ্বারোহী মুশরিক সেনা তরবারীর আঘাতে মুসআবের ডান হাত তাঁর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। তিনি তৎক্ষণাৎ বাম হাতে পতাকা তুলে ধরলেন।
যুদ্ধের প্রান্তরে তলোয়ার ঝনঝনানি ভেদ করে একটা আওয়াজ শোনা গেলো – “মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে…!!” তিনি জানতেন না যে ওটা ছিলো বিভ্রান্ত শত্রুর ভুল উক্তি।
মুসআব বলে উঠলেন, ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল…আর মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহর একজন রাসূল! তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।”
যে সকল মুসলিম একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, তাঁরা সবাই যেন জেগে উঠলেন। ইতোমধ্যে আরেক মুশরিক সেনা তার বাঁ হাতটি বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। তিনি এবার বাহু দুটির অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা আঁকড়ে ধরে রাখলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন- “মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহর একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে” তবুও ইসলামের পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দিলেন না। এমতাবস্থায় ইবনে কামিয়া নামের এক নরাধম এসে একটি তীক্ষ্ম বর্শা দ্বারা তাঁর দেহে আঘাত করলো, বর্শাটি তাঁর দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেললো। এবার মুসলিম বাহিনীর পতাকা মাটিতে পড়ে গেলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যে কথাটি (‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল…মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে) বলে গেছেন, পরবর্তীতে সে কথা রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর কাছে আল্লাহ্ কুরআনের একটি আয়াত (সূরা আলে ইমরান:১৪৪) হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন এবং পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ কথাটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সংরক্ষিত থাকবে।
যুদ্ধ শেষ হলো। রাসুলুল্লাহ্ ﷺ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধ ময়দানে ঘুরে ঘুরে শহীদ মুসলিমদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এবং তাদের জানাজার আয়োজন করছিলেন। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে তিনি প্রিয় মুসআবের কাছে এলেন। মুসআবকে দেখে তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রগড়িয়ে পড়ছিলো। মুসআবের দেহকে ঢেকে দেবার জন্য একখণ্ড কাপড় চাওয়া হলেও একমাত্র তাঁর পোশাকটি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাচ্ছিলো না। যে জামাটি তাঁর ছিলো, সেটি দিয়ে তাঁর পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে পড়ছিলো এবং মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে পড়ছিলো। অবশেষে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বললেন, “জামাটি দিয়ে ওর মাথা ঢেকে দাও এবং পা ইখজির (এক প্রকার ঘাস) দিয়ে ঢেকে দাও।”
উহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ্ ﷺ তাঁর প্রিয় অনেক মানুষকে হারিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন তাঁর চাচা হামযা (রাঃ), যার দেহকে কাফিররা পৈশাচিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছিলো। কিন্তু মুসআবের দেহের সামনে এসে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন তখনকার কথা যখন তিনি মুসআবকে প্রথম দেখেছিলেন মক্কায়। তখন মুসআব ছিলেন মক্কার সবচেয়ে স্টাইলিশ যুবক, তাঁর গায়ে ছিলো সময়ের সেরা এবং দামী পোশাক, অথচ আজ তাঁর মৃতদেহটিকে ঢেকে দেবার জন্য একটি পূর্ণ কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।
রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এরপর অশ্রুসিক্ত চোখে যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকে মুসআব এবং তাঁর অন্য শহীদ সাথীদের লক্ষ করে বললেন, “আল্লাহর রাসূল সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে তোমরা হলে শহীদ এবং কিয়ামাতের দিন এ মর্যাদা নিয়েই তোমরা উত্থিত হবে।”
সত্যিই, রাসূলুল্লাহ্ﷺএর এ স্বীকৃতি একজন মুমিনের জন্য পৃথিবীর সেরা প্রাপ্তি, যা মুসআব অর্জন করে আল্লাহর কাছে পৌঁছেছিলেন।
আমাদের কাছে হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হতে পারে অনেক অর্থ-বিত্ত, আভিজাত্য। আমাদের যাদের কাছে দুনিয়ার জীবনই মুখ্য তাদের কাছে ধনী এক যুবকের পরিবারকে ত্যাগ করা, আভিজাত্যকে ত্যাগ করা, বিলাসিতার জীবনকে ত্যাগ করে দরিদ্রতাকে বরণ করা, নেতার মৃত্যুর কথা শুনে যুদ্ধ থেকে না পালিয়ে জীবন বিলিয়ে দেওয়া নিছক বোকামি ও হেঁয়ালীপনা ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু যাদের কাছে আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনটা ছিলো বিশাল সাগরে এক ফোঁটা জল, তাদের কাছে এত কষ্টের বিনিময়েও জান্নাত ছিলো সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আমাদের কাছে এটা হয়তো নিছক একটা গল্প, কিন্তু এটা তো তাঁদের গল্প যারা এক ফোঁটা জলের বিনিময়ে রূপকথাকেও হার মানিয়েছিলেন। গভীর ভালোবাসায় জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আগলে রেখেছিলেন ইসলামের পতাকা।
আমরা যারা পরকালকে উপেক্ষা করে দুনিয়াতে সামান্য কিছু অর্জন করে নিজেকে হিরো ভাবা শুরু করি, আল্লাহর শপথ আমরা কখনোই সফলকাম নই, সফলকাম তো তাঁরা যারা আভিজাত্যের পোশাক ছেড়ে দারিদ্র্যের পোশাক পরেছিলেন।
সফলকাম তো তাঁরা, যারা এক ফোঁটা জলের বিনিময়ে পুরো সমুদ্র কিনে নিয়েছিলেন।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।