এককাশ্মীরে আসার পর থেকে লক্ষ্য করেছি এখানকার মানুষের মনে একটা কষ্ট যেন তুষের আগুনের মত ধিকে ধিকে জ্বলছে। প্রথম নজরে কাশ্মীরকে দেখলে হয়ত অনেকের চোখে এই অস্বাভাবিকতা ধরা পরবে না। কারণ পর্যটকরা এখানে আসে নিজেদের আমোদ ফুর্তির জন্য, দর্শনীয় জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, স্যুভেনির কেনে, গাইড, পোর্টার অথবা রেস্টুরেন্টের বেয়ারাদের টিপস দেয়। আত্মকেন্দ্রিক আনন্দ মুখর কিছু দিন কাটিয়ে কাশ্মীরের সৌন্দর্য ভোগ করে কয়েকদিন পর নিজের দেশে চলে যায় । এসব করতে গিয়ে অনেকেরই খেয়াল করেন না যে, এই সৌন্দর্যের পিছনে আরো এক কালো অধ্যায় থাকতে পারে।
যাদের দেশে এত উল্লাস করছি তাদের মনে কত ক্ষোভ আছে, কত লুকানো কান্না আছে, তা আমরা বিদেশীরা কল্পনাও করতে পারবো না। তবে যদি কেউ যদি ভাল করে নজর দেয় এবং সাধারণ কাশ্মীরী নাগরিকদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তাহলে অসঙ্গতির কারণটুকু জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। শ্রীনগরে রাস্তায় রাস্তায় কিছুদূর পর পর দেখা যায়, আর্মি ক্যারাভান, চেক পোস্ট, যেখানে সেখানে আর্মিরা দাঁড়িয়ে আছে। এক কথায় চোখে পড়ার মত কঠোর নজরদারির পরিবেশ সবখানে। শ্রীনগরের রাস্তায় হাঁটলে, হঠাৎ করে মনে হয় যুদ্ধাবস্থা চলছে এমন কোন দেশে এসে পড়েছি।
বাংলাদেশের মানুষ জীবনেও এত বাঁধা নিষেধের ভেতর শান্ত হয়ে থাকত না। অবশ্য কাশ্মীরের জনগণও যে এসব হাসি মুখে মেনে নিচ্ছে না। স্থানীয়দের সাথে কথা বললে সহজেই বোঝা যায়, সেখানে কিভাবে ধীরে ধীরে বিদ্রোহ দানা বাঁধছে! প্রতিনিয়ত ভেতরে ভেতরে সরকারের বিরুদ্ধে গুমড়ে উঠছে জনগণ। এখন যেন প্রয়োজন শুধু একটি স্ফুলিঙ্গের, অতঃপর অগ্নুৎপাতের মত বহিঃপ্রকাশ হবে এত দিনের জমানো ক্ষোভ। বহুদিন ধরে ছোটখাট বিদ্রোহ যে একেবারেই হচ্ছে না, তা নয়! কিন্তু শক্তিশালী ভারতীয় আর্মি বরাবরই ‘কাশ্মীরী বিদ্রোহী’দের কঠোর হস্তে দমন করে। এসব দেখলে মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কাছে আমরা ছিলাম দেশদ্রোহী এবং তারা আমাদেরকে দমন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের জয়লাভের পর পাকিস্তানীরা হয়েছে হানাদার এবং আমাদের নাম হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। ইতিহাস নিয়ে একারণেই বলা হয়, “History is always written by the winners”. হয়তো একদিন কাশ্মীরি বিদ্রোহীদেরকেও বিশ্ববাসী চিনে নেবে ‘মুক্তিসেনা’ হিসেবে!!
দেশ ভাগের পর থেকে মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের মুসলমানরা নিজেদের ভারতের অংশ হিসাবে এক দিনের জন্যেও মেনে নেয় নি। অনেকবার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। কিন্তু শক্তিশালী ভারতীয় সেনাদের সাথে তারা কিছুতেই পেরে উঠেনি। ভারতের বিশাল সেনাবাহিনীতে প্রায় ১৪ লাখের বেশি সেনা আছে। এবং এর এক পঞ্চমাংশ আর্মি মোতায়েন রয়েছে শুধু মাত্র কাশ্মীরে। চায়না আর পাকিস্তান বর্ডার সামলে রাখা আর কাশ্মীরের বিদ্রোহী জনতাকে কাবু করে রাখাই এদের উদ্দেশ্য।
দুই‘বিদ্রোহীদের’ মোকাবেলা করার জন্য কাশ্মীরে ভারতীয় সরকারের কিছু বিশেষ বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন উদাহারন স্বরূপ বলা যায়, কাশ্মীরে প্রি পেইড ফোন কাজ করে না। সরকার থেকে ‘নিরাপত্তার’ খাতিরে এখানে প্রি- পেইড ফোনের ব্যাবহার নিষেধ। কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল কথাটা শুনে। এ এলাকায় স্বাধীনতার ব্যাপারে মন খুলে কথা বলতে ভয় পায় অনেকে। এখনো মনে আছে শ্রীনগর হতে কিছুটা দূরের, কাশ্মীরের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ গুলমার্গ থেকে ফেরত আসার সময় এক রেস্টুরেন্টে খাবার জন্য থেমেছিলাম।
সেখানে এক স্বাধীনতাকামী নাগরিকের সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল। তার সাথে গল্প করার এক পর্যায়ে সে বলতে শুরু করেছিল তাদের স্বপ্নের কথা। স্বপ্নালু চোখে লোকটি বলছিল, যদি তারা কখনো স্বাধীন হয়, তাহলে নিজেদের যা আছে তা দিয়ে তারা দেশ চালাতে পারবে, পর্যটন শিল্প হবে তাদের প্রধান আয়ের উৎস। বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে গল্প করার পর সে হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। যেন দেয়ালেরও কান আছে। এসব কথা সব জায়গায় আলোচনা করা ঠিক নয়। আমার বুকের ভিতর কেমন একটা শীতল ভয় এসে ধাক্কা দিল। যদি কেউ শুনে ফেলে আমাদের কথা, তার সাথে সাথে আমরাও তো বিপদে পড়ব। না জানি কোথায় ছড়িয়ে আছে সরকারি গুপ্তচর।
যদি মাত্র একজনের মুখ থেকে তাদের স্বাধীন হবার স্বপ্নের কথা শুনতাম, বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা বলে চালিয়ে দিতাম। কিন্তু কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকার একাধিক মানুষের মুখে শুনেছি এই এক বুলি। অনেকে আছে ভয়ে ভয়ে মনের গোপন ইচ্ছেটি ব্যক্ত করে। আবার অনেকেই আজকাল নির্ভয়ে স্বাধীনতার কথা বলে, ভয় পেতে পেতে তাদের মাঝে যেন জিদ চেপে গেছে। কাউকেই কেয়ার করে না তারা। আমরা যখন শপিং করতে যেতাম, এ জনপদের লোকজনদের জীবন কাহিনী শোনার জন্য দোকানদারদের সাথে আলাপ জুড়ে দিতাম। তারা যখন শুনত আমরা বাংলাদেশী, শুধু মাত্র তখন আমাদের সাথে মনের কথা খুলে বলত। কারণ ভারতের অন্য কোন অংশের মানুষের সাথে মনের কথা বলা তাদের জন্য নিরাপদ নয়।
বাংলাদেশীদের বিশ্বাস করার কিন্তু আরো একটি কারণ আছে। কাশ্মীরীরা আমাদেরক দেখলে নিজেরা নিজেদের মনকে আশ্বাস দেয়, একদিন তারাও নিশ্চয় আমাদের মত স্বাধীন হবে। আমাদের দিকে তারা অদ্ভুত ঈর্ষা মিশ্রিত সম্মানের চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন আমরা মুক্ত বিহঙ্গ, আমাদের খাঁচায় বন্দি ভাইদের দেখতে গেছি। যেন আমরা তাদের সাহস যোগাতে গেছি, যেন আমরা বলতে গেছি একদিন তোমরাও পারবে। আমি কাশ্মীরে না আসলে কখনো বুঝতামনা আল্লাহ্ আমাদের কত বড় নেয়ামত দিয়েছেন, আমরা কতটা ভাগ্যবান, স্বাধীনতার স্বাদ কত সুমধুর!! জন্ম থেকে লাভ করা সৌভাগ্যকে খুব কম মানুষ মূল্যায়ন করতে পারে।
একবার এমনও হয়েছে যে, আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় পেয়ে এক দোকানদার চা এর দাওয়াত দিয়ে বসলেন। আবার অন্য একদিন এরকম একজন উৎসাহী দোকানীর কাছে এক মজার গল্প শুনলাম। বহুবছর আগে একবার কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছিল। ভারতের মাটিতে পাক-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। পাকিদের প্রচন্ড চাপের মাঝে খেলতে হয়। কারণ তাদের পক্ষে কোন ভারতীয় সমর্থক খুঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু কাশ্মীরে ঘটেছিল সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। যতবার ভারতের উইকেট পড়ছিল, কাশ্মীরীরা উল্লাসে ফেটে পড়ছিল, পাকিস্তানের প্রতিটি চার আর ছক্কায় হাততালি আর চিৎকারে স্টেডিয়ামে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। কিন্তু ভারতের পক্ষে কেউ কোন করতালি দিচ্ছিল না। সবাই পাকিদেরই সমর্থন করে যাচ্ছিল। ভারতীয় দল তীব্র অপমানিত হয়ে সেবার ফিরে যায় এবং বলা বাহুল্য এর পর থেকে কাশ্মীরের মাটিতে আর কখনো পাক-ভারতের কোন ক্রিকেট ম্যাচ হয়নি।
এখানে উল্লেখ্য পাকিস্তানীদের সবাই সমর্থন করছিল মানে এই নয় যে, এই অঞ্চলের মানুষ তাদের খুব ভালবাসে। দর্শকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বিরুদ্ধে যাওয়া। এখানে পাকিস্তানের বদলে যদি অতি ফালতু কোন দল খেলত, সেই দলও এরকম সমর্থন পেত। কারণ কাশ্মীরীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় তারা কোন দেশের অংশ হতে চায়, ভারতের নাকি পাকিস্তানের? তখন তারা বলে, কোন দেশের অংশ হবার শখ তাদের নেই। তারা শুধু স্বপ্ন দেখে স্বনির্ভর আজাদ কাশ্মীরের।
তিনএক রাশ স্বপ্ন চোখে নিয়ে বেঁচে থাকা এ মানুষগুলোর কথা ভাবতে গেলে মাঝে মাঝে মনে হয়, আসলেই কি স্বাধীনতা সকল সমস্যার সমাধান আনতে পারে? স্বাধীনতা কি দিতে পারে অনন্ত সুখ? তাই যদি হত তাহলে আমাদের দেশের এখন এই অবস্থা কেন? হতে পারে আমাদের বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে গত ৪৮ বছরে, কিন্তু এই উন্নতির পরিমাণ কি আশানুরূপ? পশ্চিম পাকিস্তান যেমন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করত, তারা যেভাবে বাঙ্গালীদের অর্জিত অর্থ দিয়ে নিজের দেশের উন্নতি করত। এত বছরেও আমরা কি তাদের চেয়ে খুব বেশি আলাদা হতে পেরেছি? এখনো তো আমাদের মতো শহুরে কিছু সুবিধাবাদী মানুষ রক্তচোষার মত শুষে নিচ্ছে দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। অসৎ মন্ত্রী-আমলারা আমাদের টাকা নিয়ে নিজেদের সুইস ব্যাংক এর একাউন্ট ভারী করছে। নিজেদের স্ত্রী- সন্তানদের বিদেশে পাচার করে আমাদের সন্তানদের জীবন নিয়ে রাজনীতি করছে। সুবিধাবাদীরা সব যুগেই ক্রিম খাচ্ছে, আর বঞ্চিতরা চিরকাল বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। ধনতান্ত্রিক এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা হচ্ছে দরিদ্রতর।
কাশ্মীরের ভাগ্যে কি আছে জানিনা। সত্যি তারা যদি কখনো স্বাধীন হয়, তাহলে পরিণত হবে land locked দেশে। অর্থাৎ তাদের থাকবেনা কোন সমুদ্র সীমা। যার ফলে আমদানি- রপ্তানিতে নির্ভর করতে হবে প্রতিবেশী দেশের উপর। ভারতের থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে, ভারত নিশ্চয় তাদের সাহায্য করবে না। আর পাকিস্তান অথবা চীন নিশ্চয় চাইবে কাশ্মীরকে তাদের প্রদেশ বানিয়ে ফেলতে। শুধুমাত্র পর্যটন শিল্প দিয়ে কোন দেশ কি স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে? , ‘আজাদ কাশ্মীর’ এর স্বপ্ন আপাতদৃষ্টে স্বপ্ন-বিলাসী মনে হলেও, আশা করি একদিন তারা নিজের দেশে প্রাণ খুলে হাসতে পারবে, নজরদারীমুক্ত স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারবে। তাদের জন্য স্বাধীনতা যদি কল্যাণকর হয়, আল্লাহ্ নিশ্চয় তাদের মনের আশা পূর্ণ করবেন। এবং ভূস্বর্গ কাশ্মীরের মানুষদের দুঃখের অবসান করবেন।
চারকাশ্মীরে সহজে সবাই যেতে পারে না বলে এখানে আসার জন্য আগ্রহ এত তীব্র ছিল, তাছাড়া কাশ্মীরের অপার্থিব মোহনীয় রূপের কথা কে না শুনেছে। বেড়ানোর জন্য এসেছিলাম সত্যি কিন্তু ফিরে যাচ্ছি কাশ্মীরিদের প্রতি এক বুক ভালবাসা নিয়ে। তাদের বলতে ইচ্ছা হচ্ছে তোমাদের কথা আমাদের স্মৃতিতে অমলিন থাকবে বহুদিন।
কাশ্মীর এয়ারপোর্টে আগমনের সময় আমরা নাম তালিকাভুক্ত করেছিলাম, এখন আবার আমাদের বহির্গমন তালিকাভুক্ত করতে হবে। আমরা যখন প্রয়োজনীয় paper work সম্পাদন করছিলাম, তখন কাউন্টারের এক কাশ্মীরি ভদ্রলোক আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন লাগল তাদের দেশ, নিশ্চয় কাশ্মীর বাংলাদেশের চেয়ে অনেক সুন্দর?” উত্তর দিতে যেয়ে থমকে গেলাম এক মুহূর্ত, তারপর স্মিত হাসি নিয়ে জবাব দিলাম, “প্রতিটি দেশের নিজস্ব আলাদা সৌন্দর্য আছে” –ভিনদেশীর কাছে নিজের দেশের চেয়ে তাদের দেশকে কেন যেন কিছুতেই বেশি সুন্দর বলতে পারলাম না, কিছুতেই পারলাম না।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।