একবেশ ক’ বছর আগে স্বামীর কর্মসূত্রে অনেক দিন দক্ষিণ ভারতের কোচিন শহরে ছিলাম। তখন ভারতের এক মাথা থেকে প্রায় অপর মাথা পর্যন্ত লম্বা এক সফরে গিয়েছিলাম। আমাদের সফরের শেষ গন্তব্য ছিল কাশ্মীর। আমাদের সফর সঙ্গী অন্যান্য বাঙ্গালীরা মুম্বাই, গোয়ার মত আধুনিক ও বিলাসী জায়গায় যেতে চেয়েছিলেন। শুধু আমাদের দু’জনকে যেন শহুরে আনন্দের বদলে রহস্যময়ী কাশ্মীরের অপার সৌন্দর্য আহ্বান করছিল। নৈসর্গিক রূপবৈচিত্র্য অবলোকনের পাশাপাশি আমাদের চোখে আবিষ্কৃত হয়েছিল ভূস্বর্গের এক অন্য চিত্র। দুনিয়া যে কখনো জান্নাত হতে পারে না, কাশ্মীর যেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
এত অনাবিল সৌন্দর্যে ভরপুর কোন স্থানের মানুষেরা যে এতটা দুঃখী হতে পারে, তা না দেখলে কখনো জানা হত না। শ্রীনগর থেকে শুরু করে পেহেলগাম, গুলমার যেখানেই গিয়েছি, সব সময় মনে হয়েছে, দেয়ালেরও যেন কান আছে। কিছুদূর পর পর ব্যারিকেড আর সেনাচৌকি দেখে ভ্রম হচ্ছিল যে- হয়তো কোন যুদ্ধ এলাকায় চলে এসেছি। যতদিন আমি সেখানে ছিলাম, একজনও সত্যিকারের সুখি মানুষ দেখিনি। শুধু দেখেছি, আযাদীর স্বপ্নে বিভোর এক জনপদকে; যারা দিন গুনছে স্বাধীনতার জন্য।
দুইসকাল সাড়ে ১০টায় আমাদের কাশ্মীর যাবার ফ্লাইট জেট কানেক্টের প্লেনে করে। প্লেনে সব গৌরবর্ণের আর রূপবান কাশ্মীরিদের ভিড়। এদের দেখতে ভারতীয় মনে হয় না মোটেও। প্লেনে দেয়া ব্রেক ফাস্ট খেতে খেতে গল্প করতে করতে দেড় ঘণ্টা নিমিষেই কেটে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে সাদা মেঘের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল অসংখ্য পেঁজা তুলার মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছি। উপরে নীল আকাশ আর নিচে ফোম আইসক্রিমের মত থোকা থোকা সাদা মেঘ। সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে অনেক নিচের কাশ্মীর ভ্যালি দেখা যাচ্ছে। উপর থেকে ছবির মত মনে হচ্ছে শ্রীনগরকে। সাড়ে এগারটার দিকে আমরা কাশ্মীরের শ্রীনগরে নামলাম। শ্রীনগর ডাল লেকের ধারে মুসলমান অধ্যুষিত শহর এবং কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। আর জম্মু হল কাশ্মীরের শীতকালীন রাজধানী। জম্মু থেকে কাশ্মীরের দূরত্বও কম নয়, প্রায় ৭/৮ ঘণ্টার যাত্রা। এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার আগে বিশেষ কাউন্টারে আমাদের নাম তালিকাভূক্ত করতে হল। কাশ্মীরে বিদেশীদের নাম, আগমনের দিন, হোটেলের নাম ইত্যাদি লিখে রাখা হয়, এমনকি যদি ডোমেস্টিক ফ্লাইটে আসি তাহলেও। আবার ফেরত যাওয়ার সময় অন্য একটি ফর্ম ফিল আপ করতে হয়। ভারতের অন্য কোথাও এ নিয়ম দেখিনি। কাশ্মীরে বহুবছরের সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে জোরদার।
শ্রীনগরে এসেই সবার আগে চোখে পড়ল, এদের এয়ারপোর্টের আয়তন ও সাদামাটা পুরানো আমলের চেহারা। দিল্লীর বহু মেট্রো রেল স্টেশন এর থেকে উন্নত। প্লেন থেকে নেমেই চারদিকের পরিবেশ এবং মানুষের চেহারা দেখে মনে হল এ যেন ভারত নয়, হয়তোবা আমরা ভুল করে পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানে চলে এসেছি। সবাই দেখতে ধবধবে ফর্সা। আফগানিদের মত চেহারা। বেশিরভাগ ছেলেদের মুখে দাড়ি। অনেকের পরনে কাবুলি স্যুট। মেয়েদের এক একজন হুর পরীর মত সুন্দর। কিন্তু কারো চেহারাতেই স্বাভাবিক আনন্দ বা উচ্ছলতা দেখলাম না। সবার চেহারায় কেমন যেন একটা চাপা আক্রোশ। তখন ব্যাপারটা অতটা আমলে না নিলেও, পরে বুঝতে পেরেছি এ কি চাপা ক্ষোভ ছিল, নাকি চাপা কষ্ট!
বিমানবন্দর থেকে বাসে করে হোটেলে যাবার পথে জানালা দিয়ে শ্রীনগর দেখতে লাগলাম। প্রায় দু হাজার বছরের পুরানো শহর শ্রীনগর একসময় ইউসুফ শাহ চক নামের একজন শাসন করতেন। তার থেকে চালাকি করে সম্রাট আকবর শ্রীনগর দখল করে নেন ও মুঘলদের রাজত্ব শুরু হয়। এখনো শ্রীনগরের চারিদিকে তাকালে মুঘলদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য ও রুচিশীলতার নিদর্শন দেখা যায়। শ্রীনগর যত দেখছি, তত মনে হচ্ছে আমি টাইম মেশিনে করে অন্তত ৩০ বছর পেছনে চলে গেছি। আধুনিক মেট্রো শহরের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। কোন ঝাঁ চকচকে গাড়ি, হাইরাইজ বিল্ডিং, শপিং মল, সিনেপ্লেক্স নেই। ভারতের অন্যান্য অংশ যতটা উন্নত হয়েছে তার ছোঁয়া এখনো এ অঞ্চলে লাগেনি। মনে হল ইচ্ছা করেই যেন কাশ্মীরী জনগণকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
তিনরূপকথার গল্পে সৎ মা সুন্দরী রাজকন্যাকে অনেক অত্যাচার করার পরও যেমন তার রূপে কোন কালিমা লেপন করতে পারেনা, বরং সে আরো বেশী অপরূপা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে, ঠিক তেমনি কাশ্মীরকে যত বঞ্চিত করা হোক না কেন, তার সৌন্দর্যে কোন কালিমা কেউ লাগাতে পারেনি। কাশ্মীর সব সময় অনন্যা অসাধারণ, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার হিসেবে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, এই অপরূপ প্রদেশে কেন সব সময় হানাহানি লেগে থাকে? কেন ‘ভূ-স্বর্গ’ নামে বিখ্যাত কাশ্মিরি জনগণের হৃদয়ে এত কষ্ট, কেন এখানে এত রক্তক্ষরণ? কোথায় সূত্রপাত এই চিরায়ত অশান্তির? উৎসাহী পাঠকদের জন্য কাশ্মীরের অজানা কিছু গল্প দিয়ে আজকের পর্ব শেষ করছি।
১৪শ শতাব্দী থেকে কাশ্মীর যথাক্রমে ইউসুফ চক ও মোঘলদের শাসনে ছিল। এরপর উনবিংশ শতাব্দীতে কাশ্মীর শিখদের দখলে আসে। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় কাশ্মীরের শিখ মহারাজা হরি সিং কে তিনটি options দেয়া হয়। যথা-
১) স্বাধীন থাকার ২) ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবার অথবা ৩) পাকিস্তানের সাথে যোগ দেবার।
তখন মুসলমান জনগোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, মহারাজা হয়ত ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে চাইবে এই আশঙ্কায়। তাই তারা পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় কাশ্মীর দখল করার জন্য আক্রমণ করে। মহারাজা যখন দেখলেন তাদের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠবেন না, তখন তিনি ভারতীয় আর্মির সাহায্য চান। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নেহেরু বলেন, যদি কাশ্মীরকে ভারতের অংশ করা হয় শুধু মাত্র সেই শর্তে ভারত মহারাজাকে সাহায্য করবে। মহারাজা তখন বাধ্য হয়ে এই শর্তে রাজি হন। সেই সাথে শুরু হয় কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান- ভারতের যুদ্ধ এবং ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরের জনগণের দুঃখের দিন ও সংঘাতময় যুগের সূত্রপাত।
যুদ্ধ শেষে কাশ্মীর দু টুকরা হয়ে যায়, এক অংশ যায় পাকিস্তানে ও অন্য অংশ যোগ হয় ভারতের সাথে। কাল পরিক্রমায় কাশ্মীরের আরো একটি অংশ চায়না দখল করে নেয়। হতে পারে দেশটি বহুভাগে বিভক্ত হয়েছে, কিন্তু কাশ্মীরীদের দু মিনিট প্রাণ খুলে কথা বলতে দিলেই দেখা যাবে, এদের স্বাধীন সত্ত্বাকে আজও পরাধীনতার শিকল পরানো যায়নি। তারা এখনো আযাদ কাশ্মীরেরই স্বপ্ন দেখে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।