এক হোটেলে ফিরে দেখি কর্তা মশাই রেগে আগুন, তেলে বেগুন হয়ে আছেন। আমি নাকি সাংঘাতিক দেরী করে ফেলেছি। হোটেলের রিসেপশনের সামনের লবিতে উপর তলা থেকে লোকজন মালপত্র নিয়ে নিচে নেমে আসছেন। খাওয়া, গোসল শেষ করে অনেকেই তৈরি মিনায় যাবার জন্য। হোটেল থেকে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে, গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছদে আমরাও নিজেদের প্রস্তুত করে নিলাম ইহরাম বাঁধার জন্য। কেউ কেউ এতক্ষণে ইহরাম বেঁধে ফেলেছে। আমি চিন্তা করলাম এত আগে ইহরাম বাঁধবো না, বাসে ওঠার আগে আগে “লাব্বাইক হাজ্জান” বলে হাজ্জের নিয়ত করে নেব।
বলে রাখা ভালো, অধিকাংশ ব্যক্তি মনে করেন সাদা দু খণ্ড কাপড়কেই ইহরাম বলে। প্রকৃতপক্ষে হাজ্জ/উমরাহ এর ‘নিয়ত’ করার মাধ্যমে লোকে ইহরাম বাঁধেন, এর সাথে বস্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘ইহরাম’ অবস্থায় প্রবেশের সাথে সাথে অনেক হালাল কার্যক্রমও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ) হয়ে যায়। যেমন পশু হত্যা করা, বিবাহ করা ইত্যাদি।
কাল থেকে হাজ্জের মূল কার্যাবলী শুরু হবে। আগামী দিনসমূহে আমাদের করণীয় হলো সংক্ষেপে নিম্নরুপ:
■ ৮ই যিলহাজ্জ: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মিনাতে আদায় করা।
■ ৯ই যিলহাজ্জ: যোহরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা।
■ ৯ই যিলহাজ্জ রাত: সূর্যাস্তের পর মুযদালিফায় গমন ও সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন।
■ ১০ই যিলহাজ্জ: ফজরের পর মিনাতে রওনা হওয়া ও জামারাতে পাথর ছোঁড়া, কুরবানী করা ও মস্তক মুণ্ডন করা। অতঃপর ইহরামের বস্ত্র খুলে সাধারণ বস্ত্র পরিধান করা (ছেলেদের ক্ষেত্রে)।
■ ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ, তথা আইয়ামে তাশরিকের দিনসমূহে মিনায় অবস্থান করা ও প্রতিদিন জামারাতে রমি করা (পাথর ছোঁড়া)।
আগামী কয়েক দিনের জন্য অল্প কিছু কাপড়, কিছু শুকনো খাবার (চিড়া, চিনি, বিস্কিট ইত্যাদি), ব্রাশ (টুথপেস্ট ছাড়া), সুগন্ধি-হীন সাবান, মুযদালিফায় রাত্রি যাপনের জন্য কেনা, ভাঁজ করা যায় এমন মাদুর, চাদর, ছোট্ট বালিশ, এছাড়া ছাতা ও আরো কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। অতিরিক্ত কিছু নেয়া যাবে না, কারণ নিজের মালপত্র নিজের কাঁধে নিতে হবে। তাই বহন করতে পারবো না, এমন কিছু নিলাম না। সাফির এক সেট ইহরামের সাদা কাপড় পরে নিলো ও দু সেট ব্যাগে নিলো। এত কিছুর সাথে স্পঞ্জের স্যান্ডেল ও হাঁটার জুতা নিয়ে নিলাম মনে করে। সামনে দীর্ঘ হাঁটাহাঁটি করতে হতে পারে, তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া ভালো।
হোটেলের লবিতে একদল যাত্রী উৎসুক হয়ে অপেক্ষমাণ। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সবাই। ঈশার পর বাস আসার কথা। এখন রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে, বাসের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সকলে আশা করছেন আর অল্প কিছুক্ষণের মাঝে বাস এসে যাবে। তখন তো আর আমরা জানতাম না যে, আজ রাতে আমাদের কপালে লম্বা ভোগান্তি আছে। বাস দেরী হওয়া দিয়ে সবে তার সূচনা হলো। পুরো হোটেলের সবার জায়গা এক বাসে হবে না, তাই কয়েকটি বাস আসার কথা।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের হোটেলে থেকে যতগুলো বাস মিনা গিয়েছিলো, সেগুলোর মাঝে আমাদের বাসের যাত্রীদের ভোগান্তি হয়েছে সব চাইতে বেশি। তাও আবার হাস্যকর সব কারণে।
আমাদের ভেতর রুমমেট রুকসানা আন্টি আর পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তার ভদ্রলোক হাজ্জের ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। রুকসানার আন্টির এটি তৃতীয়বার ও ডাক্তার আঙ্কলের এটি সপ্তমবার হাজ্জে আগমন।
আন্টি আগেই আমাকে আর রওশন আপাকে মিনার তাঁবু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিয়ে রেখেছেন। শোবার যায়গা কতটা সরু হবে, মুযদালিফায় বাথরুম পাওয়া কতটা মুশকিল হবে, ইত্যাদি নানা রকম জ্ঞানে তিনি আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। ডাক্তার সাহেব বেশি কথা বলেন না, স্বল্পভাষী মানুষ। তবে তিনিও একটি জ্ঞানের কথা বললেন, উনার মতে মিনায় গেলে মানুষের আসল চেহারা দেখা যায়!! এই এক বাক্যের উপদেশের অর্থ তখন না বুঝলেও মিনায় যাবার পথেই বুঝে গেছি।
রাত গভীর হচ্ছে, বাসের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। সবাই চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছে। শুধু একজনের মাঝে কোনো দুশ্চিন্তা দেখা গেলো না। সেই বিশিষ্ট একজন হচ্ছেন আমাদের গাইড। তিনি অতি সন্তর্পণে এক কোণায় বসে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। তাঁর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, জগত সংসারের কোনো সমস্যা তাঁকে স্পর্শ করছে না। বাস আজ আসুক, কিংবা কাল আসুক, তাঁর কিছুই যায় আসে না। এরকম সময়ে কেউ এভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাও আবার তিনি যে সে কেউ নন, তিনি আমাদের গাইড, আমাদের দেখভাল করার দায়িত্ব তাঁর। এমন গাইড বোধহয় শুধু সরকারি প্যাকেজেই মেলা সম্ভব!!!
দুই বহু জল্পনা-কল্পনা ও প্রতীক্ষার পর রাত একটার দিকে একে একে বাস এলো। যে যেখানে জায়গা পেলাম, উঠে পড়লাম। রুকসানা আন্টি এক বাসে উঠলেন, আমরা আর রওশন আপারা অন্য বাসে উঠলাম, আমাদের সাথে ডাক্তার ও তাঁর বিবিও সঙ্গী হলেন। আমাদের সবার সামনের সিটে বসার সুবিধা দেওয়া হলো, যেন সাফির কিছুটা হলেও পা মেলে রাখতে পারে। এক পাশে হুইল চেয়ারটি ভাঁজ করে রাখলাম।
মিনা মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে। সাধারণ সময়ে এই দূরত্ব কিছু নয়। আজ যেহেতু লাখের অধিক বাস ও ততোধিক হাজ্জ যাত্রী এই পথে রওনা হবে, তাই ভিড়ের কারণে হয়তো একটু দেরী হবে। দেরী হলেও ঘন্টাখানেকের ভেতর পৌঁছে যাবার কথা। আমাদের সাথের সকলেই কিছুদিন আগে গাইডের সাথে মক্কার দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে দেখেছে। সাফিরের পা ব্যথার জন্য শুধু আমরা তাদের সাথে ছিলাম না। হেরা পর্বত থেকে শুরু করে মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা সবকিছু সবাই দেখে এসেছে। তাই কোথায় যাচ্ছি, সে সম্পর্কে আমাদের দুজনের ছাড়া সবার কম বেশি ধারণা আছে। আশা করি তারা পথও চিনে রেখেছে!! কিন্তু হায়!! কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের আশা যেন মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে গেলো!!
রাস্তায় মানব সমুদ্র ঠেলে আমরা হাইওয়েতে গিয়ে উঠলাম, সেখানে সুদীর্ঘ বাসের সারি। শম্বুক গতিতে সবাই চলছে। তারপর এক পর্যায়ে রাস্তা খালি খালি হয়ে এলো। এখন সাঁই সাঁই করে বাস চালানো যাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বিরাট এক সাইনবোর্ডে তীর চিহ্ন দিয়ে মিনার রাস্তার দিক নির্দেশনা করা আছে। কিন্তু আমাদের বাস সেদিকে না গিয়ে চলতেই থাকলো তার মনের মতো রাস্তা দিয়ে! আমি ভাবলাম আমার মতো দিক কানা মানুষ, কী না কী দেখলাম, আমি নিজেই আজকাল নিজের দিকজ্ঞান বিশ্বাস করি না।
বাসের সবাই এখানে কিছুদিন আগে এসেছে, ভুল পথে গেলে তারা নিশ্চয় খেয়াল করতো। তাছাড়া বাসের ড্রাইভার ও হেল্পার থাকতে আমাদের রাস্তার দিকে তাকানোর কী দরকার! চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেই হয়, চোখ খুলে দিব্যি দেখবো মিনাতে চলে এসেছি।
এত সব দিবাস্বপ্ন দেখার পূর্বে আমার জানা ছিলো না যে, আমরা সৌদি আরবের রাস্তায় হলেও আমাদের বাস ড্রাইভার মিশরীয় এবং বাসের হেল্পার বার্মিজ! এবং এরা কেউ মিনার রাস্তার কিছুই জানে না। এদের বিশ্বের আনাড়িতম ড্রাইভার-হেল্পারের খেতাব দেয়া যাবে। এখানে ছোট্ট একটা কাহিনী আছে। হাজ্জের সময় প্রচুর ড্রাইভার দরকার হয় বিধায় পার্শ্ববর্তী দেশের থেকে আউট সোর্সিং করে সাময়িক সময়ের চুক্তিতে ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়া হয়, যাদের অনেকে রাস্তা চেনে না। আমাদের গাড়িচালকও এর ব্যতিক্রম নন।
আমাদের গাইড বাবাজি আগেও হাজ্জ করেছেন। তাঁর অন্তত রাস্তা চেনার কথা, কিন্তু তাঁকে আশেপাশে কোথাও দেখলাম না। ভালো করে তাকিয়ে বোঝা গেলো, উনি বাসের পিছনের সারির সবচেয়ে কোণার চেয়ারে বসে আবারো গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছেন!! যেন বাস সারারাত চললেও তাঁর কিছু যায় আসে না। ধীরে ধীরে ডাক্তার সাহেবের কথা সত্য প্রমাণিত হতে শুরু করলো। সবার আসল চেহারা বের হয়ে আসতে লাগলো। কোনো মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে মনে হয় তাকে রাগিয়ে দেবার বিকল্প নেই। সত্যিকারভাবে রাগাতে পারলে তার আসল চেহারা বের হয়ে আসতে বাধ্য।
আমরা এখন ইহরামরত আছি। এই অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহের মাঝে রেগে যাওয়া একটি। তাছাড়া আমাদের যাত্রাপথে আমরা যেহেতু হাজ্জের নিয়তে আছি, তাই পুরো সময়টাই ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। বুদ্ধিমানেরা এসময় আল্লাহ্র যিকির করে, তিলাওয়াত করে কাটিয়ে দেন। এ কথা কে না জানে, মুমিনের পায়ে কাঁটা ফুটলেও পাপ ঝরে যায়? তাদের উপর কোনো কষ্ট আপতিত হলে কষ্টের বিনিময়ে গুনাহ মাফ হয়। তাই হাজ্জ যাত্রার সময় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার যদি হয়েও থাকে, তাতে দুঃখ পাবার বদলে চিন্তা করা উচিৎ এই কষ্টটুকুর বিনিময়ে আল্লাহ্ আমাদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থানে এসে হাজ্জের মতো পুণ্যময় ইবাদাত করার সুযোগ দিচ্ছেন। এ সৌভাগ্যের তুলনায় যাবতীয় মানবীয় ঋণাত্মক অনুভূতি তুচ্ছতা ছাড়া আর কিছুই নয়!!
বাসের অনেকেই রাগে অন্ধ হয়ে মেজাজ সামলাতে ভুলে গেলেন। এক ভদ্রলোককে দেখলাম তুমুল হারে গালাগালি শুরু করতে। বাস ড্রাইভারের চৌদ্দ গুষ্টি আর হেল্পারের পনের গুষ্টি উদ্ধার চলছে। তাদের সাথে রাগ করতেও মায়া হচ্ছে, “উড়ে এসে জুড়ে বসা” বিপাকে পড়ে বেচারারা যথেষ্ট বিব্রত। জানি না কেন ইহরামের নিয়ত করার সাথে সাথে এমন অনেক ব্যাপার ঘটতে থাকে, যেসব ঘটনায় রাগী মানুষের জন্য রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এতদিন জানা ছিলো বয়সের সাথে সাথে ধৈর্যের উন্নতি হয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বয়স বাড়লে লোকে অধিকতর অস্থির ও অধৈর্য হয়ে যায়।
রাস্তা খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আবার মক্কায় ফেরত যাওয়া হবে। উল্লেখ্য, আমাদের সবার কাছে মক্কা থেকে মিনা যাবার ম্যাপ দেওয়া আছে। কিন্তু ম্যাপ দেখার প্রতি কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না, ম্যাপের দিকে কিছুক্ষণ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ। আবার মক্কা ফেরত আসা হলো। সেখান থেকে নতুন উদ্যমে আমরা পুনরায় মিনার দিকে যাত্রা করলাম।
বাসে কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে আমি আর সাফির নিশ্চুপ দর্শকের মতো সবার কাণ্ডকারখানা দেখছি। এতজন বয়স্কদের মাঝে কিছু বলে লাভ নেই, আমাদের কোনো কথা পাত্তা দেওয়া হবে না। তার উপর আমি মহিলা মানুষ। বাঙালি অধিকাংশ পুরুষেরা এখনো নারীদের কথাকে মর্যাদা দিতে শেখেনি। রুকসানা আন্টিকে ফোন দিলাম তাঁদের হাল হকিকত জানতে, উনারাও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে রাস্তা খুঁজে বের করে পৌঁছে গেছেন তাঁবুতে। উনাদের বাসেও রুকসানা আন্টিকে মহিলা বলে কেউ পাত্তা দিচ্ছিলো না, যদিও পরে আন্টির নির্দেশনা ঠিকই কাজে লেগেছে।
এ ধরনের সমস্যায় পড়লে সবাই উপদেশ দেওয়া শুরু করে। বাসের অনেকেই মিনা কোনদিক দিয়ে যেতে হবে, তা নিয়ে তাঁদের বিজ্ঞ মতামত ব্যক্ত করতে লাগলেন। লাভের লাভ হলো, নানা মুনির নানা মতে ড্রাইভার আরো কনফিউজড হয়ে গেলো। একবার এদিক যায়, আরেকবার ওদিক যায়। আমরা দিকভ্রষ্টের ন্যায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা চক্কর দিতে লাগলাম।
হেল্পারের উপর মধুর বাক্য বর্ষণ চলছেই। সবাই তার উপর আরো বেশি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেলো, কারণ কেউ তার বার্মিজ ভাষা বুঝতে পারছে না। অতএব সে আমাদের কথা কতটুকু বুঝতে পারছে, তাও বোঝা যাচ্ছে না!! কিন্তু আমি অতীব আশ্চর্যান্বিত হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি বার্মিজ ভাষা বুঝি! সেই বোঝা আবার হালকা পাতলা বোঝা নয়, বেশ ভালোরকম বোঝা!! নব্য এই আবিষ্কারের আনন্দ আমাকে বেশিক্ষণ উদ্বেলিত রাখতে পারলো না। কারণ সাথে সাথেই আরো একটি আবিষ্কার হয়ে গেলো। তা হলো, হেল্পার ব্যাটা আসলে রোহিঙ্গা!! এবং সে পুরো সময়টা চিটাগাঙের ভাষায় কথা বলছে। নানাবাড়ি চিটাগাং হবার কারণে এই ভাষা বুঝতে আমার বিন্দু মাত্র সমস্যা হয়নি।
সবার হইচইতে পাগল হয়ে হেল্পার বললো বাস দাঁড় করাতে, সে কারো কাছ থেকে পথ জিজ্ঞেস করে আসবে। আমরা হেল্পারের অপেক্ষায় বসে আছি তো বসেই আছি। এক পর্যায়ে সবাই টের পেলো, আমাদের বার্মিজ মিয়াঁ পগারপার হয়েছেন, বাতি দিয়ে খুঁজলেও তাঁকে আর পাওয়া যাবে না। ড্রাইভার বেচারা হয়তো তখন হেল্পারের ভাগ্যের উপর ঈর্ষান্বিত হচ্ছিলো। আহারে সেও যদি হেল্পার হতো, তাহলে আমাদের মতো অস্থির বাঙালিদের ফেলে কবেই পালিয়ে যেতে পারতো!! আহারে বেচারা।
আবারো মিনার রাস্তায় আমরা বহুক্ষণ ঘোরাঘোরি করতে লাগলাম। রাস্তার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ও লাখ লাখ তাঁবুর ভেতর কিছুতেই নিজের তাঁবু খুঁজে পেলাম না। সুতরাং আবার মক্কায় ফেরত আসা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমরা আবার মক্কাতে ফেরত এলাম। এ যেন ভিডিও গেমের মতোন, হেরে যাবার সাথে সাথে আবার নতুন করে, প্রথম থেকে সব শুরু করতে হচ্ছে।
তৃতীয়বারের মতো আমরা মিনার রাস্তায় রওনা করলাম!! হাজ্জের ইতিহাসে এমন উদ্ভট ও হাস্যকর ঘটনা আর ঘটেছে কি না জানা নেই। এতক্ষণে সবার রাস্তা সম্পর্কে জ্ঞান দেবার উৎসাহ ঝিমিয়ে পড়েছে, সবার চেহারায় কেমন যেন হতাশার আভাস দেখা যাচ্ছে, ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে বাস থেকে নেমে সবাই সালাত পড়ে নিলাম।
রাসুল ﷺ এর সুন্নাত হলো যিলহাজ্জ মাসের আট তারিখ ফজর পড়ে মিনার পথে যাত্রা করা। আমরা সাত তারিখ রাতে, অর্থাৎ এক দিন আগে মিনাতে যাচ্ছিলাম বলে মনের মাঝে খচখচ করছিলো। এতে কোনো গুনাহ নেই … তারপরও … । আমরা আগে আগে রওনা হয়েও কোনো লাভ হলো না, সেই ফজরের পরই মিনাতে যাওয়া হচ্ছে। এত ঝামেলা হওয়ার পরও এই একটি ব্যাপারে আমার মন হালকা আনন্দিত হয়ে গেলো।
তিন সারা রাতের ঘূর্ণিপাকে সকলে ক্লান্ত। আমার নাবিক মশাইকে বললাম, ও যেন এবার নেতৃত্ব নেয়, রাস্তা চিনিয়ে আমাদের মিনায় নিয়ে যায়। আল্লাহ্ ওকে রাস্তা চেনার এক আশ্চর্য ক্ষমতা দিয়েছেন। অচেনা দেশের অচেনা রাস্তাতে যদি সাফিরকে ছেড়ে দেওয়া হয়, ও ঠিক বেড়ালের মতো পথ চিনে জায়গা মতো চলে আসে। সবাই এখন ভগ্ন হৃদয়ে, হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে বসে আছে। তাই সাফির যখন দিক নির্দেশনার প্রস্তাব দিলো, কেউ কিছু মনে করলো না। বিপদে পড়লে, সকল উপায় ব্যর্থ হলে মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। দু/তিন ঘণ্টা আগে হলে যুবক কোনো পাত্তা পেতো না, কিন্তু এখন সে খড়কুটোর মর্যাদা পেলো।
ও ধীরেসুস্থে চোখের সামনে মানচিত্রখানা খুলে ধরলো, তারপর সুন্দর করে গাড়ির চালককে রাস্তা দেখাতে লাগলো। এই দৃশ্য দেখে মনে হলো, এবার আমি একটু ঘুমাতে পারি। কারণ সাফিরের হাতে যখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ্ আর কোনো চিন্তা নেই। ভোরের আলো ফুটে গেছে, অনেকে মক্কা থেকে হেঁটে মিনাতে যাচ্ছে। যারা বাসের ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে চান এবং ৬/৭ কিলোমিটার হাঁটার সামর্থ্য রাখেন, তারা হেঁটে যাওয়া পছন্দ করেন। অনেকে আবার আমাদের বাসগুলোর মতো যাত্রীবাহী বাসে উঠে কিছুদূর লিফট নেন, আবার নেমে যেয়ে বাকি রাস্তা হাঁটতে থাকেন।
রাস্তা জুড়ে শ্বেতশুভ্র বস্ত্রের অগুনতি মানুষের ঢল চোখে পড়ছে। শুভ্রতার সাথে পবিত্রতার কেমন এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ইহরামের বস্ত্র পরিহিত অসংখ্য হুজ্জাজগণ হতে পবিত্রতা যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। সত্যিই সেদিন অপার্থিব নূরে ভেসে যাচ্ছিলো চারদিক। কেমন এক শান্ত সমাহিত ভাব বিরাজমান ছিলো সর্বত্র। পবিত্রতার এক আলাদা সৌন্দর্য আছে … পবিত্রতার এক অন্যরকম আলো আছে।
চার ঝিমাতে ঝিমাতে দেখলাম আমরা মিনার কাছাকাছি চলে এসেছি। আমাদের তাঁবু যে এলাকায় হবার কথা, তার নিকটে এসে মোয়াল্লেমের লোকদের ফোন দেওয়া হলো। তারা এসে আমাদের তাঁবু পর্যন্ত নিয়ে গেলো। তখন ঘড়ির কাঁটা সাতটার আশেপাশে। যারা গত রাতে চলে এসেছে, তারা এখন ঘুম ভেঙে উঠে পড়ছে, নতুন দিন শুরু করছে। অনেকে আজ মক্কা থেকে ফজরের সালাত আদায় করে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে, তাদের কেউ কেউ এখন এসে পৌঁছাচ্ছে।
এদিকে আমাদের অবস্থা তথৈবচ। সারা রাতের দীর্ঘ অভিযানের পর সবার কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন। আজ রাতে আরাফাতের ময়দানে চলে যাবার কথা। সেখানে কেমন ঘুম হবে জানি না এবং আগামীকাল আমাদের প্রতীক্ষিত হাজ্জের দিন। এখনই যদি ক্লান্ত হয়ে যাই, তাহলে আগামীকাল তার প্রভাব পড়তে পারে। আমরা সবাই যার যার তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম কিছুটা গড়িয়ে নেবার আশায়।
সকলে ক্লান্ত হলেও বাংলার এক নাগরিক আড়মোড়া ভেঙে বাস থেকে নামলেন। রাতে লম্বা ঘুম দিয়ে ইনি এখন ফুরফুরে তরতাজা মেজাজে আছেন। তাঁর আপাতত বিশ্রাম না নিলেও চলবে। তিনি আর কেউ নন, আমাদের কর্মপটু গাইড মহোদয় !
পরবর্তী পর্ব: হাজ্জ শুরু- মিনায় প্রথম দিন
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।