প্রশ্ন ইসলামে কি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা থাকা বাধ্যতামূলক? যদি তা-ই হয়, তাহলে কারো একাধিক স্ত্রী থাকলে সেটা কীভাবে সম্ভব?

শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ: আলহামদুলিল্লাহ।

IIRT Arabic Intensive

প্রথমত, স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা হচ্ছে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক একটি বিষয়। এমন একটি বিষয় সম্পর্কে এমনটি বলা যায় না যে এটি শারী’আহ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক বা ইসলামের কোনো হুকুম। এইসব বিষয় প্রাকৃতিকভাবে যতটুকু অর্জন করা যায়, ততটুকুই যথেষ্ট। এর জন্য কোনো ধর্মীয় দলিলের প্রয়োজন নেই।

যদি কেউ বিবাহিত জীবনকে রোমান্টিক উপন্যাস বা সুখস্বপ্নের মতো কিছু একটা ভেবে থাকে, তবে সে আসলে এমন কিছুর খোঁজ করছে যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই। কেননা বাস্তব জীবনে প্রকৃতিগতভাবেই কাঠিন্য, পরিশ্রম আর কষ্ট থাকে। মহান আল্লাহ বলেন (ভাবার্থ)

আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি অত্যন্ত কষ্ট এবং শ্রমের মাঝে, (দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষ কোনো না কোনো কষ্টের মধ্যে পতিত আছে)। [সূরাহ আল-বালাদ (৯০):৪]

কবি বলেছেন

জীবন তো সহজাতভাবেই মুশকিল আর কষ্টের,তবুও তোমরা চাও যে এটি হোক সকল কষ্ট আর সমস্যা থেকে মুক্ত;

জীবনের সহজাত ও স্বভাবগত প্রকৃতি থেকে বিপরীত কিছু যে আশা করা আর পানির কাছ থেকে একটি জ্বলন্ত কাঠ আশা করা একই কথা।

যখন আমরা এটি বুঝবো এবং জীবনের দিকে বাস্তববাদী দৃষ্টিতে তাকাবো, তখন আমরা দেখবো যে নিখুঁত আর সমস্যাবিহীন জীবন আশা করাটা নিতান্তই অসাধ্য। আর তখন এই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের দুঃখের সময় কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট হবে এবং সামনে এগিয়ে চলার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে সাহায্য করবে। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইছিলো। উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কেন তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাও?”

সে জবাব দিলো, “আমি তাকে ভালোবাসি না।”

উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, “সকল পরিবারের ভিত্তি কি শুধুই ভালোবাসা? যত্ন-আত্তি আর শিষ্টাচার বলে কি কিছু নেই?” (উইয়্যুন আল-আখবার,৩/১৮)

অর্থাৎ, আপনার বন্ধু-বান্ধব কিংবা স্ত্রীর পক্ষ থেকে আসা বিরক্তিকর আচরণগুলো সবরের সাথে সহ্য করুন। কেননা মানুষ  মাত্রই বন্ধু-বান্ধব ও জীবনসঙ্গীর সাথে অনুরুপ পরিস্থিতির শিকার হয়, যেমনটা আপনি হচ্ছেন। একে অপরের সাথে পরিপূর্ণ সুখী না হওয়া সত্ত্বেও কিংবা একে অপরকে ভালো না বাসলেও তারা একসাথে থাকতে পারে। তাদের একে অপরের প্রতি প্রয়োজনবোধটাই তাদেরকে এক করে রাখে।

যত্ন আর সহমর্মিতার মাধ্যমেই একটি পরিবারের সদস্যরা একে অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে। আর তারা প্রত্যেকেই একে অন্যের প্রতি তাদের কর্তব্যের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল আছে। শিষ্টাচার ও দায়িত্ববোধের কারণেই তাদের প্রত্যেকে মিলেমিশে থাকে, পরিবার ধ্বংসের কারণ হওয়া থেকে বিরত থাকে। মহান আল্লাহ তা’আলা কী বলেছেন সেটা ভাবুন (ভাবার্থ)

তাঁর নিদর্শনের মধ্যে হলো এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসাদয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য বহু নিদর্শন আছে। [সূরাহ আর-রূম (৩০):২১]

ভাবুন যে মহামহীম আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসা আর অনুরাগের কথা কীভাবে তুলে ধরেছেন। বুঝিয়েছেন যে এটা আসলে তাঁরই সৃষ্টি এবং তাঁর ক্ষমতার একটি নিদর্শন। এটি এমন কিছু নয় যা আল্লাহ শারী’আহর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। কেননা হৃদয়ে ভালোবাসার আবেগের উপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; বরং তার নিয়ন্ত্রণে যা রয়েছে, তা হলো অন্যদের সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং তাদের প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শন করা।

ইবন কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

এবং তাঁর নিদর্শনের মধ্যে একটি হলো এই যে তিনি তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তিনি তোমাদের স্ত্রী হবার জন্য তোমাদের জাতি থেকেই নারীদের সৃষ্টি করেছেন।

যেন তুমি তাদের মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পাও – এটা অনেকটা এই আয়াতের মতো (ভাবার্থ),

তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন আর তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়। [সূরাহ আল-আ’রাফ (৭):১৮৯]

যা মূলত হাওয়াকে (‘আলাইহাসসালাম) নির্দেশ করে। আল্লাহ তাঁকে আদাম (‘আলাইহিসসালাম) হতে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর শরীরের বাম পাঁজরের সবথেকে ছোট হাড়টি থেকে। যদি তিনি আদামের সব পরবর্তীদের পুরুষ বানাতেন আর তাদের জন্য নারী সৃষ্টি করতেন অন্য জাতি থেকে (জ্বিন কিংবা অন্য জীবজন্তু থেকে), তাহলে তাদের মধ্যে আর তাদের স্ত্রীদের মধ্যে এত মিল থাকতো না। বরং তখন ফলাফলটা হতো বিমুখতা আর অরুচি। এছাড়াও মানবতার প্রতি আল্লাহর নিখুঁত রহমতের নিদর্শনস্বরুপ আল্লাহ তাদের জাতি থেকেই তাদের বানিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছেন ভালোবাসা আর দয়া। অতএব, হয় একজন স্বামী তার স্ত্রীকে রাখবে সে তাকে ভালোবাসে বলে, আর নয়তো তাকে রাখবে তার প্রতি সহমর্মিতা থেকে। কারণ সে তার সন্তানদের জননী। কিংবা এজন্যেও হতে পারে যে, ভরণপোষণের জন্য স্ত্রীর স্বামীকে প্রয়োজন কিংবা তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে অথবা অন্য যে কোনো কারণে।” (তাফসীর ইবনে কাসীর, ৬/৩০৯)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো বলেন (ভাবার্থ)

তাদের সাথে দয়া ও সততার সঙ্গে জীবন যাপন কর। যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হতে পারে যে তোমরা যাকে অপছন্দ করছো, বস্তুতঃ তারই মাঝে আল্লাহ বহু কল্যাণ দিয়ে রেখেছেন। [সূরাহ আন-নিসা (৪):১৯]

শাইখ আস-সা’দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

“স্বামী তার স্ত্রীর সাথে উদারভাবে বসবাস করতে বাধ্য। স্ত্রীর সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, তাকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে এবং তার প্রতি ভদ্র ও সদয় থাকতে হবে। এর মধ্যে আছে তার ভরণপোষণ, পোশাক-আশাক এবং অন্যান্য সবকিছু।

যদি তাদেরকে অপছন্দ করো, তবে হতে পারে যে তোমরা যাকে অপছন্দ করছো, বস্তুতঃ তারই মাঝে আল্লাহ বহু কল্যাণ দিয়ে রেখেছেন এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আপনারা অর্থাৎ স্বামীরা স্ত্রীদের অপছন্দ হলেও তাদেরকে রেখে দিন। কারণ এটিই আপনাদের জন্য অধিক উত্তম। এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর আদেশ মান্য করলেন, যা আপনাকে দুনিয়া এবং আখিরাতে এনে দিবে শান্তি।

আবার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা না থাকা সত্ত্বেও স্বামী নিজেকে স্ত্রীর প্রতি দয়ালু হতে বাধ্য করছেন। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন এবং ভালো আচরণ ও উত্তম আদবকেতা অর্জনের চেষ্টা করছেন। হতে পারে এই অপছন্দ একসময় উবে যাবে, আর তার জায়গায় চলে আসবে ভালোবাসা। এমনটি প্রায়শই ঘটে। এমন হতে পারে যে, তিনি হয়তো এই স্ত্রীর কাছ থেকেই একজন নেককার সন্তান লাভ করে সৌভাগ্যবান হবেন যে কিনা এই দুনিয়ায় এবং আখিরাতে তার বাবা মায়ের কাজে আসবে। এটা তখনই কার্যকর হবে, যখন কোনো হারামের মধ্যে পতিত হওয়া ছাড়াই স্ত্রীকে রাখা সম্ভবপর হবে।

কিন্তু যদি তার কাছে স্ত্রীকে ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনোই রাস্তা খোলা না থাকে এবং যদি তাকে রাখাটা বিবেচনাতীত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তাকে রেখে দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।” (তাফসীর আস-সা’দী, পৃষ্ঠা ১৭২)

মুসলিম (১৪৬৭) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

কোনো মু’মিন পুরুষেরই কোনো মু’মিনা নারীকে ঘৃণা করা উচিত নয়। যদি সে সেই নারীর চরিত্রের একটি দিক অপছন্দ করে, তো তার চরিত্রের অন্য কোনো একটি দিক তার পছন্দ হতেও পারে।

আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) এর ব্যাখ্যায় বলেন,

“এর মানে হচ্ছে এই যে, কোনো মু’মিন (স্বামী)র উচিত নয় মু’মিনা (স্ত্রী)কে ঘৃণা করা। কেননা যদি সে তার চরিত্রের কোনো একটি দিক অপছন্দ করে, তো সে তার চরিত্রের অন্য আরেকটি পছন্দনীয় দিক পাবে। উদাহরণস্বরুপ, সে (স্ত্রী) হয়তো আগ্রাসী মনোভাবের কিংবা একটু মেজাজী স্বভাবের। কিন্তু একইসাথে সে হতে পারে ধার্মিক, সুন্দরী, পূতপবিত্রা কিংবা তার স্বামীর প্রতি দয়ালু ইত্যাদি ইত্যাদি।”

দ্বিতীয়ত, আমরা ধরে নিলাম যে, স্বামী আর স্ত্রীর একে অপরের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা আবশ্যকীয় কিছু এবং স্বামীকে অবশ্যই তার স্ত্রীকে ভালবাসতে হবে এবং তার সাথেই একত্রে থাকতে হবে। এখন যদি সে দুইজন, তিনজন কিংবা চারজন নারীকে বিয়ে করে এবং তাদের সবাইকেই ভালোবাসে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

ভালোবাসা কারো সাথেই ভাগ করা যাবে না, এমন অবাস্তব রোমান্টিক ধারণা কোথা থেকে পেয়েছেন? ব্যাপারটা যেন এমন যে, তারা তাদের ভালোবাসার মানুষকে কোনো ‘উপাস্য’ মনে করে যে তার সাথে আর কাউকে শরিক করা যাবে না!

এটা কি হতে পারে না যে একজন লোক তার বাবাকে, তার মাকে এবং অন্যদেরও ভালোবাসে? এটাও তো একই রকমের ভালোবাসা এবং একজনের অধিককেও ভালোবাসা অসম্ভব নয়। তাহলে একজন পুরুষ একজনের অধিক স্ত্রীদের ভালবাসতে পারবে না কেন?

একজন মানুষ কি বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা সুঘ্রাণ ভালোবাসে না? তাহলে সে যদি সেই সব খাদ্য আর সুঘ্রাণ একত্রে চায় এবং সবগুলোকেই একত্রে ভালোবাসে, তাহলে তাকে এই ভালোবাসা থেকে বিরত রাখবার কী কারণ থাকতে পারে কিংবা কী ধর্মীয় দলীল থাকতে পারে? একাধিক স্ত্রীদেরও একইসাথে ভালোবাসার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অভিন্ন কিছু নয়।

এটা কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রতি ভালোবাসা নাকি যে, কারো সাথেই তা ভাগ করা যাবে না??

যদি প্রশ্ন করা হয় যে, আমরা বাস্তব জীবনে তো দেখি বেশিরভাগ পুরুষ একজন নারীর সাথেই সংযুক্ত এবং নারীরাও শুধুমাত্র একজন পুরুষকেই ভালোবাসে?

এই প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, এটা সত্য। বাস্তব জীবনে অধিকাংশ লোক বহুবিবাহে জড়ান না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এমন লোক পাওয়াই যাবে না যারা বহুবিবাহ করছে না এবং ভালোবাসা অন্যদের সাথে ভাগ করছে না; এটা অবশ্যই ঘটে এবং এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।

এবং আল্লাহই সবথেকে ভালো জানেন।

(পুরুষদের মতো নারীরাও কেন একইসাথে একাধিক স্বামী রাখতে পারবে না, তা আলাদা আলোচনা এবং এই প্রবন্ধের পরিসরভুক্ত নয়।- সম্পাদক)


উৎস: ইসলাম কিউএ ডট ইনফো (মূল আর্টিকেল লিংক)

অনুবাদক: মোহাম্মদ আল-মাহী, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি

অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive