আপনি ব্যাংকে গেলেন, কিছু কাগজপত্র সিগনেচার করলেন, এরপর টাকা পেয়ে গেলেন। ইসলামিক ব্যাংক হলে না হয় আগে পরে দু’একটা পেপার বেশি সই করা লাগে বা দু’একটা পেপার বেশি জমা দেওয়া লাগে, এ-ই যা! এরপর ব্যাংক থেকে বের হয়ে মনে মনে বললেন, এইটা কীসের ইসলামিক ব্যাংক! সব ভণ্ডামি! ইসলামের নাম ভাঙিয়ে খাওয়ার ধান্দা! এরপর জনগণের কাছে প্রচার করতে লাগলেন, সব ভণ্ডামি, পার্সেন্টেজ তো ঠিকই খায়! শুধু নামে ইসলামিক!

এই তো গেলো আমজনতা’র কথা। তবে যারা শুধু ‘নামে’ নয়, ‘কর্মে’ও মুসলিম, তাদের মধ্যেও বিশাল একটা অংশ মনে করে এবং ‘প্রচার’ করে দু’টোর মধ্যে কোনো ‘পার্থক্য’ নাই! বরং এমন অনেকেই আছেন, যারা ইসলামে ‘ইসলামিক ব্যাংকিং’ নেই মর্মে ফতোয়া দেন। এইসব ভাইদের জন্যেই এই লিখা, যারা তাকওয়াবান, মুত্তাকি, যারা চিন্তা করে।

IIRT Arabic Intensive

কুরআনে সূরাহ বাকারাহ’র ২৭৫ নং আয়াতে কাফিরদের একটা উক্তির মধ্যে অনেক চিন্তা করার বিষয় আছে বৈকি। তারা বলেছিলো, ‘ব্যবসায় তো সুদের মতোই।’ বর্তমানে, বিশেষ করে এই দেশের ইসলামিক ব্যাংকিং প্র্যাক্টিসের সাথে সুদি ব্যাংকগুলোর অনেক সাদৃশ্য আছে! সাদৃশ্য স্বাভাবিক, দুটোই আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কাফিররা কেন বলেছিলো যে, ব্যবসায় তো সুদেরই মতো?

নিশ্চয়ই সুদের সাথে ব্যবসায়ের একটা বাহ্যিক সাদৃশ্য আছে। সুদ ও ব্যবসায় উভয়ের সাথেই ‘আর্থিক’ বিষয় রিলেটেড এবং উভয়ের উদ্দেশ্যই ‘বৃদ্ধি’ করা। আল্লাহ্‌ কী বলেছেন এরপর? আল্লাহ্‌ কি বলেছেন যে, না ব্যবসায়ের সাথে সুদের কোনো ন্যূনতম সাদৃশ্য নেই? আল্লাহ্‌ বলেছেন,

আল্লাহ্‌ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন, কিন্তু সুদকে করেছেন হারাম। [সূরাহ আল-বাকারাহ (২):২৭৫]

ব্যবসায় হালাল মানে সকল ব্যবসায়ই হালাল। তা বাকিতে বিক্রয় হোক, বাকিতে বিক্রয়ে মূল্য বৃদ্ধি করে হোক বা মূল্য কমিয়ে হোক! এই আয়াতটি হচ্ছে ‘আম’ বা জেনারেল, যেখানে সকল ব্যবসায়ের মোড (ধরন)-কে হালাল করা হয়েছে। এখন কেউ যদি বলে “না, অমুক টাইপ ব্যবসায় হারাম,” তবে তাকে প্রমাণ দিতে হবে।

যেমন, রাসূল ﷺ ইনা’ ব্যসাকে নিষিদ্ধ করেছেন। এই বিষয়ে হাদীস আছে। সুতরাং ইনা’ ব্যবসায় হারাম সাব্যস্ত হলো। (মুরাবাহ ও টাইম ভ্যালু নিয়ে আমার একটা লিখা আছে, আগ্রহীগণ পড়তে পারেন। ইনশা আল্লাহ আপনার জন্য চিন্তার দরজা খুলবে। )

অনেকেই ইসলামিক ব্যাংকিংকে ‘সন্দেহজনক বিষয়’এ ফেলে থাকেন। অবশ্যই তাকওয়ার দাবী এটাই যে, মুমিনরা ‘সন্দেহজনক’ বিষয় থেকে দূরে থাকবে! এই পৃথিবীকে দয়াময় আল্লাহ্‌ আমাদের জন্য এতটা ছোট করে ফেলেননি যে, আমাদের সন্দেহজনক বিষয়ের ওপর নির্ভর করতেই হবে! আপনি যদি মনে করেন আপনার কাছে যতটুকু ইনফরমেশন আছে, আপনি ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে যা জানেন তাতে মনে হচ্ছে এটা সন্দেহজনক বিষয়, আপনার জন্য তো এটাই উত্তম যে আপনি ‘সন্দেহজনক’ বিষয় এড়িয়ে চলবেন যতক্ষণ না আপনার জন্য আল্লাহ্‌ বিষয়টা পরিষ্কার করে দেন! কিন্তু আপনি যখন কোনো বিষয়কে সন্দেহজনক বলে ‘প্রচার’ করবেন, তখন ব্যপারটা ভিন্ন! তাকওয়ার দাবী তো এটাই যে, আমরা যা জানি না তাতে চুপ থাকবো। যারা জানে, তাদের জিজ্ঞেস করবো।

দেখুন ভাইয়েরা, ইসলামিক ব্যাংকিং কোনো আক্বীদাহর বিষয় নয় যে, আমি আপনাকে কুরআন বা সুন্নাহ থেকে আয়াত বের করে দেখিয়ে দিতে পারবো যে এই দেখেন আল্লাহ্‌ নাযিল করেছেন ‘ইসলামিক ব্যাংকিং হালাল’। কিন্তু আল্লাহ্‌ যেই বিষয়কে হারাম করেননি, তাকে আমরা তো হারাম বলতে পারি না! অবশ্যই এটা আল্লাহ’র প্রতি মিথ্যা আরোপ করা। দেখুন, যতসব বিচারক জাহান্নামে যাবে তাদের মধ্যে তো একদল থাকবে যারা বিচার করতো সঠিক ইলম ছাড়া, নলেজ ছাড়া। এইবার হোক তাদের বিচারের ফলাফল সঠিক অথবা ভুল। সত্যি কথা বলতে, আমি এমন কাউকে দেখিনি যিনি ইসলামিক ব্যাংকিং এর বিষয়ে ফরমাল অথবা ইনফরমাল কোনো এজুকেশন নিয়ে তারপর বিরোধিতা করেন! দেখুন, আপনি দু’একটা বই পড়ে যদি এই বিষয়ের বিরুদ্ধে বলতে যান, তবে নিশ্চয়ই এখানে আপনি ‘জাস্টিস’ করেননি।

ইসলামিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন টাইপের কন্ট্রাক্ট ব্যবহার করে ফাইনান্সিং এর জন্য। এইসব কন্ট্রাক্ট এর বিস্তারিত জুরিস্টরা (ফকিহ) তাঁদের জুরিসপ্রুডেন্সের বইগুলোতে আলোচনা করেছেন বহু শতাব্দী আগে। বর্তমান ইসলামিক ব্যাংকগুলো এর মডিফাইড ভার্শন ব্যবহার করে যেগুলো’র বিষয়ে অনেক রিসার্চ আছে। কথা আছে, আফটার অল এগুলো অ্যাকাডেমিক ডিসকাশনের বিষয়, যেখানে স্কলাররা ইজতিহাদ করেছেন যাদের নলেজ আছে। আপনার যদি কোনো একটা মত ভালো না লাগে, তা খুবই স্বাভাবিক। এই দেশের অনেক ইসলামিক ব্যাংকের প্র্যাক্টিস নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কথা হতে পারে, অ্যাকাডেমিক ডিসকাশন হতে পারে। কিন্তু এক কথায় ‘ইসলামিক ব্যাংকিং’কে হারাম বলে দেওয়া, ‘সন্দেহের লিস্টে’ ঢুকিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে, জাস্টিস হবে? যেখানে অনেক স্কলাররা এসব নিয়ে গবেষণা করছেন, যেখানে মুসলিমরা চেষ্টা করছে সুদী সিস্টেমের বিপক্ষে একটা সিস্টেম দাঁড় করাতে?

ব্যক্তিগত পর্যায়ে হয়তোবা ব্যাংক ছাড়া কেউ তার লাইফ পার করে দিতে পারবে, এটা অসম্ভব না। তবে গ্রসভাবে এটা অনেক কঠিন। আমি অনেক দ্বীনি ভাইকে চিনি, যারা ব্যবসায় করতে সমস্যায় পড়েছেন ‘ক্রেডিট কার্ড’ এর জন্য। এইখানে ইসলামিক ব্যাংকগুলো একটা ‘অপশন’ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কারো ব্যাংক ছাড়া চলা এখন অনেকটাই অসম্ভব। বাস্তব বিশ্ব থেকে সরে গিয়ে চিন্তা করা কি উচিত হবে! যেখানে আল্লাহ্‌ আমাদের জন্য দ্বীনকে সহজ করতে চেয়েছেন? অবশ্যই আল্লাহ্‌ তো এটা পছন্দ করেন না যে, যেখানে তিনি সহজ করেছেন আমরা তা কঠিন করি?

আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের কষ্ট দিতে চান না। [সূরাহ আল-বাকারাহ (২):১৮৫]

সবশেষে, কিছু কথা চিন্তার জন্য যথেষ্ট হবে ইনশা আল্লাহ! তা হলো, ইসলামিক ব্যাংকিং কোনো স্ট্যাটিক বিষয় না, এটা ডাইনামিক বিষয়। ব্যাপারটা এমন না যে, এখন ইসলামিক ব্যাংকগুলো যা প্র্যাক্টিস করছে, তা-ই সারাজীবন প্র্যাক্টিস করতে হবে। বরং এই বিষয়ে যত বেশি ডিসকাশন হবে, রিসার্চ হবে এবং সর্বোপরি যোগ্য লোক এই সেক্টরে আসবে, ততই ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের উন্নতি হবে, এবং সর্বোপরি সুদী সিস্টেম এর বিপরীতে একটা স্ট্রং সিস্টেম দাঁড় করানো যাবে।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive