সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস
লেখক: আহমদ ছফা
স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের সুবিধাজীবী আচরণের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে ১৯৭২ সালে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইটি প্রকাশ করেন আহমদ ছফা। পাঠক চাহিদা ও সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় মূল বইটির প্রায় সমান আকৃতির ভূমিকা সহ পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। বুদ্ধিজীবীরাই মূল টার্গেট হওয়ায় বইটিতে সাংস্কৃতিক দ্বিমুখিতার দিকটিই আলোচিত হয়েছে বেশি। রাজনীতিবিদদের সুবিধাজীবী চেহারা সংক্ষিপ্তভাবে আসলেও বিশদ আলোচনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের ব্যক্তিদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
লেখক দেখাতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ নিজে থেকে জনগণের চিন্তনজগতে কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে অক্ষম। ক্ষমতা বা জনমতের হাওয়া যেদিকে প্রবাহিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাও সেদিকেই পাখা চালিয়ে আসছেন। বিদেশ-পলাতক অনেকেই স্রেফ ঘটনাচক্রে হয়ে পড়েছেন মুক্তিসংগ্রামী। আজকের দিনেও বিভিন্ন টকশোর আলোচকদের অতীত পর্যালোচনা করলে অভিযোগগুলোর সত্যতা প্রতিভাত হয়। এ ছাড়া রাজনীতির মাঠে নির্দিষ্ট আদর্শে অটল না থেকে যখন যে দল শক্তিশালী, তখন সে দলে যোগদানের প্রথাকেও তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন বামপন্থী এ লেখক। সংসদ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে এই চিত্র এখনও পুরোপুরি বাস্তব।
প্রসঙ্গক্রমে বাম রাজনীতির নানা ভাঙাগড়া, দেশভাগ ও প্রতীক যুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু অকপট সত্য উচ্চারিত হয়েছে। রাজনীতির জটিল সমীকরণে বামপন্থীরা কী করে পাকিস্তানের অখণ্ডতাপন্থী হয়ে গেলো, তা আজকের বিপ্লবীরা সহজেই চেপে যায়। পাকিস্তানের ভাঙনকে শুধুই দ্বিজাতি তত্ত্বের ব্যর্থতা হিসেবে দেখলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের একীভূত হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বাংলাদেশের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ভারত ইউনিয়নের বিভিন্ন রাজ্যে স্বাধীনতার দাবি মাথাচাড়া দেয়। উপমহাদেশ আসলে একজাতি-দ্বিজাতির সরল কোনো বিতর্ক নয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র মাঝে জয়-জিন্দাবাদ ও বাঙালি-বাংলাদেশি বিতর্কগুলোর ভেতর অস্বস্তিকর কিছু স্ববিরোধিতা ও অন্তঃসারশুন্যতা দেখানো হয়েছে।
বইটি অনেক বিষয় একত্রে আলোচনা করায় এতে ইউনিটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এছাড়া পর্ব আকারে পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সময় যাদের নাম উল্লেখ করে আক্রমণ করা হয়েছিলো, বইয়ে সেসকল নাম উহ্য রাখায় পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকদের কাছে বইটিকে ছন্নছাড়া বিলাপের চেয়ে বেশি কিছু বলে মনে হবে না। তবে যতটুকু নাম উল্লেখ আছে, বর্তমান আওয়ামী নজরদারিতে সেগুলোও প্রায় ব্লাসফেমি লেভেলে গণ্য হওয়ার দাবিদার। ডানঘেঁষা সামরিক শাসকদের উত্থানের জন্য কেন যেন বঙ্গবন্ধুর একনায়কতন্ত্রকে দায়ী করছেন লেখক, যদিও বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসনই সমাজতন্ত্রের সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল।
পছন্দের ধারাকে ‘প্রগতিশীল’ এবং অপছন্দের ধারাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে লেবেলিং করার প্রথা ভাঙতে পারেননি ছফা। তবে এটিও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, প্রগতিবাদও একটি ধর্ম। প্রগতিশীল দাবিদার যে কাউকেই কাছে টেনে নেওয়ার পক্ষপাতী তিনি নন। বরং ‘প্রকৃত প্রতিক্রিয়াশীল’ গোষ্ঠীর চেয়েও ‘নকল প্রগতিশীল’ গোষ্ঠীকে বেশি বিপদজনক বলেছেন লেখক। ঘুরিয়ে বললে, ‘প্রকৃত প্রতিক্রিয়াশীল’রা প্রগতিবাদ ধর্মের কাফির এবং ‘নকল প্রগতিশীল’রা মুনাফিক।
জাতীয় জীবনে ধর্মের ‘অভিভাবকত্ব’ কমিয়ে আনতে সংস্কৃতিকে ব্যবহার করার জোর আহ্বান রয়েছে বইটিতে। উদ্দেশ্যহীন শিল্প-সংস্কৃতির বিপরীতে Art for life’s sake দর্শনের যৌক্তিকতা আলোচিত হয়েছে। ‘সংস্কৃতি’ বলে আজকে বাঙালি মুসলিমদের যা গেলানো হচ্ছে এবং যারা গেলাচ্ছে, এর কোনোটিই যে নিরপেক্ষ নয় – সে ব্যাপারে মুসলিম পাঠকগণ ভালো ধারণা পাবেন। লক্ষণীয় যে, ধর্মীয় ‘কুসংস্কারে’ আচ্ছন্ন জনগোষ্ঠীকে লেখক বলেছেন ‘সংস্কারান্ধ’। অথচ ‘সংস্কৃতি’ ও ‘সংস্কার’ একই মূল থেকে উৎপন্ন শব্দ।
সাতানব্বই সালে ছফা যখন পরিবর্ধিত সংস্করণের ভূমিকা লিখছেন, ততদিনে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে ফেলেছে। উসমানী খিলাফাতের পতনকে সহস্রাধিক বছরের খিলাফাত ব্যবস্থার অনুপযোগিতার প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা লেখক কিন্তু সোভিয়েতের পতনকে সমাজতন্ত্রের অনুপযোগিতার প্রমাণ বলে মানেননি। বরং বাংলাদেশের সংকট উত্তরণের জন্য সমাজতন্ত্রকেই সমাধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিগত দশকগুলোর ব্যর্থতা কাটাতে বামপন্থীদেরকে নসিহত করা হয়েছে বিদেশমুগ্ধতা কাটিয়ে বাংলাদেশের দিকে মন দিতে। বিদেশমুগ্ধতার উদাহরণ হিসেবে মুসলিমদের উসমানী রাজধানীর দিকে তাকিয়ে থাকার দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। অথচ লেখক নিজেও কামাল পাশার প্রতি মুগ্ধ। কামালের অনুকরণে বাংলাদেশেও ব্যাপক ভাঙাগড়ার জন্য একটি জঙ্গী তৎপরতার আহ্বান করা হয়েছে একেবারে রাখঢাক ছাড়াই। বলা হচ্ছে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে ‘তাত্ত্বিকভাবে হলেও’ সেখানে যে সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, বাংলাদেশেও এমনটা করতে। তাত্ত্বিকভাবে তো কতকিছুই প্রতিষ্ঠিত আছে। তাহলে এ ধরনের সমাধানের যৌক্তিকতা কোথায়? বিদেশের মাটি থেকে উঠে আসা সমাধানগুলো যদি লেখকের মতে বাংলায় প্রয়োগযোগ্য না-ই হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপের লু হাওয়ায় জন্ম নেওয়া সমাজতন্ত্রই বা বাদ যাবে না কেন?
সমাজতন্ত্রে অর্থনীতি মূল কথা হলেও আলোচ্য বইটিতে শুধু সংস্কৃতির দিকটি আলোচিত হওয়ার কারণ হলো একটি ‘মানসবিপ্লবে’র আকাঙ্ক্ষা। মানসিকতার জগতে একটি আদর্শিক বিপ্লব না করে কেবল ক্ষমতার পালাবদলকেই লেখক স্থায়ী সমাধান মনে করেন না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ তাওহীদের বাণীর মাধ্যমে কত স্বল্প সময়ে সেই মানসবিপ্লব সংঘটিত করে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হতে পেরেছেন, তা অধ্যয়ন করলে আজকের বিপ্লবীদের অনেক সময় ও শ্রম সাশ্রয় হতো।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।