বর্তমান সময়ে অহরহই যেকোনো অচেনা ব্যক্তি আপনার ব্লগ অথবা ফেসবুক ফীড সাবস্ক্রাইব করতে পারে।
পারে আপনার পেইজ লাইক করতে,
পারে আপনাকে টুইটারে ফলো করতে,
আপনাকে তাদের সার্কেলে যুক্ত করতে,
আপনার ছবি পিন করতে পারে।
সারা বিশ্বে মানুষ এখন তাদের অধরা, ভার্চুয়াল ব্যক্তিত্ব, প্রোফাইল অথবা ‘ফেইস’ দ্বারা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ধরে নেওয়া হয় এটাই তাদের আসল, শারীরিক পরিচয়ের প্রতিফলন।
কিন্ত আসলেই কি তা-ই?
বাস্তবতা থেকে ভিন্নতা
বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলি অনলাইন থেকে যেমন আলাদা, অনলাইনের সম্পর্কও তেমনই বাস্তব জীবনেরগুলো থেকে ভিন্ন। আমরা বাস্তব জীবনে অনেক বছর ধরে যাদেরকে চিনি, তাদের সাথে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে পরস্পর মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নেয়াটা আসলেই মজার।
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আমরা তাদের এমন কোনো দিক দেখতে ফেলতে পারি, যা তাদের সাথে এত বছরের বাস্তব জীবনের সম্পর্কে আমরা জানতামই না। যেমন, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের মতামত এবং সেই ব্যাপারে তাদের অনুভূতির স্পর্শকাতরতা।
উৎসুক পাঠক, লেখক, চিন্তাবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট অথবা অন্যান্য ক্ষেত্রে সক্রিয় প্রফেশনালদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো সত্যি। কারণ তারা তাদের চিন্তাভাবনাগুলো স্পষ্টভাবে অনলাইনে শেয়ার করতে পছন্দ করে।
আমরা তাদের ব্যক্তিসত্ত্বার নতুন দিক প্রত্যক্ষ করি। তারা হয়তো আমাদেরই সহকর্মী, পরিবারের সদস্য, শৈশবের বন্ধু অথবা জীবনসঙ্গী। কিন্তু তাদের অনলাইনে উন্মুক্ত আলোচনা এবং মিথষ্ক্রিয়া ঘটে অন্য সার্কেলের মানুষদের সাথে। তার এই অনলাইন সার্কেলের মানুষগুলোকে আমরা এতদিন চিনতামই না।
দুর্ভাগ্যবশত, তাদের চরিত্রের এই নতুন দিকগুলোর ব্যাপারে আমাদের এই এপিফ্যানি হয়তো কিছুক্ষেত্রে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ইতি ঘটানোর অশনি সংকেত দিতে শুরু করে।
বিপরীত চিত্র
এখন এর কিছু ইতিবাচক/কম হতাশাব্যঞ্জক দিক বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন কিছু মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে, যারা একে অপরের পরিচয় জানতো না, কখনও দেখেনি অথবা সাক্ষাতও করেনি।
আইরনি হলো, এইক্ষেত্রেও নির্ণায়ক ঠিক একই, যা আমি উপরের দৃশ্যপটে বর্ণনা করেছি। বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা অনলাইনে যুক্ত হয়। তারপর কোনো নির্দিষ্ট ইশ্যুতে তাদের আবেগপূর্ণ মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনা অনলাইনে খোলামেলাভাবে শেয়ার করে। এভাবে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ও মনোমালিন্য হয়। তারা পরস্পর দূরে সরে যায়। উল্টো দিকে তাদের ব্যক্তিগত চিন্তার এই অভিব্যক্তিগুলি নতুন সমমনা মানুষদের সমর্থন, ভালোবাসা এবং প্রশংসা জুটাতে শুরু করে। এই সমমনারা তাদের টুইটগুলিতে প্রতিক্রিয়া দেখায়, ফেইসবুকের লেখা দেখে অথবা ব্লগের পোস্টে মন্তব্য করে।
বাস্তব জীবনে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী! চোখে চোখ রাখা মাত্রই যেন তারা একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। যদিও এইমাত্রই তারা একে অপরকে প্রথমবার সশরীরে দেখলো, তবু তাদের কাছে মনে হয় “হাজার বছর তোমার সাথে ছিলো পরিচয় বুঝি, ছিলো পরিচয়!”
দুই ধারওয়ালা খঞ্জর
আলহামদুলিল্লাহ, উপরোল্লেখিত দুটি চিত্রের মাঝে দ্বিতীয় ঘটনাটি আমার ক্ষেত্রে অনেক বোনের সাথে ঘটেছে। প্রথম ধরনের ঘটনা সেই তুলনায় কমই ঘটেছে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে আমার বাস্তব জীবনের বান্ধবীরা আমার থেকে দূরে সরে গেছে। আমার সাথে অনলাইনে যুক্ত হওয়ার পর ফেইসবুক এবং ব্লগে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পড়ে আমার সম্বন্ধে বাজে মনোভাব নিয়ে আমাকে ত্যাগ করেছে।
আমার অতীত “বন্ধু”দের কেউ কেউ জনসম্মুখে আমার দৃষ্টিভঙ্গীকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা দোষের কিছু না। কিন্তু আমি নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অনর্থক বিতর্কে লিপ্ত হলাম।
আমি লক্ষ করলাম যে, এতে আমি কেবলই অর্থহীন কথাবার্তায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছি, যা নিঃসন্দেহে আমার এবং তাদের সময়ের অপচয় করছিলো।
যারাই আমাকে চিনে, তারা জানে যে, আমাকে চ্যালেঞ্জকারীরা আমার সাথে কোনো টপিকে তর্ক করতে এসে কিছুসময় পর আমার দিক থেকে কোনো সাড়া পায় না। কারণ, আমি তর্কবিতর্ক একদমই পছন্দ করি না। হয় আমি তর্ক শুরু হওয়া মাত্রই সেখান থেকে সরে পড়ি, নাহয় চুপ থাকি। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, হকের উপর থেকেও যে বিতর্ক পরিহার করে, তার জন্য জান্নাতে গৃহ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি হাদীসে এসেছে।
এই প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব মতামত: তর্কবিতর্ক এবং ঝগড়াঝাটি হচ্ছে শান্তি, শক্তি এবং সময় বিনষ্ট করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এগুলো আদৌ কোনো সুফল নিয়ে আসে না। তবে যা পাওয়া যায় তা হলো, প্রথমে চ্যালেঞ্জকারী ব্যক্তির আসল চেহারা এবং নিয়্যাত উন্মোচিত হয়ে যায়।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
যা–ই হোক। আমার বাস্তব জীবনের এরকম কিছু বন্ধুকে ফেসবুকে যুক্ত করার পর যখন বাস্তব জীবনের তথাকথিত ‘বন্ধুত্ব’ শেষ হতে শুরু করলো, তখনও আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্য বোনদের সাথে কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলাম।
অনলাইনে কিছু চমৎকার বোনের সাথে যুক্ত হয়ে আমি অনেক নতুন নতুন বন্ধু বানিয়েছিলাম। তাদের কয়েকজনের সাথে আমার বাস্তবে দেখা হয়। আর ভার্চুয়াল জগতে তাদের সাথে উপকারী কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে আরো ভালোভাবে জানতে পারলাম। তাদের সুখদুঃখ ভাগাভাগি করে নিলাম। আমি তাদের বিয়ে হওয়া এবং প্রথম সন্তান হওয়াও দেখেছিলাম। এর পাশাপাশি আমি কিছু বিশিষ্ট নতুন পেশাদার ব্যক্তিত্ব, যেমন সম্পাদক, অন্যান্য ব্লগারদের সাথে নতুন যোগাযোগ তৈরী করে নিলাম।
ব্যাপারগুলো অসাধারণ ছিলো!
এই সুখের সময় চলতে লাগলো জাকারবার্গ ওই আইপিও (Initial Public Offering) জিনিসটা তৈরী করার আগ পর্যন্ত।
এই যাহ! আমার সুখস্বপ্নের বেলুন ঠাস করে ফেটে গেলো!
আতঙ্কের সূচনা
আমি জানি না এই দুটো বিষয় পরস্পর সম্পর্কিত কি না। কিন্তু যখন থেকে ফেইসবুক আইপিও (IPO) তৈরী করলো এবং প্রাইভেসিতে প্রভাব পড়ার ব্যাপারে সতর্ক করে ইউজারদেরকে ইমেইল করতে লাগলো, তখন থেকেই আমি কিছু ভয়ের জিনিস দেখেছি। যার ফলে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে ব্রাউজিং অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ফেইসবুক লগ ইন থাকা অবস্থায় অত্যন্ত সতকর্তার সাথে চলতে নির্দেশ দেয়।
প্রথমত, হঠাৎ করে আমার জন্য অপ্রত্যাশিতভাবে “টার্গেটেড” বিজ্ঞাপন এবং “সাজেস্টেড” পোষ্ট ও পেইজ আসা শুরু করলো।
অন্য সবার মতো আমারও স্মার্টফোনে ইনস্টল করা ফেইসবুক অ্যাপ ব্যবহার করার অভ্যাস ছিলো। আমিও অন্য সবার মতো আমার ফোনের সাফারি ব্রাউজারে স্বভাবতই বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে ব্রাউজ করতাম।
সবকিছুই ঠিক ছিলো। এরপর আমি লক্ষ করলাম যে, আমার ব্রাউজ করা জিনিসের প্রায় একই রকম নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন আমার ফেইসবুক নিউজফীডে রহস্যময়ভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে!
এই ঘন ঘন বিজ্ঞাপন প্রদর্শন তো এমনিতেই যথেষ্ট বিরক্তিকর। কীভাবে ফেইসবুক আমার ফোন থেকে আমার ব্রাউজিং ডেটা জেনে নিচ্ছে, এই ভেবে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
দ্বিতীয়ত, ফেইসবুক কীভাবে আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বিনয়ী ও প্রচারবিমুখ মানুষগুলোকেও তাদের অজ্ঞাতসারে আত্মপ্রেমীতে পরিণত করছে, তা দেখে আমি সত্যিই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। তাদের যেসব পোস্ট, স্ট্যাটাস, লিঙ্ক এবং …এহেম এহেম… ছবিতে ডিফল্ট প্রাইভেসি সেটিং দেওয়া ছিলো, ফেইসবুক সেগুলোকে “পাবলিক” করে দিলো!
এটাও হয়তো মানা যেত, যদি ফেইসবুক অনলাইনে কিছু পোস্ট করার আগে পোস্টদাতাকে জানিয়ে দিতো যে তাদের প্রাইভেসি সেটিং পাবলিক করা ছিলো। তারপর সেই সেটিং পাল্টানোর ব্যাপারে আগে জিজ্ঞেস করে নিতো। সেই সাথে যদি সকলকে অনলাইনে কিছু পোস্ট করার সময় ট্যাগ করা এবং নিজের অবস্থান জানাতে প্ররোচিত না করতো।
কিন্তু ফেইসবুক তা করেনি। তারা প্রত্যেকের মুখের উপর ‘People you may know’ এর একটা তালিকা লটকে রাখে। কেউ যদি বহুদিন যাবত লগ ইন না করে, ফেইসবুক তাদেরকে ই-মেইল প্রেরণের মাধ্যমে তারা ফেইসবুকে কী কী মিস করছে – তা না জানিয়ে ছাড়ে না।
সোশাল মিডিয়াগুলো মানুষের একটি মৌলিক চাহিদার উপর অনন্তর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা হলো “সামাজিক স্বীকৃতি”। এর মধ্যে আছে অন্যদের কাছে পছন্দনীয় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, শ্রদ্ধা পাওয়ার লোভ ও প্রশংসা কামনা। প্রয়োজন শুধু যেন নিজেকে খাপ খাওয়ানো, জনপ্রিয় হওয়া এবং ‘আনন্দিত’ বোধ করা।
সে কারণেই ফেইসবুকের মতো সাইটগুলো চায় আমাদের প্রত্যেকেই যেন আমাদের তুচ্ছ, অযাচিত বিষয়গুলোও অনলাইনে শেয়ার করতে থাকি। এবং সেই শেয়ারকৃত বিষয়গুলি প্রায় সময়েই ‘লাইক’ করার দর্শক থাকবে – এটাও তারা নিশ্চিত করে।
ফলাফল?
মানুষের নিতান্ত ঘরের ভেতরের ঝগড়াঝাটির আবর্জনা এসে পড়ছে আমাদের চোখের সামনে। তৈরি হচ্ছে ভার্চুয়াল ডেইলি সোপ আর মেগাসিরিয়াল। অথচ এগুলো একদম কাছের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষদের মাধ্যমে সমাধা হওয়ার কথা ছিলো।
‘কিছু’ করণীয়
সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করতে নিষেধ করাটা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নয়। কেউ এসব একদম ছেড়ে দিয়ে বাস্তব জীবনে কল্যাণকর কাজে ব্যস্ত থাকলে তো ভালোই। তবে যারা সেটা পারছেন না, তারা অন্তত এই কাজগুলো করতে পারেন:
১। ফেইসবুক অ্যাপ ব্যবহার না করে ব্রাউজার দিয়ে ফেইসবুক চালানো।
২। ইনকগনিটো মুড বা প্রাইভেট ব্রাউজিং ব্যবহার করলে কিছু ক্ষেত্রে ট্র্যাকিং প্রোটেকশান পাওয়া যায়।
৩। ওয়েবক্যাম বা ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা স্ককচটেপ বা অস্বচ্ছ কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে রাখলে তা অযাচিত ব্যবহারকারীদের জন্য বাধাস্বরূপ হবে।
৪। বিশেষত বোনেরা নিজের কোনো ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে না দেওয়া।
এছাড়া আপনাদের কোনো সাজেশান থাকলে কমেন্টে তা শেয়ার করতে পারেন।
উৎস: About Islam Dot Net (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদক: তানজিলা শারমিন, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।
খুবই ভাল