একরাসূল (সাঃ)-এর একজন সাহাবী একটা শহরে ইসলামের বাণী প্রচার করতে গিয়ে খুব সুন্দরভাবে তার বক্তব্যকে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমাদের দাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দাসের প্রভুর দাসত্বের কাছে নিয়ে যেতে এসেছি।” এই কথার মাঝে এক মূল্যবান সম্পদ লুকানো আছে। এই কয়টা শব্দের মাঝে ক্ষমতার চাবিকাঠি ও মুক্তির একমাত্র সঠিক পথ বলে দেয়া হয়েছে।

ঠিক যে মুহূর্তে আপনি বা আমি, স্রষ্টাকে ছাড়া অন্য যে কোন কিছুকে আমাদের সাফল্য, ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখ কিংবা আমাদের মূল্য নির্ধারণের মানদণ্ড বানাই, আমরা এক নীরব কিন্তু ধ্বংসাত্মক দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। যে জিনিসটা আমার আত্মমর্যাদা, সাফল্য, ব্যর্থতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা তখন আমাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। আর এটাই হয়ে ওঠে আমার প্রভু। একজন নারীর মূল্য নির্ধারণকারী প্রভু সময়ের সাথে সাথে নানারূপ নিয়েছে। নারীর মূল্য নির্ধারণের জন্য যে মানদন্ডগুলো গ্রহণ করা হয়েছে তার মাঝে সবচেয়ে প্রচলিতটি হলো পুরুষের মানদণ্ড। কিন্তু আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, স্রষ্টা নারীকে যে সম্মান দিয়েছেন তা তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সাথে সম্পর্কিত – পুরুষের সাথে নয়। কিন্তু কিছু মতবাদ স্রষ্টাকে মুছে দিয়েছে এবং পুরুষ ছাড়া আর কোন মানদণ্ড রাখেনি। এর ফলে, একজন নারী বাধ্য হয়েছে নিজের মূল্য নির্ধারণ করার জন্য পুরুষকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে। আর এটা করতে গিয়ে তার মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণা ঢুকে গিয়েছে। সে মেনে নিয়েছে যে পুরুষ হচ্ছে মানদণ্ড – আর তাই একজন নারী ততক্ষণ পর্যন্ত একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে অবিকল একজন পুরুষের মতো হচ্ছে। যখন একজন পুরুষ তার চুল ছোট করে কাটছে, সেও চাইছে তার চুল ছোট করে কাটতে। যখন একজন পুরুষ সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, সেও চাইছে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। যখন একজন পুরুষ সিগারেট টানছে বা মদপান করছে, সেও চাইছে সিগারেট টানতে বা মদপান করতে। বেশির ভাগ সময়ই এমনটি করতে চাওয়ার একমাত্র কারণ হলো সেই মানদণ্ড।

IIRT Arabic Intensive

সে যা বুঝতে পারেনি তা হলো স্রষ্টা নারী ও পুরুষ উভয়কেই মর্যাদা দিয়েছেন তাদের স্বতন্ত্রে–তাদের অভিন্নতায় নয়। যখন আমরা পুরুষকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে নেই তখন অনন্যভাবে মেয়েলি বিষয়গুলোকে নিকৃষ্ট মনে করতে শুরু করে দেই। স্পর্শকাতর হওয়া হয়ে যায় অপমানজনক, সার্বক্ষনিক মায়ের দায়িত্ব পালন করা হয়ে যায় – অমর্যাদাকর। সুখে-দুঃখে নির্বিকার থাকা (যাকে পুরুষালি বলা হয়) ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা (যাকে মেয়েলি বলা হয়)–এই দুইয়ের যুদ্ধে প্রথমটাই আধিপত্য বিস্তার করে।

যখন আমরা মনে করি পুরুষের যা কিছু আছে ও তারা যা করে তা-ই শ্রেষ্ঠতর, তখন আমরা তা করতে অস্থির হয়ে উঠি। চিন্তা করি, যদি পুরুষদের এটা থাকে তাহলে আমরাও এটা চাই। যদি পুরুষরা সামনের সারিতে সালাত আদায় করে, আমরা ধরে নেই যে এটা উত্তম, তাই আমরাও সামনের সারিতে সালাত আদায় করতে চাই। যদি পুরুষরা ইমামতি করে, আমরা ধরে নেই যে ইমাম আল্লাহর বেশি কাছে থাকে, তাই আমরাও ইমামতি করতে চাই। কারও পার্থিব নেতৃত্বের অবস্থান আল্লাহর সাথে তার নৈকট্যকে ইঙ্গিত করে–এমন একটা ধারণাকে আমরা মেনে নিয়েছি।

দুইকিন্তু একজন মুসলিম নারীর নিজেকে এভাবে ছোট করার প্রয়োজন নেই। তার জন্য আছে স্রষ্টার মানদণ্ড। তাকে মূল্য দেয়ার জন্য স্রষ্টা আছেন; তাকে মূল্য দেয়ার জন্য তার কোন পুরুষের প্রয়োজন নেই।

নারী হিসেবে আমাদের বিশেষ অধিকার দেয়ার পর যদি আমরা যা নই তা হতে চেষ্টা করি তবেই আমরা নিজেদের অপমানিত করব। আর সত্যিই–আমরা পুরুষ হতে চেষ্টা করি না। নারী হিসেবে আমরা কখনোই সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব না যদি আমরা পুরুষদের অনুকরণ করা বন্ধ না করি এবং আমাদের স্রষ্টা- প্রদত্ত স্বতন্ত্র সৌন্দর্যের মূল্য না দেই।

এছাড়াও সমাজে আর এক ‘প্রভু’ বিদ্যমান যা নারীদের মূল্য নির্ধারণ করে। আর তা হচ্ছে তথাকথিত সৌন্দর্যের মানদণ্ড।একদম ছোটবেলা থেকেই নারী হিসেবে সমাজ আমাদের এক স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়। আর সেটা হচ্ছে “স্লিম হও। আবেদনময়ী হও। আকর্ষণীয় হও। আর তা না হলে … তুমি কিছুই না।” তাই আমাদের বলা হয় মেক-আপ নিতে ও ছোট স্কার্ট পড়তে। সুন্দর হওয়ার জন্য আমাদের জীবন, আমাদের শরীর, আমাদের মর্যাদা বিলিয়ে দিতে শেখানো হয়। আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে আমরা যত যা-ই করি না কেন, আমাদের মূল্য শুধু ততখানিই যতখানি আমরা পুরুষদের সন্তুষ্ট করতে ও তাদের কাছে সুন্দর হতে পারি। তাই আমরা কসমোর কভারের পেছনে জীবন ব্যয় করি আর বিজ্ঞাপনদাতাদের বিক্রির জন্য শরীর উৎসর্গ করি।

আমরা দাস হয়ে রই, কিন্তু তারা আমাদের বোঝায় যে এটাই স্বাধীনতা। আমরা হয়ে পড়ি মূল্যহীন কিন্তু তারা শপথ করে বলে যে এটা আমাদের সাফল্য। কারণ তাদের মতে, তোমার জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে প্রদর্শন করা, পুরুষদের কাছে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা ও তাদের আকর্ষণ করা। তারা তোমাকে বিশ্বাস করায় যে তাদের গাড়ির বাজার তৈরি করার জন্য তোমার শরীর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তারা মিথ্যা বলেছে। তোমার শরীর, তোমার প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরও মহৎ কিছুর জন্য। আরও অনেক মহৎ কিছুর জন্য। আল্লাহ বলেছেন-

নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। [সূরাহ আল-হুজুরাত (৪৯): ১৩]

তাই তুমি সম্মানিত। কিন্তু পুরুষদের মতো হওয়ার বা তাদের সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে না। নারী হিসেবে তোমার মূল্য তোমার কোমরের মাপ বা কতজন পুরুষ তোমাকে পছন্দ করে তার দ্বারা  নির্ধারিত হয় না। মানুষ হিসেবে তোমার মূল্য আরও উঁচু মানদণ্ডে মাপা হয়-সৎকর্ম তাকওয়ার মানদণ্ডে। ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো যা-ই বলুক না কেন, তোমার জীবনে উদ্দেশ্য পুরুষদের জন্য সুন্দর হওয়া থেকেও আরও মহিমান্বিত।

তিনআমাদের সম্পূর্ণতা আসে আল্লাহর কাছ থেকে ও তার সাথে আমাদের সম্পর্ক থেকে। কিন্তু তারপরও, আমরা যখন একদম ছোট তখন থেকেই আমাদের শেখান হয় যে একজন পুরুষ এসে আমাদের সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত আমরা সম্পূর্ণ হব না। আমাদের শেখানো হয় যে আমরা নিরুপায় যতক্ষণ পর্যন্ত না সিন্ডারেলার গল্পের মতো একজন রাজপুত্র এসে আমাদের উদ্ধার করছে। আমাদের শেখানো হয় যে আমাদের জীবন পুরোপুরি শুরু হবে না যতক্ষণ না স্লিপিং বিউটির কাহিনীর মতো কোনো প্রিন্স চার্মিং এসে আমাদের চুম্বন করছে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে কোন রাজপুত্র আমাদের সম্পূর্ণ করতে পারবে না। কোন বীর এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না। শুধু স্রষ্টা পারবে।

তোমার রাজপুত্র শুধুই একজন মানুষ। স্রষ্টা হয়ত তাকে তোমার সঙ্গী হিসেবে পাঠিয়েছে–কিন্তু তোমার রক্ষাকর্তা হিসেবে না।তোমার চোখের প্রশান্তি হিসেবে পাঠিয়েছে–তোমার ফুসফুসের অক্সিজেন হিসেবে না। তোমার অক্সিজেন আল্লাহর হাতে।তোমার মুক্তি ও পূর্ণতা তাঁর নৈকট্যের মাঝে–কোন সৃষ্ট জীবের নৈকট্যের মাঝে না। কোন রাজপুত্রের নৈকট্যের মাঝে না, কোন ফ্যাশন, সৌন্দর্য বা স্টাইলের মাঝে না।

তাই আমি তোমাদের বলব যা শিখেছ তা মন থেকে ঝেড়ে ফেল। উঠে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে বল যে তুমি ফ্যাশন, সৌন্দর্য বা পুরুষের দাস নও। তুমি শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র স্রষ্টারই দাস। আমি তোমাদের বলব তুমি জানিয়ে দাও যে তুমি এখানে তোমার শরীর দিয়ে পুরুষদের সন্তুষ্ট করতে আসনি;  তুমি এখানে এসেছ স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে। তাই যারা বলছে যে তোমার ভালো চায় ও তোমাকে স্বাধীন করতে চায় তাদের হাসিমুখে বলে দাও “ধন্যবাদ।”

তাদের জানিয়ে দাও যে তুমি এখানে নিজেকে প্রদর্শনের জন্য আসোনি। তোমার শরীর সর্বসাধারণের ভোগের জন্য না।দুনিয়াকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দাও যে তুমি কখনোই নিজেকে কোনও জড় পদার্থ বা পায়ের জুতার বাজার বৃদ্ধি করার মতো হীন কিছু নও। তুমি একটা আত্মা, একটা মন,  স্রষ্টার একজন দাস। তোমার মূল্য নির্ধারিত হয় সেই আত্মার, মনের, নৈতিক চরিত্রের সৌন্দর্যের দ্বারা। তাই তুমি তাদের সৌন্দর্যের মানদণ্ডে নিজের মুল্য নির্ধারণ করো না; তুমি তাদের ফ্যাশনবোধের কাছে আত্মসমর্পণ করো না। তোমার আত্মসমর্পণ আরও মহিমান্বিত কিছুর কাছে।

সুতরাং কোথায় ও কিভাবে একজন নারী ক্ষমতায়নের সন্ধান পাবে এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি আমাদের রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবীর উক্তির মাঝে। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, সত্যিকারের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিহিত রয়েছে নিজেকে অন্য সব প্রভুর থেকে, অন্য সব মানদণ্ড থেকে মুক্ত করার মাঝে।

মুসলিম নারী হিসেবে এই নীরব দাসত্ব থেকে আমাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। আমাদের মূল্য নিরূপণ করার জন্য সৌন্দর্য বা ফ্যাশনের মানদণ্ডের প্রয়োজন আমাদের নেই। সম্মানিত হওয়ার জন্য অবিকল পুরুষের মতো হওয়ার প্রয়োজন আমাদের নেই এবং আমাদের রক্ষা করবে বা সম্পূর্ণ করবে এই আশায় কোন রাজপুত্রের অপেক্ষায় থাকার দরকার আমাদের নেই। আমাদের মূল্য, আমাদের সম্মান, আমাদের মুক্তি, আমাদের পূর্ণতা দাসের মাঝে নিহিত না। বরং, দাসের প্রভুর মাঝে নিহিত।


অনুবাদ : রাবেয়া রওশীন

অনুবাদ সম্পাদনা: সানজিদা শারমিন

মূল আর্টিকেল লিন্ক 

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive