এক সকাল সকাল মাসজিদে চলে গেলাম জুমু’আর সালাতের জন্য। দীর্ঘদিন যাবত যখন কোনো অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় এবং কঠিন পরিশ্রমের সাথে বিভিন্ন আচার ব্যবস্থা মেনে যখন সেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়, তখন সব শেষে কর্তব্য পালনের নির্ভারতার সাথে সাথে আকস্মিকভাবে কেমন যেন এক উদ্দেশ্যহীনতা ভর করে।
এত দিন হাজ্জ সঠিক উপায়ে পালন করে গুনাহ মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, আল্লাহ্কে খুশি করার এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আমাদের সবার মন এতটাই কেন্দ্রীভূত ছিলো যে, আজ হঠাৎ করে নিজেদের লক্ষ্যহীন ও অসম্ভব হালকা মনে হচ্ছে। যদিও হাজ্জ শেষ হবার পর আসল উদ্দেশ্য শুরু হয় জীবনে, তা হলো আল্লাহ্র ইচ্ছায় হাজ্জ হতে প্রাপ্ত শিক্ষা কাজে লাগিয়ে জীবনে পজিটিভ পরিবর্তন আনা।
কারণ কবুল হাজ্জের অন্যতম লক্ষণ হলো জীবনযাত্রায় ও ইবাদাতে পরিবর্তন আসা। বলা হয়, হাজ্জ কবুল হলে সেই মানুষের মাঝে মাঝে কিছু না কিছু বদল আসবেই। সেই বদলানো অন্যদের চোখে পড়তেও পারে, না-ও পড়তে পারে। একমাত্র আল্লাহ্ই জানবেন কোন ব্যক্তি খাস নিয়তের সাথে, শুধু মাত্র আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজ জীবন নতুন করে গড়ে নেবার চেষ্টা করছে। এই পরিবর্তন সমাজের সামনে নিজেকে বিশেষ কিছু প্রমাণের জন্য হবে না, মানুষকে দেখানোর জন্যও হবে না। এটি হবে আল্লাহ্র সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য।
ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সমাপ্তির পর আজ সবার মন প্রশান্ত। শান্তির সাথে দেশ বিদেশের মুসল্লিরা মাসজিদে প্রবেশ করছে, ইহরাম মুক্ত হবার পর আজ সবাই আবার স্বাভাবিক কাপড়ে। সব পুরুষদের মাথা ন্যাড়া। কাবাঘরও আজ চকচক করছে নতুন গিলাফে। প্রতি বছর আরাফাতের দিন কাবা ঘরে নতুন কিসওয়া পরানো হয়, যাকে আমাদের দেশে গিলাফ বলে।
বর্তমানে প্রতিটি গিলাফ তৈরিতে ছয়শ সত্তর কেজি প্রাকৃতিক সিল্ক ও এম্ব্রয়ডারির জন্য পনেরো কেজি সোনা ব্যবহার করা হয়। সোনার সুতা দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করে কুরআনের আয়াত ও আল্লাহ্র প্রশংসাসূচক বাণী নকশা করে ফুটিয়ে তোলা হয়। পুরানো গিলাফ বিভিন্ন টুকরায় বিভক্ত করে উপহারস্বরূপ বিদেশি মুসলিম কূটনীতিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম ব্যক্তিবর্গকে দেওয়া হয়। এটি নির্মাণ করতে সৌদিতে আলাদা একটি কারখানা আছে, তাদের কাজ হলো প্রতি বছর নতুন কিসওয়া তৈরি করা। একটি সম্পূর্ণ কিসওয়া সেলাই করতে মোট ১৭,০০০,০০০ সৌদি রিয়াল খরচ হয়। তরল সোনার উপর বসে থাকা সৌদি বাদশাহদের জন্য এ অর্থ নস্যিতুল্য।
মাসজিদের নব সম্প্রসারিত ভবনের নিচতলায় মেয়েদের অংশে বসলাম জুমু’আর জন্য। আমার স্বামী কিছুটা দূরে পুরুষদের অংশে বসলো। আজ আমার অসম্ভব মন খারাপ। আগামীকাল মক্কা ছেড়ে চলে যেতে হবে, এই বেদনায় হৃদয় ভারাক্রান্ত। আয়নার মতো ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন সাদা টাইলসের শীতল মেঝেতে বসে আছি। ততোধিক শীতল কষ্ট যেন অন্তরে দলা পাকিয়ে আছে। আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায়, প্রায় দেড় মাস পর আপনজনদের মাঝে ফিরে যাবার আনন্দ আমায় স্পর্শ করতে পারছে না। আল্লাহ্র ঘরকে কীভাবে বিদায় জানিয়ে চলে যাবো, ভাবতে পারছি না একদম। এত কষ্ট হবে, সত্যিই ভাবিনি।
আল্লাহ্ আবার কখনো ভাগ্যে রাখলে ইনশা আল্লাহ্ আসবো। এবারের মতো যতটুকু সময় আমার রিযিকে আছে, তার সদ্ব্যবহার করা উচিৎ। এ বরকতময় স্থানে বসে অনেক অনেক দু’আ করা উচিৎ ও ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। কিন্তু আবার এখানে ফিরে আসার জন্য দু’আ করা ছাড়া আর কিচ্ছু মাথায় আসছে না। অন্যান্য কীসের জন্য দু’আ করবো, তা ভাবনা চিন্তা করে মনে করতে হচ্ছে। অথচ কত কিছুই তো চাওয়ায় আছে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতার কাছে। আমরা তো তাঁর কাছে চির মুখাপেক্ষী।
সম্মানিত ও পবিত্র এ কাবা গৃহ নিজ চোখে না দেখা ও নিজের অন্তর দিয়ে এর অপার্থিব পবিত্রতা অনুভব করতে না পারা পর্যন্ত এর মাহাত্ম্য অনুধাবন করা সম্ভব নয়। জান্নাতে যারা যাবেন, তাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম পুরষ্কার হবে সুমহান রবের দিদার লাভ। এই পৃথিবীতে মানব নির্মিত বাইতুল্লাহ দেখে সবার যে তীব্র ভালো লাগার অনুভূতি হয়, জান্নাতে যারা আল্লাহ্কে দেখবেন, তাঁদের তখন কেমন সুখানুভূতি হবে, তা আমাদের দুনিয়াবি সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে ধারণা করাও সম্ভব নয় এবং সেই অপার আনন্দ অন্য কোনো অনুভূতির সাথে তুলনা করাও অসম্ভব।
আজকের জুমু’আ বার অনেক আলোকিত ও উজ্জ্বল লাগছে। কিছুদিনের মাঝে হারাম এলাকায় হুজ্জাজদের ভীড় হালকা হয়ে যাবে। কেউ কেউ আমাদের মতো দেশে ফিরে যাবে, আবার অনেকে মদিনা যাবে। খুৎবা শেষ হবার পর সালাত শুরু হলো। সুন্দর সময়গুলো দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। সালাত শেষে আমরা মাসজিদের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এখন হোটেলে ফিরে যাবো, খেয়ে দেয়ে আবার আসবো, আজকের মাঝে আমাদের বিদায়ী তওয়াফ করতে হবে।
দুই হাজ্জের সর্বশেষ ধাপ হলো মক্কা ছেড়ে নিজ দেশে/শহরে ফেরত যাবার আগে তওয়াফ-ই-বিদা বা বিদায়ী তওয়াফ করা। এর মাধ্যমে হাজ্জের সকল নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন হয়। মক্কায় থাকাকালীন ‘শেষ’ কাজ হতে হয় এই তওয়াফ। ঈশার পর ভয়াবহ ভীড় ঠেলে দীর্ঘ সময় লাগিয়ে আমরা তাওয়াফ-ই-বিদা শেষ করলাম।
তওয়াফ করে হোটেলে চলে এলাম। রাতে মোসাদ্দেক মামা আমাদের সাথে দেখা করে গেলেন, উপহার হিসেবে দু’জনের জন্য দুটো জায়নামাজ এনেছেন। আরো এনেছেন রান্না করা কুরবানির গোস্ত। মক্কায় বাস করলেও প্রতি বছর হাজ্জের অনুমতি পাওয়া যায় না, তাই তিনি ঈদের দিন উমরাহ্ করেছেন। সাফা-মারওয়ার পাশে উনার বাসা। জীবনে মোট কতবার উমরাহ্ করেছেন, তা নিজেও জানেন না। উনাকে বিদায় দিয়ে গোছগাছে লেগে গেলাম।
সবার গোছগাছ প্রায় শেষ, আমাদের এখনো প্রচুর কাজ বাকি। লাগেজ অনেক ওভার ওয়েট, কিছু জিনিস ফেলে না গেলে উপায় নেই। একে তো সরকারি সুটকেস, এছাড়া হাজ্জের সময় বিমান বন্দরগুলোতে মালপত্রের কোনো যত্নও থাকে না। এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলা হয় মাঝেমাঝে। তাই সবার সুটকেস ভালো করে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেয়া হলো, যেন ভেঙে গেলেও ভেতরের জিনিস বের হয়ে না যায়!
তিন রাতে সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে ঘুমাতে বারোটা বাজলেও আজ ভোরে উঠে পড়লাম। সবাই বাসের জন্য রেডি হয়ে বসে আছি। ভোরে জেদ্দাগামী বাস আসার কথা। দুপুরে জেদ্দা থেকে আমাদের ফ্লাইট। ঘণ্টা কয়েক বসে থাকার পরও যখন বাসের নিশানা দেখা গেলো না, তখন হঠাৎ মনে হলো আবার হারাম শরীফে গেলে কেমন হয়! গত রাতে তওয়াফ করে আমার একদমই মন ভরেনি। আরো একবার সেখানে যাবার জন্য অস্থির লাগছে। সাফিরকে বললাম বেশিক্ষণ দেরী করবো না, বাস এলে যেন আমাকে ফোন দেয়। সবার মাল বাসে ওঠাতে ওঠাতে আমি চলে আসবো।
দ্রুত পায়ে মাসজিদের দিকে হাঁটতে লাগলাম। গত রাতেও ভাবিনি সকালে আবার এখানে আসার সুযোগ পেয়ে যাবো। ফজরের সালাত ও ইশরাকের সালাতের পর এ সময় মাসজিদে অত মানুষ থাকে না। কিন্তু এখন হাজ্জের মৌসুম বলে কথা! দিন রাতের কোনো বালাই নেই, চব্বিশ ঘণ্টা কাবা প্রাঙ্গণে প্রচুর লোকসমাগম থাকে। গত কয়েক দিনের মতো না হলেও বেশ ভীড় ছিলো তখন। মাতাফের দিকে তাকিয়ে সাহস করে তাওয়াফকারীদের সাথে শামিল হয়ে গেলাম।
আল্লাহ্ আমার জন্য তওয়াফ করা অতি সহজ করে দিলেন। আমার ঠিক সামনে এক ব্যাক্তি দু’জন মহিলাকে নিয়ে তওয়াফ করছেন। সবার বয়স দেখে অনুমান করলাম, একজন ভদ্রলোকের মা অন্যজন সম্ভবত ভদ্রলোকের স্ত্রী। লোকটি সবার সামনে, তার ঠিক পেছনে বয়স্ক মহিলাটি ছেলের কাপড় ধরে আছেন, এবং ট্রেনের তৃতীয় বগির মতো অল্প বয়সী মহিলাটি দ্বিতীয়জনের বোরকা ধরে আছেন। আমিও আস্তে করে চতুর্থ বগি হয়ে তিন নাম্বার জনের বোরকার কোনা ধরে ফেললাম। এতে তারা কোনো রকম বিরক্ত হলো না। বরং আমাকেও নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে নিয়ে এক সাথে তওয়াফ করাতে লাগলো।
আল্লাহ্র অশেষ রহমতে বিনা প্রতিবন্ধকতায় তৃপ্তির সাথে আমার বিদায়ী তওয়াফ শেষ হয়ে গেলো। মাতাফ থেকে সরে মাসজিদের ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। প্রশান্তিময় এ পরিবেশে আরো কিছু সময় কাটানোর লোভ সংবরণ করা বড় মুশকিল মনে হচ্ছিলো! তওয়াফের সময় ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো। ফোন হাতে নিয়ে আমার চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে গেলো!! সাফিরের একগাদা মিসড কল!! হায় হায়! নিশ্চয় বাস এসে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এমনিতে বাস অনেক লেট, এখন আমার কারণে যদি আরো দেরী হয়, নিঃসন্দেহে খুব লজ্জায় পড়ে যাবো। তাড়াহুড়া করে মাসজিদ থকে বের হয়ে লম্বা লম্বা কদম ফেলে যত দ্রুত সম্ভব হাঁটতে লাগলাম।
চার হোটেলে এসে দেখি গেটের বাইরে সুটকেসের দীর্ঘ সারি। অনেকে নিচে নেমে রিসেপশনের সামনে লবিতে বসে আছে। সবার সুটকেস আর ব্যাগের জন্য হোটেলের লবিতে ঠিক মতো হাঁটার জায়গা, বসার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেদের ব্যাগের ওপরই বসে পড়েছে কেউ কেউ। অপেক্ষা করতে করতে আর বাস লেট হওয়া দেখতে দেখতে এত দিনে অভ্যাস হয়ে গেছে সবার। সময়মতো কিছু হলেই এখন সবাই আশ্চর্য হয়ে যাবে।
আরো কতক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হবে জানি না, কারণ বাস এখনো আসেনি!! অহেতুক এমন দৌড়াতে দৌড়াতে এলাম!! আসার পর সাফির বললো, এবার সে মাসজিদুল হারামে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসতে চায়! বাস এলে যেন তাকে ফোন দেই। ও যাবার পর আমার কামরায় গিয়ে বসে রইলাম, নিচে বসে রইতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না।
সাফির মাসজিদে লম্বা সময় কাটিয়ে ফিরে আসার অনেক পর এগারোটার দিকে অবশেষে বাস আসলো। সময়মতো জেদ্দা পৌঁছে দুপুর সোয়া একটার ফ্লাইট ধরা এখন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। ভরসার কথা হচ্ছে, হাজ্জের ফ্লাইট শেষ যাত্রীটি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। আর এখন তো প্রায় সব যাত্রী মক্কায়। সুতরাং আমাদের ফেলে ফ্লাইট ছেড়ে দেবার প্রশ্নই আসে না।
অল্প সময়ের ভেতর সবাই বাসে উঠে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলাম। মক্কা থেকে বিদায় নেবার সময় হয়ে গেছে। প্রথম দিন যখন এ নগরীতে এসেছিলাম, তখন এর প্রকৃতির নিদারুণ রুক্ষতায় যারপরনাই বিস্মিত হয়ে ভেবেছিলাম, কোনো দেশ এতটা শুষ্ক ও শ্যামলীমা বিবর্জিত হয় কী করে! আল্লাহ্র কী কুদরত! এমন স্থানই তিনি তাঁর কাবার জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং মুসলিম জাহানের অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। কাবার প্রতি সবার চৌম্বকীয় আকর্ষণ ও এর magnificent beauty ম্লান করে দিয়েছে প্রকৃতির যাবতীয় রুক্ষ বিবর্ণতাকে।
মক্কা থেকে দেশে প্রত্যাগমনের সময়, নিজের পরিজনদের বহু দিন পর দেখার আনন্দের সাথে সাথে আল্লাহ্র ঘর ছেড়ে চলে যাবার এক অব্যক্ত বেদনা গ্রাস করে হৃদয়কে। অদ্ভুত এই কষ্ট বুকে চেপে ধীরে ধীরে মক্কার সীমানা ত্যাগ করলাম।
পরবর্তী পর্ব- শেষ পর্ব
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।