আসসালামু আলাইকুম ভাই ও বোনেরা,

আপনি যদি কাউকে এমন একটা অভ্যাসের কথা বলতে বলেন, যেটা আপনার মানসিক কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিবে, আপনার শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধি করবে এবং আপনার অন্তরে শান্তি এনে দিবে, তাহলে সে কী বলবে ? এমন একটি অভ্যাস আছে যেটাকে অনেকে অবমূল্যায়ন করে এবং এভাবে তারা মন, আত্মা, শরীর ও হৃদয়ের জন্য অসংখ্য উপকার থেকে বঞ্চিত হয়। মানবাত্মার শান্তি মূলত যিকির  বা আল্লাহর স্মরণের অভ্যাসেই নিহিত থাকে।

IIRT Arabic Intensive

আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে আয়াত, তাতে মহান আল্লাহ তায়ালা একটা খুব সুন্দর ওয়াদা করেছেন, তা হলো:

“নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকিরকারী পুরুষ ও যিকিরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার।”  [সুরা আল-আহযাব : ৩৫]

জীবনকে বদলে দেওয়া তিনটি দু’আকে আয়ত্তে আনতে হলে তাওহীদের গুরুত্বকে অনুধাবন করতে হবে। আর মহান আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তিনটি আলাদা আলাদা নিয়তে দু’আগুলো করতে হবে ইনশাআল্লাহ্‌।

মহানবী ﷺ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণ করে আর যে করে না তাদের তুলনা যেন জীবিত ও মৃতের মতো।”

 [আল-বুখারী, মুসলিম]

এটাই সময় নিজেকে একজন যিকিরকারী হতে অনুপ্রাণিত করা।

আল্লাহর স্মরণে বা যিকিরে একত্রিত হওয়ার ফযিলত :

আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেন, “মহিমান্বিত আল্লাহ তায়ালার ফেরেশতারা দল বেঁধে এমন লোকের সন্ধান করে যারা আল্লাহর কথা স্মরণ করে। যখন তারা এমন কারো খোঁজ পায়, তারা বলাবলি করতে থাকে, ‘এসো, যার খোঁজে এসেছো তাকে পাওয়া গেছে।” এরপর তারা তাকে তাদের পাখা দ্বারা আবৃত করে ফেলে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের এবং নিম্ন আকাশের মধ্যকার তফাৎ শূন্য হয়ে যায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের কাছে জানতে চান, (যদিও তিনি সকল বিষয় সম্পর্কেই জানেন) ‘আমার বান্দারা কী বলছে?’ তারা বলে, ‘তারা আপনার ত্রুটিহীনতার প্রশংসা করছে, আপনার মহানুভবতা ও মহিমার কথা স্মরণ করছে।” তিনি জানতে চাইবেন, ‘তারা কি  আমাকে দেখেছে?’ তারা বলবে, ‘না, দেখেনি।” তিনি জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তারা আমাকে না দেখেই কীভাবে তা করছে?’ তখন তারা  কী বলবে, ‘তারা যদি আপনাকে দেখতে পেতো তাহলে আরো আন্তরিকভাবে আপনার ইবাদতে নিযুক্ত হতো এবং আপনার গুণগান করতো।” তিনি বলবেন, ‘তারা আমার কাছে কী চায়?’ তারা বলবে, ‘তারা আপনার কাছে আপনার জান্নাত চায়।” আল্লাহ বলবেন, ‘তারা কী জান্নাত দেখেছে?’ তারা বলবে, ‘না,আমাদের রব।‘ তিনি বলবেন, ‘তারা যদি আমার জান্নাত দেখতে পেতো তাহলে কী করতো ?’ তারা উত্তর দিবে, ‘তারা যদি দেখতে পেতো তাহলে তারা এর জন্য আরো তীব্র আগ্রহ প্রকাশ করতো।‘ ফেরেশতারা বলবে, ‘তারা আপনার আশ্রয় চায়।‘ তিনি বলবেন, ‘তারা কী  থেকে আমার আশ্রয়  চায়?’ ফেরেশতারা বলবে, ‘হে আল্লাহ, তারা জাহান্নামের আগুন থেকে আপনার আশ্রয় চায়।‘ মহান স্বত্বা বলবেন, ‘তারা কি জাহান্নামের আগুন দেখেছে ?’ তারা বলবে, ‘না, আপনার রহমতে তারা তা দেখেনি।” তিনি বলবেন, ‘তারা জাহান্নামের আগুন দেখলে কী করবে?’ তারা বলবে, ‘যদি তারা তা দেখতো তাহলে আরো ব্যগ্রভাবে তা থেকে দূরে থাকার জন্য দু’আ করতো। তারা আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছে।” তিনি বলবেন, ‘আমি তোমাদের সাক্ষী হিসেবে ডেকেছি, আমি তাদের ক্ষমা কবুল করলাম, তারা যা চায় তা তাদের দান করলাম এবং তারা যা থেকে নিরাপত্তা চায় সে বিষয়ে তাদের সাহায্য করলাম।” ফেরেশতাদের মধ্য থেকে একজন বলবে, ‘হে আল্লাহ, এই মজলিসে আপনার এমন এক বান্দা আছে যারা আপনার যিকিরে  অংশগ্রহণ করে না। ‘ তিনি বলেন, ‘আমি তাকেও ক্ষমা করে দিলাম, কারণ তাদের কারণে তাদের সঙ্গীরা দুর্ভাগ্য বরণ করবে না।”

 আল্লাহর  যিকিরের মজলিসে উপস্থিত থাকার জন্য এই হাদিসটিকে অনুপ্ররণা হিসেবে কাজে লাগান।

আপনি কি তিন ধরনের তাওহীদ সম্পর্কে জানেন ?

আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে জানা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান। তাঁর নাম, তাঁর গুণ এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান তো আছে কুর’আনে। তাওহীদ, তাঁর একাত্বতা সম্পর্কে ধারণা, নিহিত রয়েছে যিকিরে । এজন্য, তিন ধরনের তাওহীদ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা খুব জরুরি।

তিন ধরনের তাওহীদ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত আলোচনা:

প্রথমত, আল্লাহর একক কর্তৃত্বের প্রতি বিশ্বাস (তাওহীদ আর-রুবুবিয়াহ) অর্থাৎ, একমাত্র আল্লাহই সব সৃষ্টি করেছেন, জীবন ও মৃত্যু দান করেন, ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত, সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব (তাওহীদ আল উলুহিয়্যাহ অথবা আল-ইবাদাহ) অর্থাৎ, আল্লাহই একমাত্র স্বত্ত্বা যার প্রতি মানুষ তাদের আত্মিক ও বাহ্যিক সকল কিছু উৎসর্গ করবে। তাই, তিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদাতের যোগ্য নয়। নিশ্চয়ই তিনি সমুচ্চ ও মহিমান্বিত।

তৃতীয়ত, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর প্রতি ঈমান (তাওহীদ আল-আসমা ওয়াস-সিফাত) । যার অর্থ হলো, আল্লাহ যা কিছু নিজের বলে ঘোষণা করেছেন তার প্রতি ঈমান আনা। যা তিনি নিজের সম্পর্কে বলেননি তা অস্বীকার করা। তবে তিনি যা নিজের বলে ঘোষণা করেছেন তা অস্বীকার করা যাবেনা এবং তাঁর গুণাবলীকে অন্য কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনাও করা যাবে না। (মাজমু আল-ফতোয়া; আল-ফতোয়া আল-কুবরা দেখুন) ।

যিকিরে আল্লাহর নাম ব্যবহার করুন!

যিকিরের সওয়াব কল্পনাতীত। আর কুর’আন সুন্নাহ অনুসারে যিকিরে আল্লাহর নাম ব্যবহার করা অনেক সওয়াবের। আল্লাহর নামের যিকির করার পাঁচটি নেক উদ্দেশ্য রয়েছে। আল্লাহ আমাদের এই উদ্দেশ্যগুলো পূরণের তৌফিক দান করুন আমিন।

প্রথমত, আমাদের তৈরি করার উদ্দেশ্য পূরণ করা। কারণ আমাদের তৈরি করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালাকে জানা । তিনি বলেন,“আল্লাহ সপ্তাকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণে, এসবের মধ্যে তাঁর আদেশ অবতীর্ণ হয়, যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সবকিছু তাঁর গোচরীভূত।” [সূরা আত-তালাক, ৬৫:১২]

দ্বিতীয়ত, জান্নাত অর্জনের জন্য। ইহসাহ – অথবা আল্লাহর নামে যিকির করা জান্নাত অর্জনের একটি পন্থা ।

তৃতীয়ত, আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদের চরিত্র ও কর্মকে উন্নত করে। এবং এগুলো প্রত্যহ ব্যবহার আমাদের কাজকে আমাদের জন্য সহজ করে দিবে।

চতুর্থত, আল্লাহর ইবাদাত করার উদ্দেশ্যে তাঁর নাম প্রত্যহ যিকির করা। তিনি বলেছেন,

“আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাকো।” [কুর’আন, ৭:১৮০]

পঞ্চমত, ইবন আল-কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “নবী – রাসূলদের প্রচার করা বাণীর নির্যাস পেতে গেলে, তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিতে হলে অবশ্যই আল্লাহর নামসমূহ, গুণসমূহ, ক্ষমতাকে চিনতে হবে, জানতে হবে। কারণ, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর উপরে ভিত্তি করেই নবুয়তের বাণী দণ্ডায়মান রয়েছে ।

 তিনটি জাদুকরী নিয়ত,    তিনটি অসাধারণ দু’আ

 যিকির অর্থাৎ আল্লাহর সুন্দর নামগুলোর ব্যবহার ও রসূলের ﷺ সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করার পুরস্কার সম্পর্কে চিন্তা করুন। অসংখ্য ফযিলত পূর্ণ দু’আ তিনটি শিখুন এবং ব্যবহার করুন। এবং তা করার সময় এই তিনটি সুন্দর নিয়ত করুন; যিকিরে মগ্ন হওয়া, মহান আল্লাহ তায়ালাকে তাঁর নামে ডাকা এবং রাসূলের ﷺ সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করা।

১। সর্ব রোগের প্রতিষেধক

উসমান বিন আফফা্ন  কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেন, “যে প্রতিদিন সকাল-বিকাল তিনবার করে বলবে, ‘বিসমিল্লাহিল-লাজি লা ইয়াদুররু মা ‘আস-মিহি শাই’উন ফিল-আরদি ওয়া লা ফিস-সামা’ই, ওয়া হুয়াস-সামি’উল আলিম’ (পরম করুণাময় আল্লাহর নামে, যার নামে পৃথিবী ও জান্নাতের সমস্ত ক্ষতিকর কিছু থেকে নিরাপত্তা রয়েছে এবং তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী কোনোকিছুই তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারে না।)”

[আবু দাঊদ ও আত-তিরমিযি]

২। আল্লাহর মহান নাম ব্যবহার করে দু’আ  কবুল করানো

বুরাইদাহ (রাদিয়াল্লাহুয়ানহু) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ﷺ এক ব্যক্তিকে বলতে শুনেছেন যে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আস আলুকা বি আন্নি আশ-হাদু আন্নাকা আন্তাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লা আনতা, আল আহাদ আস-সামাদ, আল্লাযি লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইউলাদ, ওয়া’লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।‘ যার অর্থ, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য আর কেউ নেই। তুমি এক, স্ব-নির্ভরশীল প্রভু, যাকে সকল প্রাণীর প্রয়োজন। তুমি কাউকে জন্ম দাওনি বা কেউ তোমাকে জন্ম দেয়নি এবং কেউ তোমার সমতুল্য বা যোগ্য নয়।‘ তিনি ﷺ বললেন, ‘তুমি আল্লাহর সর্বোত্তম নামগুলো ব্যবহার করে তাঁর নিকট প্রার্থনা করেছো। যখনই তাঁর নামে কিছু চাওয়া হয়, তিনি তা দান করেন। আর যখন তাঁর নামে কিছু প্রার্থনা করা হয়, তিনি তাঁর উত্তর দেন।” [আবু দাঊদ, আল-তিরমিযি, আল-নাসা’ঈ এবং ইবন মাজাহ]

৩ । গুনাহর ভয়াবহতা সত্ত্বেও ক্ষমা

আমাদের নবী ﷺ বলেন, “আস্তাগফিরুল্লাল-লাজি লা ‘ইলাহা ‘ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু ওয়া ‘আতুবু ইলাইহি’ অর্থাৎ আমি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, তিনি ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নেই। তিনি সকলকে জীবন, জীবিকা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। আমি তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” যে ব্যক্তি এই দু’আ করবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন, এমনকি সে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করলেও।” [আবু দাঊদ, আত-তিরমিযি]  হে আল্লাহ, আপনি আমাদের যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমিন।


উৎস:  understandquran.com (মূল আর্টিকেল লিংক)

অনুবাদক: শারিকা হাসান , মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি

অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive