কবিরাহ গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় সম্পর্কে জানতে চেয়ে ইমাম ইবন কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহকে জনৈক ব্যক্তি চিঠি পাঠান। সেই চিঠির উত্তরে তিনি আল-জাওয়াব আল-কাফি নামে বিখ্যাত লেখাটি রচনা করেন। পাপের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে।
১. উপকারী জ্ঞান থেকে মাহরুম হওয়া। জ্ঞান এমন একটি নূর যা আল্লাহ মানুষের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত করেন, কিন্তু আল্লাহর অবাধ্যতা এই নূরকে নির্বাপিত করে। ইমাম শা’ফিঈ বলেন,
“আমি ওয়াকী’কে আমার স্মৃতিশক্তির বিষয়ে অনুযোগ করলাম। তিনি আমাকে আল্লাহর অবাধ্যতা (পাপ) ছেড়ে দিতে উপদেশ দিলেন; এবং বললেন, ‘জ্ঞান হলো নূর; আল্লাহর এই নূর অবাধ্যতাকারীদের দেওয়া হয় না’।”
২. রিযকে ঘাটতি। তাকওয়া যেমন রিযক বৃদ্ধি করে, তাকওয়ার বর্জনও তেমনি দারিদ্র্য ডেকে আনে। আর পাপের বর্জনের মতো এমন কিছুই নেই যা রিযকে বৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
৩. আল্লাহর আনুগত্য করতে না পারা। পাপের ফলস্বরূপ আল্লাহর আনুগত্যে অনীহা ছাড়া আর কোনো শাস্তি যদি না থাকতো, তবে শাস্তি হিসেবে এটিই যথেষ্ট হতো।
৪. পাপ অন্তর ও দেহকে দুর্বল করে। অন্তরকে দুর্বল করে তোলার বিষয়টি স্পষ্ট। দেহ-মন নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত এ প্রভাব চলতেই থাকে।
৫. অবাধ্যতা আয়ুস্কালকে কমিয়ে দেয় এবং যেকোনো নিয়ামতকে ধবংস করে দেয়। সৎকর্ম যেমন হায়াতকে বৃদ্ধি করে, তেমনি পাপ একে কমিয়ে দেয়।
৬. পাপ নতুন পাপের বীজ বপন করে। এভাবেই একের পর এক পাপ করতে করতে এমন পর্যায়ে সে পৌঁছে যায় যে, সেখান থেকে ফিরে আসা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
৭. অবাধ্যতা অন্তরের ইচ্ছাশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। ফলে পাপের প্রতি আকাঙ্ক্ষা মানুষের মাঝে তীব্র হতে থাকে এবং তাওবার ইচ্ছা আস্তে আস্তে হ্রাস পেতে থাকে; এক সময় তা হৃদয় থেকে সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়ে যায়।
৮. প্রত্যেক পাপই আল্লাহর অবাধ্য কোনো না কোনো জাতির ধবংসের কারণ। সমকামিতা লূত (আঃ) এর সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। নিজের অধিকারের থেকে বেশি নেওয়া, আর অন্যকে তার ন্যায্য অধিকার না দেওয়া ছিল শুয়াইব (আঃ) এর জাতির বৈশিষ্ট্য। জমিনে দখল ও ফাসাদ সৃষ্টি করা ফেরাউনদের বৈশিষ্ট্য ছিল। অহংকার ও শোষণ হূদ (আঃ) এর জাতির বৈশিষ্ট্য। তাই যে পাপ করছে, সে আল্লাহর শত্রু কোনো না কোনো জাতির অনুসরণ করছে মাত্র।
৯. অবাধ্যতার কারণে আল্লাহর লানত ও লাঞ্ছনা নেমে আসে। হাসান আল-বাসরী (রঃ) বলেন,
“তারা আল্লাহর চোখে লাঞ্ছিত হয়ে যায়, তাই তারা পাপ করে। তারা যদি আল্লাহর কাছে সম্মানিত হতো তবে তিনি তাদের রক্ষা করতেন। আল্লাহ বলেন,
“যাকে আল্লাহ লাঞ্ছিত করেন, তাকে কেউ সম্মানিত করার ক্ষমতা রাখে না।” [সূরা হাজ্জ (২২): ১৮]
১০. পাপের কুপ্রভাব পাপীর আশেপাশের মানুষ ও পশু-পাখির ওপরও পড়ে।
১১. পাপ করতে করতে মানুষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সে পাপ তার কাছে অনেক মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, এটা ধবংসের দ্বারপ্রান্তের আলামতমাত্র। যখনই কোনো পাপ বান্দার চোখে তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়, আল্লাহর কাছে তখন তা অনেক বড় হয়ে যায়। ইবন মাস’উদ (রাঃ) বলেন,
“আল্লাহর বান্দা তার পাপকে এমনভাবে দেখে যেন সে কোনো পর্বতের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে আর এই ভয়ে সে তটস্থ যে, হয়ত এটা এখনই তার মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়বে। আর পাপী তার পাপকে এমনভাবে দেখে যেন কোনো মাছি তার নাকের ডগায় এসে গেছে, আর সে তা হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে।” (আল-বুখারী)
১২. অবাধ্যতা লাঞ্ছনা ও অসম্মান ডেকে আনে। আল্লাহর আনুগত্যের মাঝে সম্মান নিহিত। আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক বলেন,
“আমি পাপের কারণে বহু অন্তরকে মরে যেতে দেখেছি এবং ফলস্বরূপ লাঞ্ছনা তাদের পেয়ে বসেছে। পাপ পরিত্যাগ অন্তরকে জীবিত করে এবং এটাই এর জন্য কল্যাণকর।”
১৩. বোধশক্তিকে পাপ কলুষিত করে। বিবেকের মাঝে নূর দেওয়া হয়েছে, আর পাপ সে নূরকে কলঙ্কিত করে। ফলে তা দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৪. অবাধ্যতা বৃদ্ধি পেলে মানুষের অন্তরে মোহর পড়ে তা অন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,
“বরং তাদের অন্তরে রন (পাপ ও কুকর্মের কারণে আস্তরণ) পড়েছে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ।” [আল-মুতাফফিফীন (৮৩): ১৪]
১৫. মানুষের পাপের কারণে জমিনে নানা দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়ে। পানি, বাতাস, গাছ, ফসল এবং বাসস্থানে বিপর্যয় দেখা যায়। আল্লাহ বলেন,
“মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।” [সূরা আর-রূম (৩০): ৪১]
১৬. শালীনতার অভাব। শালীনতা প্রতিটি ভালো কাজ ও অন্তরের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক। এর অনুপস্থিতি মানে সকল ভালো গুণের অনুপস্থিতি। নাবি (সঃ) বলেন,
“শালীনতার মাঝেই পূর্ণরূপে মঙ্গল নিহিত।” (মুসলিম)
১৭. পাপ অন্তরে আল্লাহর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাকে সরিয়ে ফেলে।
১৮. পাপের কারণে বান্দাকে আল্লাহ ভুলে যান, তাকে পরিত্যাগ করেন। ফলত সে নিজের নাফস ও শয়তানের জালে জড়িয়ে পড়ে নিজের ধবংস ডেকে আনে।
১৯. পাপের কারণে মানুষ ইহসান বা সৎকর্মবিমুখ হয়ে যায়, এর সাওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হয়। বরং ইহসান যখন অন্তরকে ঢেকে ফেলে, অবাধ্যতা তখন সেখানে প্রবশের পথ হারায়।
২০. অবাধ্যতার কারণে আল্লাহর বারাকাহ দূরীভূত হয়। আলী(রাঃ) বলেন,
“প্রতিটি পরীক্ষা (বা সমস্যা) বান্দার ওপর আপতিত হয় তার পাপের কারণে এবং তাওবা না করা পর্যন্ত সেই পরীক্ষাকে দূর করে দেওয়া হয় না।”
আল্লাহ বলেন,
“ প্রতিটা দুর্ভাগ্যই তোমাদের নিজের হাতের কামাই। এবং তিনি পরম ক্ষমাশীল।” [ সূরা আশ-শুয়ারা (৪২): ৩০]
তিনি আরো বলেন,
“এই শাস্তির কারণ এই যে, আল্লাহ যদি কোনো জাতির উপর নি‘আমাত দান করেন, সেই নি‘আমাত ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই জাতি নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহাশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।” [সূরা আনফাল (৮):৫৩]
এই আর্টিকেল হতে অনূদিত।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।