এক মেয়েরা ‘ঘরের বাইরে’ গিয়ে জব করতে চায়। কেন জানেন? ক্যাপিটালিস্টিক সিস্টেমে সবকিছুকেই ‘প্রাইস’ দিয়ে মাপা হয়। আমার বিষয়বস্তু ‘জাগো গো ভগিনী’র বিরোধিতা করা নয়, বিষয় হলো অর্থনীতি।

বরাবরই আমরা শুনি ‘ডেভেলপড’ কান্ট্রির কথা। ক্যাপিটালিজমে সব কিছুই ‘প্রাইস’ দিয়ে মাপা হয়। এই যে আমার মা আমাকে দেড়-দুই বছর বুকের দুধ খাইয়েছে, এটার তেমন কোনো প্রাইস নেই। মানে এটার প্রাইস মার্কেটে ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়নি। এজন্যই এখন নারীরা তাদের সন্তানদের ‘বুকের দুধ’ খাওয়াতে চায় না, টিভিতে আপনি যতই জনসচেতনতামূলক অ্যাড দিয়ে বলেন, ‘ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই স্বাস্থ্যকর,’ কোনো লাভ নেই। কারণ এটার প্রাইস নাই। আরো সমস্যা আছে। বডি ফিটনেস, স্ট্রাকচার যে নষ্ট হয়ে যাবে! জব মার্কেটে কিন্তু এটার প্রাইস অনেক ভালো।

IIRT Arabic Intensive

ইউএসএ অনেক উন্নত, মানে জিডিপি অনেক বেশি আর কি। যত সম্পদ তত উন্নতি। ম্যাটেরিয়ালিস্টিক প্যারামিটার। কিন্তু এই প্যারামিটারে সমস্যা আছে। এই ‘উন্নতি’ মানে এটা নয় যে, ইউএসএতে কোনো ধর্ষণ হয় না। আরেকটা মেজারমেন্ট অবশ্য এখানে আছে, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স। ভালো যে এই সিস্টেমে অন্তত হিউম্যান ক্যাপিটালের দিকে কিছুটা নজর দেওয়া হয়েছে। যেমন এজুকেশন, লাইফ এক্সপেকটেন্সি।

NYC Blackout 1977! ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না কিছু ঘণ্টা। ১৬১৬টি দোকান লুট করা হয়েছে। ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড সব মিলিয়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলার (!) এর কিছু বেশি ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ। ‘উন্নত’ আর ‘এডুকেটেড’ পিপলদের ভিতর যে কালো কুৎসিত লোক বাস করে, এটা তার একটা স্ন্যাপশট।

আমি কী বলতে চাচ্ছি? আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মদীনাহ’কে আপনি কি উন্নত দেশ বলবেন? নাকি উন্নয়নশীল? নাকি অনুন্নত? HDI ইনডেক্সে দেশ অনেক এগিয়েছে; আগে শিক্ষার হার এত ছিলো, এখন এত! তো ঐ শিক্ষিত ব্যক্তিটি মদ খায় কি না, সিগারেটের নেশা আছে কি না, তা কিন্তু এখানে অনুপস্থিত। দুর্নীতিতে ১ম কি চাষাদের অশিক্ষার ফলে হয়েছে? ইউএসএ অনেক সুখে আছে না? আপনার কাছে ১০০ টাকা আছে আর তাদের কাছে ১০০ ডলার! ‘We are 99%‘ স্লোগান কিন্তু আমাদের অজপাড়াগাঁয়ে হয়নি! ম্যাটেরিয়ালিজমের সিস্টেমই হলো ‘আরো চাই’ প্রিস্নিপালস। রাসূলুল্লাহ ﷺ সঠিকই বলেছেন, বনী আদমের পেট কখনোই ভরাট হবে না, উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ এনে দিলেও আরো চাইবে।

কিছু মুসলিম মনে করছে মুসলিমদের পিছিয়ে পড়ার কারণ আমাদের সম্পদ কম, মানে মার্কেট ভ্যালুতে সম্পদ কম আর ইউরোপ আমেরিকার সম্পদ বেশি। মুসলিমদের বিশ্বে দাঁড়াতে হলে সম্পদশালী হওয়া লাগবে, মানে প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে হবে। ঐ প্রোডাক্টিভিটি যার মার্কেট প্রাইস আছে। আপনি সালাত আদায় করেন, আপনি জীবনের উদ্দেশ্য বুঝেন; আরেকজনের মাসিক ইনকাম মাসে দশ হাজার ডলার, আপনার চেয়ে বেশি। ইনডেক্সে কিন্তু আপনি পিছিয়ে। মুসলিমরা কেন পিছিয়ে? কীভাবে আমরা উন্নত হতে পারি? ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তৈরী করা প্যারামিটারে?

আমিরুল মুমিনীন উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর কথা দিয়ে এই অংশ শেষ করি।

“আমরা এমন জাতি যাদের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না, সম্মান ছিলো না। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মান দিয়েছেন। আমরা যদি ইসলামকে ছেড়ে অন্য কোনো কিছুর মাধ্যমে সম্মান পেতে চাই, তাহলে আল্লাহ্‌ আমাদের আবার লাঞ্চিত করবেন।”

দুই উন্নত বিশ্ব, অনুন্নত বিশ্ব শব্দগুলো প্রায়ই আমরা শুনি। অনুন্নত বিশ্বকে কীভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে রিসার্চ পেপার, পিএইচডি থিসিসের অভাবও নেই। অমর্ত্য সেন সম্ভবত এই বিষয়েই নোবেল পেয়েছিলেন। কোনো এক ভাই একবার বলেছিলেন যে, দ্রারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করে অমর্ত্য সেন নোবেল পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দরিদ্ররা আজও দরিদ্রই আছে। বিশ্বব্যাংক (WB) এর একটা স্বপ্নও হলো দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব।

আমাদের দেশ নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে এই নিয়ে অনেকের মধ্যে যথেষ্ট উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনাও আছে, না জানি কী হয়! আমাদের গ্রামের যেই কৃষক ধান চাষ করে, রাত দশটার পরের টকশোগুলোতে উন্নয়নমূলক কথা শোনে না, তাঁকে যদি আপনি গিয়ে বলেন আমাদের জনপ্রতি আয় বেড়েছে (GNI Per Capita), তাঁর মধ্যে খুব বেশি উচ্ছ্বাস দেখার আশা না করাই ভালো। ইমার্জিং ইকোনমিগুলোর একটা হচ্ছে ব্রাজিল। ব্রাজিলের জনপ্রতি আয়ও বঙ্গদেশ থেকে ঢের বেশি, কিন্তু এই ‘জনপ্রতি’ শব্দটাতেই তো সমস্যা। আয়ের অসমতা (inequality) প্রচণ্ড ব্রাজিলে। জনপ্রতি আয় যে কিছু ক্যালকুলেটরের হিসাব, এটা টিভি সাংবাদিকদেরকে বুঝাবে কে!

ইউরোপে বসে বসে যেসব দেশপ্রেমিক গবেষকরা উন্নয়নের থিওরি দেন, পশ্চিমা গবেষকদের লেজ ধরে উন্নয়নের মডেল আঁকেন, তাঁরা ভুলে যান যে, অ্যাডাম স্মিথ কিংবা ডেভিড রিকার্ডোর উন্নয়নের মডেলের পটভূমি ইউরোপ, যার সভ্যতা সংস্কৃতি মুসলিম বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন। উন্নয়নের মডেল তো আর তরল পদার্থ নয় যে, যে পাত্রে রাখা হয় ঐ পাত্রের আকার ধারণ করবে। তবে পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরাও কিছুটা সচেতন হয়েছেন। ইউরোপিয়ান ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশানের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করা বর্তমান অনুন্নত দেশগুলোর জন্য কেন কাজে লাগবে না, তার ৮টা কারণ মাইকেল পি তদারো চিহ্নিত করেছেন তাঁর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট বইতে।

উন্নয়ন কাকে বলে এটা নিয়েও পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের কোনো ঐক্যমত্য নেই। অনেকে মনে করে শুধু ইকোনমিক গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধিই উন্নয়ন। কিন্তু যখন দেখা গেলো ইকোনমিক গ্রোথ ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু দরিদ্র আর ধনীদের পার্থক্য বাড়ছে, তখন চিন্তা হলো ইকুইটি বা ইকুয়ালিটির কথা। সমবণ্টন না হলে গ্রোথ হলে কী হবে! কার্ল মার্ক্সের চিন্তার অনুসারীরা সবাইকে সমান করে ফেললো। কিন্তু সোভিয়েত টিকলো না। যে ব্যক্তি ঘন্টায় ২০ পিস প্রোডাকশন করে, সে যখন দেখে যে ১০ পিস প্রোডাকশন করে দু’জনের প্রাইজ সমান, তখন কি আর কাজ করার মানসিকতা থাকে? একসময় মনে করা হতো উন্নয়ন মানে কৃষি সেক্টর থেকে ম্যানুফেকচারিং সেক্টরে পদার্পণ। এরপর আসলো উন্নয়ন মানে শুধু ইকোনমিক উন্নয়ন নয়, তখন লাইফ এক্সপেকটেন্সি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, বেকারের হার হ্রাস ইত্যাদি যোগ করা হলো উন্নয়নের ডেফিনেশনে। অর্মত্য সেনের মতে তো উন্নয়ন মানে ‘সক্ষমতা’ (capability) তৈরী! বিবিসির হার্ডটক স্টুডিওতে ড. মাহাথির মুহাম্মদ ঠিক কথাই বলেছেন। পশ্চিমারা ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন থিওরি অ্যাপ্লাই করেছে, যখন ঐ থিওরির প্রব্লেম দেখা দিয়েছে তখন নতুন থিওরি আনা হয়েছে।

GDP বা GNI per capita-ই উন্নয়ন নির্দেশ করে না। আমার ইনকাম আর সালমান এফ রহমানের ইনকাম যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ দিলে আমাদের এভারেজ ইনকাম বের হবে। এই এভারেজ ইনকামের ফিগার ধরে যদি কেউ আমার ব্যাংক ব্যালেন্স চেক করতে যায়, তাহলে কিন্তু বিপদে পড়তে হবে। আচ্ছা এতে সমস্যা কী? সমস্যা হলো, যখন সম্পদের বণ্টন এখনকার মতো অসম হবে, সোসাইটিতে আর ভ্রাতৃত্ব থাকে না, থাকে মনিব আর দাসের সম্পর্ক। এটার আরেকটা নাম দেওয়া যায় ‘Slave of Capitalism’।

ইসলামে উন্নয়ন মানে সেক্যুলার ম্যাটেরিয়ালিস্টিক প্যারামিটার থেকে একটু ভিন্ন। সব চাইতে বড় উন্নয়ন হলো সোসাইটিকে মূর্তিপূজা থেকে, পেগান রিলিজিওন থেকে এক ও একক আল্লাহ’র ইবাদাতে ফিরানো। রাসূল ﷺ এর সমস্ত জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো এই উন্নয়ন। দেশের পাবলিক এক্সপেন্ডিচারের একটা বড় অংশ এই উদ্দেশ্যে ব্যয় করা উচিত। এজন্য বিভিন্ন অর্গানাইজেশন, NGO, গ্রুপের কাজ করতে হবে। মানুষ যখন এক ও একক আল্লাহ’র ইবাদাত করবে এবং সামগ্রিকভাবে আল্লাহ’র বিধি বিধান মেনে নেবে, তখন এই প্রথম ধাপ শেষ হবে। এমতাবস্থায় সুদ বলতে কিছু থাকবে না, বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে, ডিমান্ড ক্রিয়েট করবে যা উৎপাদন বৃদ্ধি করবে।

সোসাইটিতে যাকাত বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে এবং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ট্যাক্স নেয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, ট্যাক্স হচ্ছে একটা জুলুম। পাবলিক পলিসি মেকারদের লক্ষ্যই থাকবে জিরো ট্যাক্সের দিকে হাঁটা। যাকাত ইকুয়ালিটি নিশ্চিত করবে। এটা ধনীদের আত্মিক উন্নতি ঘটাবে, দুনিয়াবি সম্পদের মোহ থেকে মুক্তি দিবে আর দরিদ্রদের লিভিং স্ট্যান্ডার্ডের উন্নতি ঘটবে। সুদ না থাকলে মানুষের বিজনেস অ্যাক্টিভিটি বাড়বে, এটা বিনিয়োগ ও ক্যাপিটাল ফরমেশানে সহায়তা করবে। মানুষের মধ্যে যখন আখিরাতের চিন্তা আসবে, আল্লাহ্‌র প্রতি জবাবদিহিতার চিন্তা আসবে, মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটবে। সমাজে সহযোগিতা ও বিশ্বস্ততা বাড়বে। ডেট ক্রিয়েশান মোডের ফাইনান্সিং বাদ দিয়ে ট্রেড বা অংশীদারের ভিত্তিতে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রচলন বাড়বে। এর ফলে এমন সময় আসবে, যে সময় এসেছিলো উমর বিন আব্দুল আজিজের শাসনের সময় ১০০ হিজরিতে, যখন যাকাত নেয়ার মতো দরিদ্র মানুষের অভাব পড়েছিলো। ইসলামে উন্নয়ন মানে সামগ্রিক উন্নয়ন, সেক্যুলার ম্যাটেরিয়ালিস্টিক উন্নয়নই শুধু নয়। সবশেষে বলতে হয়, এই উম্মাহ’র শেষ অংশ সেভাবেই পরিশুদ্ধ হবে, উন্নত হবে, যেভাবে এই উম্মাহ’র প্রথম অংশ পরিশুদ্ধ হয়েছিলো, উন্নতি লাভ করেছিলো।

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থাবলি

১। ইসলাম ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন – ডঃ উমার চাপরা
২। ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট – মাইকেল পি তদারো ও স্টিফেন সি স্মিথ

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive