বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে নানা ধরণের লোকের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে, নানা মতের পরিচয় পেয়েছি, চিন্তাভাবনার প্রসারতা বেড়েছে, দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হয়েছে কিছুটা। তবে এ যাত্রায় কিছু জিনিস আবিষ্কার করেছি, কিছু ভাবনার কথা জেনেছি যা আমার চিন্তাভাবনার প্রসারতা বাড়ায়নি, দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করেনি, করেনি পরিশীলিত। বরং এগুলো আমাকে হতাশ করেছে, দুঃখ দিয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ওই সমস্ত ব্যক্তিবিশেষের প্রতি করুণারও জন্ম দিয়েছে।
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা এক সময় ভালোই নামাজ রোজা করতো, কোরআন নিয়ে বসতো অন্তত সপ্তাহের কয়েকদিন। তারা ভার্সিটিতে জুনিয়র মোস্ট হিসেবে আসলো। হলের রুমে রুমে সুন্দর আরবি কোরআন, জায়নামাজ, টুপি নিয়ে ঢুকলো। ভার্সিটির মসজিদে এদের পদচারণাও ঘটলো। কী সুন্দর! একঝাঁক নবতরুণের দল মসজিদে আসছে। বিনয় তাদের চরিত্রে, নূর তাদের চেহারায়। আসলে মানুষ যখন নেক আমল করে, বিনয়ী হয়, তখন তার চেহারায় অন্যরকম একটা মোলায়েম ভাব, প্রচ্ছন্নতা বিরাজ করে। ধারাবাহিক গুনাহের কাজ চেহারার এ উজ্জ্বলতাকে মেরে ফেলে। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর কথা বলে, আল্লাহর পথে চলে, তাদের দেখলে আল্লাহর কথাই মনে হয়, তাদের সাথে বসলে আল্লাহর মহিমাই গাওয়া হয়। কত সুন্দর অনুভূতি!
তো আগের কথায় আসি। এসমস্ত জুনিয়রেরা ভার্সিটিতে কিছুটা সময় পার করলো। থিতু হলো। হাবভাব বুঝলো ক্যাম্পাসের। ইতোমধ্যে র্যাগ নামক মানসিক যন্ত্রণার উত্তাল দিনগুলোও কিছুটা ঠান্ডা হলো। এবার এরা আড়মোড়া ভেঙ্গে হাঁটাচলা শুরু করলো। গায়ে গতরে ভাব আসলো কোত্থেকে যেন।
কয়েকদিন বাদে নতুন ব্যাচ চলে আসলো। সিনিয়রেরা তাই সদ্য এক ব্যাচ সিনিয়র হওয়া জুনিয়রদের অফিসিয়ালি বরণ করে নিল। অতপর ঐ সমস্ত সদ্য আগত জুনিয়রদের ভাবসাব দেখে মনে হল যে এরা যেন এদের সমস্ত বিনয়, ধার্মিকতা জুনিয়রদের স্বতঃত্যাগ করে দান করে বলল, “লেব্বাবা, ল্যাঠা চুকিয়ে দিলাম, এবার তো চিলিং এর পালা।”
এমনই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলা এক বন্ধুর সাথে একদিন কথা হচ্ছিলো। স্কুল কলেজ লাইফে তার নামাজ কালামের অবস্থা ভালোই ছিলো। তো তাকে বর্তমান বাজে চলাফেরা ও সঙ্গের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করায় সে যা বলল তার ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তারুণ্যের গন্ডিতে খেই হারিয়ে ফেলে অনেকেই এমন হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর বাস্তব জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবার পর নাকি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। আবার নাকি পুরনো ধর্মপরায়ণতা ফিরে আসে।
হ্যাঁ, বাস্তবে এ ধরনের কিছু উদাহরণ আমরাও দেখি। একটি উচ্ছন্নে যাওয়া তরুণ বিয়ে করলো, বাচ্চা হলো এবং ওর মাঝে কোত্থেকে যেন দায়িত্বশীলতার একটা ব্যাপার চলে আসলো। হ্যাঁ, এমনটা হয়। তাই বলে কি এটা অহরহ ঘটনা? সবার ক্ষেত্রেই কি এমনটিই ঘটে? বা সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দুনিয়াবি দায়িত্ববোধটা ফিরে আসলেও হারানো ধর্মপরায়ণতা ফিরে আসে কি? মসজিদে তার নিত্য উপস্থিতি, কোরআনের পাতায় হাতের স্পর্শ এসবও কি সাথে সাথে এসে যায়? না, আসে না সচরাচর। বিষয়টা এত সহজ নয়। হারানো এ অভ্যাসগুলো ফিরিয়ে আনতে তখন রীতিমত সংগ্রাম করতে হতে পারে। কারণ সে জীবনে সংগ্রাম আরো বেশি, ব্যস্ততা আরো প্রবল, সংকটগুলো গভীর এবং গাঢ়। তাই বয়স হলে ভালো হয়ে যাবো এ চিন্তাটা আমার কাছে এক অনিশ্চিত দুরাশা মনে হয়, যার ভিত্তি খুবই নড়বড়ে।
মানুষের মৃত্যু বলে কয়ে আসে না। এইতো সেদিন আমাদের ভার্সিটিরই এক ছেলে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে হাঁটছিল। আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে রেললাইনের কাছে চলে এসেছিল। এয়ারফোনের শব্দে হুঁশ ছিল না। ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেল। বা প্রতিবেশী মেডিকেল কলেজ থেকে সেদিন এক তরুণের মৃত্যুর ঘোষণা আসছিলো। এসব ঘটনার পর আমার প্রায়ই মনে হয় মৃত্যু আমার আশেপাশেই চলাফেরা করে। একদিন আমাকেও পাকড়াও করবে। আমাদের চারপাশের বহু সিস্টেম মৃত্যুর দূতকে বহন করতে সক্ষম। যে ইলেক্ট্রিসিটির সুইচটা টিপলেই বাতাসে আরামে চোখে ঘুম এসে যায়, মালাকুল মউত সেখানেও আসতে সক্ষম। আর মৃত্যুর অতশত এজেন্ট আমাদের আসেপাশে থাকার পরও যদি আমরা ভাবি আমরা ৬০/৭০ বছর বাঁচবো এবং একদিন ভালো হয়ে যাবো, তাহলে এ ভাবনার জন্য আমার একরাশ সমবেদনা।
মানুষের ভালো হওয়া, দ্বীনের পথে ফিরে আসা, ইসলাম প্র্যাক্টিস করা সবই একটা ব্যাপকতর চলমান প্রক্রিয়া যা নিয়মিত করলেই অভ্যাস অর্জন করা সম্ভব। আপনি যৌবনের সতেজ শরীরটাকে যাবতীয় হারাম কাজে ব্যবহার করবেন, আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যবহার করবেন আর বয়সকালে বুড়ো পঁচা শরীরটাকে আল্লাহর কাজে ব্যয় করার চিন্তা করবেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই তা পছন্দ করবেন না। আর বয়সকালে আপনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকলে তো এ চিন্তাটাও বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। তাই যুবকদের উচিৎ যৌবনটাকে আল্লাহর পথে কাটানো। এই সুন্দর সময়ে মানুষ অনেক কিছু করতে সক্ষম। মেধা-যোগ্যতার শক্তিতে দ্বীনের অপরিমেয় কল্যাণ এ সময়েই করা যায়। বিয়ে করে বাচ্চা হলে বয়স হলে ভালো হয়ে যাব এসব দুরাশা বাদ দিয়ে আজই যৌবনের শক্তিতে আল্লাহর পথে ব্যয়ের অদম্য আগ্রহ তৈরি করতে পারলেই জান্নাতের পথে যাত্রা শুরু করতে পারবেন।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।
অনেক ভালো লিখেছেন । যৌবনকালকেই আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে চাই ।