“আমার দু‘আ কি কবুল হচ্ছে?” এই প্রশ্ন প্রায় সবসময়ই আমাদের মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। কিন্তু আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি সমস্যাটা আসলে কোথায়? আসুন জেনে নেয়া যাক।
পরম করুণাময় আল্লাহ সুবহানাহুতা‘আলা সবসময় আমাদের প্রার্থনা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তিনি অপেক্ষায় থাকেন, কখন আমরা কিছু চাইব আর তিনি আমাদের চাওয়াগুলো পূর্ণ করবেন। কিন্তু আমরা কি আসলেই তাঁর অনুগ্রহের উপযুক্ত? আমরা কি কোনভাবে নিজেদেরকে এমন সমস্ত জিনিস দিয়ে ঘিরে ফেলেছি যেগুলো আমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার দয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? আফসোসের বিষয়, উত্তরটা হচ্ছে হ্যাঁ। আমাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা এমন। আসুন দেখি কীভাবে:
১. হারাম উপার্জন
রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক লোক অনেক দূর থেকে সফর করে এসেছে। তার চুল-কাপড় এলোমেলো, ধূলিধূসরিত। আর সে তার দুই হাত আকাশের দিকে তুলে বলছে: “ইয়া রাব! ইয়া রাব!” অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরনের কাপড় হারাম, আর তার তার শরীর পুষ্ট হয়েছে হারাম দিয়ে। এমন অবস্থায় কীভাবে তার দু‘আ কবুল হতে পারে? [মুসলিম]
আমাদের উপার্জনের প্রতিটা পয়সা যদি হারাম উৎস অথবা সুদ থেকে এসে থাকে, তাহলে কীভাবে আমরা আশা করতে পারি যে, আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের দু‘আ কবুল করবেন? আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের জন্য সুদকে হারাম করেছেন, [সুরা আল বাকারা; ২:২৭৮-২৭৯] অথচ আমরা এমনভাবে সুদ গ্রহণ করি যেন এটা কোন অপরাধই না! আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সুদখোরদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এত বড় হুশিয়ারি আসা সত্ত্বেও আমরা সুদ ছাড়তে পারি না!
আফসোস যে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলাকে খুশি করার জন্য এই সামান্য কাজটাও করতে পারি না, অথচ আমরা আশা করি যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন আর আমাদের সমস্ত চাহিদা মিটিয়ে দেবেন। কত বড় অবিবেচক আমরা!
২. দু‘আ নিয়ে উদাসীনতা
চোখ বন্ধ, হাত পেতে রাখা, ঠোঁট নড়ছে, মুখ চলছে অবিরাম, কিন্তু মন আর হৃদয় অন্য জগতে। মুখের কথা আর অন্তরের চিন্তায় বিস্তর ফারাক। এই যদি হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কিছু চাওয়ার সময় আমাদের মনের অবস্থা, তাহলে দু‘আ কবুল না হওয়াতে আর আশ্চর্যের কি আছে!
৩. জিনা
আমরা অনেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কিছু চাইতে থাকি এমন অবস্থায় যে আমরা চাওয়ার মুহূর্তেও জঘন্য সব গুনাহতে লিপ্ত। এগুলো এমন সব গুনাহ যার গোপনীয়তা আমরা সমাজের সামনে খুব সতর্কতার সাথে বজায় রাখি। অথচ যখন আমরা এসব করি তখন আল্লাহ তা‘আলার দৃষ্টিসীমার মধ্যেই করি! জিনার ব্যাপারে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা এতটাই কঠোর যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এর ধারেকাছে যেতেও মানা করে দিয়েছেন; আর এতে জড়িয়ে পরাত অনেক পরের কথা। [সুরা আল-ঈসরা(১৭): ৩২] যখন জিনাকারি ব্যাক্তি তার লজ্জাকর কাজ সমাপ্ত করে, তখন সে তার বিশাল অপরাধের বোঝা নিয়েই আল্লাহর কাছে আরও নিয়ামত চাইতে থাকে! সুবহানাল্লাহ! এভাবে আল্লাহর সামনে হাজির হতে কি তার লজ্জা করে না?
৪. কাবিরা গুনাহ
গীবত, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অন্যকে কষ্ট দেয়া এবং এরকম অন্যান্য সকল কাজ আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন। আর আমরা মনে করি যে, আমরা আল্লাহর অবাধ্যতা করতে থাকা অবস্থায় তিনি আমাদের দু‘আ কবুল করবেন!
কোন সাহসে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার সামনে দাঁড়াই যখন কিনা আমরা তাঁর হুকুমের ঠিক বিপরীত কাজ করে চলছি!
তবে আশার বিষয় হচ্ছে যে; আমরা যেই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম তার আরও একটি দিক রয়েছে। যারা আল্লাহ তা‘আলার একান্ত বাধ্য, যারা তাদের আমলের ব্যাপারে আন্তরিক, যারা আল্লাহর ভয়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে আর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির আশা নিয়ে ভালো কাজ করে, দু‘আর প্রতিফল তাৎক্ষণিক না পেলেও তাদের হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই।
“তোমরা কি ভেবেছ যে তোমরা এমনি এমনিই জান্নাতে প্রবেশ করবে; যদিও তোমাদের অবস্থা এখনও তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতো [পরীক্ষা] হয়নি? অর্থ- সংকট, দুরাবস্থা, ক্লেশ তাদের স্পর্শ করেছিল এতদুর পর্যন্ত যে, [এমনকি তাদের] রাসূল এবং তাঁর সাথে ঈমানদারগণ বলে উঠেছিলেন যে, ‘কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য?’ জেনে রাখ, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য অতি সন্নিকটে”। [সুরা আল বাকারা(২): ২১৪]
আমাদের চারপাশের সবকিছুই পরীক্ষা। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ চাইবে না এই পরিক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে চূড়ান্ত ও সবচাইতে বড় পুরস্কার হাতছাড়া করতে। আল্লাহ যাঁকে কুর’আনে সান্ত্বনা দিয়েছেন, যেখানে সেই রাসূলকে আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন, সেখানে আমরা কোন ছাড়? হাল ছেড়ে দিবেন না, আমাদের রাব্ব আমাদের পক্ষে আছেন। আন্তরিকতার সাথে চোখের পানি ফেলতে থাকুন; আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সর্বোচ্চ ভরসা রেখে দু‘আ করতে থাকুন। জেনে রাখুন, আল্লাহ আপনাকে নিরাশ করবেন না।
রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দাকে ভালবাসেন, তখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন”। [তিরমিজি]
হাদীসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা‘আলা জিবরাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, দু‘আর উত্তর দিতে দেরি করতে কারণ তিনি দু‘আকারীর আওয়াজ শুনতে ভালবাসেন! [তাবরানী]
মনে রাখবেন, আমাদের দু‘আ কখনই বিফলে যায় না। ‘আলিমগণ বলেন যে, যখন কেউ দু‘আ করে, তখন তা অবশ্যই শোনা হয়, কিন্তু এর উত্তর বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে।
“হয়তো আল্লাহ তাঁর বান্দার দু‘আ অনুযায়ী প্রতিদান তাকে দেবেন, অথবা তিনি এই দু‘আর বিনিময়ে তার উপর থেকে কোনো বিপদকে সরিয়ে দিবেন, অথবা কোনো উত্তম জিনিস পাওয়া তাঁর জন্য সহজ করে দেবেন, আর তা না হলে তিনি এই দু‘আর প্রতিদান হাশরের দিন পর্যন্ত নিজের কাছে রেখে দেবেন, এবং দু‘আকারী বান্দাকে অনুগ্রহ করবেন সেই সময়ে যখন সে সবচে বেশি বিপদের মধ্যে থাকবে।” [শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ, islamqa.info]
জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও আল্লাহ্র কাছে চাও।
ইবন রাজাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:
আল্লাহ পছন্দ করেন যে, তাঁর বান্দারা দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত প্রয়োজন, যেমন খাবার, পানি, কাপড়, হিদায়াহ, মাগফিরাত ইত্যাদি সকল বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইবে। এক হাদীসে সাবিত আল-বুন্নি থেকে বর্ণিত, রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমরা তোমাদের সকল প্রয়োজনের জন্য তোমাদের রাব এর কাছে চাইতে থাক, যতক্ষণ না এমন হয় যে, তোমাদের লবণের দরকার হলে সেটাও আল্লাহ্ তা‘আলার কাছ চেয়ে নেবে, আর জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও আল্লাহ্র কাছেই চাইবে।“ [হাসান (দারুসসালাম), জামি আত-তিরমিজি; অধ্যায় ৪৮, হাদিস নং ২৪৪] সালাফ দের মধ্যে অনেকে আল্লাহ্র তা‘আলার কাছে দু‘আর মধ্যে সব কিছু চাইতেন, এমনকি নিজেদের রুটি বানানোর জন্য লবণ আর ভেড়ার জন্য ঘাসও আল্লাহ্র কাছে চাইতেন।
ইসরাইলিয়াত (ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত ধর্মীয় কাহিনি)-এ পাওয়া যায়, মূসা আলাইহিস-সালাম আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে বলেছিলেন: “হে আমার রাব!, আমার কিছু দুনিয়াবি চাওয়া ছিল, কিন্তু আপনার কাছে চাইতে আমার খুব লজ্জা হচ্ছে।” আল্লাহ্ মূসাকে বললেন: “তোমার রুটির খামিরে মেশানোর জন্য লবণ আর তোমার গাধার জন্য ঘাসও যদি লাগে তবুও আমার কাছে চাও।”
একজন মানুষের যে জিনিসেরই দরকার হোক, সে যদি তা আল্লাহ্র কাছে চায়, তাহলে সে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলার প্রতি তার মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করল। আর এটা আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলা তার বান্দাদের মধ্যে দেখতে ভালোবাসেন। সালাফদের অনেকে যদিও দুনিয়াবি প্রয়োজনে আল্লাহ্র কাছ থেকে চেয়ে নিতে লজ্জা বোধ করতেন, তারপরও যেহেতু এটা সুন্নাহসমর্থিত সেহেতু এটার অনুসরণ করাই উত্তম। [জামি আল-উলুম ওয়াল-হুকুম (১/২২৫)]
আমার মুসলিম ভাই ও বোনেরা, আপনারা আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলার কাছে চান! রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বলেছেন:
“নিশ্চয়ই তোমাদের রাব উদার এবং লজ্জাশীল। যদি তাঁর বান্দা তাঁর কাছে হাত তুলে কিছু চায়, তাহলে তিনি তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন”। [আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি]
আর যারা দুনিয়ার চাকচিক্য অর্জন করতে গিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুম থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন, আপনারা পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তাওবা করে মহান আল্লাহ্র কাছে ফিরে আসুন।
আপনার কি ইচ্ছে হয় না যে, আপনার জীবনও আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলার দয়া ও অনুগ্রহে ভরে উঠুক?
আপনাদের কি দু‘আর অলৌকিক ক্ষমতার অভিজ্ঞতা আছে? এই প্রবন্ধটি পড়ার পর আপনারা অন্যদের কী উপদেশ দেবেন? আপনার মতামত নিচের কমেন্ট সেকশনে শেয়ার করুন।
উৎস: “ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি ব্লগ” (মূল আর্টিকেল লিঙ্ক)
অনুবাদক: আরিফ আবদাল চৌধুরী, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি।
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।
অনেক সুন্দর লেখা এবং ইউজফুল রিমাইন্ডার ।