দৃষ্টি সংযত রাখা এক ধরনের প্রতিরোধের অনুশীলন। গ্রীষ্মের দাবদাহে রোযা রাখা কিংবা শীতের ভোরে ফজর পড়তে ওঠা – এগুলোও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার এক ধরনের অনুশীলন। কারণ, সাধারণভাবে কেউই লেপের নিচ থেকে উঠে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওযু করতে আরাম পায় না কিংবা রোযার সময় ১৩-১৪ ঘণ্টা পানি না খেয়ে বিনা কষ্টে থাকতে পারে না। এই আচার অনুষ্ঠানগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন মুসলিমকে দৃঢ়, ধৈর্যশীল, জ্ঞানী, নিয়মানুবর্তী, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায়ে পরিপূর্ণ করে তোলা। আর একজন অত্যাচারী শাসক কখনো এ ধরনের মানুষে পরিপূর্ণ একটি দেশের উপর চেপে বসতে পারে না।
আর তাই যে কোনো ভূমিতে চেপে বসা জালিমেরা সেখানকার ‘সুশীল’, নৈতিকভাবে স্খলিত, সবকিছুতে আনন্দ খুঁজতে যাওয়া ঈমানহারা গোষ্ঠীগুলোকে একটা ধন্যবাদ দিতেই পারে। এরাই একটা ধ্বজভঙ্গ জনগোষ্ঠীর মূল উপাদান। জালিম তো শুধু দুর্বল ইচ্ছাশক্তির লোকেদেরকেই কব্জা করতে পারে। এই নিস্তেজ মানুষগুলো কীভাবেই বা তাদের ইচ্ছাশক্তি ফিরে পাবে যখন তাদের মন মগজে সারাক্ষণ শুধু এই বার্তাই ঠুসে দেওয়া হচ্ছে যে, ‘বাসনাগুলো খায়েশ মিটিয়ে পূরণ করো, নিষিদ্ধ কল্পনাগুলোকে বাস্তব করো, তোমার কামনাকে যেকোনো উপায়ে প্রকাশ করো আর কেউ তোমার এই লাগামছাড়া ইন্দ্রিয়ের ক্ষুধা মেটানোর পথে বাধা দিলে তবেই প্রতিবাদ করো’? তাহলে ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্যের জন্য নিয়ত বিদ্রোহের আকাঙ্ক্ষা কোথা থেকে আসবে? হ্যাঁ, ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছোটা এ সমাজে কত মানুষই তো প্রতিদিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তবে সেটা শুধুই নিজের স্বার্থ আর তার তাৎক্ষনিক চাহিদা মেটাতে। নিজের স্বার্থ আর চাহিদার বাইরে কিছু? ভুলেও না। এই ধরনের সংস্কৃতিতে প্রতিরোধের কোনো স্পৃহা গড়ে ওঠে না। তাই যখন জালিম সুযোগ পেয়ে জেঁকে বসে আর প্রতিরোধের সময় দরজায় এসে কড়া নাড়ে, তখন আমাদের ভেতরের সৈন্যগুলো জেগে ওঠে না। প্রতিরোধ কোনো বাল্বের সুইচ নয় যে হুট করে জ্বেলে দেওয়া যায়। প্রতিরোধ একটা অভ্যাস যা প্রতিদিন অনুশীলন করতে হয়। আমার ফুটবল কোচ প্রায়ই বলতেন, ‘যেটা অনুশীলনের সময় করতে পারবে না, সেটা খেলার মাঠে কখনোই করতে পারবে না।’
এজন্যই অ্যারিস্টটল বলেছিলো, সবচেয়ে ‘প্রগতিশীল’ জাতিই সবচেয়ে নির্মম জুলুমের জন্ম দেয়। কারণ, এই জাতির নাগরিকেরা সবাই ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা আর বিশ্বাসহীনতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই যে জালিম এদের উপর ক্ষমতা লাভ করে, সে-ও এই সমাজের অন্যদের মতোই নিজের স্বার্থ আর অহংকারের রাক্ষুসে খিদে নিয়ে আসে। পার্থক্য শুধু এই যে, এই রাক্ষুসে খিদে মেটাতে ক্ষমতা তার হাতে তুলে দেয় নিয়ন্ত্রণ আর নির্যাতনের লাইসেন্স।
হালের পপ-কালচার আর পপ-চিন্তাভাবনার কোন উপাদানগুলো আমরা গ্রহণ করছি সেটা খুব ভালোভাবে খেয়াল করা জরুরি। আমাদের বিশ্লেষণ আর পর্যালোচনার মনোভাব রাখতে হবে। নির্বোধ অন্ধ অনুসারী হলে চলবে না।
একজন মুসলিম জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা রাখে। জ্ঞানের সাহায্যে প্রাসঙ্গিকতা যাচাই করতে শেখে। স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া তার কাজ নয়। তাই একজন মুসলিম তার বেশভূষায় স্বতন্ত্র (কিন্তু বহিরাগত’র মতো নয়), তার আচার আচরণে থাকে আত্মবিশ্বাস আর গৌরবের ছাপ। সে ফজরের জন্য ওঠে, পরিপাটি ওযু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। এই অভ্যাস আমাদের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির জাতি হিসাবে গড়ে তোলে। কারণ আমরা প্রতিনিয়ত এমন কাজ করছি যার ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি, তাৎক্ষণিক কোনো খায়েশ মেটানোর মাধ্যম নয়। একজন মুসলিম হয় পারিবারিক ও সামাজিক। এর ফলে আমরা ধৈর্যশীল, নিঃস্বার্থ এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠি। নানান ধরনের ব্যক্তিত্ব আর ব্যবহারের সাথে মানিয়ে নিতে শিখি। ছুটে আলাদা হয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের ব্যক্তিত্ব আর অহমবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে হলেও ঐক্যবদ্ধ থাকি। একজন মুসলিম নিয়মিত রোজা রাখে। আর এটা তাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা – প্রতি মুহূর্তে শিক্ষা দেয় যে, সবসময় ইচ্ছামতো সবকিছু পাওয়া যায় না। আর ইচ্ছামতো কিছু না পেলেই কেউ মরে যায় না।
যারাই এ অভ্যাসগুলো গড়ে তোলার চেষ্টা করবে (এমনকি যদি চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েও লেগে থাকে), তারা বাহ্যত এই ভোগবাদী সমাজের অংশ হলেও এর পতন তাদের স্পর্শ করবে না। টয়েনবি বলেছিলো, রোমান সাম্রাজ্যের পতন যাদের ধ্বংস করতে পারেনি, এমন না যে তারা রোমান সাম্রাজ্য থেকে বহুদূরে ছিলো, বরং তারা অক্ষত থেকেছে এ কারণে যে, রোমানদের সংস্কৃতি আর ঈশ্বরদের মেনে না নিয়ে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। আর ঠিক এই কাজটা করাই আমাদের জন্য এখন ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি। এর বাইরে আমাদের জন্য কোনো বিকল্প নেই। আমরা আল্লাহর কাছে ‘আফিয়া (নিরাপত্তা), সিতর (দোষত্রুটি ঢেকে দেওয়া) এবং ইস্তিক্বামা (অধ্যবসায়) চাই।
ড. শাদি এল-মাসরি’র মূল লেখার লিঙ্ক
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।