দাওয়াহর সৌন্দর্য বনাম দ্বীন বিকৃতি
যারা শরীয়তের বিভিন্ন হুকুম আহকাম মেনে নিতে পারে না, তারাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক করে। কিছুটা নিজের মতো করে শরীয়তকে বুঝতে চায়। যেকোনো মূল্যেই তারা শরীয়তকে বর্তমান সমাজের সাথে যৌক্তিক প্রমাণ করতে চায়। এটি একটি ভুল পন্থা। সুতরাং, যারা তর্ক করে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে চায়, তাদেরকে আপনি যতই বলুন না কেন, তারা মানবে না। অতএব, তাদের সাথে তর্কে না জড়ানোই উত্তম। এতে সময় নষ্ট ছাড়া অন্য কোনো উপকার হবে না।
ইসলামের হুকুম আহকাম কখনোই পরিবর্তনযোগ্য নয়, যদিও সেটা সমাজের বিরুদ্ধে যায়। ধরুন, সমাজে এখন ব্যাপকভাবে সুদ-ঘুষের প্রচলন রয়েছে। আপনি বাড়ি তৈরি করবেন কিংবা গাড়ি কিনবেন বা যেভাবেই হোক, কোনো ব্যাংকের সহযোগিতা নিলেই আপনাকে সুদের সাথে জড়িয়ে যেতে হবে। এখন যেহেতু সমাজের বিপুল পরিমাণ মানুষ সুদকে সুদই মনে করছে না, বরং ইন্টারেস্ট বা লাভ বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে, সেহেতু ইসলামি আইনে সুদ কি হালাল হয়ে যাবে? না! সেটা কখনোই না। সুদ হারাম, তো সেটা হারামই থাকবে, চাই সমাজের শতভাগ মানুষও যদি এর সাথে লিপ্ত হয়, তবুও সুদ হারামই থাকবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ইসলামের কোনো আইন পরিবর্তন হবে না। ইসলামের আইন অনুযায়ী সমাজ পরিবর্তন করতে আমরা বাধ্য। কারণ, আমরা স্বীকার করেছি যে – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
আল্লাহ্ তা’আলা কখনোই বলেননি যে, ইসলামকে সবার কাছে আকর্ষণীয় বা পছন্দনীয় করে তুলতে হবে। কিছু মানুষ সর্বদাই থাকবে, যাদের কাছে ইসলামের হুকুম আহকাম পছন্দ হবে না। ইসলামী ইতিহাসে সর্বদাই এমন কিছু মানুষ ছিলো, যারা ইসলামে বা এর হুকুম আহকামে সন্তুষ্ট ছিলো না। আর এজন্য আমাদের পক্ষ থেকে তাদের কাছে ইসলামকে আকর্ষণীয় করে তুলতে অপূর্ণাঙ্গ ইসলামের প্রচার করা একটি ভুল পন্থা। আপনি মানুষের কাছে সঠিক ইসলামকেই তুলে ধরবেন। যদি তাদের ফিতরাহ সঠিক হয়, তাহলে তারা এই দাওয়াতকে কবুল করবে। আর যদি ফিতরাহ কলুষিত হয়, তাহলে তারা এটাকে প্রত্যাখ্যান করবে।
উপমা দেবার জন্য কুরআন খুব সুন্দর একটি উৎস। আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের মধ্যে বলেছেন,
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا
ভাবানুবাদ: আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা বিশ্বাসীদের জন্য রোগের আরোগ্য এবং মুমিনের জন্য করুণা। কিন্তু তা সীমালঙ্ঘনকারীদের (জালিম) শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। [সূরাহ আল-ইসরা (১৭): ৮২]
সীমালঙ্ঘনকারী বা জালিমরা যখন কুরআন অধ্যয়ন করে, তখন কুরআন তাদের কোনো উপকার পৌঁছায় না। এটি আরো তাদেরকে দূরে ঠেলে দেয়। কারণ তাদের ফিতরাহ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এবং অন্তর হয়েছে কলুষিত।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই বিনয়ী হবেন। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবেন ইসলামের সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে। কিন্তু তাই বলে আপনি দ্বীনকে বিকৃতভাবে তুলে ধরতে পারেন না। আপনি তাদের চিত্তকে সন্তুষ্ট করতে তাদের মতো করে ইসলামকে উপস্থাপন করতে পারেন না। আল্লাহ’র (جل جلاله) দেওয়া বিধানকে আপনি নিজের মতো করে পরিবর্তন করতে পারেন না। ধরুন আপনি কোনো কুরিয়ার সার্ভিসের কোনো কর্মচারী। আপনার কাজ শুধু কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রাপ্ত মালামাল গ্রাহকের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। এর মধ্যে কোনো জিনিস নিজ থেকে ঢুকানো বা বের করে রেখে দেওয়া আপনার জন্য সঠিক কাজ নয়। ইসলামি শরীয়াহ আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এসেছে। নবী ও রাসূলগণের কাজ ছিলো শুধুমাত্র পৌঁছে দেওয়া। আপনি যেহেতু মানুষকে দাওয়াত দেবেন, সেহেতু আপনার কাজও হবে শুধুমাত্র পৌঁছে দেওয়া। এতে কোনোরূপ সংযোজন বা বিয়োজন কাম্য নয়। হ্যাঁ, আপনি কীভাবে মালামাল গ্রাহকের বাড়িতে পৌঁছে দেবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। আপনি গ্রাহকের বাড়িতে গিয়ে দরজা নক করে মালামাল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতে পারেন। কিংবা আপনি ভদ্রতার সাথে দরজায় নক করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত বাড়িওয়ালা দরজা খোলেন। এরপর দরজা খুললে খুব বিনয়ের সাথে আপনি প্রাপককে মালিকের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত মালামাল পৌঁছে দিতে পারেন। সুতরাং, আপনিও দাওয়াতের সময় বিনয়ী হতে পারেন। কিন্তু এটুকুই, এর বেশি নয়। এটাই দাওয়াতের হিকমাহ। কিন্তু আমরা কিছু কিছু সময় দাওয়াত দিতে গিয়ে হিকমাহ অবলম্বনের নামে অপূর্ণাঙ্গ ইসলামকে উপস্থাপন করি। এটা আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে আমাদের দেওয়া আমানতের খিয়ানত। যদিও আমরা মনে করছি এভাবে আমরা ইসলামের প্রচার করছি, কিন্তু আদৌ সেটা হচ্ছে না। আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিনে যদি জিজ্ঞাসা করেন তাঁর দ্বীন বিকৃতির অধিকার আমাদের কে দিয়েছে, তাহলে আমরা কী উত্তর দিবো? তাই আমাদের এসব বিষয়ে সময় থাকতে সতর্ক হওয়া উচিত।
সম্প্রতি আমরা নাস্তিকতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্টিকেল বা গ্রন্থ লিখছি। আগে তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো, কিন্তু আমরা উত্তর দিতাম না। কারণ, ইসলাম সম্পর্কে জানলে এবং ফিতরাহ শুদ্ধ থাকলে এগুলো মেনে নিতে সমস্যা হয় না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আমরা দেখছি যে, তাদের উত্থাপিত ক্লাসলেস প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিলে যারা ইসলাম সম্পর্কে বেসিক জ্ঞান রাখে না, তারা সংশয়ে নিপতিত হচ্ছে! তাই আমাদের পক্ষ থেকেও উত্তর আসছে। আমরাও তাদের প্রতি ছুঁড়ে দিচ্ছি পাল্টা প্রশ্ন। কিন্তু তাদের উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদেরই কিছু ভাই ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। আমি মনে করি তাঁরা জিনিসটি ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি। হয়তো না জানার কারণে বা অসতর্কতাবশত কাজগুলো হয়ে গিয়েছে। আমরা আল্লাহ্’র কাছে তাঁদের জন্য ক্ষমার আশা করি। কিন্তু যেই ফিতনা চালু হয়েছে, সেটা বন্ধ করতে তাঁদেরই এক ভাই হিসেবে আমার দায়িত্ব তাঁদের সঠিক দ্বীন বুঝানো। তাই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ
সম্প্রতি যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অপব্যাখ্যা দেখা যায়, সেটা হলো “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহ্’র রাস্তায় যুদ্ধ করা”। ইসলামের স্বর্ণযুগে কাফির-মুশরিকরা যখন মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তখন মুসলিমরাও তাদের সাথে যুদ্ধ করেছে। একে ‘রক্ষণাত্মক জিহাদ’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। এই জিহাদকে বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে সবাই মেনে নেয়। কারণ, কেউ যদি আমার উপর আক্রমণ করে, তাহলে আমার অধিকার আছে প্রতিরোধ করার। কিন্তু মুসলিমরাও তো স্বেচ্ছায় বিভিন্ন সাম্রাজ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহ্’র আইন বাস্তবায়নের জন্য আক্রমণ করেছে। একে ‘আক্রমণাত্মক জিহাদ’ বলা হয়। নাস্তিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এই বাস্তবতাকে অনেকেই তাদের (নাস্তিক) মনঃপূত উত্তর দেবার জন্য পাশ কাটিয়ে যায়! অনেকেই বলে আল্লাহ্’র রাসূল (ﷺ) জীবনে শুধু ৯০ দিন আল্লাহ্’র রাস্তায় জিহাদ করেছেন, আর সেগুলো ছিলো রক্ষণাত্মক! আসলে তাদের এই উপলব্ধি কতটুকু সঠিক? আসলে আমরা আল্লাহ’র দ্বীনকে বিকৃত করছি। আমরা মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছি, প্রকারান্তরে আমরা নিজেরাই ধোঁকা খাচ্ছি।
তিনিই রাসূলুল্লাহ (ﷺ), যিনি স্বেচ্ছায় মক্কা আক্রমণ করেছেন। এক্ষেত্রে মক্কাবাসীর কোনো ভূমিকা ছিলো না। যদিও এর আগে মক্কাবাসীরা মুসলিমদের অত্যাচার করে মদীনায় যেতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু এভাবে আক্রমণের উৎসাহ মক্কাবাসী যোগায়নি। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ), যিনি রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ করেছেন। আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) রোমান সাম্রাজ্যে এবং পারস্য সাম্রাজ্যে স্বেচ্ছায় আক্রমণ করেছিলেন। এসব ক্ষেত্রে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উৎসাহ যোগায়নি। মুসলিমরা স্বেচ্ছায় তাদের সাথে যুদ্ধ করেছে। হ্যাঁ, অবশ্যই সেই যুদ্ধের কিছু নীতিমালা ছিলো। পৃথিবীর ইতিহাসে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সবগুলোই নিজেদের ক্ষমতা বিস্তার, ধন-দৌলত ইত্যাদির লোভে হয়েছে। কিন্তু ইসলামের যুদ্ধ হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য। সেখানে কোনো লোভ-লালসা বা ক্ষমতা বিস্তারের উদ্দেশ্য ছিলো না। এর প্রমাণ আমরা ইসলামি শাসকদের উপর দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাই। ধর্মপরায়ণ প্রতিটি মুসলিম শাসকই অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করেছেন। দুনিয়ার ভোগ বিলাসে কেউ কখনো লিপ্ত হননি। আর জনগণের বিরুদ্ধে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কখনো তাঁরা দেখাননি। কখোনো না। যা করেছেন, শুধুমাত্র আল্লাহ’র জন্য। সুতরাং, আক্রমণাত্মক জিহাদকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ধোঁকা দেবার শামিল। তাই আমরা যদি আক্রমণাত্মক জিহাদকে স্বীকার করতে ইতস্তত বোধ করি, তাহলে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে আমাদের দুর্বলতা চলে আসে। অতএব, আমাদের সত্য বলা উচিত। আসলে সত্য এতই সুন্দর যে, আমাদের এটা লুকানো উচিত নয়।
আল ওয়ালা ওয়াল বারাআ
পরের যে বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার না, সেটি হলো “আল ওয়ালা ওয়াল বারাআ অর্থাৎ, আল্লাহ্’র জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহ্’র জন্যই ঘৃণা”-এর নীতি। ‘কাফির-মুশরিকদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কি না’ – এ ব্যাপারে একটি পপুলার টপিক। এই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন,
“এখানে আল্লাহ তায়ালা ‘বন্ধু’ শব্দটার জন্য যে এ্যারাবিক ওয়ার্ডটি ব্যবহার করেছেন, তা হলো – আউলিয়া। এ্যারাবিকে ‘আউলিয়া’ শব্দটির জন্য দুটি অর্থ করা যায়। এক- বন্ধু, দুই- অভিভাবক। আমরা এখানে সেই অর্থটা নেবো, যেটা রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণ হয়ে আসবে। তার আগে দুটি বিষয় ক্লিয়ার করি। ‘আউলিয়া’ শব্দের জন্য ‘বন্ধু’ আর ‘অভিভাবক’ দুই অর্থ করা গেলেও, এই দুই শব্দের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। … ‘এবার মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনীতে দেখা যায়- তিনি অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করেছেন। অমুসলিমদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। তাদের সাথে খেয়েছেন, কাজ করেছেন, কত কী! তাহলে দেখা যাচ্ছে- এই আয়াতে ‘আউলিয়া’ অর্থে আমরা ‘বন্ধু’ শব্দটা নিতে পারবো না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা যদি ‘আউলিয়া’ শব্দটি দ্বারা ‘বন্ধু’ই বুঝাতেন, তাহলে রাসূল সাঃ কখনোই অমুসলিমদের সাথে উঠা-বসা করতেন না। তাহলে প্রশ্ন, এখানে ‘আউলিয়া’ শব্দের কোন অর্থ বুঝানো হয়েছে? হ্যাঁ, এখানে- ‘আউলিয়া’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে ‘অভিভাবক’। আল্লাহ আমাদের বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা অমুসলিমদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহন করো না।’ … এখানে বন্ধু বানাতে নিষেধ করেনি, নিষেধ করেছে অভিভাবক বানাতে।’”
মাঝের (…) কথাগুলো কলেবর বৃদ্ধি পাবে বিধায় উল্লেখ করিনি। আগ্রহীরা খুঁজে পড়ে নেবেন। এই ব্যাখ্যাটি ‘ওয়ালা-বারাআ’ এর নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আল-বারা’র দাবীসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
১) কুফর, শির্ক এবং এতে লিপ্ত লোকদেরকে আল্লাহ’র জন্য ঘৃণা করা। তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করা। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
তোমাদের জন্যে ইব্রাহীম ও তার সঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলো, “তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদাত করো, তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে।” কিন্তু ইব্রাহীমের উক্তি তার পিতার উদ্দেশে এই আদর্শের ব্যতিক্রম। সে বলেছিলো, “আমি অবশ্যই তোমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবো। তোমার উপকারের জন্যে আল্লাহর কাছে আমার আর কিছু করার নেই। হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমারই দিকে মুখ করেছি এবং তোমারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন।” [সূরাহ আল-মুমতাহিনা (৬০): ০৪]
২) কাফেরদেরকে আউলিয়া (মদদানকারী, সাহায্যদানকারী ইত্যাদি) হিসেবে গ্রহণ না করা এবং তাদের সাথে স্নেহ ও ভালোবাসার সম্পর্ক না রাখা। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
“মুমিনগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করছে। তারা রাসূলকে ও তোমাদেরকে বহিষ্কার করে এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখো। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্যে এবং আমার পথে জিহাদ করার জন্যে বের হয়ে থাকো, তবে কেন তাদের প্রতি গোপনে বন্ধুত্বের পয়গাম প্রেরণ করছো? তোমরা যা গোপন করো এবং যা প্রকাশ করো, তা আমি খুব জানি। তোমাদের মধ্যে যে এটা করে, সে সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। [সূরাহ আল-মুমতাহিনা (৬০): ০১]
এ বিষয়ে অবশ্য কেউ প্রশ্ন তোলে না। কারণ, আউলিয়া শব্দের অর্থ অবিভাবক হিসেবে নিলে কেউই সবাইকে অবিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে না। কিন্তু এসব আয়াতে যে ‘আউলিয়া’র অর্থ ‘বন্ধু’ও উদ্দেশ্য, আমরা সেটাকে স্বীকার করি না বা পাশ কাটিয়ে তাদের মনমতো উত্তর দেবার চেষ্টা করি। অথচ তাফসীর পড়লে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।
৩) কাফিরদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং জীবন ব্যবস্থাকে অনুসরণ না করা।
৪) তাদের সঙ্গ এবং বন্ধুত্ব ত্যাগ করা। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
আর পাপিষ্ঠদের প্রতি ঝুঁকবে না। নতুবা তোমাদেরকেও আগুনে ধরবে। আর আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো বন্ধু নেই। অতএব কোথাও সাহায্য পাবে না। [সূরা হুদ, (১১): ১১৩]
৫) কাফিরদের সাথে আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে শিষ্টাচার এবং সম্মানের খাতিরে দ্বীনের মধ্যে কোনো আপোষ মীমাংসা করা হবে না। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
আপনার পালনকর্তা সম্যক জানেন কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি জানেন যারা সৎপথ প্রাপ্ত। অতএব, আপনি মিথ্যারোপকারীদের আনুগত্য করবেন না। তারা চায় যদি আপনি নমনীয় হন, তবে তারাও নমনীয় হবে। [সূরাহ আল-কলাম (৬৮): ০৯]
সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে যে তাদের সাথে ‘আল-বারাআ’-এর নীতিতে আমাদের করণীয় কী। আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আফিফা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা গ্রন্থটি পড়তে পারেন।
তাহলে তাদের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বসবাস কেমন হবে? এর উত্তর হিসেবে মাসিক আল-কাউসার এর নিম্নের লেখাটিই যথেষ্ট আমি মনে করি। তবুও কারো ভিন্নমত থাকতে পারে বলেও আমি মনে করি। কেউ চাইলে সেগুলোও বলতে পারেন।
“সাহাবী হযরত জাবের রা. বর্ণনা করেন, “একদিন আমাদের পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর দেখাদেখি আমরাও দাঁড়ালাম। আমরা তাঁকে বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ তো এক ইহুদির লাশ!’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যখন কোনো লাশ নিতে দেখবে, তখন দাঁড়াবে।’”[সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৩১১]
আরেক হাদীসে এসেছে,
হযরত সাহল ইবনে হুনাইফ ও হযরত কায়েস ইবনে সাদ রা. একদিন বসা ছিলেন। তাঁরা তখন কাদিসিয়ায় থাকেন। পাশ দিয়ে একটি লাশ নেয়া হচ্ছিল। তা দেখে তাঁরা দুজনই দাঁড়ালেন। উপস্থিত লোকেরা তাঁদেরকে জানাল, ‘এ এক অমুসলিমের লাশ।’ তাঁরা তখন শোনালেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশ দিয়েও একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি যখন তা দেখে দাঁড়ালেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তখন বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘أليست نفسا’ অর্থাৎ ‘সে মানুষ ছিল তো?’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৩১২]
অমুসলিমদের সাথে আচরণে ভদ্রতা ও সৌজন্য রক্ষা করার জন্যে ইসলাম যে উদার নির্দেশনা দেয়, উপরোক্ত হাদীসটিই তার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।
সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে গিয়ে নানা শ্রেণির নানা পেশার নানা মত ও পথের মানুষের মুখোমুখি হতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় অমুসলিমদেরও। লেনদেন ওঠাবসা চলাফেরা সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে একজন মুসলমান ও একজন অমুসলমানের সাক্ষাৎ হতে পারে। কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে অমুসলিমদের বসবাস কিংবা কোনো অমুসলিমপ্রধান দেশে মুসলমানদের বসবাস এখন বিচিত্র কিছু নয়। অমুসলিম ব্যক্তি হতে পারে কোনো মুসলমানের প্রতিবেশী। কোনো অমুসলিম যদি পুরনো ধর্ম ছেড়ে ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়, তাহলে তো আরও অনেক অমুসলিমের সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্কও থাকবে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে যেভাবে দলে দলে অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আসছে, তাতে এ বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। ইসলামে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিধানও দেয়া হয়েছে- এ কথা ঠিক, তবে এও অনস্বীকার্য যে, যুদ্ধের ময়দানের বাইরে তাদের নিরাপত্তাদান, তাদের সাথে সৌজন্য বজায় রেখে উত্তম আচরণের কথাও বলা হয়েছে। এমনকি যুদ্ধের মাঠেও যেন অমানবিক আচরণ করা না হয়, যারা যুদ্ধে অংশ নেয়নি তাদেরকে, বিশেষত নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর যেন হামলা করা না হয়- এ আদেশও দেয়া হয়েছে। যদি কারও কোনো প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয় অমুসলিম হয়, ইসলামের নির্দেশনা হলো- তার সাথেও প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের হক রক্ষা করে চলতে হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ দুটি সম্পর্ক রক্ষা করার ওপর যথেষ্ট জোর দেয়া হয়েছে। সাহাবী হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, একজন প্রতিবেশীর ওপর আরেকজন প্রতিবেশীর কী হক রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন,
إِنِ اسْتَقْرَضَكَ أَقْرَضْتَهُ وَإِنِ اسْتَعَانَكَ أَعَنْتَهُ وَإِنْ مَرِضَ عُدْتَهُ وَإِنِ احْتَاجَ أَعْطَيْتَهُ وَإِنِ افْتَقَرَ عُدْتَ عَلَيْهِ وَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ هَنَّيْتَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ مُصِيبَةٌ عَزَّيْتَهُ وَإِذَا مَاتَ اتَّبَعَتَ جَنَازَتَهُ وَلَا تَسْتَطِيلُ عَلَيْهِ بِالْبِنَاءِ فَتَحْجُبَ عَنْهُ الرِّيحَ إِلَّا بِإِذْنِهِ وَلَا تُؤْذِيهِ بِرِيحِ قِدْرِكَ إِلَّا أَنْ تَغْرِفَ لَهُ وَإِنِ اشْتَرَيْتَ فَاكِهَةً فَأَهْدِ لَهُ …
‘যদি সে তোমার কাছে ঋণ চায় তাহলে ঋণ দেবে, যদি তোমার সহযোগিতা চায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তার খোঁজখবর নেবে, তার কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাকে তা দেবে, সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেবে, যখন সে ভালো কিছু লাভ করবে তখন তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে সান্ত্বনা দেবে, মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরিক হবে, তার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যে তার ঘরে বাতাস ঢুকতে পারে না, কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট দেবে না, তবে যদি তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দাও (তাহলে ভিন্ন কথা)। যখন কোনো ফল কিনে তোমার বাড়িতে নেবে তখন হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেবে।[১]
আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার বিষয়ে নির্দেশনা তো আরও স্পষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
যে আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৬১৩৮]
প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার এই যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এমনটি বলা হয়নি- তোমার প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় যদি মুসলমান হয়, ধার্মিক হয়, ভালো মানুষ হয়, তাহলে তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। বরং প্রতিবেশী ও আত্মীয় যেমনই হোক, মুসলমান হোক কিংবা না হোক, তার অধিকার অকাট্য ও অনস্বীকার্য। একজন মুসলমানকে এ অধিকার রক্ষা করেই জীবনযাপন করতে হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কিছু নির্দেশনা এমনও রয়েছে, যেখানে সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্ক রক্ষা করতে বলা হয়েছে। যেমন, সূরা আনকাবুতের ভাষ্য,
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا
ভাবানুবাদ: আমি মানুষকে বাবা-মায়ের সাথে সুন্দর আচরণের আদেশ করেছি। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সঙ্গে এমন কিছু শরিক করতে, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের কথা মানবে না। [সূরাহ আল-আনকাবুত, (২৯) : ৮]
সূরা লুকমানে একই প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে,
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
ভাবানুবাদ: তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচরণ করো। এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করবো তোমরা যা-কিছু করতে। [সূরাহ লুকমান, (৩১) : ১৫]
কুরআনে কারীমের উক্ত আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, যদি কোনো মুশরিক বাবা-মা তাদের মুসলিম কোনো সন্তানকে ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে শিরক করতে বলে, তাহলে তাদের এ আদেশ কখনো মানা যাবে না। কিন্তু এমতাবস্থায়ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। বাবা-মায়ের হক আদায় করতে হবে। প্রতিবেশীর অধিকার সম্বলিত যেসকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেসবে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি- সাহাবায়ে কেরামের জীবনী থেকেও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর ঘটনা। একদিন তার ঘরে একটি বকরি জবাই করা হল। খাবার রান্না হলে তিনি তাঁর গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে কি এ খাবার দিয়েছ?’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
প্রতিবেশীর বিষয়ে জিবরাইল আমাকে এত উপদেশ দিচ্ছিলেন, আমি মনে করছিলাম, তিনি হয়ত তাদেরকে ওয়ারিশই বানিয়ে দেবেন।’ [জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৯৪৩]
ইসলামী রাষ্ট্রে যে সকল অমুসলিম রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে বসবাস করবে, তারা সেখানে পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে নিরাপদ জীবন যাপন করবে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তারা তাদের নির্ধারিত সকল হক পাবে। সন্দেহ নেই, রাষ্ট্রের শান্তিশৃংখলা বজায় রাখার জন্যে এ বিধানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। হযরত উমর রা.-এর একটি ঘটনা। তিনি তখন খলীফাতুল মুসলিমীন। একদিন এক ইহুদি বৃদ্ধকে দেখলেন মসজিদের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে বেড়াতে। তখন তিনি ইহুদিকে লক্ষ্য করে বললেন,
مَا أَنْصَفْنَاكَ إِنْ كُنَّا أَخَذْنَا مِنْكَ الْجِزْيَةَ فِي شَبِيبَتِكَ، ثُمَّ ضَيَّعْنَاكَ فِي كِبَرِكَ. قَالَ: ثُمَّ أَجْرَى عَلَيْهِ مِنْ بَيْتِ الْمَالِ مَا يُصْلِحُهُ
আমরা তোমার ওপর ইনসাফ করতে পারিনি যদি তোমার যৌবনে আমরা তোমার নিকট থেকে জিয্য়া গ্রহণ করে থাকি আর তোমার বার্ধক্যে তোমাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেই। এরপর তিনি তার জন্যে বায়তুল মাল থেকে প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা করে দেন।[২]
হযরত উমর রা. বৃদ্ধ ইহুদির জন্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন- এটা তো তিনি শাসক হিসেবে করতেই পারেন। কিন্তু তিনি সেই ইহুদিকে লক্ষ্য করে যে কথাটি বললেন, তা আমাদের সামনে চিন্তার নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। যে সহানুভূতি তিনি প্রকাশ করেছেন এটাই ইসলামের সৌন্দর্য ও আসল চরিত্র। অমুসলিমদের সাথে সুন্দর ও সৌজন্যপূর্ণ আচরণ রক্ষার শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি ইসলাম তাকিদের সাথে বারবার এ নির্দেশও দিয়েছে- ‘কোনো মুসলমান যেন কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে।’ এবং এ তাকিদও করেছে, সৌজন্য ও উদারতার নামে যেন নিজেদের দ্বীনদারি আক্রান্ত না হয়। দ্বীনের বিষয়ে আপোস করা কোনোক্রমেই বৈধ নয়।
এমনিভাবে সদাচরণের ক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে মুসলিম ভাই থেকে প্রাধান্য দেওয়াও বৈধ নয়। অমুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সূরা মুমতাহিনার এই নির্দেশনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য-
لَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ إِنَّمَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ قَاتَلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَأَخْرَجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ وَظَاهَرُوا عَلَى إِخْرَاجِكُمْ أَنْ تَوَلَّوْهُمْ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে ও তাদের প্রতি ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তো তোমাদের তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করার কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা জালিম। [সূরাহ আল মুমতাহিনা (৬০) : ৮-৯]
শরীয়তের সীমারেখায় থেকে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে যেমন অমুসলিমদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়, তেমনি এ আচরণটুকুও অনেক সময় দাওয়াতের ভূমিকা পালন করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন মহানুভব আচরণে মুগ্ধ হয়েও তো অনেকেই ইসলাম কবুল করেছেন এবং পরবর্তীতেও সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে শুরু করে যারাই ইসলামের সুন্দর আচারগুলো নিজেদের মাঝে লালন করে গেছেন, তাঁদের আচরণই নীরবে অমুসলমানদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানিয়েছে। অনেক অমুসলিম এতে যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে এবং আশ্রয় নিয়েছে ইসলামের শীতল ছায়ায়।”
সায়েন্টিজম
পরের যে বিষয়টি আমাদের মধ্যে প্রচুর দেখা যায় সেটি হলো, কুরআন এবং হাদীসের বিভিন্ন বিষয়কে জোর করে বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়ে দেওয়া, যার আদৌ তেমন ব্যাখ্যা করা যুক্তিযুক্ত নয়। এ ব্যাপারটি বেশি ঘটে যখন এমন ব্যক্তি ইংরেজি থেকে কিছু আর্টিকেল অনুবাদ করে, যার ব্যাকগ্রাউন্ড সাইন্সের নয় বা সেই বিষয়ে অনুবাদকের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে আমাদের করা অযৌক্তিক ব্যাখ্যাগুলো অন্যরা যারা বিজ্ঞান বোঝে, তারা দেখে হাসাহাসি করবে। ফলে দ্বীনের খেদমত করতে গিয়ে উল্টো কাজ হবে। হ্যাঁ, কুরআন এবং হাদীসের কিছু বিষয় আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলে যায়। কারণ, বিজ্ঞান হলো বাস্তব ঘটনাসমূহের অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যাখ্যা। তাই বাস্তব জিনিসের সাথে ইসলামের বিরোধিতা নেই। এসব বিষয়ে আমরা কুরআন এবং হাদীসের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা করতে পারি। তাই, এই বিষয়ে একটি মূলনীতি নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি।
শেষকথা
পরিশেষে বলতে চাই, দ্বীনের কোনো হক কার্যক্রমকে আমরা অস্বীকার করি না। আবার হক দলসমূহের ভুল কাজকেও আমরা সমর্থন করি না। আমরা সবাইকে ভালোবাসি কিন্তু সত্যকে অধিকতর পছন্দ করি। আমাদের সবার দ্বারাই কিছু না কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যায়। যখন সেটা হকপন্থী আলেমগণের মাধ্যমে আমাদের চোখ ধরা পড়বে, ঠিক তখনই আমরা পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের শুধরে নেবো। এখানে যেন আমরা জ্ঞানের বড়ত্ব না দেখাই। আলেমদের সামনে হাটু গেঁড়ে বসে নিজের ভুল সংশোধন করতে আমরা যেন সদা প্রস্তুত থাকি। এতে আমাদের কল্যাণ ব্যতীত ক্ষতি হবে না। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের উম্মাহ’র স্বার্থে নিজেদের ছোট ছোট ইখতিলাফকে পাশে রেখে এক হয়ে আল্লাহ’র রজ্জুকে শক্ত করে ধরার তৌফিক দান করুক। ইসলামের উপরে বর্তমানে পতিত বড় বড় ফিতনার বিরুদ্ধে একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে কাজ করার তৌফিক দিক। এই প্রতাশায় …।
[১] ফাতহুল বারী, খণ্ড- ১০, পৃষ্ঠা- ৫১৯, কিতাবুল আদব, বাব-৩১
[২] কিতাবুল আমওয়াল, ইবনে যানজূয়াহ্, ১/১৪৩, হাদীস নং- ১৭৯
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।