আদনানের গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার মোকামপুর গ্রামে। ঈদের পরে ফসল কাটার সময় কোনো ছুটি পেলেই ফাতিমাকে নিয়ে সেখানে বেড়াতে যাবার কথা আদনানের। আদনানের দাদাবাড়িতে তার চাচারাই মূলত পরিবারসহ থাকে। তারা মূলত কৃষিনির্ভর। বছরে যখন ফসল কাটা হয়, তখন ভালোই আনন্দের আমেজ তৈরি হয় গ্রামে। বিশেষভাবে যারা শহরে থাকে তাদের কাছে ফসল কাটা, ধান মাড়ানো, চাল সিদ্ধ করা, মুড়ি ভাজা সবকিছুই খুব আনন্দের বিষয়।
এই বছর কুরবানির ঈদ এমন সময় হয়েছে যে, একদম ঘরে ফসল উঠানোর কিছুদিন আগে। তাই আদনান ঈদের ছুটির সাথে কিছু সময় বাড়িয়ে ঈদের পরে গ্রামে যাবার প্ল্যান করলো। ফাতিমাকেও জানিয়ে রাখলো যে, এবার ঈদের পরে ফাতিমার বাড়িতে যাওয়া হবে না। এতে ফাতিমার কিছুটা মন খারাপ হলেও এতে সে দ্বিমত করলো না!
ঈদের আমেজ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আদনান, ফাতিমা এবং আদনানের বোন নাবিলা বুধবার সকাল ৭ টায় খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। টানা ৬ ঘণ্টার সফর শেষে তারা খুলনা এসে পৌঁছালো। খুলনা সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছু ফলফলাদি কিনে সোজা নদীঘাট। সেখানে গিয়ে আদনান মাঝিদের সাথে কথা বলে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ঠিক করলো যেটি সোজা মোকামপুর গিয়ে থামবে। অন্যভাবেও যাওয়া যেত, কিন্তু ফাতিমার ইচ্ছা সে নৌকায় উঠবে। তাই আদনান ফাতিমার ইচ্ছা পূরণ করতে নৌকাই ঠিক করলো। সবাই নৌকায় ওঠার পরে বেলা আড়াইটার দিকে নৌকা চলা শুরু করলো মোকামপুরের উদ্দেশ্যে। ভৈরবের ঢেউ চিরে নৌকা সমনে যেতে লাগলো। একপর্যায়ে নদীর ওপারের কোণা ঘেঁষে গাছপালার নিচ দিয়ে যাবার সময় মনে হলো সিলেটের রাতারগুল দিয়ে নৌকা বনের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
ঐ দূরে মোকামপুরের ঘাট দেখা যাচ্ছে। সাথে ছোট ছোট কিছু অবয়বও দেখা যাচ্ছিলো। ঘাটের কাছে গিয়ে দেখা গেলো আদনানের চাচা এবং চাচাত ভাইয়েরা তাদের নিতে এসেছে। প্রথম সস্ত্রীক আদনান গ্রামের বাড়িতে এসেছে – যত্ন করতে হবে না?
বাড়ি পৌঁছানোর সাথে সাথে পিচ্চিগুলো আদনানকে জড়িয়ে ধরে এটা ওটা আবদার শুরু করে দিলো। এভাবে অসময়ে এরা আবদার করে বসবে, এটা আদনান বুঝতেই পারেনি। অনাথের মতো ফাতিমার দিকে তাকাতেই ফাতিমা কিছু চকলেট বের করে দিলো। সেগুলো দিয়ে আপাতত পরিস্থিতি শান্ত করলো আদনান। এরপর সবাইকে সালাম দিয়ে, কে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করতে করতে ঘরে ঢুকে পড়লো আদনান। যুহরের সালাতের সময় শেষ হবার ভয়ে কোনো বিশ্রাম না নিয়েই তিনজন আগে সালাত আদায় করলো।
এরপর ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো সবাই। খাওয়াদাওয়া শেষে কেবল বিশ্রাম নিতে যাবে এই সময়ে আদনানের চাচাত ছোট ভাই বলে উঠলো, “ভাইয়া, চলো নৌকা নিয়ে ধানের জমিত যাই। সিখানে ধান কাটা হসসে।”
নৌকায় ওঠার কথা শুনে ফাতিমা আর নাবিলার বিশ্রামের কথা মাথা থেকে উড়ে গেলো। তারা আদনানকে বললো, “আমরা বিশ্রাম রাতে নিবো ইনশা আল্লাহ। এখন চলো ধান কাটা দেখে আসি।”
আদনান বললো, “কাল গেলে হয় না? আজই যেতে হবে এমন তো নয়!”
ফাতিমা বললো, “না! আজই যাবো। তুমি যাবে? সেদিন না সূরা নিসায় পড়েছিলে যে, ছেলেরা মেয়েদের অভিভাবক। তো এখন ওই আয়াতের উপর আমল করবে না?”
নাবিলাও ফাতিমার কথায় সায় দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, ভাইয়া। আজই চলো না!”
বাঁকা চোখে কতক্ষণ ফাতিমার দিকে তাকিয়ে থেকে আদনান বললো, “ও চাচা! এদিকে আসেন তো! নৌকা নিয়ে বাইরে যেতে হবে। এরা ধান কাটা দেখবে।”
চাচা বিলে নৌকা নিয়ে আসলে সবাই নৌকায় করে রওনা দিলো ধান কাটা দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখলো দু’জন লোক ধান কেটে কেটে আরেকটি নৌকায় উঠাচ্ছে। লোকটাকে আদনানের চেনা চেনা লাগছে। কাছে গিয়ে আদনান প্রশ্ন করে বসলো, “জাফর চাচা নাকি?”
আদনানকে অনেকদিন পরে দেখে জাফর চাচা চিনতে পারলেন না। সাথে আবার মুখে লম্বা দাড়ি! আদনানের চাচা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা আমাগে আদনান আর এটা উর বউ!”
জাফর চাচা বললেন, “ও! আদনান বাবাজি। কিরাম আছো, বাবা?”
আদনান উত্তর দিলো, “হ্যাঁ! আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
জাফর চাচা বললেন, “আমি তো ভালোই আছি, কিন্তু তোমরা ইরাম আরবের বেশ ধরিছো কেন? আগেই তোহ ভালো ছিলা! এই লম্বা দাড়ি, লম্বা জামা, বুরখা এগুলো তো আরবগে সংস্কিতি! বাঙালি হয়ে তোমরা কিশির জন্যি এগুলো পরবা? এগুলো তোহ উরা পরে উগে দেশে জম্মের গরমেরতে বাঁচতি। আমাগে দেশের আবহাওয়া তো উরাম না!”
আদনান ভদ্রতার সাথে জাফর চাচাকে বললো, “ঠিক আছে এরকম পোশাক আরবেরা পরে বা ওদের সংস্কৃতির অংশ। পোশাকের ক্ষেত্রে ইসলামের আইন হলো ঢোলাঢালা হতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা থাকতে হবে এবং পায়জামা যেন টাখনুর নিচে না চলে যায়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে মুখমন্ডল, হাতের কব্জি ব্যতীত সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে রাখতে হবে। এখন কেউ যদি এরকম ঢোলা লম্বা জুব্বা পরে, তাহলে যেহেতু আল্লাহর রাসূল ﷺ পরতেন- সেই কারণে সওয়াব পাবে। আবার নারীরা ফিতনা এড়াতে এবং তাকওয়ার কারণে সম্পূর্ণ শরীরের পর্দা করলে এতে আল্লাহ তা’আলা তাদের পুরষ্কৃত করবেন। বিদেশি সংস্কৃতি হলেও এটা একটা ইসলামিক পোশাক। তাছাড়া বিদেশি সংস্কৃতি হলেই যে সবকিছু বর্জন করতে হবে এমন তো নয়।”[১]
জাফর চাচা বললেন, “আমি তো বাবা তুমারে ধর্মের কথা জিজ্ঞেস করিনি! ওতে আমার বিশ্বাস নাই। তুমাগে ধর্ম অনেক নির্মম আর কঠিন! এজন্যি আমার ওইসব ভালো লাগে না।”
আদনান জিজ্ঞাসা করলো, “তো! জাফর মিয়া, কোন জিনিস আপনার কাছে এত নির্মম আর কঠিন লাগলো?”
জাফর চাচা বললেন, “কথা হচ্ছে যে যারা আল্লাকে মানবে না তাগে উনি আজীবন জাহান্নামের আগুনে পুড়াবেন! রক্ত মিশ্রিত পুঁজ খাতি দিবে! কাঁটাওলা ফল খাওয়াবে! একজন স্রষ্টা কিশির জন্যি এত কঠিন হবে? কিশির জন্যি উনি নিজের তৈরি মানুষকেই উনারে না মানার জন্যি সারাজীবন এই শাস্তি দিবেন? এই জন্যিই এগুলোর উপর বিশ্বাস নেই!”
আদনান বললো, “আচ্ছা জাফর মিয়া, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না যে, আপনি তো জান্নাত জাহান্নাম এগুলো বিশ্বাসই করেন না! তাহলে আপনার এত ভয় পাবার কী আছে?”
আদনানের শিশুসুলভ উত্তর শুনে ফাতিমা আর নাবিলা হো হো করে হেসে দিলো। তারপর ফাতিমা জাফর চাচাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা চাচা, আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন?”
জাফর চাচা উত্তর দিলেন, “আমার দুইটা ছাওয়াল। কোনো মাইয়ে নেই। মজার বিষয় হচ্ছে দুই ছাওয়ালই জমজ। তারপরে আর তুমার আন্টির কোনো ছাওয়াল-মাইয়ে হয়নি। এক ছাওয়ালের নাম আতিক আর আরেকজনের নাম সজীব। দুইজনই কলেজে পড়তেছে। আর উগেও আমি আমার আদর্শে গড়ে তুলতিছি। কিন্তু সমস্যা হলো, সজীবের রেজাল্ট সেইরাম ভালো না। পড়াশুনা করতিই চায় না। পড়াশোনা না করলি কি মাস্টার ওরে ফাও নাম্বার দেবে? ও সকালে বাড়ি থেকে বাইর হয় আর রাতি ফেরে। মাস্টার তো তাও ওরে পাশ করায়! আমি হলি পাশই করাতাম না। আমি হসসে খুব ন্যায়পরায়ণ মানুষ। আমার ছাওয়াল বলে পড়াশুনায় পাশ করায়ে দেবো – এমন মানুষ আমি না। এদিক দিয়ে আবার আতিক বাবাজি খুবই ভালো। সারাদিন পড়াশুনা করে। রেজাল্টও ভালো। কিলাশে সবসময় রোল এক থেকে তিনের এর মধ্যে থাকে। ওর সব চাওয়াগুলো আমি পূরণ করার চিষ্টা করি। আমি যে তোমাগে জমিতে ধান কাটতিছি, এ কাজ কি আমার সাজে? আমার বাড়িতে গরুর খামার আছে, হাঁস-মুরগি, ছাগল সবই আছে। এগুলো দিয়েই সংসার চালাসসি। কিন্তু এগুলো করতিছি আমার ছাওয়ালের বই কিনার জন্যি।”
ফাতিমা জাফর চাচাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “আচ্ছা চাচা ঠিকাছে, জিজ্ঞাসা না করতেই অনেককিছু বলেছেন। আচ্ছা চাচা, সজীব তো আপনারই ছেলে। তাহলে আপনি তো তাকে পাশ করিয়ে দিতেই পারেন, যদিও সে লেখাপড়া ঠিক মতো করে না!”
জাফর চাচা বলেন, “না, মা! আমি একজন ন্যায়পরায়ণ মুক্তচিন্তার মানুষ হইয়ে কেমনি আমার ছাওয়ালকে দুর্নীতি করায়ে পাশ করাবো? তাহলি যে ছাওয়ালগুলো সারাবছর লেখাপড়া করে, তাগে প্রতি অবিচার হয়ে যাবে না? তাই আমি এই কাজের পক্ষে না!”
ওদিক থেকে রসুল মিয়া চিৎকার করে বলে উঠলো, “ও জাফর! তুমার গল্প এখন বাদ দেও! ধান কাটা আইজকের মতো শেষ। এবার চলো বেলা ডুবার আগে ধান মাড়াই করতি হবে। আর ও আদনান বাবা, চলো বাড়ি যাইয়ে কথা কই!”
এদিকে আসরের সময় হয়ে যাওয়াতে আদনান, ফাতিমা ও নাবিলা দ্রুত নৌকায় চাচার সাথে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। আর চাচাতো ভাইকে জাফর মিয়ার সাথে আসতে বলে চাচা নৌকা চালানো শুরু করলেন। যাত্রাপথে আদনান ফাতিমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “ফাতিমা, তুমি তো উনার কোনো প্রশ্নের উত্তরই দিলে না। শুধু কিছু ফালতু আলাপ করে সময় নষ্ট করলে। আমি তো তবুও উত্তর দেবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তোমরা তো হো হো করে কথা উড়িয়ে দিলে!”
ফাতিমা বললো, “উত্তর দেবার সময়ই তো পেলাম না। তো দিবো কী করে? চলো, বাড়ি গিয়ে দেখি উত্তর দেওয়া যায় কি না।“
বাড়ি পৌঁছানোর পরে সবাই আসরের সালাত আদায় করে বাড়ির উঠানে চেয়ার নিয়ে বসলো ধান মাড়াই দেখার উদ্দেশ্যে। উঠানের সামনেই রসুল মিয়া আর জাফর চাচা মেশিনে ধান মাড়াই করছিলেন। আদনান আর ফাতিমা দেখার উদ্দেশ্যে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রসুল মিয়া বললেন, “বাবা, একটু পাশে যাইয়ে দাঁড়াও। নাকে-চোখে ময়লা যাবে। এই খড়কুটো ভালো জিনিস না। এতে রোগ হয়।”
ফাতিমা উৎসুক মনে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা জাফর চাচা! এই খড়কুটোগুলো ফেলে দিচ্ছেন কেন?”
জাফর চাচা বললেন, “এইগুলো দিয়ে এখন কোনো কাজ নেই। আমাগে এখন ধান দরকার। ধান আলাদা হইয়ে যাওয়ার পরে এই খড়কুটো দিয়ে হয় চুলায় আগুন জ্বালানো হবে অথবা গরুকে খাওয়ানো হবে। এছাড়া এই খড়কুটো কোনো কাজে আসে না।”
ফাতিমা বললো, “হ্যাঁ, জাফর চাচা! আপনি ঠিক বুঝেছেন যে, এই খড়কুটো থেকে ধান আলাদা করে নেওয়ার পরে এর আর তেমন কাজ থাকে না। তাই এটি আগুনে পোড়ানো হয় অথবা গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন আপনাকে আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে মানুষ এবং জ্বীন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের সৃষ্টি করেছেন। সেটি হলো আমরা শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদাহ করবো।[২] তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না। সাথে সাথে আমরা রাসূলকে ﷺ আল্লাহর প্রেরিত দূত ও বান্দা হিসেবে মেনে নিবো। এটাই হচ্ছে পরীক্ষায় পাশ করার সীমারেখা। যে ব্যক্তি এই শর্ত পূরণ করবে, সেই ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি সৎ থাকলো এবং এই ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রয়োজনীয় হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি এই শর্ত পূরণ করতে পারবে না, তাকে দিয়ে আল্লাহ তা’আলার কোনো কাজ নেই এবং সে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে গণ্য হবে। তাই আমরা যেমন অপ্রয়োজনীয় খড়কুটো আগুনে পুড়িয়ে দেই, ঠিক তেমনি আল্লাহর কাছেও ওই সৃষ্টি যে তাঁকে স্বীকার করেনি সে অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং তাকেও আল্লাহ চিরকাল জাহান্নামের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবেন।[৩] আমি কি বুঝাতে পারলাম, জাফর চাচা?”
জাফর চাচা বললেন, “না, এত সহজে তো আমি ছাইরে দিসসি না! আসসা তুমি কী কইরে মানুষ আর স্রষ্টাকে একই কাতারে আইনে উদাহরণ দিলে? মানুষ তো নিষ্ঠুর হয়। কিন্তু স্রষ্টা তো দয়াময় হবেন। তিনি কি পারতেন না সবাইকে একসাথে জান্নাতে দিতে?”
ফাতিমা উত্তর দিলো, “এর উত্তর কিন্তু আপনি আগেই দিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলার গুণবাচক নাম যেমন রয়েছে সৃষ্টিকর্তা, ঠিক তেমনি রয়েছে দয়াময়। আবার তাঁর গুণবাচক নামের মধ্যে রয়েছে ন্যায়পরায়ণ এবং সুবিচারক। হ্যাঁ, আল্লাহ তা’আলা চাইলেই সবাইকে জান্নাতে দিতে পারতেন। কিন্তু যে ব্যক্তিগুলো সারাদিন মদ, জুয়া, গান-বাজনা, সুদ, ব্যভিচার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে এবং অপরদিকে যারা আল্লাহর হুকুম মেনে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করেছে, সুদের ব্যবসা না করে মানুষকে বিনা সুদে টাকা ধার দিয়েছে, যারা সমাজে নৈতিকতা বজায় রেখেছে তাদের পুরষ্কার কি এক হয়? যদি এদের দুই শ্রেণীকে আল্লাহ তা’আলা একই পুরষ্কার দিতেন, তাহলে যারা ভালো কাজ করেছে তাদের প্রতি অবিচার হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তো ন্যায়বিচারক এবং সুবিচারকও বটে। তাই তিনি এই অবিচার করবেন না। যার যেটা প্রাপ্য, বিচারের দিন তাকে তিনি সেটাই দিবেন। সেদিন কাউকে বিন্দুমাত্র ঠকানো হবে না। দেখেন জাফর চাচা, আপনি যদি আপনার ছেলে পড়াশোনা না করার কারণে তাকে পাশ করাতে না চান আপনার সততা ও ন্যায়পরায়ণতার দোহাই দিয়ে, তাহলে যিনি জগৎসমূহের মালিক এবং সমস্ত ন্যায়পরায়ণদের উপরে যার ন্যায়পরায়ণতা, তিনি কী করে ভালো মানুষগুলোর প্রতি অবিচার করবেন? তাই এক্ষেত্রে তিনি সঠিক বিচারই করবেন। এতে তো দোষের কিছু নেই!”
জাফর চাচা বললেন, “এখানে তুমি কিন্তু একটি ভুল কইরলে। তুমি মনে কর যে যারাই আল্লাকে বিশ্বাস করে না তারাই ব্যভিচার, চুরি, মানুষকে ঠকানো ইত্যাদি কইরে থাকে। কিন্তু অনেক মানুষ আসে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না, কিন্তু এগুলোও করে না। আবার অনেকে আসে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে, কিন্তু ওইসব কাজও করে। তাই এইভাবে সবাইরে দোষারোপ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়!”
ফাতিমা বললো, “দেখেন চাচা, আমি কিন্তু বলিনি যে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে তারা এমন কাজ করে না। হ্যাঁ, তারাও ওসব কাজ করে। তাই আল্লাহ তা’আলা তাদেরকেও যে ছেড়ে দেবেন – এমন নয়। যার যার মন্দ কর্মের শাস্তি তাকে ভোগ করতে হবে। আর এভাবে যদি শাস্তি দেওয়া না হয়, তাহলে মানুষ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাবে। অপরাধ বেড়ে যাবে। সুতরাং, শাস্তি দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। এবার আসি যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না কিন্তু ওসব কাজ করে না এমন ব্যক্তির ব্যাপারে কী হবে? আসলে এমন লোক পাওয়া খুব কঠিন। যদিও উপরে উপরে থাকতে পারে, তবে ভিতরে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে ওদের অন্তরেও এসব অপরাধের আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। শুধুমাত্র সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই কাজে লাগায়। আচ্ছা চাচা, আপনি বলেছিলেন আপনার বাসায় গরু-ছাগল রয়েছে। তো গাভীর দুধ তো বিক্রি করেন। নাকি?”
জাফর চাচা উত্তর দিলেন, “কোন কথা থেকে কোথায় চইলে গেলে তুমি? এই কথা জাইনে এখন কী হবে?”
ফাতিমা বললো, “চাচা, আগে বলবেন তো!”
-“হয়! গাভীর দুধ প্রতিদিন বিক্রি করি।”
-“ও! তো দুধে আপনি পানি মেশান না?”
-“এগুলো কী বলো? দুধে পানি মেশানোর মতো দুই নম্বর কাজ আমি করি নে। আমি একেবারে খাঁটি দুধ বিক্রি করি। ক্রেতাগে কইয়েই দি যেন পানি মিশায়ে নেয়। আমি দুধে এক ফোঁটা পানিও মিশাই নে!”
-“আচ্ছা! কেউ যদি বলে আপনি পানি মেশান, তাহলে সে কি অপরাধ করবে?”
-“অপরাধ করবে মানে? কঠিন অপরাধ করবে! সে আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে আর এটা অপরাধ হবে না? তারে তো আমি মেম্বার সাহেবের কাছে বিচারের জন্যি নিয়ে যাতাম! হুঁ!”
-“হ্যাঁ চাচা, তখন আপনার সেই ব্যক্তির বিচার করাই উত্তম হবে। এই একই কাজ আল্লাহ তা’আলাও করবেন। আল্লাহ তা’আলা নিজেই স্রষ্টা এবং তিনি নিজেই এই কথার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যুগে যুগে নবীদের নিদর্শন দেখিয়েছেন। তাঁদের সাথে কথা বলেছেন, তাঁদের উপর ওয়াহী নাযিল করেছেন। তাঁরা মানবজাতির কাছে সেই স্রষ্টার পরিচয় তুলে ধরেছেন। এরপরেও যদি কেউ তাঁকে স্রষ্টা হিসেবে অস্বীকার করে, তাহলে সেটা হবে সবথেকে বড় অপরাধ।[৪] আর এই অপরাধ তিনি ক্ষমা করবেন না।[৫] তাই যে তাঁকে সৃষ্টিকর্তা না মেনে ভালো কাজ করবে, তার এই ভালো কাজের বদলা আল্লাহ দুনিয়াতেই দিয়ে দিবেন। কিন্তু বিচারের দিনে সেই ভালো কাজ তার কোনো উপকারেই আসবে না। সে চিরকাল জাহান্নামের শাস্তিই ভোগ করবে।[৬] তাই এখানেও আল্লাহ তা’আলার অবিচার লক্ষ করা যাচ্ছে না, চাচা!”
ফাতিমার চৌকস উত্তরগুলো শুনে জাফর চাচার চোখ আর উপরে উঠলো না। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে রসুল মিয়া বললেন, “মিয়া! কত কইছি তুমারে যে, ওইসব জটিল চিন্তা করার দরকার নাই। সহজভাবে জীবনযাপন করো। দুনিয়ার আল্লাহর কথাই মাইনে চলো। তাইলে পরকালে সুখে থাকবা। তা তো শুনবা না! এহন শিক্ষা হয়সে?”
তখনো জাফর চাচার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। কী যে একমনে চিন্তা করেই যাচ্ছেন। তাঁর এই অবস্থা দেখে আদনান বললো, “জাফর মিয়া! আজ আপনার আর কাজ করা লাগবে না। চাচার কাছ থেকে মজুরী নিয়ে বাড়িতে চলে যান। বাড়িতে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাববেন যে, আর কতদিনই বা বাঁচবেন। আপনার এই চিন্তাধারার কারণে যদি চিরকাল জাহান্নামের শাস্তির মধ্যে থাকা লাগে তাহলে তা কতই যন্ত্রণার! আর এই বয়সেও যদি আপনি আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে তাঁর কাছে ফিরে আসেন, তাহলে আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন। চিরকাল জান্নাতের নিয়ামতে পুরষ্কৃত করবেন।[৭] আপনি তো শুধু কুরআনের শাস্তির আয়াতগুলো নিয়েই বেশি চিন্তা করছেন! কিন্তু আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, আমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং ঈমান আনি, তাহলে আমাদেরকে শাস্তি দিয়ে আল্লাহ্র কী লাভ?[৮] এরপরে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি এবং তিনি যা দিয়েছেন, সেখান থেকে ব্যয় করি, তাহলে আমাদের জন্য রয়েছে মহাপুরষ্কার। তারপরে, আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছো না, অথচ রাসূল তোমাদেরকে তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার দাওয়াত দিচ্ছেন? আল্লাহ তো পূর্বেই তোমাদের অঙ্গীকার নিয়েছেন – যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’।[৯]
ফাতিমা তখন মোবাইল এগিয়ে দিয়ে আদনানকে বললো, “এই আয়াতটি বলতে পারো।”
আদনান মোবাইলটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো, “একজন ঈমানদার বান্দাকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা’আলা দয়ার সুরে বলেন, ‘যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মতো যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিলো। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।’[১০] এই আয়াতগুলো কি একটু মনে নাড়া দেয় না, চাচা?”
জাফর চাচা কোনো কথা বলছেন না। একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরে ফাতিমা আবার বলা শুরু করলো, “চাচা, আমরাও তো মানুষ। আল্লাহর বিধান মানতে গিয়ে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আমাদের ভুলত্রুটি হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তা’আলা আমাদের নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন। আমাদের তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’[১১] এরপরেও কি চাচা আল্লাহ্ তা’আলার সীমাহীন দয়া আপনি অনুভব করেন না? শুধু আল্লাহ্কে শাস্তিদাতা হিসেবেই দেখলেন?”
এতটুকু বলতেই দূর থেকে মাগরিবের আযানের শব্দ শোনা যাচ্ছে, “কল্যাণের পথে এসো;’’ এরই সাথে জাফর মিয়ার কান্নার আওয়াজ! মনে হয় কিছু হলেও তিনি বুঝেছেন! কুরআন তো এমনই। পাথরের মতো হৃদয়গুলোকেও মোমের মতো গলিয়ে দেয়।
[জাফর চাচার সাথে এবং ফাতিমা’র কথোপকথনের সময় ফাতিমা পর্দার বিধান সম্পূর্ণভাবে পালন করতে পারেনি। তাই এভাবে কথা বলা শরী’য়াহ সম্মত নয়। কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এভাবে কথা না বলে অন্য কোনো উপায় ছিলো না। শুধুমাত্র গল্প হিসেবেই এগুলো বিবেচনা করার অনুরোধ থাকলো। সমস্ত জ্ঞান তো আল্লাহ তা’আলার কাছেই। লেখাটিতে যা কিছু ভুল, তা আমার ও শয়তানের পক্ষ হতে এবং যা কিছু কল্যাণ, সবই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে।]
[১] পুরুষের পোশাক: https://islamqa.info/en/36891
নারীদের পোশাক: https://islamqa.info/en/235
[২] সূরা আয-যারিয়াত (৫১); আয়াত: ৫৬
[৩] কিতাবুয যুহদ: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল
[৪] https://islamqa.info/en/113901
[৫] সূরা তাওবা (০৯); আয়াত: ৮০
[৬] সূরা বাকারাহ (০২); আয়াত: ১৬১-১৬২
[৭] সূরা বাকারাহ (০২); আয়াত: ৮২
[৮] সূরা নিসা (০৪); আয়াত: ১৪৭
[৯] সূরা হাদীদ (৫৭); আয়াত: ৭-৮
[১০] সুরা হাদীদ (৫৭); আয়াত: ১৬
[১১] সূরা যুমার (৩৯); আয়াত: ৫৩
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।