আদনান ও ফাতিমার আজ ফুফু বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা। অনেকদিন ধরে ফুফু তাঁর বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা বললেও ফাতিমা কখনো যেতে রাজি হতো না। এর কারণ ছিলো আদনানের সংশয়। এগনোস্টিক আদনানকে নিয়ে সে কোথাও যেতে ইচ্ছুক ছিলো না। কিন্তু এখন তো আর সেই সমস্যা নেই। আদনানের সংশয়ও কেটে গিয়েছে, নিয়মিত সালাতও আদায় করে, আবার সে কুরআনের ভাষা শেখাও শুরু করেছে। দু’জন একে অপরের দ্বীন পরিপূর্ণ করছে। ঘড়িতে দুপুর দুইটা বাজে। এখন তো ফুফুর বাসায় যেতে হবে! তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। কিন্তু আকাশ তো কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে এবং প্রচণ্ড বৃষ্টিও হচ্ছে। ওদিকে আদনানের ড্রাইভারও নেই। মায়ের অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। তাই গাড়ি নিয়েও যাওয়া যাচ্ছে না। আবার ফুফু বারবার ফোনও দিচ্ছেন তাড়াতাড়ি যাবার জন্য। কিন্তু কী আর করার? অপেক্ষা করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই!
কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থেমে গেলো। তাই এই সুযোগে আদনান ও ফাতিমা ফুফু বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ঘড়িতে যখন দুইটা বেজে আটচল্লিশ মিনিট, ঠিক তখন আদনান ও ফাতিমা ফুফু বাড়ি গিয়ে পৌঁছালো। আদনানের ফুফু আদনানকে দেখে খুবই খুশি। কিন্তু ফাতিমাকে তিনি তেমন একটা গুরুত্ব দিলেন না। বিয়ের পরে আদনান ও ফাতিমা ফুফুর বাসায় একসাথে কখনো আসেনি। সেই সূত্রে রাগ করে আছেন ভেবেই ফাতিমা নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলো।
আদনানের ফুফু সেই ৩০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে ভার্সিটির শিক্ষিকা। তবে তিনি আবার নাকি বিজ্ঞানমনস্ক লোক! মুক্তচর্চা করতে পছন্দ করেন! তাঁর নাম জেবুন্নেসা হওয়ায় সবাই তাঁকে জেবু ম্যাম বলেই ডাকে। কারণ এলাকায় অনেকেই তাঁর ছাত্র অথবা ছাত্রী। আর আদনানের ফুফুর স্বভাবই হলো, কাউকে পেলেই জ্ঞান বিতরণ শুরু করা। আদনানের কাছ থেকে তার ফুফু সম্পর্কে এতটুকুই শুনেছে ফাতিমা।
দুপুরের খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পরে জেবু ম্যাম আদনানের কাছে গিয়ে বসলেন। বলেলেন, “বাবা, তোকে একটি জিনিস জানাতে চাই জিনতত্ত্বের ব্যপারে। বিষয়টি বুঝলে তুই আরো ভালোভাবে মুক্তচিন্তা করতে পারবি।”
ফাতিমা এই কথা শুনেই বুঝতে পারলো যে, আদনানের পূর্বের অবস্থার পিছনে তার এই ফুফুরই মূলত হাত রয়েছে। তবুও ফাতিমা কিছু বললো না এই ভেবে যে, ফুফু কী বলেন সেটা শোনার আগে কিছু বলা সমীচীন হবে না।
বিভিন্ন কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে জেবু ম্যাম বললেন, “শোন বাবা, একটি সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে সেটা সম্পূর্ণই নির্ভর করে একজন পুরুষের উপর এবং কীভাবে নির্ভর করে, সেটা বলছি। মানুষের দেহে দুই ধরনের কোষ থাকে। একটি হলো দেহকোষ এবং অপরটি হলো জননকোষ। দেহকোষে মাইটোসিস কোষ বিভাজন হয়। মাইটোসিস কোষ বিভাজনে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ক্রোমোজোম সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকে। আর জননকোষে মায়োসিস কোষ বিভাজন হয়। এই মায়োসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে গ্যামেট, মানে শুক্রাণু আর ডিম্বাণু তৈরি হয়। এই কোষ বিভাজনে ক্রোমোজোম সংখ্যা হ্রাস পায়। এই, শুনছিস তো নাকি?”
আদনান উত্তর দিলো, “হুম। শুনছি তো। তুমি বলে যাও।”
আদনানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জেবু ম্যাম বললেন, “প্রতিটি প্রকৃত কোষের ভিতরে নিউক্লিয়াস থাকে। নিউক্লিয়াসের ভিতরে ক্রোমোজোম নামের একটি পদার্থ থাকে, যেটি জীবের বৈশিষ্ট্য বংশপরাম্পরায় সঞ্চালিত করে। তুই কোনো পিতামাতার সন্তানদের দিকে লক্ষ করলে দেখবি যে, তাদের মধ্যে পিতার অথবা মাতার বা উভয়ের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে তাদের মধ্যে খুব বেশি মিল পাওয়া যায়। মনে কর, একটি ছেলের চোখ ও নাক হয়েছে তার মায়ের মতো। আবার, ছেলের চেহারা ও উচ্চতা হয়েছে তার বাবার মতো। এসব বৈশিষ্ট্য পিতা-মাতা থেকে সন্তানে বহন করার কাজ করে এই ক্রোমোজোম।”
জেবু ম্যামকে থামিয়ে দিয়ে আদনান বললো, “আমি তো এসব জানি, ফুফু! এগুলো কি এখন বলার সময়?”
বিরক্তির সুরে জেবু ম্যাম উত্তর দিলেন, “আহা! কেন বলছি সেটা একটু পরে বুঝবি। এখন শুধু শুনে যা। তো যা বলছিলাম সেটা হলো, কোষে এই ক্রোমোজোম সংখ্যা গণনা করা যায়। গণনা করে দেখা গেছে মানুষের একটি কোষের নিউক্লিয়াসে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম আছে। তার মধ্যে ২২ জোড়া বা ৪৪টি ক্রোমোজোমকে বলে অটোজোম এবং ১ জোড়া বা ২টি ক্রোমোজোমকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। এই ২ জোড়াকে সেক্স ক্রোমোজোম বলার কারণ হলো এই দু’টি ক্রোমোজোমই সন্তানের সেক্স বা লিঙ্গ নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা এই দু’টি ক্রোমোজোমের উপর নির্ভর করবে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই দু’টি ক্রোমোজোমকে ‘XY’ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে এই দু’টি ক্রোমোজোমকে ‘XX’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এই ‘Y’ ক্রোমোজোমের কারণে ছেলে সন্তান হয়। যেহেতু এই ‘Y’ ক্রোমোজোম শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়, সেহেতু সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে এই বিষয়ে শুধুমাত্র পুরুষেরাই দায়ী।”
এ কথা বলে জেবু ম্যাম বিছানায় তাঁর পাশে থাকা মোবাইল বের করে একটি ছবি বের করে আদনানকে বললেন, “এই ছবিটি দ্যাখ, তাহলে কন্সেপ্ট আরো ক্লিয়ার হবে। এখানে ক্রোমোজোমের ক্রমবিন্যাস বা ক্যারিওটাইপ দেখানো হয়েছে।”
আদনান বললো, “ওয়াও! দেখতে তো খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু এতে তোমার কী সমস্যা? তুমি কি বলতে চাও যে, আমাদের সমাজে সন্তান মেয়ে হবার কারণে নারীদের দোষী করা হয়, এটা যেন কেউ না করে, আর সেজন্য সবাইকে আমি সচেতন করবো, তাই তো?”
জেবু ম্যাম বললেন, “আরে না! না! এতক্ষণ তো কিছুই হয়নি। তবে এখন হবে! শোন তাহলে। একটি সন্তানের সেক্স ক্রোমোজোম ‘XY’ হবে নাকি ‘XX’ হবে, তা নির্ধারিত হয় নিষেকের সময়। পুরুষের শুক্রাণু ও নারীদের ডিম্বাণু মিলে জাইগোট তৈরি করে। এই জাইগোটে ‘XY’ ক্রোমোজোম থাকলে একটি ভ্রূণ ছেলের মতো করে বৃদ্ধি পায় এবং ‘XX’ থাকলে ভ্রূণ মেয়ের মতো করে বৃদ্ধি পায়। তাই সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে তা নিষেকের সময়ই নির্ধারিত হয়ে যায়। কিন্তু মোহাম্মদ কী বলেছে জানিস?”
আদনান জিজ্ঞাসা করলো, “কী বলেছেন?”
জেবু ম্যাম বললেন, “মোহাম্মদ বলেছে যে সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা নাকি আল্লার নির্দেশে হয়। এতটুকু বললেও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সে বলেছে, সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা নাকি ভ্রূণের উপর বিয়াল্লিশ দিন অতিবাহিত হবার পরে নির্ধারিত হয়!”
আদনান বললো, “ফুফু, তুমি এটা কোথায় পেয়েছো?
জেবু ম্যাম মোবাইলে অ্যাপ ওপেন করলেন। অ্যাপ থেকে একটি হাদিস বের করে আদনানের সামনে দিয়ে বললেন, “এই দ্যাখ! মুসলিম শরীফে আছে। আমি পড়ে শোনাচ্ছি। তুই শোন।”
আদনান বললো, “আচ্ছা, পড়ো।”
এবার জেবু ম্যাম বললেন, “আদনান, ভালো করে শোন কী বলেছে। মোহাম্মদ বলেছে, ‘যখন মাতৃগর্ভে নুতফার অর্থাৎ শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর উপর বিয়াল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়, তখন আল্লা তালা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তিনি নুতফাকে একটি রূপ দান করেন, তার কান, চোখ, চামড়া, মাংস ও হাড় তৈরি করে দেন। তারপর ফেরেশতা জিজ্ঞাসা করে বলে, হে আমার রব! সে কি ছেলে হবে নাকি মেয়ে? তখন তোমার প্রভু যা চান সিদ্ধান্ত দেন এবং ফেরেশতারা আদেশ অনুসারে সেটা লিখে ফেলে।’[১] সুতরাং, মোহাম্মদের এই কথা থেকে বোঝা যায় যে, সে জানতো না নিষেকের সময় সন্তানের সেক্স বা লিঙ্গ নির্ধারিত হয়! অতএব, সে একজন ভণ্ড ও মিথ্যা নবী! হা হা হা। এখন বুঝেছিস এতকিছু তোকে কেন বললাম?”
আদনান দেখে বললো, “তাই তো! কিন্তু ফুফু একটা বিষয় তোমাকে বুঝতে হবে যে, যদি বিজ্ঞানের কোনো ঘটনা কুরআন ও সহিহ হাদিসের বিপরীতে যায়, তাহলে সেখানে দুইটি সম্ভাবনা থাকে। প্রথমত, তুমি কুরআন বা হাদিসের অর্থ না বুঝতে পারো অথবা সেই বিষয়ে তোমার পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকতে পারে। আরেকটি হলো, বিজ্ঞান এখনো সেটা সঠিকভাবে আবিষ্কার করতে পারেনি।”
এটুকু বলে ফাতিমার দিকে তাকিয়ে আদনান বললো, “আচ্ছা ফাতিমা, এই ব্যাপারে তোমার কাছে কি কোনো উত্তর আছে?”
আদনানের উত্তর শুনে জেবু ম্যাম বললেন, “এটা তুই কেমন কথা বললি, বাবা! তুই তো এমন ছিলি না! আর এই বিষয়ে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা তো একদম পানির মতো পরিষ্কার। এতে তো আর আবিষ্কারের কিছু নেই।”
ফাতিমা ম্যাডামের বিকৃত মুক্তচিন্তা চর্চা দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। ফাতিমা মৃদু স্বরে ফুফুকে জিজ্ঞাসা করলো, “ম্যাম, আপনি কি কখনো ‘কুয়োর ব্যাঙ’ এর গল্প শুনেছেন?”
জেবু ম্যাম উত্তর দিলেন, “গল্প করতে এখানে এসে বসিনি। তুমি কথা ঘুরাচ্ছো কেন?”
“ম্যাম বলেন, প্লিজ। আপনি নাকি খুব সুন্দর গল্প বলেন। সবার কাছে আপনার গল্পের সুনাম শুনেছি। থাক না ওসব কথা আজ।” বলে জোর করতে লাগলো ফাতিমা।
নিজের সুনাম শুনে জেবু ম্যাম খুশিতেই বলা শুরু করলেন, “একবার এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রের কাছে থাকা কুয়ার মধ্যে সমুদ্রের পানিসহ ব্যাঙ ঢুকে পড়েছিলো। দুর্যোগ কমে যাবার পরে কুয়োর ব্যাঙ দেখলো তার রাজত্বে আরেক ব্যাঙ, যাকে সে চেনে না। তখন কুয়োর ব্যাঙ সমুদ্রের ব্যাঙকে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘তুমি আবার কোন জলাশয়ের?’
-‘আমি সমুদ্রের।’
-‘সেটা আবার কী জিনিস?’
-‘সমুদ্র এমন জিনিস যে, সেখানে এখান থেকে অনেক বেশি পানি আছে।’
-‘কত পানি? এ-এত?’
-‘আরে না! সমুদ্র অনেক বড়!’
-‘তাহলে এ-এ-ত।’
-‘আরে না! আরো বড়!’
-‘তাহলে এ-এ-এ-এত? এই জলাশয়ের, মানে কুয়ার সমান?’
-‘আরে না! না! এর থেকে অনেএ-এ-এ-এ-এ-ক বড়।’
অবশেষে সেই কুয়োর ব্যাঙকে বুঝানোই গেলো না সমুদ্র কত বড়! বুঝবেই বা কী করে? সে তো কোনোদিন কুয়ার বাইরেই যায়নি! তাই কুয়ার পানি থেকে অধিক পানি কোথাও যে থাকতে পারে, সেটা সে বিশ্বাসই করে না!”
কিন্তু গল্প শেষ করেই জেবু ম্যামের চেহারার ভঙ্গি পাল্টে রাগ ফুটে উঠলো। বললেন, “কিন্তু এই গল্পের প্রসঙ্গ তুলে তুমি কী বোঝাতে চাও, সেটা পরিষ্কার করে বলো!”
ফাতিমা বললো, “স্যরি, ফুফুমনি। আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি। তাই একটু মজা করছিলাম। দয়া করে রাগবেন না। আচ্ছা ফুফুমনি, শাহারিয়ার আর প্রাচী কোথায়? ওদের দেখছি না যে!”
জেবু ম্যাম উত্তর দিলেন, “ওরা তো পড়াশোনার জন্য নিজ নিজ হোস্টেলে থাকে। বাসায় খুব কমই আসার সুযোগ পায়! তোমাকে একটি কথা বলে রাখি। আদনান আমাকে ফুফু ডাকে ঠিক আছে। কিন্তু তুমি আমাকে ন্যাকামো করে ফুফুমনি ডাকবে না! আমাকে ম্যাম বলেই ডাকবে। ঠিকাছে?”
ফাতিমা বললো, “আচ্ছা, ঠিকাছে। তাহলে ম্যাম, আমার একটি জিজ্ঞাসা ছিলো। সেটি হলো, শাহারিয়ার যে ছেলে আর প্রাচী যে মেয়ে, এটা আপনি কীভাবে বুঝলেন?”
ভার্সিটির শিক্ষিকা হবার কারণে এই প্রশ্ন তাঁর কাছে তেমন বিদঘুটে লাগেনি। জেবু ম্যাম স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন, “বোকা মেয়ে! এটা কীভাবে বোঝে তুমি জানো না? ছোটবেলায় তাদের লিঙ্গ দেখে আর বড় হলে সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল ক্যারেক্টারগুলো দেখে বুঝেছি।”
ফাতিমা বললো, “কেন, ম্যাম? আপনি তাদের জেনেটিক সেক্স XX নাকি XY, সেটা কেন পরীক্ষা করে দেখলেন না?”
জেবু ম্যাম হেসে দিয়ে উত্তর দিলেন, “এই সাধারণ বিষয়ে কেউ কি এত ঝামেলা করে? আর সব জায়গায় তো এগুলো করাও হয় না। বাংলাদেশের ১% মানুষেরও জেনেটিক সেক্স নির্ধারণ করা নেই। আর এভাবে ছেলে-মেয়ে নির্ধারণ করতে বললে তো মানুষ আমায় পাগল বলবে!”
ফাতিমা বললো, “না! না! ম্যাম। আপনি কিন্তু এখানে একটা ভুল করেছেন। কারণ কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের লিঙ্গ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ছেলেদের মতো হলেও তার জেনেটিক সেক্স হয় ‘XX’ অর্থাৎ, মেয়েদের মতো! এই সমস্যা হয় অ্যাড্রেনাল হাইপারপ্লাশিয়া হলে। আবার কিছু সময় সন্তানের লিঙ্গ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য মেয়েদের মতো হলেও তার জেনেটিক সেক্স হয় ‘XY’ অর্থাৎ, ছেলেদের মতো! এই সমস্যা হয় টেস্টিকুলার ফেমিনাইজেশান হলে। এগুলোকে ‘সিউডো হারমাফ্রোডিটিজম’ বলা হয়।[২] তাহলে ম্যাম, আপনি যা ভেবেছেন সেটা তো না-ও হতে পারে! একসময় জেনেটিক সেক্স পরীক্ষা করার পরে দেখা গেলো শাহারিয়ার মেয়ে, মানে XX আর প্রাচী XY অর্থাৎ, ছেলে।”
এই বলে ফাতিমা খিলখিল করে হেসে উঠলো। জেবু ম্যাম ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “অ্যাঁ! উম! ফাতিমা, তুমি ব্যাপারগুলো এত জটিল করছো কেন? সাধারণভাবে দেখলেই তো হয়। এত ঝামেলা করার তো দরকার নেই।”
আদনান মাঝখান থেকে বলে উঠলো, “তাহলে ফুফু, তুমি একটি সাধারণ হাদিসকে এত জটিল করছো কেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ নাহয় একটি সাধারণ বিষয় আল্লাহর কাছ থেকে ওহীপ্রাপ্ত হয়ে সাহাবাদের বলেছেন। ওই সময়ের মানুষ তো এসব ক্রোমোজোম, জিন ইত্যাদি ব্যাপারগুলো বুঝতোই না। তাই তাদের এসব বিষয় বুঝানোর কোনো দরকারই আল্লাহর রাসূলের ﷺ ছিলো না। উনি হয়তো এই হাদিস দিয়ে অন্য কিছু বুঝিয়েছেন।”
জেবু ম্যাম রেগে গিয়ে বললেন, “তুই কি তাহলে বলতে চাচ্ছিস যে, সন্তান ছেলে কি মেয়ে হবে এটা বিয়াল্লিশ দিন পরেই আল্লার অনুমতি পাবার কারণে আলাদা হয়?”
আদনান বললো, “সেটা আমি জানি না। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি। আল্লাহ তা’আলা এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ যেসব কথা বলেছেন সেগুলো সবই ঠিক। আমি সেগুলো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিয়েছি।”
জেবু ম্যাম বিস্ময়ের সাথে বললেন, “কী? তুই কোনো প্রমাণ ছাড়াই এগুলো মেনে নিবি? এভাবে তো ধর্মান্ধরা বিশ্বাস করে! তুইও কি সেই দলে যোগ দিলি? এই দেশ কি এমন মুক্তমনা চেয়েছিলো? এই ধর্মান্ধরা…।”
জেবু ম্যামকে ভদ্রতার সাথে থামিয়ে দিয়ে ফাতিমা বললো, “ম্যাম, ধর্ম আর বিজ্ঞান দু’টি তো দুই মেরুর জিনিস। বিজ্ঞান এমন একটি শাখা যেখানে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে শারীরিক ও প্রাকৃতিক জগতের গঠন এবং আচরণের পদ্ধতিগত, বুদ্ধিগত ও বাস্তব কার্যকলাপ সম্পর্কে গবেষণা করা হয়। এখানে যা প্রমাণ করা যায়, সেটাই বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাস হলো আল্লাহ তা’আলা এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের যা কিছু জানিয়েছেন সেগুলো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেওয়া। যেমন, আল্লাহ তা’আলা কুরআনের মধ্যে বলেছেন, ‘যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে; এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। সর্বোপরি, তারা পরকালের উপরও দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।’[৩] আর, বিজ্ঞান তো কয়েকবছর আগেও গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেনি। তাই বলে কি পূর্বের এত বছর এই তরঙ্গ ছিলো না? অবশ্যই ছিলো। তাহলে বিজ্ঞান দিয়ে আপনি কীভাবে সব কিছু বিচার করবেন? এটাতো ম্যাম বোকামি! তারপরেও আপনি যখন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ চাইছেন, আমি প্রমাণ দিচ্ছি।”
“কী প্রমাণ দিবে তুমি? তাহলে আমার কথা কি ভুল?” জেবু ম্যাম জিজ্ঞসা করলেন।
ফাতিমা বললো, “সাধারণত মানুষের প্রজননতন্ত্র দেখেই বোঝা যায় যে, সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে। মানুষের প্রজননতন্ত্র মূলত তিনটি জিনিস নিয়ে গঠিত। প্রথমত, গোনাড বা শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয়। তারপরে, জেনিটাল ডাক্ট যা পরবর্তীতে মেসোনেফ্রিক ও প্যারামেসোনেফ্রিক ডাক্টে রূপান্তরিত হয়। এবং সবশেষে, এক্সটারনাল জেলিটালিয়া বা, বাহ্যিক যৌন অঙ্গ। এগুলোর সাহায্যে কারো জেন্ডার নির্ণয় করা না গেলে তখন হরমোন এবং সাইকোলজিক্যালি জেন্ডার নির্ণয় করা হয়। মানুষের ভ্রূণে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রজননতন্ত্রের এই প্রধান অংশগুলির কোনো অংশই পার্থক্য করা যায় না। অর্থাৎ, এই অবস্থায় ছেলে বা মেয়ের জননতন্ত্রের অংশগুলো একই থাকে। এই অবস্থাকে বলে ইন-ডিফ্রেন্ট স্টেজ।[৪] আবার ভ্রূণবিদ্যা থেকে এটাও জানা যায় যে, ৬ সপ্তাহের আগে অর্থাৎ, বিয়াল্লিশ দিনের আগে সাধারণভাবে ভ্রূণটি ছেলে নাকি মেয়ে সেটা আলাদা করা অসম্ভব।”[৫]
তারপর ফাতিমা ব্যাগ থেকে দ্রুত মোবাইলটি বের করে ইন্টারনেট থেকে একটি ছবি ওপেন করে বললো, “ম্যাম দেখেন, আমার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছবিটি দেখেন। তাহলে সহজেই ব্যপারটি বুঝতে পারবেন। এখানে, প্রজননতন্ত্রের অবিভক্ত অবস্থা উপরে এবং বিভক্ত অবস্থা নিচে দেখানো হয়েছে।”
ম্যাম মোবাইলের দিকে তাকালেন। তখন ফাতিমা বলা শুরু করলো, “এখানে উপরের যে ছবিটি আছে, সেটা হলো প্রজননতন্ত্রের সেক্সুয়ালি ইন-ডিফ্রেন্ট স্টেজ। অর্থাৎ, এই সময়ে এটা ছেলে কি মেয়ে সেটা বোঝা যায় না। এটা বিয়াল্লিশ দিনের আগের অবস্থা। কিন্তু নিচের ছবিতে বাম দিকের ছবিটি ছেলেদের প্রজননতন্ত্রের। এবং ডানদিকের ছবিটি মেয়েদের প্রজননতন্ত্রের। এটা বিয়াল্লিশ দিন অতিবাহিত হবার পরের কোনো সময়ের অবস্থা। বুঝেছেন, ম্যাম?”
মুখ কালো করে জেবু ম্যাম উত্তর দিলেন, “হুম! দেখলাম। কিন্তু তাহলে ছেলে এবং মেয়ের প্রজননতন্ত্র আলাদা কখন এবং কীভাবে হয়?”
ফাতিমা হালকা করে গলা ঝেড়ে তারপর বলা শুরু করলো, “হ্যাঁ ম্যাম, বলছি। ভ্রূণের বয়স যখন ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ, অর্থাৎ ৪২ থেকে ৪৯ দিন, তখন ভ্রূণের ক্রোমোজোমগুলোর মধ্যে যদি ‘Y’ ক্রোমোজোম থাকে, তাহলে সেই ‘Y’ ক্রোমোজোমে অবস্থিত ‘SRY’ Gene নামক একটি জিন সক্রিয় হয়।[৬] তখন ‘SRY’ জিনটি ‘SOX’ নামক আরেকটি জিন সক্রিয় করে যেটি আবার ‘SF1’ ফ্যাক্টরসহ অন্যান্য জিন সক্রিয় করার মাধ্যমে ছেলেদের প্রজননতন্ত্র বিভক্ত করা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ছেলেদের শুক্রাশয় তৈরি করে। একই সাথে ‘SOX’ জিনটি ‘WNT4’ নামক আরেকটি জিনকে সক্রিয় হওয়া থেকে বাধা দেয় যাতে একই ভ্রূণে ছেলে ও মেয়ের প্রজনন্তন্ত্র গঠিত না হয়। এবার উৎপন্ন শুক্রাশয়ের সারটলি কোষ থেকে বিভিন্ন হরমোন নিঃসৃত হয়ে ছেলেদের জেনিটাল ডাক্ট থেকে এপিডিডাইমিস, ভাস ডিফারেন্স, সেমিনাল ভেসিকল ও লেডিগ কোষ থেকে বিভিন্ন হরমোন নিঃসৃত হয়ে বাহ্যিক যৌনাঙ্গ তৈরি হয়।”[৭] এভাবেই একটি ভ্রূণের জেন্ডার আস্তে আস্তে পুরুষে পরিণত হয়। ম্যাম, আমি মনে হয় আপনাকে বুঝাতে পেরেছি।”
“হ্যাঁ, গো অ্যাহেড।”
ফাতিমা আবার বলা শুরু করলো, “তারপরে, যে ভ্রূণের ক্রোমোজোমগুলোর মধ্যে ‘Y’ ক্রোমোজোম থাকে না, সেই ভ্রূণে ‘WNT4’ জিনটি সক্রিয় হয়। তারপর ‘WNT4’ জিনটি আবার ‘DAX1’ এবং ‘TAFII 105’ জিন সক্রিয় করার মাধ্যমে মেয়েদের প্রজননতন্ত্র বিভক্ত করা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মেয়েদের ডিম্বাশয় তৈরি করে। আবার এক্ষেত্রে ‘WNT4’ জিনটি ‘SOX’ নামক জিনকে সক্রিয় হওয়া থেকে বাধা দেয়, যাতে একই ভ্রূণে ছেলে ও মেয়ের প্রজনন্তন্ত্র গঠিত না হয়। এবার উৎপন্ন ডিম্বাশয় থেকে বিভিন্ন হরমোন নিঃসৃত হয়ে মেয়েদের জেনিটাল ডাক্ট থেকে জরায়ু, ফেলোপিয়ান টিউব এবং আলাদাভাবে বাহ্যিক যৌনাঙ্গ তৈরি হয়।[৮] এভাবেই একটি ভ্রূণের জেন্ডার আস্তে আস্তে মহিলাতে পরিণত হয়। ম্যাম একটু ওয়েট করুন। আমি আরেকটি ছবি দেখাচ্ছি। ছবি দেখে আমার কথার সাথে মেলানোর চেষ্টা করুন।”
ফাতিমা মোবাইলের লক খুলে গুগলে গিয়ে ইন্টারনেট থেকে আরেকটি ছবি ওপেন করলো। ছবিটি ওপেন করে ফুফুর হাতে মোবাইলটি দিয়ে দেখতে বললো। ছবিটি ছিলো এমন।
জেবু ম্যাম ছবির দিকে তাকিয়ে ফাতিমার বলা কথার সাথে মিলাচ্ছিলেন। মিলানো শেষে জেবু ম্যাম মোবাইলটি বিছানায় রেখে দিলেন। তখন ফাতিমা বললো, “এবার আপনি লক্ষ করলে দেখে থাকবেন যে, এর প্রত্যেক ঘটনাই ৬ সপ্তাহ অর্থাৎ, ৪২ দিনের পরে হয়। আর যেহেতু রাসূলুল্লাহ ৪২ দিন পরে ছেলে কি মেয়ে হবে সেটা তাকদীরে লেখা হয় বলে আমাদের জানিয়েছেন, সেহেতু রাসূলুল্লাহ এই জননতন্ত্রের বিভক্তির মাধ্যমে ছেলে-মেয়ে আলাদা হবার কথাই বলেছিলেন। সুবহানাল্লাহ। ম্যাম, এই সম্পর্কিত জ্ঞান আধুনিক বিজ্ঞান জেনেছে হয়তো এই শতাব্দিতে, আর আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাদের জানিয়েছেন ১৪০০ বছরেরও আগে। ম্যাম, এই জ্ঞান ওই সময়ে একজন আল্লাহর প্রেরিত রাসূল ব্যতীত কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। তাই না? সুতরাং বোঝা গেলো যে, মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর প্রেরিত একজন সত্য নবী এবং রাসূল ছিলেন। আর…।”
ফাতিমাকে থামিয়ে জেবু ম্যাম বললেন, “কিন্তু তবুও তো ভ্রূণের লিঙ্গ পার্থক্যকরণে ‘Y’ ক্রোমোজোমেরই ভূমিকা অগ্রগণ্য থাকছে। আর এখানে জিনগুলোই তো সব কাজ করছে। তাহলে এখানে আল্লার আদেশের দরকার কী? হুঁহ!”
ফাতিমা বললো, “ম্যাম, এবার আপনি একটি সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। আসলে আপনার ধারণা হলো শুধুমাত্র ‘Y’ ক্রোমোজোমই সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে। কিন্তু আসলে আপনার ধারণা সম্পূর্ণ সত্য না। প্রকৃতপক্ষে ‘Y’ ক্রোমোজোমের ‘SRY’ জিন ছাড়াও কিছু জিন লিঙ্গ নির্ধারণ এবং পার্থক্যকরণে সাহায্য করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘SF1 factor’ নামক জিন, যেটি থাকে ৯ নং কোমোজোমে; ‘SOX’ নামক জিন, যেটি থাকে ১৭ নং ক্রোমোজোমে; ‘DAX1’ নামক জিন, যেটি থাকে ‘X’ ক্রোমোজোমে; এবং ‘DMTR1’ নামক জিন, যেটি থাকে ৯ নং ক্রোমোজোমে[৯]। সুতরাং, শুধু ‘Y’ ক্রোমোজোমই যে লিঙ্গ পার্থক্যকরণে সব কাজ করে, এই ধারণা ঠিক নয়।”
জেবু ম্যাম বললেন, “তাতে কী? আমার প্রশ্নের উত্তরই তো দিলে না।”
ফাতিমা উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এখন সেটা দিবো, ইনশা-আল্লাহ। একটু আগে আপনাকে যে জিনগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর তো আর নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি নেই যে, ইচ্ছামতো সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় হবে! যদি থাকতোই, তাহলে এইসব জিন সব ভ্রূণের ক্ষেত্রেই সমানভাবে সক্রিয় হতো কিংবা নিষ্ক্রিয় হতো। কিন্তু সেটা তো হয় না। মাঝে মাঝে কিছু ভ্রূণে এসব জিন সক্রিয় হয় না। ফলে সন্তান প্রজননতন্ত্র সংক্রান্ত জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। কখনো আবার ছেলে অথবা মেয়েদের প্রজননতন্ত্রের কোনো অঙ্গই তৈরি হয় না। আবার কখনো ছেলে অথবা মেয়ে উভয়ের প্রজননতন্ত্রের অঙ্গই তৈরি হয়। সুতরাং, তখন আমরা সাধারণভাবে তাকে মেয়ে অথবা ছেলে বলতে পারছি না। তাহলে বোঝা গেলো যে, এই জিনগুলোর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই। তাই আমরা বলি যে, এই জিনগুলো আল্লাহ তা’আলার আদেশেই সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়। আল্লাহ তা’আলা ভ্রূণের উপর ৪২ দিন অতিক্রম করলে যে ফেরেশতা পাঠান, সেই ফেরেশতাকে আদেশ দিলেই জিনগুলি সক্রিয় হয় এবং ছেলে অথবা মেয়ে হিসেবে ভ্রূণটি বিভক্ত হয়। আবার যদি আল্লাহর আদেশ না হয়, তখন জিনগুলি আর সক্রিয় হয় না এবং ছেলে বা মেয়ের প্রজননতন্ত্র বিভক্তও হয় না। সুতরাং, আল্লাহ তা’আলার আদেশেই ভ্রূণ ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে সেটা নির্ধারিত হয় এবং তাকদীরে লেখা হয়।”
জেবু ম্যাম কিছু একটা বলতে গেলেন। কিন্তু ফাতিমা তার আগেই বলা শুরু করলো, “ম্যাম, আপনাকে একটি সুন্দর তথ্য দেই। ধরেন কোনো ভ্রূণের জেনেটিক সেক্স ‘XY’। তাহলে সে নরমালি ছেলে হবে। তাই না?”
-“হ্যাঁ, তাই তো হবার কথা।”
-“এরকম জিনোটাইপের ভ্রূণটিও মেয়ে হতে পারে। সেটা জানেন?”
-“এ কী করে সম্ভব?”
ফাতিমা হেসে দিয়ে বললো, “অনেক কিছুই সম্ভব। তাহলে শুনুন, ভ্রূণের ‘XY’ কোমোজোমের মধ্যে ‘X’ ক্রোমোজোমে যদি ‘WNT4’ রিজিয়নটির ডুপ্লিকেশান ঘটে, তাহলে ‘DAX1’ প্রোটিনটি বেশি তৈরি হয় এবং ‘SRY’ জিনটি সাপ্রেসড হয়। তাহলে ওই ভ্রূণের গোনাড হিসেবে ডিম্বাশয় হয়। এবং পরবর্তীতে ভ্রূণটি মেয়ে হিসেবে গড়ে ওঠে।[১০] তাহলে আপনার থিওরি কি থাকছে যে, ‘Y’ ক্রোমোজোম বা ‘SRY’ জিন থাকলেই সেই ভ্রূণ ছেলে হবে?”
দীর্ঘ সময় ধরে চুপ থাকার পরে আদনান বললো, “না, তাহলে ফুফুর থিওরি ভুল। আসলে এর সবই জিন সুইচিং এর উপর ডিপেন্ড করে। আর ফুফু, মুসলিমরা বিলিভ করে, এই কাজটি জিনের নিজের শক্তিতে হয় না। এটা আল্লাহ তা’আলার আদেশে হয়। বুঝেছো, ফুফু?”
ফাতিমাও আদনানের কথায় সায় দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, একদম তা-ই।”
তখন আদনান জেবু ম্যামের দিকে ফিরে বসলো। এবং হেসে হেসে বললো, “ফুফু, এবার আমি তোমাকে ‘কুয়োর ব্যাঙের’ গল্পের মর্মকথা বুঝিয়ে বলছি। ‘কুয়োর ব্যাঙ’ যেমন মনে করে তার দেখা জলাশয়ের চেয়ে বড় কোনো জলাশয় হতেই পারে না, তেমনি এই সমাজের কিছু মানুষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। অথচ এটা ভুলে যায় যে, তার থেকে বেশি জ্ঞানও কেউ রাখতে পারে। আর জ্ঞান থাকলেও যে সে সঠিক পথ পায়, তেমনও না। আল্লাহ যাদের সঠিক পথ দেখান, তারাই সুপথপ্রাপ্ত হয়। যেমন ফুফু, আমিও তো তোমার মতোই ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছায় আজ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। তাই ফুফু, তুমিও…।”
জেবু ম্যাম ফাতিমার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “হুম! অনেক বুঝে ফেলেছিস তোরা! তোদেরও মগজধোলাই হয়েছে বোঝা যাচ্ছে! ঠিকাছে, এখন আমার আর সময় নেই। পরে আবার কথা হবে। এখন আমার একটু বাইরে যেতে হবে। তোরা এখন যেতে পারিস।”
এই বলে জেবু ম্যাম বাইরে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে ভিতরের রুমে চলে গেলেন। ফুফুর কথায় কিছু মনে না করে কিছুক্ষণ পরে ফাতিমা এবং আদনান ফুফুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রাস্তায় থাকাকালীন হঠাৎ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলে আদনান ছাতা খুলে দু’জনের মাথার উপরে ধরে বললো,
“ফাতিমা, আমার কিন্তু ‘কুয়োর ব্যাঙের’ উদাহরণটি খুবই ভালো লেগেছে। সঠিক স্থানে তুমি সঠিক উদাহরণ দিয়েছো। তাই তোমার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়।”
নিজের প্রশংসা ফাতিমা পছন্দ করে না। না শোনার ভান করে ফাতিমা বললো, “যাকে মন্দকর্ম শোভনীয় করে দেখানো হয় আর সে তাকে উত্তম মনে করে, সে কি তার সমান যে মন্দকে মন্দ মনে করে?[১১] আল্লাহ তা’আলা যাকে ইচ্ছে সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছে লাঞ্ছিত করেন।”[১২]
ছাতা হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো আদনান। বললো, “তোমার এতকিছু কীভাবে মনে থাকে?”
“এই, চলো তো তাড়াতাড়ি! বাসায় অনেক কাজ। ঢং করার সময় নেই।” বলে ঠেলতে ঠেলতে আদনানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো ফাতিমা। বৃষ্টিতে ছাতার নিচে সাদা পাঞ্জাবি আর কালো বোরকার মিশ্রণে দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন সমুদ্র তীরে হেঁটে চলা দুটি মুক্তা!
[আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই জ্ঞানের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। সেটি যারা বোঝে এবং সেই অনুযায়ী নিজে চলার চেষ্টা করে, তারাই বুদ্ধিমান। বিজ্ঞান এখনো পৃথিবীর সবকিছুই আবিষ্কার করে ফেলেছে, এমন তো নয়। তাই বিজ্ঞান দিয়েই সবকিছু জাস্টিফাই করার মানসিকতা পরিহার করা উচিত। আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই আমি ইসলাম বিদ্বেষীদের অভিযোগকৃত হাদিসের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সমস্ত জ্ঞান তো আল্লাহ তা’আলার কাছেই। লেখাটিতে যা কিছু ভুল, তা আমার ও শয়তানের পক্ষ হতে এবং যা কিছু কল্যাণ, সবই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে।]
[১] সহিহ মুসলিম; তাকদীর অধ্যায়; হাদিস নং- ৬৪৮৫, ৬৪৮৭ (ইঃফা) এবং ৬৫৩৭, ৬৫৩৯ (ইঃসে)
[২] Medical Book of Forensic Medicine and Toxicology; Written by Reddy; 33rd edition; page: 65
[৩] সূরা বাকারাহ (২); আয়াত: ৩-৫
[৪] Langman’s Medical Embryology by Thomas W. Sadler PhD (13rd edition); chapter: Urogenital system development; page: 277
[৫] The Developing Human, Clinically Oriented Embryology By Dr. Keith L. Moore(8th edition); Page: 327
[৬] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2658794/
[৭] Langman’s Medical Embryology by Thomas W. Sadler PhD (12th edition); chapter: Urogenital system development; page: page: 248) 253-243)
[৮] Langman’s Medical Embryology by Thomas W. Sadler PhD (12th edition); chapter: Urogenital system development; page: 248) 253-243)
[৯] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2658794/
[১০] Developmental Biology by Scott F. Gilbert; 9th edition; page: 521
[১১] সূরা ফাতির (৩৫); আয়াত: ০৮
[১২] সূরা আল-ইমরান (০৩); আয়াত: ২৬
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।