এক হাজ্জে এলে সবার জীবন কীভাবে যেন সালাত কেন্দ্রিক হয়ে যায়। সারাদিনের যাবতীয় কার্যাবলি সালাতের সময়কে ঘিরে আবর্তিত হয়। হারাম শরীফে সালাত পড়লে সাধারণ সময়ের চেয়ে যেহেতু এক লক্ষ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়, তাই এখানে সবাই চেষ্টা করে জামাতে শরীক হতে। শুধু কিছু ব্যক্তির, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা ঘরেই নামাজ পড়ে নেন। কারণ হারাম শরীফের ‘হুদুদের’ (চারদিকের নির্ধারিত করে দেওয়া সীমা) ভেতর সালাত পড়লেই হারাম প্রাঙ্গণে সালাত পড়ার সাওয়াব অর্থাৎ এক লক্ষ গুণের অধিক সাওয়াব পাওয়া যাবে। যদিও মাসজিদুল হারামের জামাতে অংশ নিলে জামাতে সালাত আদায়ের সাওয়াবও এর সাথে যোগ হবে।

তাই যখন অনেককে ঘরে সালাত আদায় করতে দেখতাম, তখন মনের ভেতর বেশ খুঁত খুঁত করতো। মনে হতো কাবার এত নিকটে এসেও কীভাবে কারো ইচ্ছে হয় ঘরে বসে সালাত পড়ার! তবে অন্যদের প্রতি বিচারকের ভঙ্গিতে তাকানোর চেয়ে আমার মনে হয় নিজের দোষত্রুটি অনুসন্ধানে সময় দেওয়া উচিৎ ছিলো, কারণ একজন মুসলিম হয়ে অন্য একজন মুসলিমের ব্যাপারে কু ধারণা পোষণ করা কোনো অবস্থাতেই সঠিক নয়। কী প্রেক্ষিতে একজন ব্যক্তি কোনো কাজ করছে, তা আমরা নিজের অবস্থানে থেকে কখনোই সঠিকভাবে অনুমান করতে পারবো না। যে জন্য ইসলামে অনুমান করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

IIRT Arabic Intensive

আমার আশেপাশের যারা অনেক সময় বাইতুল্লাহর জামাতে শরীক হতে পারতেন না, হয়তো তাঁদের অনেকের বয়স বা অসুস্থতাজনিত কারণে একাধিকবার মাসজিদুল হারামে যাওয়া সম্ভব ছিলো না অথবা একাধারে বেশীক্ষণ মাসজিদে অবস্থান করাও অসম্ভব ছিলো। কে কোন নিয়তে হোটেল রুমে অথবা নিকটস্থ অন্যান্য মাসজিদে সালাত আদায় করছে, তা আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই ভালো জানেন।

সামনের দিনগুলোতে আমরা দুজন যে কত কম যেতে পারবো মাসজিদুল হারামে, তা যদি তখন জানতাম, তবে অন্যদের প্রতি সমালোচনামূলক চিন্তা করার আগে একবার ভেবে নিতাম!!

জেদ্দা থেকে আসার দুদিন পর শুক্রবার ছিলো। শরীর ভালে লাগছিলো না দেখে সেদিন জুমু’আর সালাতে গেলাম না। আমি বাংলাদেশ মিশনে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে আসলাম। আর সাফির সেদিন একাই জুমু’আয় গেলো। ও মাসজিদে যাবার পর আমি আমার রুমেই অবস্থান করলাম। মক্কায় আসার পর কখনো এই সময়ে জামাত বাদ দিয়ে নিজ রুমে থাকিনি। আমার চোখের সামনে হোটেলের প্রায় সবাই সালাতে চলে গেলো।

জুমু’আর দিন অনেকটা ঈদের দিনের মতো। অনেকে এদিন সূরাহ কাহফ তিলাওয়াত করেন। সুন্দর সময়ে সকলে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরে মাসজিদে যান। চারদিকে উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করে। আমাদের দেশে যারা অন্য সময় সালাত পড়ে না, তাদেরকেও দেখা যায় জুমু’আর দিন ঠিকই টুপি মাথায় দিয়ে মাসজিদে হাজির হতে।

সালাত শেষে ধীরে ধীরে সবাই হোটেলে ফেরত আসলো। আমার রুমমেটগণ তখন দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করছিলো আর আমি অপেক্ষা করছি, সাফির কখন আসবে। ওর আসার কোনো নামগন্ধ নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আমার ফোন বেজে উঠলো। সাফির ফোন করেছে। আমি হ্যালো বলতেই ও জানালো, আসার পথে গর্তে পা হড়কে পড়ে গোড়ালি মচকে গেছে। আমি যেন অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়ে রাখি ও কিছু বরফ প্রস্তুত করে রাখি পায়ে লাগানোর জন্য। আমি কিছু বোঝার আগেই ফোন রেখে দিলো।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বুক কাঁপতে লাগলো, হঠাৎ মনে হল মাথা আর কাজ করছে না। এক দৌড়ে নিচে নামলাম, রিসেপশনে বললাম অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে। আবার ওপরে উঠলাম বরফ জোগাড় করার জন্য। এই মচকানো পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হোটেলে ফেরত আসতে বেচারার অনেক দেরী হচ্ছে। এতদূর পথ, তার ওপর হারাম শরীফ থেকে আসার জন্য তেমন কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। হাজ্জের সময় সব রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে, গাড়ি-ঘোড়া চলার জন্য রাস্তা ফাঁকা থাকে না। তাই এখানে পদব্রজে না চলে উপায় নেই। কিন্তু হায়! আমার স্বামীর তো পা-টাই মচকে গেলো, এখন ও চলাফেরা করবে কী করে? আর আমিও মাহরাম ছাড়া চলাফেরা করবো কী করে! কী উপায় হবে আমাদের এখন!!

বহুক্ষণ পর অতি কষ্টে ও কোনোরকমে হোটেলে এলো। তার কিছুক্ষণ পর অ্যাম্বুলেন্সও চলে আসলো। আমরা দুপুরে খাবার সময় পাইনি দেখে রুমমেট রোকসানা আন্টি জোর করে আমার হাতে কিছু বিস্কিট আর শুকনো খাবার ধরিয়ে দিলেন। যেন অ্যাম্বুলেন্সে করে বাংলাদেশ মিশনের ডাক্তারের কাছে যাবার সময় আমরা দুজনে মুখে কিছু দিয়ে নেই। হিজরাহ রোডের বাংলাদেশ মিশনের অফিসে বাংলাদেশি হাজ্জ যাত্রীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ থেকে আগত ডাক্তার ও নার্সগণ সারাদিন ব্যস্ত থাকেন রোগীর ভিড় সামলাতে। এখানে অধিকাংশ রোগী হলেন বয়স্ক এবং কমন সমস্যা হলো ঠাণ্ডা, জ্বর, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপ। মক্কায় এসে অনেকে ঠাণ্ডা জমজমের পানি বেশি পান করে ঠাণ্ডা লাগিয়ে ফেলেন (মাসজিদের বিভিন্ন স্থানে বরফ শীতল ও সাধারণ তাপমাত্রার জমজম কূপের পানি বিশাল বিশাল জারে সংরক্ষিত থাকে), অতিরিক্ত খেজুর খেয়ে সুগার বাড়িয়ে ফেলেন আর সময়মতো ঔষধ খেতে ভুলে গিয়ে প্রেশার বাড়িয়ে ফেলেন এবং তাঁদের খামখেয়ালিপনার জন্য ডাক্তারদের পরামর্শের সাথে সাথে একগাদা ঝাড়ি খেয়ে ফেরত যান।

আমরা যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে সাফিরের পা ফুলতে শুরু করেছে। একজন ডাক্তার গরজহীন চেহারা নিয়ে ওকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো। সারাদিন রোগীর পঙ্গপাল সামলাতে সামলাতে রোগীদের প্রতি দরদ ও গরজ দেখানোর সময় আর তাদের নেই। সাফির জানালো মাসজিদের পাশে কন্সট্রাকশান চলার কারণে রাস্তায় কিছু গর্ত ছিলো। জুমু’আর জন্য মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে মাটিতে গর্ত নজরে আসেনি, ফলাফলস্বরূপ গর্তে পা হড়কে যায়। সব শুনে ভদ্রলোক এমনভাবে ওর দিকে তাকালো, যেন পা মচকানো অতি আনন্দদায়ক কোনো ঘটনা। এমন ঘটনা লক্ষ করে চিকিৎসক সাহেব ব্যাপক বিনোদন পাচ্ছেন। তাড়িয়ে তাড়িয়ে মজা নিতে নিতে আমাদের জানালেন, “আপনাকে অন্তত তিন সপ্তাহ সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে and your Hajj is at stake!”

বলেন কী ভদ্রলোক! হাজ্জের আর ১৪/১৫ দিন বাকি আর উনি বলছেন, ২১ দিন শুয়ে থাকতে হবে!!! তাও এরকম ভয়ঙ্কর কথা এত ব্যঙ্গাত্মক মনোভাব নিয়ে বলছেন!! দেশে থাকলে পা মচকে ৩/৪ সপ্তাহ বিছানায় পড়ে থাকা তেমন কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনা নয়। কিন্তু হাজ্জে এসে পা অচল হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে ভয়াবহ ব্যাপার। এই কথা শুনে আমার ভেতর একত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই অনুভূতি কাজ করল। প্রথম হলো ডাক্তারের ওপর প্রচণ্ড রাগ! আমাদের এই অবস্থা দেখে এমন গা ছাড়া তরল ব্যবহার করতে কি তার কমন সেন্সে বাঁধছে না?? দ্বিতীয় অনুভূতি হলো, এত কষ্ট করে এতদূর এসে যদি হাজ্জ করতে না পারি তাহলে কী হবে!! আতঙ্ক যেন দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে গেলো।

দুই ভিন্ন ধরনের প্রবল অনুভূতি একত্র হয়ে নারীদের কমন অস্ত্র অঝোরে কান্নায় পরিণত হলো। কান্নার দমকে রাগে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম যে, উনি কীভাবে এত আনন্দ পাচ্ছেন ও এমন অবিবেচকের মতোন আচরণ করছেন আমাদের সাথে! যারা আমাকে চেনে, তারা জানে আমার পক্ষে রাগে চিৎকার করা ও সেই সাথে কারো মুখের উপর এতগুলো কথা বলে বসা কী পরিমাণ অসম্ভব ব্যাপার!!

এবার ডাক্তার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। তিনিও হতচকিত হয়ে গেছেন আমার কাণ্ড কারখানায়। হঠাত তিনি খুব স্নেহ মাখা গলায় বলে উঠলেন যে, উনার আমার বয়সী ছোট বোন আছে। তাঁর ব্যবহারে আমি কষ্ট পেলে উনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তাঁর নিজেরও একবার পা মচকেছিলো সাফিরের মতোন। আর পা মচকানোর একমাত্র চিকিৎসা হলো পূর্ণ বেড রেস্ট। অর্থাৎ বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া আসলেই কিছু করার নেই। তাও আবার যেনতেনভাবে শুয়ে থাকা নয়, বালিশ অথবা শক্ত কিছুর উপর পা দিয়ে পা উঁচু করে শুয়ে থাকতে হবে। বাথরুম যাওয়া ছাড়া অন্য সময় পা নিচু করা যাবে না। তাহলে ফোলা কমতে দেরী হবে। হাঁটার চেষ্টাও করা যাবে না, তাহলে ব্যথা সহজে কমবে না।

সহৃদয় ব্যবহারে আমার মন কিছুটা শান্ত হলো। বাংলাদেশ মিশন থেকে সাফিরকে আব্দুল আযিয হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করে আসার জন্য রেফার করে দিলো। অর্থাৎ আগামীকাল বড় হাসপাতালে যেতে হবে। এক্সরে করলে করলে বোঝা যাবে কোথাও কোনো ফ্র্যাকচার হয়েছে নাকি।

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, আমাদের হাজ্জের কী হবে? এই অবস্থায় বিদেশ বিভূঁইয়ে আমরা কী করব এখন?

দুই আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম। পরিচিত সবাই অপেক্ষা করছিলো আমরা কখন আসবো এবং ডাক্তার কী বললো জানার জন্য। প্রতিদিন দেখা সাক্ষাত হওয়াতে চেনা পরিচিতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এমনিতেই কম বয়সী দম্পতি হিসাবে মোটামুটি অনেকের চোখেই পড়েছি। আমাদের প্রতি কীভাবে যেন তাদের মায়া পড়ে গিয়েছিলে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো সাহায্য করার জন্য। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা বৃদ্ধরা হাজ্জে আসেন। আমরা তাঁদের অধিকাংশের সন্তান বা নাতী নাতনীর বয়সী। সবাই আগ্রহ সহকারে দেখতো বাচ্চা বাচ্চা দুটো ছেলেমেয়ে কীভাবে আলহামদুলিল্লাহ্‌ হাজ্জে চলে এসেছে।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে যুবক বয়সে হাজ্জে আসা অচেনা ব্যাপার হলেও মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য অনেক দেশে এটি কোনো অদ্ভুত ঘটনা নয়, বরং অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এদেশে বসবাসরত এক ভদ্রলোককে একদিন এক চাচা আমাদেরকে দেখিয়ে বলছিলেন যে, আমরা হাজ্জ করতে এসেছি। এ কথা শুনে সেই ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে প্রশ্ন করেছিলেন, “কত নম্বর বার?” অর্থাৎ এটি আমাদের কত নম্বর হাজ্জ। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে ত্রিশ বছর হতে হতেই অনেকে একাধিকবার হাজ্জ করে ফেলেন এবং অসংখ্যবার উমরাহ্‌ করেন। আসলে সবই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা বৈ আর কিছুই নয়।

এদিকে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে আশেপাশের সকলে সমব্যথী হয়ে পড়লো। আমরা অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে চাইনি। কিন্তু এখন প্রতিটি কাজে অন্যের সাহায্য লাগছে। এসবের ভেতরও নিশ্চয় আল্লাহ্‌ আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রেখেছেন। তাঁর অশেষ কৃপায় পা মচকানো কোনো সাঙ্ঘাতিক অসুখ নয়, কিন্তু স্থান ও কালের গুরুত্বভেদে সাধারণ পা মচকে যাওয়া বিশাল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সাফিরের পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে এবং কিছু বেদনানাশক ঔষধ ও মলম দেওয়া হয়েছে। ফার্মেসী থেকে ওষুধ নিয়ে এলাম।

এতদিন আমরা যে নিয়মে চলছিলাম, তার আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো। আমাদের স্বাধীনচেতা জীবনে লাগাম লেগে গেলো। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া বন্ধ হলো। এক বেলা আমি দোকান থেকে খাবার নিয়ে আসতাম ও অন্য বেলা রুমমেট আপাদের সাথে ভাগে খাবার খাওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। বিনিময়ে আমি মাঝেমাঝে চাল ধুয়ে দিতাম, সবজি কেটে দিতাম ও কাঁচাবাজার করে দিতাম। এদেশে এসেও আমাকে সেই কাঁচাবাজারেই যেতে হলো!! দেখা গেলো “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে”, প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।

পরদিন অ্যাম্বুলেন্সে করে সাফির আর আমি কিং আব্দুল আযিয হাসপাতাল অভিমুখে রওনা হলাম। এ হাসপাতালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজ্জ যাত্রীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ মিশন থেকে আমাদের এক বাঙালি তরুণের ফোন নাম্বার দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, তিনি মাদ্রাসা থেকে স্কলারশিপে সৌদি আরবে পড়াশোনা করতে এসেছেন। হাজ্জের সিজনে এই হাসপাতালে অসুস্থ হাজীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকেন। যেমন ডাক্তারদের সাথে দোভাষীর কাজ চালানো, বিশাল এই চিকিৎসালয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এক কথায়, অপরিচিত স্থানে নিজ দেশের মানুষদের সাহায্য করার জন্য সেই তরুণ তার সাধ্যমত চেষ্টা করে থাকেন।

আমাদের ফোন পেয়ে অল্প বয়সী, মুখে একমুষ্টি পাতলা দাড়ি, ঢিলেঢালা জোব্বা পরিহিত এক ছোটখাটো কাঠামোর তরুণ এসে আমাদের সালাম দিলো ও হাসপাতালের গেটে এসে সাফিরকে হুইল চেয়ারে করে ভেতরে নিয়ে গেলো। ২৬/২৭ বয়সী এই ছেলেটি অসম্ভব বিনয়ী ও স্বল্পভাষী, কিন্তু একই সাথে প্রচণ্ড কর্মপটু। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমাকে অপেক্ষাগারে বসিয়ে ওকে এক্সরে করাতে নিয়ে গেলো।

আমি দীর্ঘ সময় ধরে বসে আছি, ওদের এতক্ষণ লাগছে কেন বুঝতে পারছি না। যেকোনো হাসপাতালে গাইনি ওয়ার্ড ছাড়া আর সর্বত্রই মন খারাপ করা পরিবেশ বিরাজ করে। চারিদিকে রোগীদের গোঙানি কিংবা রোগীর নিকটাত্মীয়দের পাংশু মুখ। দুজন রক্তাক্ত ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারার রোগী দেখলাম, একজন বৃদ্ধ ও অপরজন কিশোর। তাদের কষ্ট দেখে মনে হলো পা মচকানো কত সাধারণ একটি অসুখ, আল্লাহ্‌ কতই না দয়ালু। আর এতেই আমরা এত বিচলিত হয়ে যাচ্ছি। অথচ এই রোগীগণও হয়তো হাজ্জে এসেছেন। তাঁদের উপর দিয়ে কত বড় পরীক্ষা চলছে!!

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ছেলেটি সাফিরকে ফেরত আনলো ও অতি উচ্ছল এক ডাক্তারকে সঙ্গে করে ধরে নিয়ে এলো। ডাক্তার এসে রোগী দেখে এক হাস্যকর মন্তব্য করলো। বললো, আপনি তিনদিন পর থেকেই হাঁটতে পারবেন। যেন পা মচকে যাওয়া দাঁত ফেলার চেয়েও মামুলি ব্যাপার!!! আমাদের দেশি ডাক্তারের পুরো উল্টো মন্তব্য। পায়ের যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তিনদিন পর থেকে হাঁটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পরবর্তীতে অন্য ডাক্তারের কাছে শুনেছি সৌদিতে প্রচুর মিশরীয় চিকিৎসক আছেন, যারা চিকিৎসা বিদ্যায় অতীব অপটু। (তা তো দেখতেই পাচ্ছি!!)

যা হোক, এক্সরেতে দেখা গেলো কোনো ফ্র্যাকচার নেই। তাই প্লাস্টার করা লাগবে না। তবে তিন সপ্তাহ বেড রেস্ট থেকে মুক্তি নেই। কারণ বিশ্রামই এখন এক মাত্র ঔষধ। হাসপাতালের কাজ শেষ হবার পূর্বে সাফিরকে আমি বললাম, মাদ্রাসার এই ছেলেটিকে কিছু অর্থ সাহায্য করতে। কারণ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো বাংলাদেশের কোনো দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মনে হয় না এদেশেও খুব একটা সচ্ছলতার মাঝে আছে। সাফির পরে আমাকে জানালো যে, কিছুতেই তাকে একটি টাকাও দেওয়া যায়নি।

সম্পূর্ণ আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে যে কাজ করছে, তাকে সামান্য অর্থ সাহায্য দিয়ে প্রতিদান দেবার ক্ষমতা কি আমাদের আছে!! নত দৃষ্টিতে কথা বলা সাধারণ চেহারার এই মানুষটিকে রাস্তায় কখনো দেখলে সম্ভবত চিনতেও পারবো না, কিন্তু আল্লাহ্‌ নিশ্চয় তার এই বান্দার সমস্ত ভালো কাজের পূর্ণ হিসাব রাখবেন ও মানুষের প্রতি তার এই নিঃস্বার্থ সেবার উত্তম বিনিময় প্রদান করবেন।

সৌদি হাসপাতালের ডাক্তারদের একজন নমুনা দেখেই শিক্ষা হয়ে গেছে। এখন কাছাকাছি কোনো সত্যিকারের ডাক্তার পেলে সুবিধা হতো। মনে পড়ে, একদিন লিফটে করে ওঠার সময় সাথের মানুষদের কথোপকথন কানে আসছিলো। সেখানে একজন কোনো এক কথাপ্রসঙ্গে “ডাক্তার ভাবী” শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। মস্তিষ্কের কোন এক গোপন কুঠুরি থেকে হঠাৎ সেই বিক্ষিপ্ত স্মৃতি খোঁচা দিয়ে উঠলো। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন, বাবার বন্ধু-বান্ধব, পাড়া- প্রতিবেশী সবাই আমার মা-কে ডাক্তার ভাবী বলে ডাকতেন। তার মানে এই হোটেলে যদি কোনো ডাক্তার ভাবী থাকেন, তাহলে তাঁর সঙ্গী হিসাবে ডাক্তার স্বামী বাবাজীর থাকার সম্ভাবনা প্রচুর। সম্ভাবনা একশত ভাগ না থাকলেও আশি ভাগ তো অবশ্যই।

অর্থাৎ, পুরো এগার-তলা হোটেলের কয়েকশত বাঙালি হাজ্জ-যাত্রীর মাঝে নিশ্চয় আমার সেই আকাঙ্ক্ষিত ডাক্তার সাহেব লুকিয়ে আছেন এবং তাঁকে যেকোনো উপায়ে খুঁজে বের করতে হবে। আবার এমনও হতে পারে “ডাক্তার ভাবী” নামক মহিলা স্বামী ছাড়া অন্য কারো সাথে এসেছেন অথবা স্বামীর সাথে আসলেও দেখা গেলো তাঁর স্বামী একজন বিশিষ্ট পশু ডাক্তার!! কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেবার মতোন নয়। যাই হোক, কানে উড়ে আসা তথ্যের উপর ভিত্তি করে ডাক্তার খোঁজার অভিযান শুরু হলো।

সবার আগে গেলাম রিসেপশনে, সেখানে গিয়ে জানতে চাইলাম এই হোটেলে কোনো বাঙালি ডাক্তার উঠেছেন কি না। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানালেন, তাঁদের জানামতে একজন ডাক্তার উঠেছেন। তাঁর রুম নাম্বার জানতে চাইলাম। আমাকে জানানো হলো উনি পাঁচ তলার একটি কক্ষে উঠেছেন। আমি এ কথা শুনে চরম আশ্চর্য হলাম, কারণ আমাদের রুমও পাঁচতলায়!!! কিন্তু আশ্চর্য হবার মতো আরো কিছু জিনিস বাকি আছে এখনো। খুঁজতে গিয়ে বের হলো, সেই ডাক্তার ভাবী থাকেন আমার ঠিক সামনের রুমে, যার সাথে আমার আগেও অনেকবার কথা হয়েছে, যদিও উনার পরিচয় জানতাম না। উনার স্বামী ডাক্তার জাহান, সাফিরের এক রুম পরে থাকেন!!!

এতদিন টাক মাথার (এখানে যদিও সবাই টাক মাথার!) সাদা হাফ হাতা স্যান্ডো গেঞ্জির সাথে সবুজ কুরশি কাটারের টুপি ও টুপির সাথে ম্যাচিং করা সবুজ রঙের লুঙ্গি পরা এই ডাক্তার জাহানকে দিনের ভেতর কত বার দেখেছি, তার হিসেব নেই। কিন্তু তখন তো আর জানতাম না উনি পেশায় চিকিৎসক! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ভদ্রলোক যে সে ডাক্তার নন। একেবারে পঙ্গু হাসপাতালের অর্থোপডিক বিভাগের একজন ডাক্তার!!! আমার বিস্মিত হবার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে মনে হয়। দুনিয়ায় এত রোগের ডাক্তার থাকতে এই পুরো হোটেলের একমাত্র ডাক্তারটি একজন অর্থোপেডিক অর্থাৎ হাড্ডি ভাঙা/ মচকানো ইত্যাদি বিশেষজ্ঞ!! এবং তিনি আর কোথাও নন, সাফিরের এত কাছের রুমে থাকেন!!!

সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র, যিনি মানুষকে বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং অবশ্যই আশাতীত উপায়ে সাহায্য করেন। আমরা এখানে আল্লাহ্ পাকের মেহমান, তাঁর পবিত্র গৃহ দেখতে ও তাঁর নির্দেশ মেনে তাঁরই অনুগ্রহে হাজ্জ করতে এসেছি। যেখানে আমরা সহ সমস্ত সৃষ্টিকূল উনার রহমতের আধারে ডুবে থাকি, সেখানে উনার আশিস প্রাপ্ত গৃহের মেহমানদের প্রতি উনার সাহায্যের দ্বার নিশ্চয় সর্বদা আরো বেশি অবারিত থাকবে। আমরা আল্লাহ্‌র কোন নিয়ামতটি অস্বীকার করবো?

পঙ্গুর ডাক্তার জাহান সাহেব সাফিরকে দেখে জানালেন, তিন সপ্তাহ বেড রেস্টের সাথে সাথে প্রতিদিন দু/তিন বেলা গরম পানিতে সেঁক দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। পা কিছুতেই নিচু করা যাবে না, ফলে হুইল চেয়ারে করে হারাম শরীফে যাবার ইচ্ছাও বাতিল হলো। ৭/৮ দিন পর ফোলা কমলে হুইল চেয়ারে করে ঘর থেকে বের হতে পারবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে বেশিক্ষণ যেন পা মাটির দিকে ঝুলে না থাকে। উনার উপদেশে অনুযায়ী চিকিৎসা চলতে থাকলো।

এদিকে এক নতুন সমস্যার উদ্ভব হলো। সাফিরকে খাবার, ঔষধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দেবার জন্য আমাকে দিনের ভেতর বহুবার ওর কক্ষে প্রবেশ করতে হচ্ছিলো। কিন্তু সেখানে আরো তিনজন পুরষ থাকেন বিধায় আমি ভেতরে গেলে উনাদের এবং আমার উভয় পক্ষের জন্যই তা অস্বস্তির কারণ হয়ে যেত। তাই অপেক্ষা করে থাকতাম, উনারা যখন জামাতে বের হতেন, তখন আমি রুমে যেতাম ও প্রয়োজনীয় খাবার দাবার ঔষধ দিয়ে আসতাম। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ চলা যায়! ওর কখন কী দরকার হয়, তার তো কোনো ঠিক নেই।

তখন আমাদের দুই রুমের সকলে মিলে চিন্তা করলো, এর একটা বিহিত করা দরকার। হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হলো যদি কোন কামরা খালি থাকে, তাহলে তা আমাদের কিছুদিনের জন্য দেওয়া যাবে কি না। কর্তৃপক্ষ জানালেন, একটি কামরা দেওয়া যাবে, সেই কামরাটি ভিআইপি প্যাকেজের হাজীদের জন্য। আট দিন পর ভিআইপি প্যাকেজের যাত্রীগণ আসা শুরু করবেন, তখন আমাদের রুম খালি করে দিতে হবে। এত বড় খুশির সংবাদে আমি আনন্দে দশখানা হয়ে গেলাম। আগামী এক সপ্তাহ যদি আমরা একত্রে থাকতে পারি, তা-ই বা কম কীসের? আশা করি ততদিনে সাফির উঠে দাঁড়াতে পারবে এবং নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিজে করতে পারবে। তাই আমরা হোটেল ওয়ালাদের প্রস্তাব সানন্দে মেনে নিলাম। পা মচকানোর উসিলায় আল্লাহ্‌ আমাদের এক লাফে ভিআইপি রুমে ট্রান্সফার করে দিলেন!

সেদিনই আমরা আমাদের লাগেজ নিয়ে ওই রুমে শিফট হয়ে গেলাম। দুপুরে আমার রুমমেটদের সাথে খাবার খেতাম। বাজার ও রান্না করার সমস্যার কারণে খাবার দাবার অত্যন্ত মেপে মেপে রান্না করা হতো। একটি মুরগী বহু ছোট ছোট টুকরায় বিভক্ত হতো, ডাল আলু ইত্যাদি দ্বারা তরকারির পরিমা  বৃদ্ধি করা হতো। আমার খানা নিয়ে অত বাছ বিচার নেই, পেট ভরলেই হলো। তাই আমি সবই খেতাম। তাছাড়া হাঁটাহাঁটির কারণে হয়তো তখন আমার রাক্ষুসে ক্ষুধা পেত এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, স্বল্পাহারী আমি হঠাৎ ভাতের প্রতি চরমভাবে আসক্ত হয়ে গেছি। শুধু ডাল দিয়ে ও নামমাত্র তরকারি দিয়েও আমি গোগ্রাসে একগাদা ভাত খেয়ে ফেলতাম।

কিন্তু সাফির সাহেবের এত রেশনিং করে খাবার অভ্যাস নেই। বেশির ভাগ দিন বিরস বদনে খেত কিংবা ওর জন্য অন্য কিছু নিয়ে আসতে হতো দোকান থেকে। রাতে সালাত শেষ করে খাবার কিনে বাসায় আসতাম। প্রতিদিন বের হবার আগে ও ছেলেমানুষের মতো ফরমায়েশ দিতো, কোন রেস্টুরেন্টের কোন খাবার নিয়ে আসতে হবে। আমিও ইশার সালাত পড়ে ছুট লাগাতাম আমাদের মক্কার আবাসের দিকে। পথের দোকান থেকে একেক দিন একেক খাবার নিয়ে যেতাম। দেশি খাবারের জন্য সবচেয়ে ভালো ছিলো হারাম শরীফের প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের ‘এশিয়ান’ হোটেল।

খাবার দাবার নিয়ে অবশ্য আমাদের বেশিদিন চিন্তা করতে হলো না। সমস্ত সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক, আর-রাযযাক আমাদের জন্য অভাবনীয় সব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণের রিযিক বরাদ্দ করলেন। নানা রকম মজাদার খাদ্যে আমাদের ঘর পূর্ণ হয়ে যেতে লাগলো। মক্কায় আমার শ্বাশুড়ির মামাতো ও চাচাতো ভাই বাস করেন। জেদ্দার শাহজাহান ও আলমগির চাচা তো আছেনই। উনাদের সবাইকে ঢাকা থেকে ফোন করে জানানো হলো সাফিরের অসুস্থতার খবর এবং তাঁদের বিশেষ করে অনুরোধ করা হলো আমাদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য।

এমনিতেই চট্টগ্রাম এলাকার মানুষ অতিথিপরায়ণতার জন্য বিখ্যাত এবং আল্লাহ্‌র ঘরের মেহমানদের জন্য কিছু করার সুযোগ পাওয়াকে সবাই সৌভাগ্য মনে করেন। এখন যদি এই মেহমান অসুস্থ হয় এবং ভাগিনা হয়, তাহলে তাকে ভালোবাসার জন্য মামা-চাচারা বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে না, তা কি সম্ভব!

প্রথম দিন এলেন মোসাদ্দেক মামা, আমাদের আগেই জানানো হয়েছিল উনি আসবেন। কিন্তু বহু বছর ধরে মক্কানিবাসী হওয়ার দরুন সাফির বুদ্ধি হবার পর উনাকে কখনো দেখেনি। আমার তো দেখার প্রশ্নই আসে না। আমরা উনাকে যেমন দেখিনি, উনিও আমাদের দেখেননি। যার অর্থ আমরা কেউ কারো চেহারা চিনি না। জীবনে না দেখার পরও উনাকে চিনতে কোনো সমস্যা হলো না। কারণ একদিন সন্ধ্যার সময় দেখি অবিকল আমার নানি শ্বাশুড়ির চেহারার, আজানুলম্বিত সফেদ জোব্বা পরিহিত শুভ্র লম্বা দাড়িওয়ালা একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন হোটেলের লবিতে এবং এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন ও কোনো একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

আমি এক দৌড়ে গিয়ে সালাম দিলাম ও জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মোসাদ্দেক মামা? উনি তাজ্জব হয়ে গেলেন, বলা নেই কওয়া নেই কোথা থেকে এক মেয়ে এসে তাঁকে চিনে ফেললো!! মোসাদ্দেক মামা মক্কায় হোটেল ব্যবসা করতেন। কিন্তু ‘একামা’ (মক্কার ওয়ার্ক পারমিট সংক্রান্ত কাগজ) জটিলতার কারণে বর্তমানে ব্যবসার খারাপ সময় চলছে, তাই দেশে যেতে পারছেন না। সেদিনের পর থেকে উনি আমাদের নিয়মিত দেখতে আসতেন। প্রতিবার আসার সময় প্রচুর ফলমূল, বিস্কিট, জুস নিয়ে আসতে ভুলতেন না। একদিন বিশাল এক টিফিন কেরিয়ার ভরে দারুণ স্বাদের উটের গোস্ত ভুনা, মাছের লোয়াব ইত্যাদি খাবার দাবার নিয়ে আসলেন। সেইসব খাবার সাফির ও আমাদের প্রাক্তন রুমমেটদের সবাইকে নিয়ে খাওয়ার পরও শেষ করতে কয়েকদিন লেগেছে। উনি ইচ্ছা করেই বেশি করে আনতেন, যেন সবাইকে নিয়ে মিলে মিশে খেতে পারি।

এরপর একদিন আসলেন ঝিলু মামা। তিনি আমার শ্বাশুড়ির চাচাতো ভাই। মক্কায় নিজস্ব দোকান আছে। তিনিও খালি হাতে আসতেন না। পারলে পুরো দোকান উঠিয়ে নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন ফ্লেভারের জুসের ক্যান, ভেতরে খেজুর দেয়া বিস্কিট, কাপ কেক, পাউরুটি, জ্যাম, সাবান, শ্যাম্পু, কাপড় ইত্যাদি জিনিস দিয়ে আমাদের হোটেল রুম ও ফ্রিজ ভরিয়ে ফেলতে লাগলেন। উনার আনা খাবার দাবার আমাদের দুজনের পক্ষে খেয়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। তাই যেগুলো বেঁচে গিয়েছিলো, সেগুলো অন্যদের জন্য গিফট হিসেবে দেশে নিয়ে এসেছিলাম।

উনি বেড়াতে এসে সৌদিদের নিয়ে মজার মজার গল্প বলতেন। তাঁর ধারণা মতে সৌদিদের মাথায় প্রচুর বুদ্ধি, কিন্তু তারা সেই বুদ্ধির চর্চা করে না!! অঢেল অর্থ কড়ি দ্বারা আয়েশি জীবন যাপন করতে করতে এবং না চাইতেই সব পেতে পেতে এদের বুদ্ধিমত্তার চর্চা করার তেমন প্রয়োজনও পড়ে না!!!

ঝিলু মামা সাধারণত ভোর সকালে বেড়াতে আসতেন। যেমন, একদিন সকাল সাতটায় এসে আমাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলেন। আমাদের সাথে সকালের নাস্তা খেলেন। গল্প করার এক পর্যায়ে গলার স্বর নিচু করে খুব সিরিয়াস গলায় বললেন, এখানে এক নাইজেরিয়ান ‘বাবা’ (সাধু) আছে খুব ভালো ঝাড়ফুঁক করে। আমরা যদি চাই, উনি আমাদেরকে সেই ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাবেন সাফিরের পা ঝেড়ে দেবার জন্য!!!! তাহলে যদি সাফির তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়, এই আশায়!!

উনার কথা শুনে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। বলে কী মামা! মক্কাতেও ঝাড়ফুঁক, তাও আবার নাইজেরিয়ান বাবার হাতে!! অচেনা কেউ সাফিরকে ঝাড়ফুঁক করবে আর আমি বসে বসে দেখবো! আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই আর কি। সেই ব্যক্তি যে শির্কি কথা দিয়ে ঝাড়ফুঁক করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? মামা সরল বিশ্বাসে আমাদের বুদ্ধি দিতে গিয়েছিলেন, সাফির কৌশলের সাথে এড়িয়ে গেলো। উনাকে জানালো, ওর পক্ষে লিফট দিয়ে নিচে নামাও সম্ভব নয়, তাই নাইজেরিয়ান বাবার কাছে কী করে যাবে! মামা দেখলেন তাই তো, এই ছেলেকে যেখানে হোটেলে থেকে বের করা মুশকিল সেখানে অন্য কোথাও নেয়া একদম অসম্ভব। তাই মামা হতদ্যোম হয়ে ফেরত গেলেন।

ঝিলু মামা যেমন সাত সকালের অতিথি ছিলেন, শাহজাহান ও আলমগির চাচারা ছিলেন একেবারে উল্টো। তাঁরা ছিলেন নিশুতি রাতের মেহমান। মাঝে মাঝে রাত এগারটা-সাড়ে এগারটার দিকে গাড়ি চালিয়ে আদরের ভাতিজাকে দেখতে চলে আসতেন। সাথে থাকতো ভাতিজার জন্য চকোলেট ও বউমার জন্য আইসক্রিম ও অন্যান্য হরেক রকম খাবার। উনাদের চকোলেট ও আইসক্রিম আনার বহর দেখে বোঝা যায়, চাচা-মামাদের কাছে আমরা চিরকাল ছেলেমানুষ হয়েই থাকবো, কখনো বড় হবো না।

আত্মীয়দের পাশা পাশি অনাত্মীয়রাও ভালোবাসার জোয়ারে আমাদের ভাসিয়ে দিলেন। হোটেলের লবিতে, লিফটে সর্বত্র আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করতে থাকলেন সাফির কেমন আছে, হাঁটতে পারছে কি না, কিছু দরকার হলে যেন উনাদের বলি। এয়ারপোর্টে প্রথমদিন যে অস্থিরমতি লুতফর আঙ্কেলের সাথে পরিচয় হয়েছিলো, উনি আমার সাথে এমনভাবে কথা বলতেন, যেন আমি উনার কন্যা-সম। দেশে ফেরত আসার পরও সাফিরকে উনি বাসায় এসে দেখে গেছেন। উনার স্ত্রীও স্বামীর মতো সহজ সরল ভালো মানুষ। তাই তাঁর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে তেমন বেগ পেতে হয়নি।

আমাদের হোটেলের ক্লিনার ছেলেটির সাথে সবার অনেক গল্প হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে মক্কায় বেশিদিন থাকলে মানুষ ধন-সম্পদ উপার্জনের পাশাপাশি আকিদা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করে। এই ক্লিনার ছেলেটিরও সহীহ আকিদা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে এবং তার থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। একদিন আমাদের সে জানালো এই হোটেলের ছাদে একটি হুইল চেয়ার পড়ে আছে। অনেক পুরানো, কিন্তু চাইলে আমরা ব্যবহার করতে পারি। তারপর সে কোথা থেকে এক হুইল চেয়ার জোগাড় করে নিয়ে আসলো, যার এক পায়ের দিকে পলিথিনের প্যাকেটের গিঁট দিয়ে জোড়া লাগানো। পুরানো হলেও হাজ্জ পর্যন্ত কাজ চলবে আশা করি। সাফিরের পায়ের ফোলা কমলে ওকে নিয়ে হুইল চেয়ারে করে হারাম শরীফে সালাতে যাওয়া যাবে।

এভাবে অল্প কিছুদিনের ভেতর আল্লাহ্‌ আমাদের খাবারের রিযিক বহুগুণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি একটি হুইল চেয়ারও মিলিয়ে দিলেন। আল্লাহ্‌ একটি বিপদ দিলেন সত্যি, কিন্তু সেই বিপদের বিনিময়ে দিলেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা, ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক এবং সর্বোপরি আল্লাহ্‌কে চেনার ও তাঁর নেয়ামতের প্রতি শুকরিয়া জানানোর সুযোগ।


পরবর্তী পর্ব: হাজ্জের আগে শেষ জুমু’আ

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive