বিশ্ব জুড়ে দিবস আর দিবস। সামান্য/ফালতু কিছু নিয়েই শুরু হয়ে যায় দিবস পালন। সামান্য/ফালতু কেন বলছি, জানেন? এই তো “কিস ডে” “চকলেট ডে” “হাগ ডে”র কথাই ধরুন। নানান দিবসের ঘুরপাকে আমরা জানতে পারি মা-বাবা দিবসের কথা। এই দিবসটা অন্যান্য দিবসের চাইতে একটু বেশি ইমোশনাল। কারণ টপিকটাই ইমোশনাল। তাই এই দিবসের কথা শুনলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ি পশ্চিমা অনুকরণে  উদযাপন করতে। কিন্তু খুব কম মানুষেরই জানা আছে এই দুইটি দিবসের ইতিহাস। আর মুসলিমদের জন্য এই দুইটি দিবস অপ্রয়োজনীয়। একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কেন বলছি? পড়তে থাকুন, জানতে পারবেন।

সেকুলারদের দৃষ্টিকোণ থেকে মা-বাবার খেদমত একটি ঐচ্ছিক ব্যাপার। গা ছাড়া ভাব টাইপ। করলে করলাম, না করলে নাই। সেকুলারদের মতে, আমরা দুনিয়াতে এসেছি মা-বাবার sexual desire পূরণের মাধ্যমে। এবং বৃদ্ধকালে যাতে তাঁদের দেখাশুনা করতে পারি, সে জন্যে। পুরোটাই তাঁদের নিজস্ব ফায়দা পাবার জন্যে। তাই তাদের কাছে মা-বাবার খেদমত গুরুত্বহীন না বললেও, তেমন গুরুত্ব নেই – তা বলাই বাহুল্য। বাবা-মা সন্তানকে শিশুকালে এত কষ্ট করে লালন-পালন করেছেন, এর প্রতিদান দিতে বলেও লাভ নেই। পাল্টা যুক্তি আসবে “আমি কি বলেছি আমাকে জন্ম দিতে?” যুক্তির বিচারে তাই সন্তানের কাছে থেকে কোনো খেদমত বাবা-মায়ের ‘প্রাপ্য’ নয়, পুরোটাই সন্তানের ‘দয়া’।

IIRT Arabic Intensive

তাদের এহেন নৈতিকতার অধঃপতন দুনিয়ার সামনে ঢাকতে তারা ধার করে পৌত্তলিকদের কাছে থেকে কিছু দিবস/উৎসব। আর সেই দিনটিকে ঘিরে নানান আয়োজন সহ ঘটা করে পালন করে দুনিয়ার সামনে দেখাতে চায়, “আমাদের থেকে মানবতায় আর কারা এগিয়ে!?”

কিন্তু মুসলিম এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাকে হুকুম দিয়েছেন যে, পিতামাতার খেদমত করতেই হবে। কোনো যুক্তিতর্কের প্রয়োজন নেই। সেই জন্যই মুসলিমরা তাদের মা-বাবাকে খেদমত করে থাকে যথাযথ আগ্রহ ও গুরুত্ব দিয়ে।

ইতিহাস

মা দিবসের দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রীসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে, যেখানে গ্রীক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশ্যে পালন করা হতো একটি উৎসব। এশিয়া মাইনরে মহাবিষ্ণুবেরর সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অফ মার্চ (১৫ই মার্চ) থেকে ১৮ই মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি পালিত হতো।

প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিলো, যদিও সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হতো।[১]

অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে পিতৃ দিবস পালন শুরু হয়। আসলে মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল – এটা বোঝানোর জন্যই এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর সব বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকে যার শুরু। ধারণা করা হয়, ১৯০৮ সালের ৫ই জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় এই দিনটি প্রথম পালিত হয়।[২]

মুসলিমদের জন্য দিন নির্ধারণ করে সম্মান প্রদর্শন করা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। কারণ তাদের কাছে আছে জীবন বিধান। তাই অন্য সম্প্রদায়ের অনুকরণ তাদের নিষ্প্রয়োজন। একজন মানুষের ঘুম থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য যে সমস্ত জ্ঞান দরকার, তা আছে কুরআন-সুন্নাহয়। এবং সেই জ্ঞান কোনো মানুষের পক্ষ থেকে আসেনি। এসেছে মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট হতে।

আল্লাহ আসমান ও জমিনের অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। তিনি অন্তরের বিষয় সম্পর্কেও সবিশেষ অবহিত। [সূরাহ ফাতির (৩৫):৩৮]

তিনিই আল্লাহ তা’আলা, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই; তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যকে জানেন; তিনি পরম দয়ালু, অসীম দাতা। [সূরাহ আল-হাশর (৫৯):২২]

মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের সামনে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন। [সূরাহ আল-হুজুরাত (৪৯):১]

মুসলিম উম্মাহর কাছে সেই জ্ঞান এসেছে মুহাম্মাদ ﷺ এর মাধ্যমে। আর মুহাম্মাদ ﷺ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন কীভাবে মা-বাবাকে যথাযথ সম্মান করতে হয়।

মাবাবার প্রতি সদ্বব্যবহার

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো। [সূরাহ বানী ইসরাঈল (১৭): ২৩]

এখানে কোনো দিন-তারিখ ঠিক করে দেওয়া হয়নি যে, আজ তাঁর সাথে ভালো ব্যবহার করবে বা কাল তাঁকে বেশি সম্মান করবে – এমনটা না। বলা হয়েছে পুরো জীবদ্দশায় সদ্ব্যবহার কর। হায়! এরপরও যদি আমরা বুঝতাম, এর চেয়ে বেশি সম্মান মা-বাবার জন্য আর কী হতে পারে! স্বয়ং আল্লাহ্‌ পাক তাঁদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে বলেছেন। তাই একজন মুসলিমের কাছে প্রতিদিনই তার জন্য মা-বাবা দিবস। আলাদা কোনো ডেট ফিক্স করা লাগে না। কারণ সে প্রতিদিন তাঁদের সাথে ভালো আচরণ করবে, যেমনটি আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেছেন।

আল্লাহ্‌ অন্যত্র আরও এরশাদ করেন,

আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। [সূরাহ লুকমান (৩১) : ১৪]

আল্লাহ্‌ এখানে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের ও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশ দিয়েছেন। যে পিতামাতার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না, তাতে আল্লাহ্‌র কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করা হয় না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

যে কেউ মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ হয় না, সে আল্লাহ্‌র কাছেও কৃতজ্ঞ হতে পারে না। [তিরমিযী, ১৯৫৪]

সদ্ব্যবহার পেতে কে অগ্রগণ্য পিতা নাকি মাতা?

হাকীম ইবনে হিযাম (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন,

আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সদ্ব্যবহার পেতে কে অগ্রগণ্য?’ তিনি বলেন, ‘তোমার মা।’ আমি বললাম, ‘তারপর কে?’ তিনি বলেন, ‘তোমার মা।’ আমি বললাম, ‘তারপর কে?’ তিনি বলেন, ‘তোমার মা।’ আমি বললাম, ‘তারপর কে?’ তিনি বলেন, ‘তোমার পিতা, তারপর ক্রমান্বয়ে আত্মীয়ের সম্পর্কের নৈকট্যের ভিত্তিতে।’ (দারিমী, তিরমিযী, হাকিম)

তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করলে আয়ু বৃদ্ধি পায়। যেমন হাদীসে এসেছে, নবী ﷺ বলেছেন,

যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করলো, তার জন্য শুভ সংবাদ। আল্লাহ তার আয়ুস্কাল বৃদ্ধি করেন। (হাকিম, তাবারানী, মুসনাদ আবু ইয়ালা)

পিতা-মাতার অসন্তুষ্টি আল্লাহ্‌র অসন্তুষ্টি

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং প্রতিপালকের অসন্তুষ্টি  পিতার অসন্তুষ্টিতে। (তিরমিযী, ১৮৯৯)

অত্র হাদীসে বলা হয়েছে রবের সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে, অনুরূপভাবে রবের অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে। উলামায়ে কিরাম বলেন, ঠিক এরূপ কথাই মাতার সম্পর্কে প্রযোজ্য, বরং তাঁর অধিকার আরো বেশি।

তাঁদের অবাধ্য হওয়া কবীরা গুনাহ ও জান্নাত যাওয়ার পথে অন্তরায়

রাসূল ﷺ বলেছেন,

বড় বড় কবীরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা কসম করা। (বুখারি)

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূল ﷺ বলেছেন,

নেশাদার দ্রব্য পানকারী জান্নাতে যাবে না। পিতামাতার অবাধ্য ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। খোঁটা দানকারী জান্নাতে যাবে না। (তারগীব, হা/২৩৬৩)

এমনকি তাঁদের (পিতা-মাতা) খেদমত করার জন্য আল্লাহ্‌র রাসূল ﷺ একবার এক সাহাবিকে ইকদামি জিহাদে (যেখানে মুসলিমরা আগ বাড়িয়ে কাফিরদের আক্রমণ করে) যেতে অনুমতি দেননি। অথচ ইসলামে জিহাদের মর্যাদা কত, তা তো বলাই বাহুল্য। হাদীসে এসেছে,

‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

এক ব্যক্তি নবীর ﷺ নিকট এসে জিহাদে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করলো। তখন তিনি বললেন, ‘তোমার পিতামাতা জীবিত আছে কি?’ সে বললো, ‘হ্যাঁ।‘ নবী ﷺ বললেন, ‘তবে তাঁদের খিদমতের চেষ্টা কর।’ [বুখারি, ৫৯৭২]

পিতা-মাতার খেদমত আল্লাহ্‌র কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল

‘আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত,

আমি নবী ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলাম, “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল কী?” তিনি বলেন, “ওয়াক্ত মতো সালাত পড়া।” আমি বললাম, “তারপর কোনটি?” তিনি বলেন, “পিতা-মাতার সাথে সদাচার।” আমি বললাম, “তারপর কোনটি?” তিনি বলেন, “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ।”

রাবী বলেন, “তিনি আমাকে এইসব বিষয়ে বললেন। আমি আরো জিজ্ঞেস করলে তিনি অবশ্যই আমাকে আরো বলতেন।” (বুখারি, মুসলিম, দারেমী, তিরমিযী, নাসাঈ)

সন্তানের দায়িত্ব

সন্তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাঁদের সাথে সর্বাবস্থায় সদ্ব্যবহার করা ও তাঁদেরকে ভরণপোষণ করা, যথাযথ টেক কেয়ার করা। এবং তাঁদের জীবদ্দশা ও মৃত্যুতে দু’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। যেমনটি আল্লাহ্‌ আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন,

 رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

আয়াতের অর্থ:  হে পালনকর্তা, তাঁদের উভয়ের প্রতি রহম করুন, যেমন তাঁরা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।  [সূরাহ বানী ঈসরাইল (১৭):২৪]

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

জান্নাতে মহান আল্লাহ্‌ নেক বান্দার স্তর উঁচু করে দেবেন। সে বলবে, “হে প্রতিপালক, কীসের বিনিময়ে আমার এ উন্নতি!” তিনি বলবেন, “তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তিগফারের (ক্ষমা প্রার্থনা) বিনিময়ে!” [সুনানে ইবনে মাজাহ]

অন্যত্র রাসূল ﷺ আরো বলেন,

মানুষ যখন মারা যায়, তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের নেকী জারী থাকে। ক. সাদক্বায়ে জারীয়া খ. ফলপ্রসূ ইল্‌ম (উপকারি বিদ্যা) এবং গ. সুসন্তান, যে তার জন্য দু’আ করে। [মুসলিম, ১৬৩১]

এত সুন্দর বিধান পিতা-মাতার সম্পর্কে থাকতে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের দেখিয়ে দেওয়া কথিত সম্মান দিবস কোনো মুসলিমের প্রয়োজন হতে পারে? নিশ্চয়ই  না। আর যে কেউ অন্য সম্প্রদায়ের অনুসরণ করবে, তার সম্পর্কে আল্লাহ্‌র রাসূল ﷺ বলেন,

যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত (হয়ে যাবে)।  [আবূ দাঊদ, ৪০৩১]

তথ্যসূত্র

[১] http://bit.ly/2IgL8bm

[২] http://bit.ly/2GaMqTu


লেখক: মুহাম্মাদ সবুজ আহমেদ

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive