অধুনা বিশ্বে “মানবাধিকার” পরিভাষাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর সংজ্ঞায় গাজী শামসুর রহমান বলেছেন, “সকল দেশের, সকল কালের, সকল মানুষের ন্যূনতম যে অধিকারগুচ্ছ সর্বজনীনস্বীকৃতস্বরুপ তারই নাম মানবাধিকার।” (মানবাধিকার ভাষ্যঃ গাজী শামসুর রহমান, পৃষ্ঠা:৩৩) মানুষের অধিকারকে ইসলামে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে। কিন্তু আজকের বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় অজাচারকারীদের জন্যও খুব জোরালো আন্দোলন হলেও প্রকৃতই মুসলিমের জন্য মানবাধিকারের কোনো হিসেব নেই। এক্ষেত্রে কোনো মোড়লদের কার্যকর উদ্যোগ নেই। বিশেষ করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের করুণ দশা নিয়ে কারো দৃশ্যমান ভ্রুক্ষেপ নেই।
একাদশ শতাব্দীতে আরাকান রাজ্য “রোহান” বা “রোয়াঙ” নামে পরিচিত ছিলো। আরাকানি মুসলিমরা সেখানে হাজার বছর ধরে বসবাস করে এলেও মিয়ানমার সরকার ও নাগরিকদের কাছে তারা বিদেশি বা অবৈধ বাঙ্গালি অধিবাসী নামে চিহ্নিত। গত ৩ জুন, ২০১২ তারিখে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময়ে শত শত মুসলিমকে হত্যা করা হয়। শুরু থেকেই হিংসাপ্রিয় বৌদ্ধ আর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যোগসাজশে এ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
শুরু থেকে বর্তমানঃ
১) ১৭৮৪ সালে বার্মা রাজা বোদাফিয়া আরাকান দখল করে দীর্ঘ ৪২ বছর শাসন করেন। তাঁর দুঃশাসনে রোহিঙ্গারা ধবংসের মুখোমুখি হয়। তিনি বহু মসজিদ-মাদ্রাসা ধবংস করে সেখানে প্যাগোডা, বৌদ্ধ বিহার স্তুপ প্রভৃতি নির্মাণ করেন। বন্ধ করে দেন মুসলিমদের পশু জবাই পদ্ধতি, কুরবানী ও ঈদ-উল-আযহা।
২) ১৮২৩ সালে বৃটিশরা আরাকান ও বার্মা দখল করে। প্রায় শতাব্দী পর ১৯৩৭ সালে বার্মাকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলেও পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদেরকে বাদ দিয়ে বর্মীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। ফলে ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা। চলে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। এতে করে প্রায় ১ লাখ মুসলিমের প্রাণনাশ করা হয়। ফলে ১৯৪৫ সালে অনেকটা নিরুপায় হয়ে আরাকানের মুসলিমরা ব্রিটিশদের সহায়তা করে। তখন শর্ত ছিল ব্রিটিশরা আরাকানীদের জন্য আলাদা একটি রাজ্য গঠন করে দিবে। কিন্তু তারা কথা রাখলো না। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় রোহিঙ্গাদের একটি বিরাট অংশ পূর্বপাকিস্তানের অংশ হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় মিয়ানমারের বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের এক হাত দেখে নেওয়ার সুযোগ পায়।
৩) ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়। ১৯৫৮ সালে কেরণ সম্প্রদায়ের এক বিদ্রোহ দমনে মুসলিমদের কচুকাটা করা হয়। এদিকে ১৯৬৩ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করলে মুসলিমদের প্রতি কঠোর হন এবং মুসলিমদের স্বীকৃত অধিকার ও সুবিধাসমূহ কেড়ে নেন। তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আর সব বিরোধীকন্ঠ রোধ করে দেন।
৪) ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা “নাগরিকত্ব আইন” পাশ করে ১৩৫ গোত্রকে নাগরিকত্ব দিলেও কেড়ে নেওয়া হয় মুসলিমদের নাগরিকত্ব। তাদেরকে দেওয়া হয় “সহযোগী নাগরিক”-এর টাইটেল। তাছাড়া শর্তসাপেক্ষে “অভিবাসী নাগরিক” করা হয় কাউকে। শর্তগুলো ছিলো- যারা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ভাষায় দক্ষ ও যাদের সন্তান মিয়ানমারে জন্ম নিয়েছে তারাই এ নাগরিকত্ব পাবে। নইলে নয়।
৫) ১৯৯০ সালে আরাকানে স্থানীয় আইন জারি করে এই অঞ্চলের মুসলিমদের বিবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ২০০৫ সালে পুনর্গঠিত নাসাকা বাহিনী দীর্ঘদিন বিবাহের আবেদন গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়। নিয়ম করে দেয় আরও কঠোর। উদ্দেশ্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যাতে তারা সংখ্যায় বেশি হতে না পারে। নবদম্পতিকে মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয় তারা যেন দুই এর অধিক সন্তান নিতে না পারে।
৬) ২০১১ সালে নতুন করে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করা হয়। ২০১২ সালে অং সান সুচির জয়ের পর সেখানে ব্যাপারটা আরও উৎসাহ পায়। কয়েকটি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি লুটপাট করা শুরু হয়।
৭) অন্যদিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদেরকে বহু বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। আমরা করি “পুশব্যাক”। ২০১৫ সালের ১০ মে চারটি নৌযানে করে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে প্রবেশ করে ৬০০ রোহিঙ্গা৷ একই সময়ে লাংকাওইতে প্রবেশ করে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা৷ সমুদ্র থেকে স্থলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলে৷ প্রতিবছর এভাবেই মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শত শত রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশিও থাকেন সব সময়৷ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলায় অনেক নৌযান ডুবে যায় সাগরে, সলিল সমাধি হয় অনেকের৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছেন অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি৷ ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ৫ দিনে সেনা অভিযানে অন্তত ৬৯ জন নিহত হবার পর আতংকিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করলে সীমান্তরক্ষী বিজিবি তাদের ‘পুশব্যাক’ করেছে, বলছে এএফপি।
মুসলিমদের হওয়ার কথা ছিল এক উম্মাহ বা এক জাতি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, স্নেহ, দয়া ও ভালোবাসায় মু’মিনদের উদাহরণ হলো একটা শরীরে মতো। এর এক অঙ্গে ব্যাথা অনুভুত হলে সারা শরীর নির্ঘুম হয়ে যায় এবং জ্বর এসে যায়। (সহীহ বুখারী ৫৬৬৫, সহীহ মুসলিম ২৫৮৬) কিন্তু আমাদের অবস্থা এখন নির্জীব ও অবশ। মিয়ানমারে মুসলিম ভাইবোনদের উপর যা হচ্ছে তার দায়ভার আমরা কি এড়াতে পারবো?
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।