আদনানের বাসায় আজ পরিবারের প্রায় সবাই এসেছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। বাড়িতে চলছে সুস্বাদু সব খাবারের আয়োজন! পোলাও, গরু, মুরগি, খাসি, মাছসহ আরো রয়েছে বিভিন্ন রকমের খাবারের ব্যবস্থা। আদনান পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলে। ছোট ভাইবোন যারা এসেছে, তারা সবাই চিল্লাপাল্লা, খেলাধুলাতে মগ্ন। কিন্তু আদনানের সেগুলোতে কোনো আগ্রহ নেই। থাকবেই বা কী করে? কর্মজীবনে পদার্পণ করলে ওসবের প্রতি আর খেয়াল থাকে না। তবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সে পরিবারে খুবই সমাদৃত। আদনানের অভ্যাস আছে যে, মা যখন রান্না করে, রান্না শেষ হবার আগেই সে কড়াই থেকে মাংস উঠিয়ে খাওয়া শুরু করে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ঠিকই রান্না শেষ হবার আগে বাটিতে করে মুরগির মাংস নিয়ে খেতে খেতে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলো নাবিলা আর ফাতিমা বসে ‘Inside The Living Body’ শিরোনামে ‘Discovery’ চ্যানেলে একটি ডকুমেন্টারি দেখছে। আদনানও গিয়ে তাদের পাশের সোফাতে বসে টিভি দেখতে লাগলো।
নাবিলা আদনানের ছোট বোন। সে ইউনিভার্সিটিতে প্রাণিবিদ্যায় ৪র্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। ফাতিমার প্রায় সমবয়সী হওয়ায় কয়েকদিনে ফাতিমার সাথে তার সম্পর্কও দুই বোনের মতো হয়ে গিয়েছে। তিনজন খুব মনোযোগ সহকারে অনুষ্ঠান দেখছে। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে দেখলো, একটি শুক্রাণু কয়েক লক্ষ শুক্রাণুর সাথে প্রতিযোগিতা করে অবশেষে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছিয়েছে। জীবন শুরুই হয়েছে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, এবং পরবর্তীতে যত দিন প্রাণ থাকবে, সংগ্রাম করেই মানুষের বেঁচে থাকতে হবে – এই ম্যাসেজটাই দিতে চাইলো বোধহয়। তারপরে দেখালো ভ্রূণ কীভাবে বৃদ্ধি পায়, তারপর কীভাবে বাচ্চা ও মায়ের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তারপরে কীভাবে সে ছোটবেলা অতিক্রম করে এক সময় বৃদ্ধ হয়ে মারা যায়।
এগুলো দেখতে দেখতে ফাতিমা নাবিলাকে বললো, “জানো নাবিলা, এই বিষয়গুলো আল্লাহ কত সুন্দরভাবে কুরআনে আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন, যাতে আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে তাঁর (ﷲ) নিদর্শনগুলো উপলব্ধি করি! আধুনিক ভ্রূণবিদ্যা আবিষ্কারের পরে কুরআনের বর্ণনার সাথে মিলে যাওয়ায় তা কুরআনের একটি মিরাকেল হিসেবে দেখা হয়। আর …”
ফাতিমাকে থামিয়ে দিয়ে আদনান বললো, “এখানে আমি তোমার সাথে একমত নই, ফাতিমা। তোমরা শুধু শুধু কিছু না জেনে কোরানকে বিজ্ঞানময় দাবী করো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এই কোরানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো থিওরি আবিষ্কার করেনি।”
ফাতিমা বললো, “আদনান, কুরআন কোনো বিজ্ঞানের বই না যে, এখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা করা থাকবে। তাই কুরআনকে বিজ্ঞানময় দাবি করার প্রশ্নই আসে না। যারা করে, ভুল করে। কুরআন মানবজাতিকে দেওয়া হয়েছে এই কারণে যে, এর দ্বারা মানুষ তার প্রকৃত স্রষ্টাকে চিনতে পারবে। যাতে মানুষ দুনিয়ায় তার প্রকৃত স্রষ্টার দেখানো পথে চলতে পারে এবং দুনিয়ায় শান্তি-শৃঙ্খলা ও নৈতিক মূল্যবোধ বজায় থাকে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দিক থেকে কুরআন একটি স্বতন্ত্র কিতাব হিসেবেই খ্যাত। বিভিন্ন যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। আর এখন তো বিজ্ঞানের যুগ, এ যুগেও কুরআন অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থাবলির মতো অবৈজ্ঞানিক না। বিজ্ঞানের কিছু জিনিস যা বিজ্ঞান কয়েক শতাব্দী আগে আবিষ্কার করেছে, সেগুলো কুরআন ১৪০০ বছর আগে আমাদের জানিয়েছে।”
আদনান বললো “তোমার কথা সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারলাম না। মুসলিমরা অধিকাংশই কোরান নিয়ে গবেষণা করে না। তারা শুধু যা আছে, তাকেই সত্য বলে মেনে নেয়। কিন্তু সেটা নিয়ে নিরপেক্ষ পড়াশোনা করে না। এটা তাদের দুর্বলতা। কিন্তু আমি কিছু কিছু জেনেছি। আমার মতে আল্লা বিজ্ঞান সংক্রান্ত নিদর্শন কোরানে বর্ণনা করতে গিয়ে ভুল করেছেন। তিনি যা বলেছেন, তার অনেককিছুই বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং একটার সাথে আরেকটি বিরোধপূর্ণ। তোমরা হয়তো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করো না। তাই ভুলগুলো ধরতে পারো না।”
নাবিলা একটু উত্তেজিত কন্ঠে বললো, “কী ভাইয়া! তুমি এটা কী বললে? তুমি কি আল্লাহ তা’আলাকে ভুলের ঊর্ধ্বে মনে করো না? তাহলে তো তোমার ঈমানই ঠিক নেই!”
ফাতিমা বললো, “নাবিলা, শান্ত হও। কেউ কোনো দাবি করলে সেই দাবি সম্পর্কে আগে তার কাছ থেকে শুনতে হয়। তার কথার পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে বলতে হয়। তার পরে তোমার যুক্তি তুমি উপস্থাপন করতে পারো। এভাবে রেগে গিয়ে কিছুর সমাধান করা যায় না। আচ্ছা আদনান, বলো তোমার কী কী ভুল মনে হয়েছে।”
আদনান বললো, “এই ধরো, মানুষ সৃষ্টির কথা বলার সময় আল্লা একেকসময় একেক কথা বলেছে। একবার বলেছে ধুলা মাটি থেকে, একবার বলেছে পানি থেকে, আবার বলেছে কাদা মাটি দিয়ে, আবার বলেছে আঠালো মাটি দিয়ে, আবার অন্য জায়গায় বলেছে শুক্রবিন্দু থেকে, আবার কখনও বলেছে জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, আবার বলেছে পানি থেকে ইত্যাদি আরো অনেক। তাহলে আসলে আল্লা কী দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে? এখানে আয়াতগুলোর মধ্যে স্পষ্ট বিরোধ আছে।”
আদনান না থেমে আবার বলতে লাগলো, “আবার, মায়ের পেটে ভ্রূণ থেকে বাচ্চা তৈরি হওয়ার ধাপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন তিনি শুক্রাণুকে একটি আধারে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু কোরানে ডিম্বাণুর কথা বলা হয়নি। আবার বলা হয়েছে জরায়ুতে নাকি শুক্রাণু জমাট বাঁধা রক্তের রূপ নেয়। এটা বৈজ্ঞানিক ভুল! কারণ একমাত্র গর্ভপাত ছাড়া ভ্রূণ কখনো জমাট বাঁধা রক্ত হয় না। তারপর বলেছে প্রথমে মাংসপিণ্ড হয়। তাতে আবার হাড় হয়। আবার সেটা মাংস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরকম হাস্যকরভাবে ভ্রূণের বৃদ্ধি হয় নাকি? বুঝলি নাবিলা, মোহাম্মদ আসলে খুব চালাক ছিলো! কীভাবে তার সঙ্গীদের এসব অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করাতে হয়, তা সে ভালোভাবেই জানতো। তাই ধারণার উপর কিছু ভুল তত্ত্ব তাদের বলেছে, আর তারা বিশ্বাস করেছে। তিনি তো জানতেন না বিজ্ঞান এতো দূর আগাবে। আর তার গল্প ভুল হয়ে যাবে। হা হা হা।”
এই বলে মুরগির রানের মাংসে কামড় দিয়ে আদনান বললো, “এই দ্যাখ, মুরগির এই রানের দিকে লক্ষ কর। দেখ, সবার উপরে আছে মাংস। তার পরে আছে হাড়। তার নিচে আছে মজ্জা। এভাবে দেখেই হয়তো মোহাম্মদ বলে দিয়েছিলো যে, ভ্রূণ আগে জমাট বাঁধা রক্ত হয়। তারপর তাতে হাড় হয়। তারপর তাতে মাংস হয়। এতেই মোহাম্মদ ধারণা করেছিলো যে মানুষ এভাবে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পায়। হা হা। এখন, বিজ্ঞান কী বলে সেটা শোন। বিজ্ঞান বলে, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিলে জাইগোট হয়। তারপর সেটা বিভাজিত হয়। তারপর সেখান থেকে এক্টোডার্ম, এন্ডোডার্ম, মেসোডার্ম তৈরি হয়। তারপর এগুলো থেকে সবকিছু তৈরি হয়। আর হাড় ও মাংস একসাথেই তৈরি হয় মেসোডার্ম থেকে। আগে বা পরে না। বুঝলি? আর ঠিক এভাবেই কোরান অপবিজ্ঞান দিয়ে ভরা। সুতরাং, কোরান ভুল। হা হা হা।”
এরকম একটা সাধারণ জিনিস আদনান বোঝে না, সেটা দেখে নাবিলা মনে মনে খুবই ক্ষুব্ধ হলো। নাবিলা বললো, “ভাইয়া, তোমার বোঝার কিছু ভুল আছে। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে মাটি থেকে তৈরি করেছে তখন, যখন প্রথমবার তিনি মানুষ সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ, যখন তিনি আদম (‘আঃ)-কে সৃষ্টি করেছিলেন। তার পরে ঈসা (‘আঃ) ব্যতীত সবাইকে তো তিনি পিতামাতার মাধ্যমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে তৈরি করেছেন।[১] আর পরের প্রশ্নের ব্যাপারে…”
ফাতিমা নাবিলাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, নাবিলা। তুমি ঠিক বলেছো। একটু থামো। আমিই বলছি। আর আদনান, তুমি অনেকগুলো অভিযোগ করেছো এবং সব অভিযোগের উত্তর আমার কাছে আছে। আদনান, তুমি মুরগির মাংস দিয়ে যে উদাহরণটা দিলে, সেটা তো তোমার নিজের কথার সাথেই বিরোধপূর্ণ। কারণ, তোমার ভাষ্যমতে কুরআনে ভ্রূণ তৈরির ক্রমধারা হলো – জমাট বাঁধা রক্ত, মাংসপিণ্ড, হাড়, মাংসপেশী। কিন্তু মুরগির রানের সিকোয়েন্স হলো, অস্থিমজ্জা, হাড়, মাংসপেশী। তোমার ধারণামতে যদি মুরগির রানে মাংসের বিন্যাস দেখে রাসূলুল্লাহ ﷺ এই তত্ত্ব দিতেন, তাহলে তিনি মজ্জার পরে হাড়কে বাদ দিয়ে তার আগে মাংসপিণ্ড বলতেন না। তাহলে তিনি বলতেন জমাট রক্ত (?) থেকে হাড় হয়েছে, তারপর তাতে মাংস হয়েছে। কিন্তু তিনি তা বলেননি। আর তোমার আরেকটা ভুল হলো, তুমি অস্থিমজ্জা ও জমাট বাঁধা রক্তকে (?) মিলিয়ে ফেলেছো। কিন্তু বাস্তবে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। তাই তোমার এই ধারণা খণ্ডানোর কোনো গুরুত্ব আমার কাছে নেই। বাকিগুলো ব্যাখ্যা করার গুরুত্ব বহন করে। তাই আমি যদি দেখাতে পারি যে মানুষ সৃষ্টি এবং ভ্রূণের বৃদ্ধি সম্পর্কে কুরআনে যে কথাগুলো আছে তার সবগুলোই সঠিক এবং একটার সাথে আরেকটা সাংঘর্ষিক না, তাহলে কী হবে?”
আদনান বললো, “বলো তো আগে। শুনে দেখি।”
ফাতিমা বলা শুরু করলো, “আচ্ছা, তোমার প্রথম অভিযোগ হলো আল্লাহ মানুষকে আসলে কী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কারণ আল্লাহ একেকসময় একেকটা বলেছেন। তাই তো?”
আদনান খেতে খেতে বললো, “হুম।”
ফাতিমা বললো, “এই বিষয়টি বুঝতে গেলে তোমাকে দুটি ভিন্ন সময়ে ভিন্ন জিনিস দিয়ে তৈরির কথা চিন্তা করতে হবে। প্রথমে, আল্লাহ সর্বপ্রথম মানুষকে কী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এবং তারপর থেকে কীভাবে সৃষ্টি করছেন। ওকে?”
আদনান বললো, “হুম।”
ফাতিমা বললো, “প্রথমত, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যখন প্রথম সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন জমিনের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাটি সংগ্রহ করে আনতে।[২] তারা জমিনের সর্বত্র হতে এক মুঠো মাটি এনেছে এবং সেটা ছিলো ধুলা মাটি বা তুরাব।[১] তারপর আল্লাহ তা’আলা এতে পানি মিশিয়েছেন। তখন এটি কাদামাটিতে বা ত্বীনে পরিণত হলো।[৩] তারপর এটিকে কিছু সময় রেখে দেওয়া হলো। তুমি জানো যে কাদামাটিকে রেখে দিলে তা শুকাতে শুকাতে আঠালো মাটি হয়ে যায়। সুতরাং, কাদামাটি বা ত্বীন পরিণত হলো আঠালো মাটিতে বা ত্বীনিন লাজিবে।[৪] তারপর মাটিতে থাকা পানির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হলো। তারপর এটি গন্ধযুক্ত কালো কাদামাটিতে অর্থাৎ, হামাইম মাসনুনে[৫] পরিণত হলো। তারপর এটি দিয়ে আদম (‘আঃ)-এর আকৃতি তৈরি করে শুষ্ক করতে রেখে দেওয়া হলো। এবং এই অবস্থাকে আল্লাহ বললেন ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মাটি বা সালসাল থেকে।’[৬] তারপরে তিনি (ﷲ) এর মধ্যে তাঁর পক্ষ থেকে রুহ এর সঞ্চার করেন এবং তাঁকে জীবন দেন। এই হলো আদম (‘আঃ) সৃষ্টির ঘটনা।”
“এখন আল্লাহ ﷻ আরেক জায়গায় বলেছেন ‘মানুষকে তৈরি করা হয়েছে মাটির সারাংশ বা সুলালাতিম মিন ত্বীন থেকে।[৭] এটা তো আগেই বলেছি। এখন আসি আসলেই মানুষ মাটির উপাদান দিয়ে তৈরি কি না। বিজ্ঞানীরা মানুষের দেহের কেমিক্যাল কম্পোনেন্ট পরীক্ষা করে বের করেছে। পরীক্ষায় দেখা যায়, মানুষের দেহের উপাদানের মধ্যে অক্সিজেন ৬৫%, হাইড্রোজেন ১০%। এই দুই উপাদান দিয়ে তৈরি হয় পানি। এরপর, আরো থাকে কার্বন ১৮%, নাইট্রোজেন ৩%, ক্যালসিয়াম ১.৫%, ফসফরাস ১%, এছাড়াও আছে অল্প পরিমাণে সালফার, সোডিয়াম, ক্লোরিন, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফ্লোরিন ও জিংক।[৮]
“আর মাটির মধ্যেও দেখবে মেইন উপাদানগুলো হলো, আয়রন ৩২.১%, অক্সিজেন ৩০.১%, সিলিকন ১৫.১%, ম্যাগনেসিয়াম ১৩.৯%, সালফার ২.৯%, নিকেল ১.৮%, ক্যালসিয়াম ১.৫%, অ্যালুমিনিয়াম ১.৪% ও অন্যান্য ট্রেস এলিমেন্ট।[৯] সুতরাং, যেহেতু মাটি ও পানির উপাদানগুলোই মানুষের শরীরে আছে, সেহেতু বৈজ্ঞানিকভাবে এটা বলা ভুল নয় যে মানুষকে মাটির সারাংশ অথবা পানি থেকে তৈরি করা হয়েছে।
“আর দ্বিতীয়ত, আদম (‘আঃ) সৃষ্টির পরে সমস্ত মানব সভ্যতাকে আল্লাহ তা’আলা পিতা-মাতার মাধ্যমে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলনের ফলেই সৃষ্টি করেছেন।[১০] বিজ্ঞানও তো তা-ই বলে, তুমি সেটা জানো। কী? বুঝাতে পারলাম?”
আদনান উত্তর দিলো, “হুম, বুঝেছি। এটা তো সহজ প্রশ্ন। কিন্তু পরের প্রশ্নটাই আমার মূল প্রশ্ন। সেটার ব্যাপারে কী বলতে চাও?”
উত্তর পাবার পর আদনানের এমন দ্বিমুখিতা দেখে নাবিলা করে হেসে দিলো। নাবিলা বললো, “ভাইয়া, এটা কেমন পল্টিবাজি? হা হা হা। সোজা বললেই হয় তোমার বোঝার ভুল ছিলো।”
নাবিলাকে থামিয়ে ফাতিমা আবার বলা শুরু করলো,“হ্যাঁ, তোমার দ্বিতীয় অভিযোগ হলো জরায়ুতে ভ্রূণের বৃদ্ধির ব্যাপারে। এই বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা কুরআনে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন সূরা মু’মিনুনে।”
এরপর ফাতিমা পাশে থাকা মোবাইল ওপেন করে বললো, “এখন, আমি মোবাইল দেখে কুরআনিক টেক্সট এবং অর্থ অনুযায়ী আয়াতগুলো উল্লেখ করছি। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। আল্লাহ ﷻ বলেন,‘অতঃপর আমি তাকে নুতফা রূপে এক সংরক্ষিত আধারে বা জরায়ুতে স্থাপন করেছি। এরপর আমি নুতফাকে আলাক্ব রূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর আলাক্ব’কে মুদগাহ’তে পরিণত করেছি, এরপর সেই মুদগাহ থেকে ইজামাহ সৃষ্টি করেছি, অতঃপর ইজামাহ’কে লাহমা দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুন বা অন্য এক সৃষ্টিরূপে বের করে এনেছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়!’ যে আয়াতগুলো বললাম সেগুলো নিয়ে আমি এখন একটু শাব্দিক বিশ্লেষণ করবো এবং কুরআন ও সহীহ হাদীসের সাথে আধুনিক ভ্রূণবিদ্যা সাংঘর্ষিক কি না সেটা বিশ্লেষণ করবো, ইনশা-আল্লাহ। আচ্ছা নাবিলা, আমার ড্রয়ার থেকে কালো কভারের ডায়েরিটা একটু নিয়ে আসবে?”
ফাতিমা যেসব বিষয়ে লেখাপড়া করে, তার সবকিছুই সে ডায়েরিতে লিখে রাখে। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করার পর প্রিন্ট করে ডায়েরিতে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখে ফাতিমা। এসব বিষয়ে সে আগেও অনেকের সাথে বিতর্ক করেছে। তাই এগুলো আগে থেকেই তার ডায়েরিতে ছিলো। নাবিলা উঠে গিয়ে ফাতিমার ঘর থেকে ফিরে এসে বললো, “এই নাও ভাবী, তোমার ডায়েরি।”
ফাতিমা ডায়েরিটি নিয়ে বললো, “বসো, নাবিলা।” নাবিলা আবার তার পাশে বসে পড়লো।
ফাতিমা একটু নড়েচড়ে বসলো। হালকা গলা ঝেড়ে নিয়ে বললো, “আদনান, ডায়েরির দিকে লক্ষ করো। সূরা মূ’মিনুনের ১৩-১৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন তিনি নুতফাহকে সংরক্ষিত আধারে অর্থাৎ জরায়ুতে স্থাপন করেছেন। এখন এই নুতফাহ (نُطْفَةٌ) অর্থ আমরা বিখ্যাত সব অ্যারাবিক টু ইংলিশ ডিকশনারিতে খুঁজলে প্রধাণত দু’টি অর্থ পাবো। সেগুলো হলো- ‘Drop of fluid of parents’[১১] এবং ‘Sperma (seed) of man and of a woman’।[১২] অর্থাৎ, ‘পানির ফোঁটা যা পিতা-মাতা থেকে নির্গত হয়’ এবং ‘পুরুষ অথবা নারীর বীজ’। বীজ এর বৈশিষ্ট্য গাছ উৎপাদন করা। তাই পুরুষ অথবা নারীর বীজ বলতে মানব দেহে এমন কিছুকে বোঝানো হয়েছে, যার বৈশিষ্ট্যও একই। সুতরাং, নুতফাহ শব্দটি দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এই শব্দ দিয়ে পুরুষ এবং নারীর যথাক্রমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং তুমি যে বললে ‘কুরআনে শুধু শুক্রাণুর কথা বলা হয়েছে কিন্তু ডিম্বাণুর কথা নেই।’-তোমার এই অভিযোগ ভুল।”
আদনান বললো, “কিন্তু এখানে তো যেকোনো একটির কথা বলা হয়েছে। হয়তো শুক্রাণু জরায়ুতে স্থাপিত হবে অথবা ডিম্বাণু জরায়ুতে স্থাপিত হবে। সেহেতু একসাথে তো দুই অর্থ আমরা নিতে পারি না। সুতরাং, তবুও তো ভুলটি থেকে যায়।”
ফাতিমা উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, একটা সুন্দর প্রশ্ন করেছো। তুমি যদি কুরআনের তাফসিরের পদ্ধতি দেখো, তাহলে দেখবে যে, তার মধ্যে একটি পদ্ধতি হলো কুরআনের একটি আয়াতের তাফসির অন্য আয়াত করে। এভাবে তাফসির করাকে বলে ‘তাফসিরুল কুরআন বিল কুরআন’। এইভাবে তাফসির করলে তোমার প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ সূরা ইনসানের ২ নং আয়াতে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি ‘নুতফাতিন আমশাজ(نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ)’ থেকে।[১৩] অর্থাৎ, মিশ্রিত শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে।’ সুতরাং, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিলে যে জাইগোট তৈরি হয়, সেটাই জরায়ুতে স্থাপিত হয় নিরাপদে, এবং সংরক্ষিতভাবে। আবার যদি আমরা নুতফাকে ‘Drop of fluid of Parents’ বা ‘পিতা মাতা থেকে নির্গত এক ফোঁটা পানি’ অর্থ হিসেবে নেই, তাহলেও সেটি ঠিক। কারণ, পুরুষের শুক্রাণু বীর্য নামক তরলসহ নির্গত হয়। এবং নারীদের ক্ষেত্রেও ডিম্বাণু তাদের ডিম্বাশয় থেকে পানিসহ বের হয়।[১৩.১] তাহলে, এই দু’টো জিনিসকে আমরা পিতা-মাতা থেকে নির্গত এক ফোঁটা পানিও বলতে পারি।”
ফাতিমাকে থামিয়ে আদনান বললো, “আচ্ছা, আরেকটি বিষয় হচ্ছে অনেকে নুতফাহকে বাংলায় বীর্য অনুবাদ করেছে। বীর্য আর শুক্রাণু কিন্তু এক জিনিস নয়। আর তুমি নুতফাহকে বলছো পুরুষের ক্ষেত্রে সেটি শুক্রাণু এবং নারীদের ক্ষেত্রে সেটি ডিম্বাণু! এই কথার পক্ষে কি তুমি কোরান-হাদীস থেকে প্রমাণ দিতে পারবে?”
ফাতিমা বললো, “আচ্ছা, সহজে বুঝানোর জন্য হয়তো তেমন অনুবাদ করেছে। কিন্তু বীর্যের আসল অনুবাদ আরবিতে মানি (مَنِي)।[১৩.২] প্রমাণ হিসেবে মুসনাদে আহমাদের ১ম খণ্ডের পবিত্রতা অধ্যায়ের বীর্য বিষয়ক হাদীসগুলো পড়লে তুমি দেখবে যে সেখানে সব কয়টি হাদীসে বীর্য বুঝাতে মানি (مَنِي) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আয়িশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহর ﷺ কাপড় থেকে মানিয়্যি বা বীর্য ঘষে তুলে দিতেন।’[১৩.৩] কিন্তু নুতফাহ আসলে বীর্যের সামান্য অংশকে বুঝায়। কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘সে কি স্খলিত বীর্যের একটি অংশ অর্থাৎ নুতফা ছিলো না?’[১৩.৪]। এছাড়াও হাদীস থেকে পাওয়া যায় যে, এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে আযল অর্থাৎ, সহবাসের পরে বাহিরে বীর্যপাতের অনুমতি চাইলে তিনি বলেন, ‘বীর্যের সমস্ত অংশ হতে বাচ্চা হয় না[১৩.৫]।’ তাহলে বোঝা যাচ্ছে নুতফা বীর্যের একটি অংশ এবং ডিকশনারি অনুযায়ী বীজ। আবার এক ইয়াহুদী রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে সন্তান কীভাবে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সন্তান হয় পুরুষের নুতফাহ ও নারীর নুতফাহ’র মিশ্রণে।’[১৩.৬] সুতরাং, নুতফাহ বলতে পুরুষের এবং নারীর যথাক্রমে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুকে বুঝায়। মনে হয় তোমাকে বুঝাতে পেরেছি। অতএব, তোমার প্রথম অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলো। এই যে, এই ছবিটা দেখো। এখানে, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ও জরায়ুতে স্থাপনের ছবি দেওয়া আছে।”
আদনান বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝেছি। বলতে থাকো।”
ফাতিমা বললো, “তারপর আল্লাহ বলেছেন ‘তিনি নুতফাহকে পরিণত করেছেন আলাক-এ।’ এখন আলাক (عَلَق)-এর অর্থ আমরা বিখ্যাত অ্যারাবিক টু ইংলিশ ডিকশনারিতে প্রধানত তিনটি পাই। প্রথমটি হলো, ‘Leech like substance’ বা ‘জোঁকের মতো বস্তু’।[১৪] তারপরের অর্থ হলো, ‘Hanging, suspended, clinging thing অর্থাৎ, ঝুলন্ত, কোনোকিছুর সাথে সংলগ্ন আছে এমন’।[১৪] এবং সর্বশেষ অর্থ হলো, ‘Blood Clot অর্থাৎ, জমাট বাঁধা রক্ত’।[১৪] আচ্ছা আদনান, এবার কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও। বলো দেখি Bug কী, আর ভাইরাস কী।”
আদনান উত্তর দিলো, “Bug হলো ধরো, আমি একটি প্রোগ্রাম বানিয়েছি স্কুলের রেজাল্টশীট তৈরি করার জন্য। কিন্তু প্রোগামে কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে, যার কারণে আমি আমার প্রোগ্রাম থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাবো না। এটাই Bug। আর ভাইরাস হলো মূলত কিছু কোড, যেগুলো নিজেই প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং এটি একটি কম্পিউটারের সিস্টেমকে নষ্ট করে দিতে পারে। যেমন, ট্রোজান।”
ফাতিমা বললো, “কিন্তু আমি যদি বলি Bug হলো মেডিক্যালি ইম্পর্ট্যান্ট একটি পোকা যা রোগ ছড়ায়, আর ভাইরাস হলো সেই বায়োলজিক্যাল এজেন্ট, যা মানবদেহের ক্ষতি করে, যেমন- এইডস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি, তাহলে কি তুমি আমার সাথে একমত হবে?”
আদনান বললো, “হ্যাঁ, হবো। কারণ এখানে দেখতে হবে তুমি কোন সেন্সে এবং কোন ক্ষেত্রে এই শব্দগুলো ব্যবহার করছো।”
ফাতিমা বললো, “এক্স্যাক্টলি। আচ্ছা, আরেকটা প্রশ্নের জবাব দাও। বলো ‘I picked it up with my right hand’ এবং ‘You gave him the right answer’ এই দুটি বাক্যেই আমি যদি Right এর অর্থ ধরি ‘ডান হাত’, তাহলে কি আমি ঠিক করবো?”
আদনান উত্তর দিলো, “না, ঠিক না। এখানে প্রথম বাক্যে ‘Right’ এর অর্থ হবে ‘ডান হাত’ এবং পরের বাক্যে ‘Right’ অর্থ হবে ‘সঠিক’। কারণ এখানে বাক্যের গঠন অনুযায়ী দেখতে হবে যে ‘Right’ এর কোন অর্থ সঠিক হয়।”
ফাতিমা বললো, “তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো যে, একটা শব্দের অর্থ তেমনভাবেই করতে হবে যেমনভাবে আমি শব্দটির ব্যবহার করবো বা যে প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করবো এবং তা অবশ্যই প্রদত্ত বাক্যের অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তাই তো?”
আদনান উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু এসব বিষয় তো এখন আলোচনার বিষয় নয়। তুমি কিন্তু প্রসঙ্গ বদলাচ্ছো!”
ফাতিমা বললো, “না, আমি প্রসঙ্গ বদলাইনি। যাতে তুমি সহজে জিনিসটা বোঝো, এজন্য বললাম। এখন আসি আলাক (عَلَق) শব্দের আমরা কোন অর্থ নিবো, সেই প্রসঙ্গে। ‘আলাকাহ’-এর মাধ্যমে কুরআনে আল্লাহ কোন শব্দটি বুঝিয়েছেন, এখানে সেটি স্পষ্ট নয়। তাহলে অবশ্যই একটু আগে তোমার বলা অনুবাদের মূলনীতি অনুযায়ী আমরা সেই অর্থই নেবো, যেটি এই আয়াত ও প্রকৃত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং, আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থ নিবো। কারণ এই দু’টি অর্থই কন্টেক্সটের সাথে মেলে। অর্থাৎ, জোঁকের মতো বস্তু এবং ঝুলন্ত বা কোনোকিছুর সাথে সংলগ্ন আছে এমন। কারণ জোঁক যেমন যেখানে লেগে থাকে সেখান থেকে রক্ত চোষে, ভ্রূণও তেমন মায়ের শরীর থেকে রক্তের মাধ্যমে পুষ্টি নেয় এবং ঝুলে থাকে। তাই এই অর্থ নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। আর আমরা জমাট বাঁধা রক্ত অর্থ নিবো না। কারণ এটা তোমার বলা মূলনীতির সাথে মেলে না এবং এটা কন্টেক্সটের সাথে মেলে না। আর আরবরাও সাধারণত ‘আলাকাহ’ বলতে জোঁকের মতো বস্তুকেই বোঝে। তোমার বিশ্বাস না হলে গুগল ট্রান্সলেটরে আরবিতে ‘عَلَق’ লিখে সার্চ দাও। তাহলেই বুঝতে পারবে।[১৪.১]
“এখন আসি, বিজ্ঞান কী বলে। বিজ্ঞান আমাদের বলে, একটি ভ্রূণ মায়ের জরায়ুতে থাকাকালীন ১৫ থেকে ২৫ দিনে অর্থাৎ ২য় ও ৩য় সপ্তাহে জোঁকের মতো আকৃতিতে পরিণত হয়।[১৫] এবং এটি তখন কানেক্টিং স্টকের সাহায্যে ঝুলে থাকে যা পরে আম্বিলিকাল কর্ডে পরিণত হয়।[১৬] সুতরাং আমরা বলতে পারি, আল্লাহ তা’আলা ‘নুতফাতিন আমশাজ’ বা নারী এবং পুরুষের প্রজনন সংক্রান্ত মিশ্রিত পানিকে ‘আলাক’ অর্থাৎ জোঁকের মতো আকৃতিতে পরিণত করেছেন ১৫-২৫ দিনে। অতএব, তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের দ্বিতীয় অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলো। এবার, ডায়েরির ছবির দিকে লক্ষ করো। তাহলে এটা সহজে বুঝতে পারবে। এখানে কুরআনে বর্ণিত আলাক বা জোঁকের মতো বস্তুকে দেখানো হয়েছে।”
আদনান অনেক্ষণ তাকিয়ে ছবিগুলো দেখার পর বললো, “বুঝলাম। কিন্তু তুমি ‘জমাট বাঁধা রক্ত’ অর্থটিকে এত সহজে রিজেক্ট করতে পারো না। কারণ পূর্বের অনেক স্কলার এই অর্থ গ্রহণ করেছেন। আর এখনো প্রায় সকল বাংলা অনুবাদে ‘জমাট বাঁধা রক্ত’-ই লেখা।”
ফাতিমা বললো, “আদনান, আগেই তোমাকে বলেছি যে অনুবাদ দেখে তুমি কুরআনকে বিচার করতে পারো না। এটা সবসময় বুঝতে হবে মূল আরবি টেক্সট দিয়ে। কারণ কুরআন আল্লাহ তা’আলার কথা। আর অনুবাদ মানুষের করা। যেসব আয়াতে ধারণা করে অনুবাদ করা হয়েছে কিংবা যেখানে অর্থের ব্যাপকতা আছে, যুগের পরিবর্তনে হয়তো সেখানে অনুবাদের পরিবর্তন আসবে। কিন্তু কুরআনের টেক্সটের কোনো পরিবর্তন হবে না। আর পূর্বের স্কলারদের আলাক-এর অর্থ এই আয়াতে ‘জমাট বাঁধা রক্ত’ মনে করারও যথেষ্ট কারণ আছে।”
ফাতিমাকে থামিয়ে আদনান বললো, “কেমন কারণ?”
ফাতিমা বললো, “বলছি, ওয়েট করো। যখন ‘আলাক’ শব্দটির অর্থ তাঁরা বের করতে গিয়েছেন, তখন তাঁরা এই শব্দের ৩টি অর্থের দিকে লক্ষ করে ‘জমাট বাঁধা রক্তকেই’ যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। কারণ সেই যুগে মাইক্রোস্কোপ ছিলো না। কেউ দেখতেও পেতো না জরায়ুতে সন্তান কীভাবে বড় হয় বা এত ছোট ভ্রূণ দেখতে কেমন হয়। তাঁরা হয়তো মনে করেছিলেন যে, মানুষের আকৃতি মায়ের পেটে জোঁকের মতো কেন হবে? আর ঝুলন্তই বা থাকবে কেন? যেহেতু রক্ত মানুষের শরীরেরই একটি জিনিস। তাই হয়তো জমাট বাঁধা রক্তই হলো আলাকাহ এর অর্থ। কিন্তু তাঁদের ধারণা সঠিক নয়। নবী-রাসূলেরা ছাড়া কোনো মানুষই তো ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাই স্কলারদেরও ভুল হতে পারে। সুতরাং, এই আয়াতে ‘আলাক’ এর অর্থ এখন স্পষ্ট। আর সেটা হলো, ‘জোঁকের মতো বস্তু’ এবং ‘ঝুলন্ত বা কোনোকিছুর সাথে সংলগ্ন’ আছে এমন। তবে, ইবনে কাসিরে দেখলাম বাংলাতে ‘লাল রঙের পিণ্ড’ অনুবাদ করা। অর্থের দিক থেকে এটাও কিন্তু ভুল নয়। কারণ ওই সময়ে ভ্রূণের ভিতরে রক্ত চলাচলের কারণে লাল রঙের পিণ্ডের মতো দেখায়।”
আদনান বললো, “আচ্ছা, ঠিক আছে। সামনে আগাও।”
ফাতিমা আবার বলা শুরু করলো, “এখন আমি পরের স্টেজ ‘মুদগাহ’ নিয়ে আলোচনা করবো। বিখ্যাত অ্যারাবিক টু ইংলিশ ডিকশনারিগুলোতে মুদগাহ (مُضْغَةً) এর মূলত দুই ধরনের অর্থ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো, ‘একটি মাংসের টুকরা’ এবং ‘চিবানো মাংসের মতো জিনিস’।[১৭] আল্লাহ তা’আলা বলেন তিনি ‘আলাক্ব’কে অর্থাৎ জোঁকের মতো বস্তুটিকে দ্রুত ‘মুদগাহ’-তে, অর্থাৎ চিবানো মাংসের টুকরার আকৃতিতে পরিণত করেন। আমি ‘দ্রুত’ কথাটি ব্যবহার করলাম কারণ এই লাইনের শুরুতে ‘ফা’ (ف) আছে এবং আরবিতে ‘ফা’ যদি কোনো দুই বাক্যের মাঝখানে বসে, তাহলে এটি ওই দুই বাক্যের মধ্যে কাছের সম্পর্ক বুঝায়। অর্থাৎ, দুটি ঘটনার মাঝে যদি ‘ফা’ শব্দটি আসে, তাহলে বুঝতে হবে সেই দুটি ঘটনা খুব দ্রুত একটির পরে আরেকটি হয়েছে। এখন দেখি ভ্রূণবিদ্যা কী বলে, ঠিকাছে?
“হুম, বলো।” বলে আদনান মাথা ঝাঁকালো।
ফাতিমা বললো, “ভ্রূণবিদ্যা বলে, একটি ভ্রূণ মায়ের জরায়ুতে থাকাকালীন ২৮ তম দিনে এতে সোমাইটগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। এই অবস্থায় এটি ৫ম সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত বা ৪০ দিন পর্যন্ত থাকে। তারপর এই সোমাইট থেকে পরে মেরুদণ্ডের হাড় ও মাথায় কিছু হাড় এবং পর্শুকা তৈরি হয়। তখন এটিকে দেখতে চর্বিত মাংসের টুকরার মতো লাগে।[১৮] এবার এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে দেখো, তাহলে বুঝতে সমস্যা হবে না। এখানে কুরআনে বর্ণিত মুদ্গাহ অর্থাৎ, মাংসের টুকরা বা চিবানো মাংসের মতো জিনিসকে দেখানো হয়েছে।”
ছবিটি দেখানোর পরে ফাতিমা বললো, “তাহলে, আমরা বলতে পারি যে, এই স্টেজের ব্যাপারেও কুরআন সঠিক তথ্য দিয়েছে।”
আদনান কোনো কথা বললো না। ফাতিমা একটু গলা ঝেড়ে তারপর বলা শুরু করলো, “এবার আসি ইজামা এবং লাহমা স্টেজে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘এরপর সেই মুদগাহ থেকে ইজামা সৃষ্টি করেছি। অতঃপর ইজামা’কে লাহমা দ্বারা আবৃত করেছি।’ এখানে ইজামা (عِظَامًا) এর অর্থ হচ্ছে হাড় এবং লাহমা (لَحْمًا) অর্থ মাংস বা সঠিকভাবে বোঝাতে মাংসপেশী ও পেশী সংশ্লিষ্ট জিনিস।[১৯] অর্থাৎ, আল্লাহ তা’আলা ‘মুদ্গাহ’ বা ‘এক টুকরা মাংস’ থেকে ‘ইজামা’ বা ‘হাড়’ সৃষ্টি করেন এবং তার পরে হাড়কে লাহমা বা মাংসপেশী দিয়ে আবৃত করে দেন এবং এটাও দ্রুত হয়। কারণ, এই দুই লাইনও ‘ফা’ (ف) শব্দটি দিয়ে যুক্ত। আর সেটা হয় ৪২ দিন অতিক্রম হবার পর।[২০]
“ভ্রূণবিদ্যা আমাদের বলে ৬ সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ৪২-৪৫ দিনে ভ্রূণে হাড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়।[২১] হাড় তৈরি হয় মেসেনকাইম থেকে। এবং ৭ম সপ্তাহে মাংস তৈরি হবার প্রক্রিয়া অর্থাৎ, মায়োজেনেসিস হিসেবে শুধু ঘনীভূত মেসেনকাইম দেখা যায়।[২১.১] তারপরে মায়োটোম বা মাংস যেটি থেকে তৈরি হবে, সেটি দেখা যায়। তারপর ৮ম সপ্তাহে সেই মায়োটোম থেকে ‘লিম্ব বাডে’ বা নির্দিষ্ট করে বললে, প্রথমে হাতে, তারপর পায়ে মাংস তৈরি শুরু হয়।[২২] সুতরাং, আগের হাড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়, তারপরে তার চারপাশে মাংস হওয়া শুরু হয়। কিছু বইয়ে অবশ্য ৭ম সপ্তাহে মাসেল বা মাংস তৈরি শুরু হয় বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু তাহলেও এক্ষেত্রে কুরআনের তথ্য ভুল নয়। কারণ সপ্তম সপ্তাহ শুরু হয় ৪২ দিনে এবং শেষ হয় ৪৯ দিনে। এর মধ্যে প্রথমে হাড়ের কাঠামো গঠন হয় এবং এরপরে হাড়ের চারিদিকে মাংস তৈরি হয়। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখবে যে, মায়োটোমকে তখনই মাংসপেশী বলা যাবে যখন মায়োটোম মাংসপেশীর বৈশিষ্ট্য পূরণ করবে।
“বিখ্যাত এম্ব্রায়োলজিস্ট জন অ্যালেন এবং বেভারলেই তাঁদের The Fundamentals of Human Embryology বইয়ে মাংসপেশি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে লিখেছেন যে, হাড়ের কাঠামো গঠিত হবার পরেই দ্রুত মাংশপেশী তৈরি করার কোষগুলো অর্থাৎ মায়োব্লাস্টগুলো হাতের সামনে এবং পিছনে জমা হয়ে মাংসপেশীর পিণ্ড তৈরি করে।’[২২.১] অতএব, তোমার ওই অভিযোগও ভুল যে, হাড় ও মাংসপেশী একসাথে তৈরি হয়।
“তারপরে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, আমাদের নতুন সৃষ্টিরূপে মাতৃগর্ভ থেকে বের করে আনেন। নতুন সৃষ্টি বলার কারণ হলো, এই প্রক্রিয়াগুলো ঘটার আগ পর্যন্ত মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভ্রূণ বাহ্যিকভাবে আলাদা করা যায় না। দেখো, কুরআন এই সূক্ষ্ম ব্যাপারেও আমাদের সঠিক তথ্য দিয়েছে। কত কল্যাণময় স্রষ্টা তিনি, সুবহানাল্লাহ! অতএব, তোমার দ্বিতীয় অভিযোগটিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলো। এখন, ছবিটির দিকে লক্ষ করো। দেখো, ৫ সপ্তাহে শুধু হাড়ের গঠন দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোনো মাংসপেশী দেখানো হয়নি। আবার, ৮ সপ্তাহে হাড়ের চারিদিকে মাংসপেশী দেখানো হয়েছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখবে। মানবদেহে হাড় তৈরি পরিপূর্ণ হয় দু’টি প্রক্রিয়ায়। প্রথমটি, ইন্ট্রামেমব্রেনাস অসিফিকেশন প্রক্রিয়ায় এবং পরেরটি ইন্ট্রাকার্টিলেজিনাস অসিফিকেশন প্রক্রিয়ায়। এই অসিফিকেশান ভ্রূণের জরায়ুতে থাকাকালীন ২য় মাস থেকে একটি বাচ্চার ২৫ বছর পর্যন্ত হয়। সুতরাং, প্রথমেই ভ্রূণে একদম পরিপূর্ণ হাড় তৈরি হয় না। এই হাড় তরুণাস্থি ও মেম্ব্রেনাস ফর্মে থাকে। ভ্রূনে আগে সম্পূর্ন হাড় হয়, তারপরে মাংস হয় – ব্যাপারটি এমন নয়। মূলত, যেখানেই হোক, আগে হাড় তৈরি শুরু হয়, তারপর তার চারপাশ থেকে আস্তে আস্তে মায়োব্লাস্ট ডিফারেন্সিয়েশন হতে হতে মাংসপেশী তৈরি হয়। কুরআনে এমনটিই বুঝানো হয়েছে। আশা করি, এর চেয়ে ভালোভাবে আর কেউ তোমাকে বুঝাবে না! এবার এই ছবিটি দেখো। এখানে, কুরআনে বর্ণিত ইজামাহ বা হাড় এবং লাহমা বা মাংস তৈরির স্টেজ দেখানো হয়েছে। ”
মাঝখান থেকে নাবিলা বলে উঠলো, “উফফ! ভাবী এত বড় লেকচার দিচ্ছো, যা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। আমার আর সময় নেই, আমি নিচতলায় সিনথিয়ার কাছে যাচ্ছি। তোমরা কথা বলো। আমার বোঝা হয়ে গেছে যে, কুরআনে আল্লাহ তা’আলা ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে ঠিকই বলেছন।”
আদনান অবজ্ঞার সুরে বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে, নিচে যা। তাড়াতাড়ি আসিস। আর ফাতিমা, আমি জানতাম তুমি এমন কোনো উত্তরই আমাকে দিবে। কিন্তু তুমি হয়তো লক্ষ করোনি যে, হাদীসের সাথে তোমার এই ব্যাখ্যার সরাসরি বিরোধ আছে। কারণ বোখারির হাদীসে বলা আছে যে, ‘নুতফাহ’ জরায়ুতে ৪০ দিন পর্যন্ত জমা থাকে, তারপর ৪০ দিন পরে তা ‘আলাকাহ’ হয়, তারপরের ৪০ দিন পর ‘মুদগাহ’ হয়। অর্থাৎ, ১২০ দিনে এই ‘মুদগাহ’ স্টেজ শেষ হয়। আর তুমি বললে ৪০ দিনেই এই তিন স্টেজ কমপ্লিট হয়। কী ব্যাখ্যা দিলে তুমি! হা হা হা। তুমি এত পড়াশোনা করেছো, আর এটা জানো না? আর এখন আবার তোমার ব্যাখ্যা ঘুরিয়ে দিয়ো না। নাবিলা কিন্তু সাক্ষী আছে তোমার দেওয়া ব্যাখ্যার ব্যাপারে। এই ব্যাপারে তুমি আর কোনো নতুন ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। আর এই হাদীসকে তুমি অস্বীকারও করতে পারবে না। কারণ হাদীসটি বোখারিতে আছে। সুতরাং, তুমি হেরে গিয়েছো। হা হা হা।”
ফাতিমা বললো, “হুম, মিশনারিদের ওয়েবসাইটে ভালোই ঘোরাঘুরি করেছো দেখছি। কিন্তু সত্য খোঁজার চেষ্টা কখনো করোনি। আচ্ছা এই হাদীসের ব্যাখ্যা যদি আমি দিতে পারি তাহলে কী হবে?”
“আরে তুমি আর কী ব্যাখ্যা দিবে? ইন্টারনেটে এসব উত্তর দেওয়া ওয়েবসাইটে হাজার বার খুঁজেও এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা পাইনি। আর তো তুমি! মূলত এই বিষয়ের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেয়েই আমার মনে সংশয় ঢুকেছিলো। তখন এক জায়গায় দেখলাম যে এক লোক ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, হাদীস নাকি মোহাম্মদের মারা যাবার অনেক পরে লেখা হয়েছে। এই জন্যে তার নিজস্ব অভিমত হলো, যদি কোনো বাস্তব সত্যের সাথে হাদীসের বিরোধ দেখা যায়, তাহলে তিনি হাদীস ত্যাগ করবেন যদিও তা সহি হয়। তুমিও এই কাজ করবে মনে হয়। হা হা। আচ্ছা যাও, তোমাকে একটা সুযোগ দেই। তুমি যদি এর ব্যাখ্যা দিতে পারো, তাহলে আমি কোরানকে আল্লাহর কেতাব হিসেবে বিশ্বাস করবো এবং তার উপর ঈমান আনবো।” কথাগুলো বলে ভাবগাম্ভীর্যের সাথে সোফায় বসা অবস্থায় পায়ের উপর পা তুলে নাড়তে লাগলো আদনান।
ফাতিমা বললো, “আচ্ছা, ঠিকাছে। প্রথম কথা হলো, আমি সহীহ হাদীস অস্বীকার করবো না। কারণ হাদীস যখন সহীহ হয়, তখন তা সত্য হিসেবেই ধরা হয়। কিন্তু সহীহ হাদীসের সাথে যদি সরাসরি কুরআনের আয়াতের প্রকৃত অর্থে সুস্পষ্ট বিরোধ থাকে, তাহলে সেটা অস্বীকার করা যায়।[২৩] এছাড়া সহীহ হাদীস অস্বীকার করলে সে ভুল করবে। যদি এখানে কুরআনে বলা থাকতো ৪০ দিনে ৩টি স্টেজ কমপ্লিট হয়, আর হাদীসে থাকতো ১২০ দিনে, তখন এটা স্পষ্ট বিরোধ হতো। তখন আমি হাদীস রিজেক্ট করতে পারি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কুরআনে দিন উল্লেখ নেই। তাই সহীহ হাদীস ত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এই হাদীসের উপর তোমার বোঝার ভুল আছে। তুমি যেই হাদীসটি উল্লেখ করেছো সেটি শুধু বুখারিতেই না; সেটি মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদেও আছে। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে এটি একটি প্রসিদ্ধ হাদীস। তুমি যেই হাদীসটি বলেছো, সেটি আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তুমি যেভাবে বলেছো, একদম সেভাবে না। বুখারিতে বর্ণিত হাদীস থেকে দুইটি শব্দ বাদ পড়েছে। সুতরাং, বুখারির হাদীসটি সংক্ষিপ্ত। আর, সেই কারণে যারা ট্রান্সলেশান পড়ে কিন্তু হাদীসের ব্যাপারে যাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই, তারা ভুল বোঝে। যেমন, তুমি!
“এখন তোমাকে একটি নীতি শিখাই। উসুলে হাদীসের নিয়ম অনুযায়ী একই বর্ণনাকারী থেকে যদি একটি হাদীস এক জায়গায় কিছু শব্দ কম ও অন্য জায়গায় কিছু শব্দ বেশি হিসেবে বর্ণিত হয়, তাহলে সংক্ষিপ্ত হাদীস দিয়ে দলিল গ্রহণযোগ্য নয়। বরং বেশি শব্দে বর্ণিত হাদীস থেকেই প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। বুখারি ও মুসলিমের উভয় হাদীসের বর্ণনাকারী আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ। তাই যেহেতু সহীহ মুসলিমে সম্পূর্ণ হাদীস আছে, তাই সহীহ মুসলিমের হাদীস দিয়ে দলিল দিতে হবে।”- কথাগুলো বলে ফাতিমা ডায়েরির কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে একটি পৃষ্ঠায় গিয়ে থামলো। সেখানে কয়েকটি হাদীস অর্থসহ লেখা ছিলো। সেখান থেকে দেখে দেখে ফাতিমা পড়তে শুরু করলো-
«عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ حَدَّثَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ الصَّادِقُ الْمَصْدُوقُ ~ إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ثُمَّ يَكُونُ (فِي ذَلِكَ) عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يَكُونُ(فِي ذَلِكَ) مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يُرْسَلُ الْمَلَكُ فَيَنْفُخُ فِيهِ الرُّوحَ وَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ بِكَتْبِ رِزْقِهِ وَأَجَلِهِ وَعَمَلِهِ وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ……
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
“তিনি বলেন, ন্যায়পরায়ণ ও ন্যায়নিষ্ঠরূপে প্রত্যায়িত রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির বস্তুসমুহ (প্রাথমিক চোখ, কান, নাক, হাত, পা ইত্যাদি) তার মায়ের গর্ভে চল্লিশ দিনে একত্রিত করা হয়, এবং এর মধ্যে (ওই চল্লিশ দিনেই) সেটি জোঁকের ন্যায় আকারে পরিণত হয় তার মতো (আলাক্বা’র মতো), তারপর এর মধ্যে (ওই চল্লিশ দিনেই) সেটি একটি গোশত টুকরায় পরিণত হয় তার মতো (মুদ্গাহ’র মতো)। তারপর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতাকে প্রেরণ করা হয়। সে তাতে রূহ্ ফুঁকে দেয়। আর তাকে চারটি কালিমা বা বিষয় লিপিবদ্ধ করার আদেশ করা হয়। রিয্ক, মৃত্যুক্ষণ, কর্ম, বদকার ও নেককার। সে সত্তার শপথ ……।”[২৪]
হাদীসটি পড়ে ফাতিমা বললো, “এখানে এমন বাংলা করার কারণ আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। হাদীসটিতে ‘তার মতো বা আলাকা’র মতো এবং তার মতো বা মুদ্গাহ’র মতো’ বলতে বোঝানো হয়েছে যে, ওই ৪০ দিনে আলাকা বা মুদ্গাহ এর যতটুকু পরিপূর্ণ হওয়ার দরকার ছিলো, ততটুকুই হয়েছে। এর বেশি হওয়া সম্ভব নয়। যেমন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা আদম (‘আঃ)-কে তৈরি করেছেন তাঁর আকৃতিতে।’ ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এখানে ‘তাঁর’ বলতে আদম (‘আঃ)-কে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, মানুষ যেমন শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পৌঁছায়, আদম (‘আঃ)-এর বেলায় বিষয়টি এমন ছিলো না। তাঁকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর আকৃতিতেই তৈরি করেছেন। সুতরাং, আল্লাহ আলাক্বা ও মুদগাহকে তাদের পরিপূর্ণ আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন। এখানে সেটিই বোঝানো হয়েছে।”
আদনান ফাতিমার কথার মাঝে বললো, “আচ্ছা, ঠিকাছে সেটা। কিন্তু আমার অভিযোগ ১২০ দিন নিয়ে। সেটার ব্যাখ্যা বলো।”
ফাতিমা বললো, “হ্যাঁ, বলছি। তোমার নতুন উত্থাপিত অভিযোগের প্রথম মিথ্যাচার হলো, এই হাদীসে কোথাও এই কথা বলা নেই যে, ৪০ দিন ভ্রূণকে ‘নুতফা’ অবস্থায় রাখা হয়।’ এই হাদীসটি অন্য একটি সূত্রে আবু আওয়ানাহ (রাঃ) থেকে পাওয়া যায়। সেখানে এই কথাটি অতিরিক্ত আছে যে, ‘নুতফা’কে ৪০ দিন পর্যন্ত রাখা হয়। কিন্তু এই বর্ণনার সনদ সহীহ না। সহীহ সনদগুলোতে ‘নুতফা হিসেবে ৪০ দিন রাখা হয়’ কথাটুকু নেই।[২৫] সুতরাং, এই কথাটুকু অপ্রমাণিত। দ্বিতীয়ত, এখানে আছে প্রত্যেকের সৃষ্টির বস্তুসমূহ অর্থাৎ, প্রাইমিটিভ বা প্রাথমিক চোখ, কান, নাক, হাত, পা ইত্যাদি তার মায়ের গর্ভে চল্লিশ দিনে একত্রিত করা হয়। এবার তুমি এখানে আরবি টেক্সটের দিকে খেয়াল করো। এখানে আমি দুটি শব্দকে ফার্স্ট ব্র্যাকেটের মধ্যে চিহ্নিত করেছি। শব্দ দু’টি হলো- ‘ফি জালিকা(فِي ذَلِكَ)’ অর্থাৎ ‘তার মধ্যে’। এই শব্দ দুইটি দুই জায়গায় আছে। একটি হলো ‘এবং’ ও ‘সেটি জোঁকের ন্যায় আকারে পরিণত হয়’ এর মাঝে। এবং দ্বিতীয়টি আছে ‘তারপর’ ও ‘সেটি একটি গোশত টুকরায় পরিণত হয়’ এর মাঝে। সুতরাং, এই লাইনের অর্থ দাঁড়ায়, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির বস্তুসমুহ অর্থাৎ, প্রাথমিক চোখ, কান, নাক, হাত, পা ইত্যাদি তার মায়ের গর্ভে চল্লিশ দিনে একত্রিত করা হয়, এবং এর মধ্যে বা ওই চল্লিশ দিনেই সেটি জোঁকের ন্যায় আকারে পরিণত হয় তার মতো অর্থাৎ, আলাকা’র মতো; তারপর এর মধ্যে বা ওই চল্লিশ দিনেই সেটি একটি গোশত টুকরায় পরিণত হয় তার মতো অর্থাৎ, মুদ্গাহ’র মতো।’ এই শব্দ দু’টি বুখারিতে এই একই হাদীসে অনুপস্থিত। এর কারণে বুখারির হাদীস থেকে অনেকে ভুল বোঝে যে, নুতফা, আলাক্বা ও মুদগাহ এই তিন স্টেজে সময় লাগে ১২০ দিন। কিন্তু এটি হাদীসের সঠিক বুঝ না, যেটি সহীহ মুসলিমের হাদীস থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।”
“কোথায়? বোখারির হাদীসটি দেখি।” উৎসুক দৃষ্টিতে আদনান ডায়েরিতে তাকালো।
ফাতিমা বললো, “এই যে দেখো। বুখারির হাদীসের দিকে লক্ষ করো এবং ‘?’ চিহ্নের দিকে তাকিয়ে দেখো যে, সেখানে ওই শব্দ দু’টি নেই।”
«عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ حَدَّثَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ الصَّادِقُ الْمَصْدُوقُ قَالَ إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ثُمَّ (؟)عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يَكُونُ(؟) مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يَبْعَثُ اللهُ مَلَكًا فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعٍ بِرِزْقِهِ وَأَجَلِهِ وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ فَوَاللهِ إِنَّ أَحَدَكُمْ أَوْ الرَّجُلَ يَعْمَلُ بِعَمَلِ….
বুখারি এবং মুসলিমের হাদীস দুটি ভালোভাবে মিলিয়ে নিলো আদনান। তারপরে ডায়েরি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ফাতিমাকে বললো, “হ্যাঁ, তাই তো।”
ফাতিমা বললো, “এই তো, লাইনে এসেছো। আদনান, আরেকটি বিষয় লক্ষ করো। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মুদগাহ’ অর্থাৎ, ‘এক টুকরা মাংস বা চর্বিত মাংস’ তৈরির পরে সেটি থেকে ‘ইজামা’ বা হাড় সৃষ্টি হয়।[২৩:১৪] এবং হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন মাতৃগর্ভে নুতফাহ’র অর্থাৎ, মিলিত শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর উপর বিয়াল্লিশ দিন চলে যায়, তখন আল্লাহ তা‘আলা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তিনি নুতফাহকে একটি রূপ দান করে তার কান, চোখ, চামড়া, মুদগাহ বা মাংসপিণ্ড ও ইজামা বা হাড় সৃষ্টি করে দেন।[২৬] তাহলে কী বুঝলে?”
“তুমিই বুঝিয়ে বলো, আমার মাথা ঘুরছে।” আদনানের সহজ উত্তর।
ফাতিমা বললো, “আচ্ছা, আমিই বলছি। এ থেকে বোঝা গেলো যে, মুদগাহ বা এক টুকরা গোশতের পরে হাড় বা ইজামাহ তৈরি হয়। এবং এই হাদীসে দেখা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ভ্রূণ মাতৃগর্ভে ৪২ দিন অতিবাহিত করলে তারপর তার হাড় বা ইজামাহ তৈরি হয়। সুতরাং, বুখারির হাদীসে যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন যে, ১২০ দিনে ‘মুদগাহ’ বা মাংসপিণ্ড তৈরি হয় এবং তার পরে হাড় বা ইজামাহ হয়, তাহলে এই হাদীসের সাথে তাঁর নিজের বক্তব্যই বিরোধপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি একই বিষয়ে দুই রকম কথা কেন বলবেন? সুতরাং, ওই হাদীসের অর্থ যদি আমরা মুসলিমে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী ধরি যে, নুতফা, আলাকা ও মুদগাহ এই তিন স্টেজ পূর্ণ হয় ৪০ দিনের মধ্যেই, তাহলে কোনো হাদীসের মধ্যে বিরোধ থাকে না এবং বিজ্ঞানের সাথেও সাংঘর্ষিক না। এই হাদীসে অর্থের ব্যাপকতা আছে। হাদীসটিতে ‘ফি জালিকা বা এর মধ্যে’ এই শব্দটুকু ৩টি শব্দগুচ্ছকে ইঙ্গিত করতে পারে। হয় এই হাদীসে ‘ফি জালিকা’ শব্দ দুটি সৃষ্টির বস্তুসমুহ বা প্রাথমিক চোখ, কান, নাক, হাত, পা ইত্যাদিকে ইঙ্গিত করছে। অথবা, শব্দ দুটি মায়ের গর্ভকে ইঙ্গিত করছে। নাহলে শব্দ দুটি ‘চল্লিশ দিনে’ শব্দগুচ্ছকে ইঙ্গিত করছে। এবং হাদীসটিতে ‘মিসলা জালিকা বা তার মতো’ এই শব্দটুকু ২টি জিনিসকে ইঙ্গিত করতে পারে। একটি ‘তার মতো অর্থাৎ, আলাকা’র মতো’ অথবা ‘তার মতো অর্থাৎ, মুদ্গাহ’র মতো’ এবং অপরটি ‘চল্লিশ দিন’।
“এখন হাদীসটিতে ‘ফি জালিকা বা এর মধ্যে’ এই শব্দটুকুর ইঙ্গিত যদি ‘সৃষ্টির বস্তুসমুহ অর্থাৎ, প্রাথমিক চোখ, কান, নাক, হাত, পা ইত্যাদি’ বা ‘মায়ের গর্ভে’ এবং ‘মিসলা জালিকা বা তার মতো’ এই শব্দটুকুর ইঙ্গিত যদি ‘চল্লিশ দিন’ ধরে অনুবাদ করা হয়, তাহলে সেই অনুবাদ প্রচলিত অনুবাদের সাথে মেলে। কিন্তু তাহলে এই হাদীসের সাথে সহীহ মুসলিমের হুযায়ফা (রাঃ) এর যে হাদীসটি আমি এইমাত্র বললাম, তার সাথে বিরোধ লেগে যায়। কারণ এভাবে অনুবাদ করলে নুতফা, আলাক্বা ও মুদ্গাহ স্টেজে ১২০ দিন লাগে এবং এই ১২০ দিন পরে ইজামাহ বা হাড় তৈরি শুরু হয়। কিন্তু, মুসলিমের আরেকটি হাদীসে আছে হাড় তৈরি শুরু হয় ৪২ দিন পরে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এভাবে অনুবাদ করা ঠিক নয়। কিন্তু যদি আমরা ‘ফি জালিকা বা এর মধ্যে’ এই শব্দটুকুর ইঙ্গিত ‘চল্লিশ দিনে’ এবং ‘মিসলা জালিকা বা তার মতো’ এই শব্দটুকুর ইঙ্গিত ‘তার মতো অর্থাৎ, আলাকা’র মতো বা তার মতো অর্থাৎ, মুদ্গাহ’র মতো’ ধরে অনুবাদ করি, তাহলে হাদীসের অর্থ আসে যে, ৪০ দিনের মধ্যেই নুতফা, আলাকা, মুদগাহ স্টেজ শেষ হয়ে যায় এবং ৪০ দিন পরে যেকোনো সময় হাড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। আবার সহীহ মুসলিমের আরেকটি হাদীসে ‘হাড় তৈরি শুরু হয় ৪২ দিন পরে’ এই কথাটুকুর সাথেও বিরোধ থাকে না। সুতরাং, উপরোক্ত হাদীসের অর্থ এভাবে করাই যুক্তিযুক্ত। তাহলে তোমার কোনো অভিযোগ তো ধোপে টিকলো না। এবার কি ঈমান আনবে?”
আদনান বললো, “আরে এত ব্যস্ততার কী আছে? আমার আরো প্রশ্ন আছে। এখন বলো, এই হাদীসের অর্থ অনেক স্কলার তো ১২০ দিনই ধরেছে। আমি যদি বলি যে, মুসলিমরা যখন দেখলো বিজ্ঞান অনুযায়ী এই হাদীসের কারণে কোরানে বর্ণিত ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন তারা এই নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে, তখন তোমার উত্তর কী হবে?”
ফাতিমা হেসে দিয়ে বললো, “দেখো, এই হাদীসে ভাষাগত জটিলতা থাকার কারণে স্কলারদের মধ্যে এর অর্থ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। কী জটিলতা আছে, সেটি তো একটু আগে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলাম। আর ভ্রূণবিদ্যা আবিষ্কারের আগে যে এই ব্যাখ্যা ছিলো না, তা কিন্তু না। কারণ ৭ম শতাব্দীতেই একজন বিখ্যাত স্কলার কামাল আব্দুল ওয়াহিদ ইবনে আব্দুল কারিম আয-জামলাকানি বলেছেন, ‘এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, মায়ের গর্ভে নুতফাহ, আলাকা, মুদগাহ এই তিনটি ধাপ পূর্ণ হয় ৪০ দিনেই’।[২৭] অতএব, এই কথা বলার সুযোগ নেই যে, এই ব্যাখ্যা পরে সংযোজিত হয়েছে। তিনি এই জিনিসটি ইসলামের প্রথম যুগেই ব্যাখ্যা করেছেন। আমার মনে হয় এর পরে তোমার আর কোনো কথা থাকতে পারে না। অর্থাৎ, শেষ কথা হলো, কুরআন মানুষ সৃষ্টির সূচনা এবং ভ্রূণবিদ্যার ব্যাপারে সঠিক তথ্য দেয়। এতে কোনো ভুল নেই। কী, আদনান? এখন কি তোমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি এই আশা করতে পারি যে, তুমি তোমার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনছো?”
আদনান বললো, “ঠিক আছে তোমার কথাগুলো। কিন্তু … ।”
“এখনো কিন্তু?” ফাতিমা বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলো।
আদনানকে বলতে না দিয়ে ফাতিমা বললো, “আদনান, একটু অন্তর থেকে চিন্তা করো। নিজের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবো। আচ্ছা, তোমাকে বুঝাতেই একটি উদাহরণ দেই। কিন্তু তাই বলে তুমি মনে করো না যে আমার বিশ্বাসে সন্দেহ আছে। ধরো, আমার বিশ্বাস মিথ্যা। সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ নেই। তাহলে মারা যাবার পরে তোমার বা আমার কারো কিন্তু কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি আমার বিশ্বাস ঠিক হয় আর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলে কেউ থাকে, তাহলে কিন্তু আমি বেঁচে যাবো। কিন্তু তোমাকে চিরদিন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই বিষয়টি নিয়ে একটু একাকী চিন্তা করো।”
আদনানকে কিছু বলতে না দিয়ে মোবাইলে কুরআনের অ্যাপস বের করে ফাতিমা বললো, “এখন, আমি তোমাকে কুরআনের কিছু আয়াত শুনাই। দেখো তোমার অন্তর উজ্জীবিত হয় কি না। তোমরা যেসব কথা এখন বলো যে, মানুষের সৃষ্টির কোনো উদ্দেশ্য নেই, মানুষ মৃত্যুর পরে মাটির সাথে মিশে যাবে, মানুষের কোনো বিচার হবে না, ইত্যাদি বিভিন্ন কথা। কিন্তু দেখো, আল্লাহ তোমাদের এসব কথার উত্তর সেই ১৪০০ বছর আগেই কুরআনে দিয়ে গেছেন।
“কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন- ‘তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না?[২৮] মানুষ বলে, আমার মৃত্যু হলে পর আমি কি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবো? মানুষ কি স্মরণ করে না যে, আমি তাকে ইতিপূর্বে সৃষ্টি করেছি এবং সে তখন কিছুই ছিলো না?[২৯] তারা বলে, আমরা যখন মরে যাবো, এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হয়ে যাবো, তখনও কি আমরা পুনরুত্থিত হবো? এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণও? বলুন, হ্যাঁ এবং তোমরা হবে লাঞ্ছিত।[৩০] কাফেররা দাবী করে যে, তারা কখনও পুনরুত্থিত হবে না। বলুন, অবশ্যই হবে, আমার পালনকর্তার কসম, তোমরা নিশ্চয় পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমাদেরকে অবহিত করা হবে যা তোমরা করতে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।[৩১] এখন আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করাবো পৃথিবীর দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; ফলে তাদের কাছে ফুটে উঠবে যে, এ কুরআন সত্য। আপনার পালনকর্তা সর্ববিষয়ে সাক্ষ্যদাতা, এটা কি যথেষ্ট নয়?[৩২] আয়াতগুলো নিয়ে একটু চিন্তা কি করবে না?”
আদনান কোনো কথা বলছে না। চুপ করে শুনছে। এতক্ষণের আলোচনায় আদনানের তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও, আয়াতগুলো পড়ে শোনানোর পরে আদনানের চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। কিছুক্ষণ চিন্তা করে আদনান উঠে নিজের রুমে চলে গেলো।
রাত তিনটা বাজে। ফাতিমা ঘুম থেকে উঠে দেখে টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো এবং আদনান বসে বসে ল্যাপটপ দেখছে। ফাতিমা চোখ দু’টি মুছে উঠে বসলো। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, আদনান নিজের ছোটবেলার ছবিগুলো একটির পরে একটি সিরিয়ালি দেখে যাচ্ছে। আর কী যেন চিন্তা করছে।
ফাতিমা জিজ্ঞাসা করলো, “কী হয়েছে, আদনান?”
আদনানের উত্তর, “চিন্তা করে দেখলাম তোমার কথাই ঠিক। এই যে ছোটবেলা থেকে দেখতে দেখতে ৩০ বছর হয়ে গেলো। ছবিগুলো দেখে নিজের পরিণতির কথা চিন্তা করছি। মৃত্যু কখন আসে, সেটা তো বলা যায় না। এই জীবন কি শুধুই খাওয়া, টাকা কামানো, খেলাধুলার জন্যই? নাকি এর কোনো উদ্দেশ্য আছে? হ্যাঁ, অবশ্যই জীবনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমাকে অবশ্যই সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”
ফাতিমা বললো, “তো? এখন কী করতে চাও?”
আদনান ঝলমলে চোখে প্রশ্ন করলো, “ঈমান কিভাবে আনতে হয় যেন?”
ফাতিমা মনের খুশিতে কেঁদে দিয়ে বললো, “আমার সাথে বলো, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”
-“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”
-“ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহু।”
-“ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহু।”
-“ওয়া রাসূলুহু।”
-“ওয়া রাসূলুহু।”
ফাতিমা বললো, “আল্লাহু আকবার। তুমি এখন একজন মুসলিম। এবার অর্থ বুঝে পড়ো, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদত যোগ্য কোনো সত্ত্বা নেই।”
আদনান বললো, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদত যোগ্য কোনো সত্ত্বা নেই।”
ফাতিমা বললো, “এবার বলো, আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র বান্দা এবং বার্তাবাহক।”
আদনান বলল, “আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র বান্দা এবং বার্তাবাহক।”
হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় জ্বলজ্বল চোখে ফাতিমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো, “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিলো।”
[বিঃদ্রঃ বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এরকম ঘটনা অবাস্তব নয়। কিন্তু ইসলামিক শরী’য়াহ অনুযায়ী একজনের কুফরি প্রকাশ পাওয়ার পরে তার সাথে সংসার করা জায়িয নয়। এগুলো প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিছক কিছু গল্প। আদর্শিকভাবে কিছু এখান থেকে গ্রহণ না করার অনুরোধ করা হলো। আমাদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু যেন শুধু গল্পের প্রধান তথ্যগুলো নিয়েই থাকে।
এটি ভ্রূণবিদ্যা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নাস্তিকদের প্রচারিত মিথ্যাচারের জবাব। আশা করি তারা এরপর থেকে অপপ্রচারগুলো বন্ধ করবে। সমস্ত জ্ঞান তো আল্লাহ তা’আলার কাছেই। লেখাটিতে যা কিছু ভুল তা আমার ও শয়তানের পক্ষ হতে এবং যা কিছু কল্যাণ, সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে।]
[১] সূরা আল-ইমরান; আয়াত নং- ৫৯
[২] সুনানে আবু দাউদ; অধ্যায়: সুন্নাহ, হাদীস নং- ৪৬৯৩
[৩] সূরা আন’আম (৬); আয়াত নং-২
[৪] সূরা সাফফাত (৩৭); আয়াত নং- ১১
[৫] সূরা হিজর (১৫); আয়াত নং- ২৬
[৬] সূরা আর-রহমান (৫৫); আয়াত নং- ১৪
[৭] সূরা মু’মিনুন (২৩); আয়াত নং- ১২
[৮] https://www.livescience.com/3505-chemistry-life-human-body.html
[৯] https://en.m.wikipedia.org/wiki/Earth
[১০] সূরা সিজদাহ (৩২); আয়াত নং- ০৭,০৮
[১১] A Word for Word Meaning of Quran By Mohar Ali; Volume: 02; Page: 371,924
[১২] Arabic-English lexicon By Edward William Lane; Volume: 08; Page: 288
E-link: http://lexicon.quranic-research.net/data/25_n/167_nTf.html
Sperma Meaning: https://medical-dictionary.thefreedictionary.com/sperma-
[১৩] সূরা ইনসান (৭৬); আয়াত নং- ০২
[১৩.১] https://www.britannica.com/science/ovulation
[১৩.২] সিমেন: https://www.almaany.com/en/dict/ar-en/semen/
[১৩.৩] মুসনাদে আহমাদ, প্রথম খণ্ড (ইঃফা), পবিত্রতা অধ্যায়, পৃষ্ঠা- ১৯৬-১৯৮
[১৩.৪] সূরা কিয়ামাহ (৭৫); আয়াত: ৩৭
[১৩.৫] সহীহ মুসলিম (সিদ্দিকি আহমেদ অনূদিত); খন্ড: ০৮, অধ্যায় বিবাহ ও আযলের হুকুম, হাদীস নং- ৩৩৮১
[১৩.৬] মুসনাদে আহমাদ; খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৪৩৭ (হাদীসটি জয়িফ। শুধুমাত্র শব্দের ব্যবহার বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।)
[১৪] Arabic-English lexicon By Edward William Lane; Volume: 05; Page: 423-417
[১৪.১] https://translate.google.com/#auto/en/%D8%B9%D9%84%D9%82%D8%A9
[১৫] The Developing Human, Clinically Oriented Embryology By Dr. Keith L. Moore; 10th edition; Page : 78
[১৬] http://www.embryology.ch/anglais/fplacenta/cordon01.html
[১৭] Arabic-English lexicon By Edward William Lane; Volume: 08; Page: 275
[১৮] The Developing Human, Clinically Oriented Embryology By Dr. Keith L. Moore; page: 619
[১৯] A Word for Word Meaning of Quran By Mohar Ali; Volume: 02; Page: 1078
[২০] সহীহ মুসলিম-তাকদীর অধ্যায়; হাদীস নং- ৬৪৮৫ (ইঃফাঃ)
[২১] Langman’s medical embryology (9th Edition); Chapter: Skeletal System Development; Page no- 196-171
The Developing Human, Clinically Oriented Embryology By Dr. Keith L. Moore(8th edition); Chapter: The limbs; page : 441
[২১.১] Langman’s medical embryology (9th Edition); Chapter: Muscular System Development; Page no- 203
[২২] Langman’s medical embryology (9th Edition); Chapter: Muscular System Development; Page no- 208-199
[২২.১] The Fundamentals of Human Embryology By John Allen and Beverley Kramer; 2nd Edition, Wits University Press(2010); Page no: 148
[২৩] https://islamqa.info/en/115125
[২৪] সহীহ মুসলিম; তাকদীর অধ্যায়; হাদীস নং- ৬৪৮২(ইঃফা)
[২৫] ফাতহুল বারি (ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী); ভলিউম: ১১; পৃষ্ঠা: ৪৭৯-৪৮১
[২৬] সহীহ মুসলিম; তাকদীর অধ্যায়; হাদীস নং- ৬৪৮৫(ইঃফা)
[২৭] আল-বুরহান আল কাশিফ, ‘আন ইজায আল-কুরআন; পৃষ্ঠা: ২৭৫
[২৮] সূরা মু’মিনুন (২৩); আয়াত নং- ১১৫
[২৯] সূরা মারইয়াম (১৯); আয়াত নং- ৬৬
[৩০] সূরা সাফফাত (৩৭); আয়াত নং- ১৬
[৩১] সূরা আত-তাগাবুন (৬৪); আয়াত নং- ০৭
[৩২] সূরা ফুসসিলাত (৪১); আয়াত নং- ৫৩
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।