“আমার দাদা যখন আমার মতো যুবক ছিলেন তখন খুব শখ করে একখানা রঙ্গিন শার্ট কিনেছিলেন দাদীকে দেখতে যাওয়ার আগের দিন। কিন্তু মুরুব্বীদের ধমকে ক্লাসিকাল কুর্তাই পরতে হলো পরের দিন, আর শার্টখানা স্থায়ী নিবাস গড়ে নিলো লোহার সিন্দুকের তলায়। দিন, মাস, বছর গেছে; গেছে যুগের পর যুগ; স্থান-কালের হামাগুড়িতে কত গ্রহণ-বর্জন, বর্ষণ, ঘর্ষণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে গেছে; ঘটে চলেছে সিন্দুকখানির বাইরে আর ভেতরে। যাই হোক, আমাদের ফোকাস যেহেতু শার্টখানা, তাই গল্পের মূলে ফিরে যাচ্ছি। বাবার মুখে শোনার পর ভার্সিটির শীতকালীন ছুটিতে এবার গ্রামে এসে খুব উৎসুকভাবে আমি সিন্দুকটি খুললাম। জং ধরা কড়া ভাঙতে হলো, বাইরের দেয়ালে ভারী মাকড়শার জাল, ভেতরে তেলাপোকার ডিম আর লোমহীন তুলতুলে শিশু ইঁদুরদের দৌরাত্ম দেখে বুঝলাম অনেক আগেই সিন্দুকের তলায় জং ধরে ছিদ্র হয়ে ছিলো। বুঝতেই পারছেন আমাদের গল্পের ফোকাস – রোমান্স মাখা সেই বর্ণিল শার্টখানা কত ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু চক্ষু-চড়কগাছ, আমি আবিষ্কার করলাম, দীর্ঘ সময়ের বায়োফিজিকোকেমিক্যাল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় শার্টখানা একটি রঙ্গিন ব্লেজারে পরিণত হয়েছে যার মধ্যে ছাপার হরফে ব্রান্ড লেখা ‘John Lewis’. অবাক হচ্ছেন? কিন্তু এটাই বাস্তবতা। মানতে পারছেন না? দেখুন আপনার পরনের শার্টখানাও কিন্তু ফেলে রাখলে ময়লা হবে, লোহার জং থেকে তাতে লালচে দাগও পড়ে, পানিতে অনেক দিন থাকলে পঁচে যাবে তথা সময়ের সাথে পরিবেশের পরিবর্তনে বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে তাতে পরিবর্তন আসবেই। আপনার অকপট জিজ্ঞাসা – তাই বলে শার্ট কি ব্লেজারে বদলে যাবে? আরে ভাই, ওই যে ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো যেগুলো আমরা প্রতিনিয়ত দেখি – সেগুলোই দীর্ঘ … মানে অনেক দীর্ঘ কিন্তু … মানে মনে করেন কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে সিলেকশনের ফলে সুতা, কাপড়, সাইজ, শেপ, কাটিং, ডিজাইন চেঞ্জ হয়ে শার্টখানা ‘John Lewis’ এর ব্লেজারে পরিণত হয়েছে। আপনি ছানাবড়া চোখে দুষ্টু ছেলের বোকামির মতো প্রশ্ন করে বসলেন – ওই মিয়া! এইডা কী কন? আপনের দাদার লগে আপনের বিলিয়ন বছরের ফারাক, আপনের দাদায় কি ডাইনোসর আছিলো, আপনে ডাইনোসরের নাতি!!!”
গল্প আপাতত এখানেই সমাপ্ত। আসুন এবার এই গল্পের অসারতা বনাম যৌক্তিকতা নিয়ে একটি গণভোট আয়োজন করি। আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক(!) মানে রেডিকাল-বস্তুবাদী চেতনাকে পুঁজি করে একের পর এক টিভি কমার্শিয়াল, মোড়ে মোড়ে রঙ্গিন বিলবোর্ড, ব্যানার, নিয়মিত আলোচনা সভা, প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সিলেবাস চেঞ্জ এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সিভিল সোসাইটি, পলিটিকাল এসেম্বলি আর বিজ্ঞান সভার সদস্যদেরকে ইনভল্ভ করে ব্যাপক প্রচারণা বা জনসচেতনতা(!) তৈরির পর ভোটের ফলাফল বেশ অনুমেয়। আর সেই সাথে যুক্ত হবে – ঠিক বেঠিকের মানদণ্ড হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা বা রায়, মানে মেজরিটি চাইলেই বেঠিকও ঠিক গণ্য হবে। এই প্রেক্ষাপটে আমি যদি একবার আমার গল্পটা যৌক্তিক এবং বিজ্ঞাননির্ভর – এই বিলটা পাশ করিয়ে ফেলতে পারি তাহলেই আমি সর্বেসর্বা, সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে। বরং আমার গল্পে অসারতা খুজতে আসলেই আপনি অজ্ঞ এবং কুসংস্কারবাদী।
গল্পের ঢেঁকি ফেলে চলুন এবার একটু ইতিহাস ঘাঁটি। মধ্যযুগের ইউরোপ – জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোহীন এক অন্ধকূপ। যেখানে বিজ্ঞানচর্চা মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ, যেখানে নারীর অধিকার হচ্ছে ডাইনি আখ্যা নিয়ে আগুনে পুড়ে মরা, যেখানে হেলথ ইনস্যুরেন্স হচ্ছে মহামারিতে এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা কমে যাওয়া, যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা মানে জীর্ণশীর্ণ-রোগাক্রান্ত জনগণের ওপর অত্যাচারের গিলোটিন, যেখানে অর্থনীতি হচ্ছে সাধারণের রক্ত-ঘামের ফসলের ওপর চার্চের আর রাজ-রাজড়াদের করের পাহাড়। শত শত বছর ধরে এভাবেই অন্ধকার ইউরোপ ছিল ক্যাথলিক চার্চের নিয়ন্ত্রণে। ধর্মের এই শোষণোন্মুখ, হিংস্র, মানবতাবিরোধী আচরণে ভারাক্রান্ত ইউরোপের ইতিহাসকে এক কথায় ইংরেজ ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন বলেছেন ‘barbarism and religion’. ধর্ম যখন স্বৈরাচারীর ভূমিকায়, তখন স্বৈরাচারবিরোধী বিপ্লব যে ধর্মবিরোধিতার রূপ নেবে তা সহজেই বোধগম্য। আর এ কারণেই ইউরোপের সংস্কারবাদী আন্দোলন তথা রেনেসাঁ বা এনলাইটেনমেন্টের রূঢ় এবং গূঢ় প্রতিপাদ্য ছিল ধর্মের শেকল থেকে মানুষকে মুক্ত করা। আন্দালুস পর্যন্ত ইসলামের বাতি পৌঁছালেও তা বাকি ইউরোপ আলোকিত করতে পারেনি। আব্দুর রহমান আল গাফেকি’র (রহঃ) পর ইউরোপের মূল ভূমি তথা ফ্রান্স, জার্মানি বা ব্রিটেন পদানত করতে কোনো মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হয়নি। এছাড়া পরবর্তীতে আন্দালুসের ব্যর্থতা ধর্মবিরোধী রেনেসাঁর জন্যে হয়েছে শাপেবর। অন্ধকার ইউরোপে তাই রেনেসাঁই একচ্ছত্র আলোর মশাল বা মুক্তির দিশা হয়ে উঠলো, যা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছিলো ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। রেনেসাঁ ইউরোপকে উপহার দিলো সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত এক জীবনব্যবস্থা – যার নাম সেক্যুলারিজম। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই পুরোপুরি ধর্ম বা স্রষ্টার প্রভাবমুক্ত মানুষের তৈরি বস্তুবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে সেক্যুলার প্রগতি। জাতিসংঘ, গণতন্ত্র, সুদী ব্যাংকিং, পার্লামেন্টারি আইন বিধান, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুই এই প্রগতির অংশ। আর এই প্রগতির দৌড়ে পিছিয়ে থাকা আমাদের মতো দেশগুলোতে প্রগতিশীলতা মানেই ধর্মনিরপেক্ষতা, আদতে ধর্মবিরোধিতা – এই বাস্তবতা অন্তত বাংলাদেশিদের বুঝিয়ে বলতে হবে না।
এবারে চলুন শুরুতে বলা সেই শার্টের গল্পে ফিরে যাই। সিন্দুকের ভেতরে শার্ট থেকে প্রাকৃতিক বিবর্তনে ব্লেজার তৈরি হওয়ার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে আমি পরিকল্পিতভাবে বায়াসড গণভোটের প্রস্তাব করেছিলাম। মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আসুন এটাকে বেশ অতিরঞ্জিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে ধরে নেই – আমরা তা নিতেই পারি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, বাস্তবতা হচ্ছে অন্ধকার ইউরোপের প্রেক্ষাপটে রেনেসাঁর অন্যতম মাইলস্টোন ‘ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদ’কে প্রতিষ্ঠা পেতে এমন কোনো ষড়যন্ত্রের প্রয়োজন ছিলো না । ফরাসী বিপ্লবের আগে পরে ইউরোপীয় প্রগতিবাদীরা রাষ্ট্র, সমাজ এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে মানবরচিত সেক্যুলার মতবাদগুলোকে প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলতে পারলেও একমাত্র পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব এবং জীববৈচিত্র্য রয়ে গিয়েছিলো তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই চার্লস ডারউইন যখন তাঁর বিবর্তনবাদের প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হলেন, তখন বিদ্যুৎগতিতে এই আইডিয়া প্রসার লাভ করলো। কারণ প্রগতিশীল ইউরোপ আগে থেকেই এরকম একটি ধারণা বা তত্ত্বের জন্যে মুখিয়ে ছিলো যার মাধ্যমে স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণকে বাদ দিয়ে জীব ও জীবনকে ব্যাখ্যা করা যাবে। ফলে যা হবার তাই হলো। সমস্ত ক্রিটিসিজমকে পাশ কাটিয়ে, হাইপোথেসিসকে থিওরিতে পরিণত করতে বিজ্ঞানের চিরাচরিত মেথডলজি যেমন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভেরিফিকেশন, এক্সপেরিমেন্টাল অবজারভেশন বা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে, ডারউইনের হাইপোথেসিস স্বতঃসিদ্ধ থিওরিতে পরিণত হলো যা কোনো প্রমাণ ছাড়াই সকলকে মেনে নিতে হবে।
দেশীয় প্রগতিবাদীরা ফসিল রেকর্ডের টেপ রেকর্ডার বাজাতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শার্ট থেকে ব্লেজার আসার জন্যে (শার্টটিকে রিপ্রোডিউসিং বায়োলজিকাল এন্টিটি ধরে নিয়ে) ন্যাচারাল সিলেকশনকে বিলিয়ন বছর কাজ করতে হলে এর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে অসংখ্য ইন্টারমিডিয়েট নমুনা পাওয়া যেতো। এদের একটির পর একটিতে ক্রমিক পরিবর্তন দেখা যেতো, যেহেতু ‘survival of the fittest’ এর কন্টেক্সটে আমাদের গল্পে ব্লেজারটাই সারভাইভ করেছে আর বাকি সব ইন্টারমিডিয়েটস কম্পিটিশনে ফেইল করেছে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে যেহেতু ফেইল্ড নমুনাগুলোর মাধ্যমেই ক্রমপরিবর্তনগুলো ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মত করে ন্যাচারালি সিলেক্টেড হয়ে সফল এন্ড প্রোডাক্ট তৈরি করলো, তাই ফেইল্ড নমুনাগুলো হাজির করলেই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রমাণ করা খুব সহজ। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে এভাবে একটি সফল স্পিসিস পর্যন্ত আসতে অসংখ্য ফেইল্ড ইন্টারমিডিয়েট থাকবে যারা বিবর্তনের ফলে ক্রমপরিবর্তনের সাক্ষী। আর বর্তমানে পৃথিবীতে স্পিসিসের সংখ্যা অনুযায়ী তাহলে সমগ্র পৃথিবী ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ফেইল্ড ইন্টারমিডিয়েটস এর ফসিলে পূর্ণ থাকবে। কিন্তু জটিল ম্যামালস তো দূরে থাক, একটি সাধারণ উদ্ভিদ প্রজাতিরও বিবর্তনের সম্পূর্ণ ক্রম ফসিল রেকর্ড দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। এজন্যে আমরা বিবর্তনবাদীদের কাছ থেকে ‘মিসিং লিংক’ কথাটা বার বার শুনি, আর এ-ও শুনি যে তর্ক না করে আমাদের কেন মিসিং লিংক খোঁজা উচিত ইত্যাদি। আর আমাদের ফসিল রেকর্ডের ফসিলগুলোও কি বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফেইল্ড বা ট্রান্সিয়েন্ট ইন্টারমিডিয়েট নাকি বর্তমানে এক্সটিংট কোনো স্বকীয় স্পিসিস, এর সুনির্দিষ্ট উত্তর প্রগতিশীল বিজ্ঞানীদের মধ্যেই নেই ।
বিবর্তনের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ হিসেবে যেটা বলা হয় বর্তমানে তা হচ্ছে ‘micro evolution’ যার উদাহরণ আমরা শার্টের গল্পেই দিয়েছি কিছুটা। ‘Micro evolution’ হচ্ছে পরিবেশের সাথে ইন্টারেকশনের ফলে জীবদেহে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবদেহ পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। এর আরেক নাম অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশন। আমরা ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়া বা সেল কালচারে জিন এক্সপ্রেশনে যে পরিবর্তনগুলো দেখি, বা চারপাশের জীবজগতে যে পরিবর্তনগুলো দৃষ্টিগোচর হয় যেমন স্পিসিসের অভ্যন্তরীণ ভেরিয়েশন, বা অবজারভেবল মিউটেশন এবং মিউট্যান্ট – এ সবই ‘micro evolution’ এর প্রাক্টিকাল উদাহরণ। এগুলোকেই ‘macro evolution’ বা ডারউইনিয়ান বিবর্তনের শক্তিশালী দলিল হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এখানে বেশ বড় একটা ফারাক আছে যেটা ধামাচাপা দেওয়ার মতো করেই চাপা দেওয়া হয়। তা হলো, ‘micro evolution’ যে ‘macro evolution’ এর নিয়ামক এই ধারণাটাও একটা প্রমাণ-অযোগ্য থিওরি, আদতে হাইপোথেসিস এবং ‘macro evolution’ নিজেও একটা হাইপোথেটিকাল থিওরি। বিজ্ঞানের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হচ্ছে থিওরিকে ভেরিফাই করা হবে এক্সপেরিমেন্ট বা অবজারভড ডাটা দিয়ে, একটি থিওরির ভেরিফিকেশন বা প্রুফ কখনই আরেকটি থিওরি হতে পারে না। শার্টের ওপরে ঘটে যাওয়া ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবজারভেবল এবং প্রাক্টিকাল। শার্টের রং চেঞ্জ হতে পারে, বোতাম ছুটে যেতে পারে, কাপড় ছিঁড়তে পারে, দাগ লাগতে পারে, কিন্তু শার্টের এই পরিবর্তনগুলোই সম্মিলিতভাবে শার্টকে পাঞ্জাবী বা ব্লেজারে পরিণত করবে এ কথা অগ্রহণযোগ্য। নিও-ডারউইনিজমে এই ফারাকটাকেই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে শার্টের ওপরে ঘটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ‘micro evolution’ এর উদাহরণ আর এখানে শার্টের চেঞ্জগুলো গ্রাজুয়াল সিলেকশনের ফলে ব্লেজারের উদ্ভব হওয়ার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘macro evolution’। প্রথমটি বাস্তব, কিন্তু পরেরটি ফিকশন। কারণ প্রথমটিকে পরেরটির চলমান প্রক্রিয়া বলার জন্যে আমাকে প্রমাণ হাজির করতে হবে যে আসলেই এমনটি হতে পারে, আর এখানেই বিবর্তনবাদীরা প্রমাণনির্ভর বিজ্ঞানকে ছেড়ে হয়ে উঠেছে গায়েবে বিশ্বাসী। মানে যদিও প্রমাণ নেই, তবুও ব্যাপারটা এটাই। প্রখ্যাত বিবর্তনবাদী জর্জ ওয়াল্ড এক্ষেত্রে সময়কেই দিয়ে দিলেন নিয়ন্ত্রকের আসন, “সময়ই হচ্ছে মূলত এই ষড়যন্ত্রের নায়ক। যে সময়কাল নিয়ে আমরা এখানে কথা বলছি তার অনুক্রম হচ্ছে দুই বিলিয়ন বছর। আমরা মানবীয় অভিজ্ঞতায় যা অসম্ভব মনে করি, তা এখানে অর্থহীন। এই দীর্ঘ সময়ের সাপেক্ষে অসম্ভব হয়ে যায় সম্ভব, সম্ভব হয়ে যায় ঘটনীয়, আর ঘটনীয় হয়ে যায় বস্তুত সুনিশ্চিত। শুধু অপেক্ষা করতে হবে, সময় নিজেই অলৌকিকের জন্ম দেবে।”[১] জর্জ ওয়াল্ড নিজেও বিবর্তনবাদের প্রমাণ-অযোগ্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং মানবীয় অভিজ্ঞতাকে জমা দিতে বলছেন অদেখা অলৌকিকতার ব্যাংকে। কিন্তু অলৌকিক তো বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান তার নিজের ডেফিনেশনেই লৌকিক মানবীয় অভিজ্ঞতার সীমায় আবদ্ধ। নিওডারউইনিস্টদের অন্যতম পুরোধা এবং DNA অণুর গঠনের আবিষ্কারকদের একজন ফ্রান্সিস ক্রিক বলেন, “জীববিজ্ঞানীদেরকে অবশ্যই প্রতিনিয়ত মনে রাখতে হবে তারা যা কিছু দেখছে তা ডিজাইন নয়, বরং বিবর্তনের ফল।”[২] ডারউইনিয়ান বিবর্তনের ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ভেরিফায়েবল কোনো প্রমাণ হাজির করা সম্ভব নয় এ কথা সবাই জানে এবং ওয়াল্ড, ক্রিকরা আমাদের চেয়েও ভালোভাবে জানে। আর এজন্যেই বিবর্তনবাদকে নিরীক্ষা না করেই জাস্ট মেনে নিতে হবে, এবং জীববিজ্ঞানীদেরকে ক্রিক তা-ই করতে বলছেন।
বিজ্ঞানের নিয়ম হচ্ছে নিরপেক্ষ নিরীক্ষণ, পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই এবং ভেরিফিকেশনের আগে কোনো হাইপোথেসিসকে গ্রহণ-বর্জন করা যাবে না। হাইপোথেসিস উপস্থাপনের স্বাধীনতা বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য আর বৈজ্ঞানিক মেথডলজির নিরপেক্ষ প্রয়োগ হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রাণ। তা নাহলে বিজ্ঞান মরে গিয়ে অপবিজ্ঞান বা গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের দরজা খুলে যায়। আর বিজ্ঞানের দর্পণ হচ্ছে – একটি গবেষণার ফলাফলকে অন্য গবেষণা প্রতিনিয়ত আক্রমণ করবে, পুরনো ধারণাকে নতুন তথ্য এসে বাতিল করে দেবে, এককালের বিজ্ঞানীদের কনসেন্সাস পরবর্তীকালের নতুন পর্যবেক্ষণের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে ইতিহাস হয়ে যাবে। এ কারণেই টলেমির সৌর মডেল, চিরস্থায়ী মহাবিশ্ব, ফ্লজিস্টন থিওরি ইত্যাদি এখন অতীত আর এভাবেই বর্তমানের ধারণাগুলোকেও বিজ্ঞান কখনো নিশ্চিত সত্যের সার্টিফিকেট দেয় না। এটাই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য এবং এভাবেই বিজ্ঞান স্বকীয় গতিতে এগিয়ে চলে সভ্যতার জন্যে সত্যের খোঁজে এবং উন্নতির পথে। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই তত্ত্বকে গ্রহণ কিংবা তথ্য-প্রমাণ অগ্রাহ্য করে তত্ত্বকে বর্জনের মানসিকতা এই স্বকীয় প্রবাহে বাঁধ তৈরি করে, যেটাকে এক কথায় গোঁড়ামি বলা যায়। বিবর্তনবাদী প্রগতিশীলরা চায় আমরা প্রশ্ন না করে, প্রমাণ না চেয়ে, তথ্যকে যাচাই না করে মেনে নেবো জীবজগত বিবর্তনের ফল। তাদের মধ্যে যারা গোঁড়া, তারা এর বিপরীত মন্তব্যকারীদেরকেই গোঁড়া বলবে। এই গোঁড়াদের সংখ্যাই বেশি যারা ডারউইনিজমকে বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর তাদের মধ্যে যারা কিছুটা মুক্তমনা তারা বলে, “আসলে আমাদের কাছে জীবনের ভৌত ব্যাখ্যার জন্যে ডারউইনিজমের কোনো বিকল্প নেই।” ডারউইনিজমকে এরা ঠিক বিশ্বাস নয়, বরং জীববিজ্ঞানের গাইডিং প্রিন্সিপাল মনে করে। কিন্তু কেন ?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদেরকে আবারো ক্যাথলিক ধর্মের যাঁতাকলে পিষ্ট ইউরোপের সেই করুণ ইতিহাস স্মরণ করতে হবে। স্মরণ করতে হবে স্বৈরাচারী চার্চের বিরূদ্ধে ধর্মবিরোধী বিপ্লব রেনেসাঁর কথা, ফরাসী বিপ্লব এবং সেক্যুলার সভ্যতার জন্মের কথা – যেখানে স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণমুক্ত ভৌত বস্তুবাদের মশালে খোঁজা হয়েছে আলোর দিশা। এই আলোই(!) ইউরোপকে আপাত মুক্তি এবং প্রগতি এনে দিয়েছে, তাই এই আলো দিয়েই বিশ্বকে দেখতে হবে। এই আলোর বাইরে যা কিছু আছে সবই অন্ধকার। তাই এই আলোতেই খুঁজতে হবে সব ব্যাখ্যা, সব প্রশ্নের উত্তর। তাই জীবনের জন্যে বিবর্তনবাদই একমাত্র ব্যাখ্যা। এর পক্ষে যত দুর্বল যুক্তি, অযুক্তি, প্রমাণহীনতা বা প্রমাণঅযোগ্যতা, ক্রিটিসিজম কিংবা বিপক্ষে তথ্য-প্রমাণ থাকুক না কেন – সবকিছুর ওপরে বিবর্তনের র্যাশনালকেই জাস্টিফাই করতে হবে যদিও তাতে মানবীয় কমনসেন্সকে উপেক্ষা করা হয়। সময়ের দোহাই দিয়ে ওয়াল্ডরা আমাদেরকে তাই করতে বলছেন। ক্রিকরা শিখিয়ে দিচ্ছেন যে, বিজ্ঞানের নিরপেক্ষ নজরকে পাশ কাটিয়ে আগে থেকেই বায়াসড দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ল্যাবরেটরিতে যেতে হবে।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমাদের মুসলিমদের কী করা উচিত? চার্চের ফান্ডিং-এ ডারউইনিজমের বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তিতর্ক তুলে ধরে ব্লগ, কলাম, বই ছাপানোর পাশাপাশি আবার জেনেসিসের বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা প্রচার প্রসারের জন্যে খোদ পোপের মুখে বিবর্তনবাদকে সত্যায়ন করিয়ে চার্চের টিকে থাকার দ্বৈরথ – আমাদের মুসলিমদের জন্যে অনুকরণীয় হতে পারে না। আমাদের মনে রাখতে হবে বিবর্তনবাদের ঝড়ে চার্চের মত করে ইসলাম এবং আমরা অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাইনি। আমাদের ইতিহাস ভিন্ন, আমাদের সভ্যতা ভিন্ন। আমাদের সভ্যতায় ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের রেষারেষি নয়, বরং দেহমনের সম্পর্ক। একারণেই দুনিয়াতে যখন রাষ্ট্র থেকে পরিবার পর্যন্ত, মসজিদ থেকে বাজার পর্যন্ত, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত ছিলো, তখন আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানেও শ্রেষ্ঠ ছিলাম।
তাই প্রথমত, আমাদেরকে নিজেদের ইতিহাস জেনে হীনমন্যতা ত্যাগ করতে হবে। দু-একটা জার্নাল পেপার পাবলিশ করার জন্যে প্রফেসরের সাথে তাল মিলিয়ে ম্যানুস্ক্রিপ্টে ঠিকই বিবর্তনের কাসুন্দী ঘাঁটবো, আর মসজিদে গিয়ে তাওহীদী হবো – এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। আপনি আলাদা সভ্যতা, আলাদা ঐতিহ্য থেকে এসেছেন সেটা প্রফেসরের সাথে শেয়ার করুন না! জার্নাল পেপারে আপনাকে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ লিখতে হবে এমন না, কিন্তু আপনি বিবর্তনবাদকে বৈজ্ঞানিক মনে করেন না। যুক্তি ও প্রশ্নের তীরের ফলা ধার দিন এবং প্রফেসরের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আদায় করে নিন, তা না হলে তাওহীদ কম্প্রোমাইজ করতে হয় এমন পেপারে নিজের অথরশিপ উইথড্র করুন। আল্লাহ খালিক্ব আর আমরা মাখলুক্ব। আল্লাহ জানা আজানা সব প্রাণ তৈরি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় এবং তাদেরকে জীবনধারণ, আহার, বিহার, বংশবৃদ্ধির জন্যে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। কোনো গর্ভ নিষিক্ত হয় না আল্লাহর হুকুম ছাড়া, কোনো গাছের পাতা পড়ে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। জমিনের অন্ধকারে ব্যাকটেরিয়া থেকে বাতাসে ফুলের রেণু – কোনো কিছুর গতিপ্রকৃতি আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয়। প্রত্যেক জীবিত প্রাণের রিযিক আল্লাহই তার কাছে পৌছে দেন, জীবন-মৃত্যুর মালিকও আল্লাহ, স্পিসিসের এক্সটিংশন কিংবা নতুন স্পিসিসের উদ্ভব আল্লাহর ইচ্ছা এবং হুকুমেই হয়। এভাবে আপনি জীববিজ্ঞানের তাওহীদকে জেনে নিন। যদি শিক্ষক হন, পাঠ্যপুস্তকে যা-ই থাকুক ছাত্রদেরকে আমাদের সভ্যতা, আমাদের বিজ্ঞান, আমাদের ঐতিহ্যের সবক দিয়ে পাঠ্যপুস্তককে আমাদের মতো করে, মানে ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করুন। আদি কোষকে প্রকৃত কোষের এন্সেসটর না বলে বরং মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখে কোষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় এবং পর্যবেক্ষণে তাদের কী কী তফাৎ ধরা পড়ে তার লিস্ট দিয়ে ছাত্রদের নিজেদেরকেই স্যাম্পল থেকে দুই শ্রেণীর কোষকে আলাদা করতে বলুন। ছাত্রদেরকে বাস্তব বিজ্ঞান পড়ান যেটা আমরা চোখে দেখি। মিলিয়ন বছর পূর্বে আদি কোষ বিবর্তিত হয়ে প্রকৃত কোষ তৈরি হওয়ার অবৈজ্ঞানিক ফিকশনকে খণ্ডন করার তথ্য-যুক্তি-প্রমাণ ছাত্রদের সামনে তুলে ধরুন। আপনি বাবা হলে সন্তানকে প্রয়োজনে বায়োলজি টিচারের সাথে কন্সট্রাক্টিভ এবং লজিকাল আর্গুমেন্টে যাওয়ার রসদ সরবরাহ করুন।
এবং দ্বিতীয়ত, আন্দালুসে যে আলো নিভে গিয়েছিলো সেই ইসলাম এবং কোরআনের মশালবাহী আলোর দিশারী হয়ে উঠি আমরা। কারণ অন্ধকার ইউরোপের গর্ত থেকে শুধু বিবর্তনবাদই উঠে আসেনি, এমন আরো অনেক কিছুই উঠে এসেছে যা আপনার আমার চারপাশে সেক্যুলারিজমের নামে তাওহীদকে ভুলুণ্ঠিত করছে। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ইস্যু নয়। সূর্যের খোঁজ না পেলে মানুষ আলেয়াকেই আলো ভাববে। কিন্তু আমরা সূর্যের দেশের বাসিন্দারাই আজ আলেয়ার পেছনে ছুটছি। সেক্যুলার ইউরোপীয় বিজ্ঞান আমরা পাতার পর পাতা মুখস্ত করছি, কিন্তু জানতে চাইনি যে রজার বেকনের দু’শ বছর আগেই প্রথম ফর্মাল বিজ্ঞানী ইবন আল হাইসাম আধুনিক বিজ্ঞানের মেথডলজি আবিষ্কার করে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ করে গিয়েছেন। আল হাইসাম বিজ্ঞানকে দেখেছেন সত্যকে জানা এবং এর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে মানবীয় এক পরশ পাথর হিসেবে। তিনি বলেছেন, “সত্যের স্বার্থেই সত্যের অন্বেষণ করতে হবে … সত্যকে খুঁজে পাওয়া কঠিন এবং এর রাস্তা অমসৃণ কেননা সত্য নিমজ্জিত থাকে অস্পষ্টতার মধ্যে … কিন্তু আল্লাহ বিজ্ঞানীদেরকে ভুল থেকে নিরাপদ করেননি এবং বিজ্ঞানকে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করেননি। যদি এমনটাই হতো, তাহলে বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের কোনো ক্ষেত্রেই দ্বিমত করতেন না। এজন্যে সত্যের অন্বেষণকারী সে নয় যে পূর্ববর্তীদের লেখাগুলো পড়ে এবং স্বভাবসুলভ প্রবণতায় সেগুলোকে আস্থার সাথে গ্রহণ করে নেয়; বরং সে-ই, যে সেগুলোর প্রতি নিজের বিশ্বস্ততাকে সন্দেহ করে এবং লব্ধ জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যে যুক্তি ও প্রমাণের কাছেই হার মানে, ভুলত্রুটি আর খুঁতে ভরা স্বভাবের মানুষের দেওয়া বাণীর কাছে নয়। তাই যে ব্যক্তি বিজ্ঞানীদের লেখা যাচাই করে, যদি সত্যকে জানা তার উদ্দেশ্য হয় তাহলে তার দায়িত্ব হচ্ছে সে যা কিছু পড়ছে নিজেকে তার শত্রু বানিয়ে নেওয়া, বিষয়বস্তুর মূল এবং সীমায় নিজের বুদ্ধিমত্তাকে প্রয়োগ করে সবদিক থেকে একে আক্রমণ করা। এছাড়াও এই প্রক্রিয়ায় সমালোচনামূলক নিরীক্ষণের সময় সে নিজেকেও সন্দেহের জায়গায় রেখে সতর্ক থাকবে যাতে গোঁড়ামি বা পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে বেঁচে থাকা যায়।”[৩, ৪]
অথচ ক্রিকদের বিবর্তনবাদে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখতে হবে। যা দেখা যাবে সেটা বিবর্তনের ফল, ভিন্ন চিন্তার জায়গা নেই এখানে। আল হাইসামের বিজ্ঞানের সাথে বিবর্তনবাদের কত পার্থক্য! আল হাইসাম বিজ্ঞানকে দেখেছেন আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জনের উপায় হিসেবে। তিনি বলেছেন, “আমি প্রতিনিয়ত জ্ঞান ও সত্যকে খুঁজি, এবং আমি বিশ্বাস করি আল্লাহর নূরে আলোকিত হতে ও তাঁর নৈকট্য লাভে, সত্য ও জ্ঞান অন্বেষণের থেকে আর কোনো উত্তম পন্থা নেই।”[৫] রেনেসাঁর বিজ্ঞানের দর্শন ঠিক এর উল্টো – সত্য ও জ্ঞানকে ভুলত্রুটি আর খুঁতে ভরা স্বভাবের মানুষের চিন্তার গণ্ডিতে বেধে Essentialy Godless সভ্যতা গড়ে তোলা। আমাদের বিজ্ঞানের দর্শন আর রেনেসাঁর বিজ্ঞানের দর্শন ভিন্ন এবং বিপরীত। ওয়াহী এবং বিজ্ঞান – জ্ঞানের শ্রেণীবিভাগে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরি, একটি ডিভাইন প্রেসক্রিপশন এবং অপরটি মানবীয় প্রচেষ্টা। এজন্যে ইঞ্চির স্কেলে যেমন ভর মাপা অর্থহীন, তেমনি ওয়াহীকে আমরা বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করি না বরং ওয়াহী বিজ্ঞানকে আলো দেখায়। কারণ ওয়াহী বা আল্লাহর বাণী হচ্ছে সুনিশ্চিত জ্ঞান আর বিজ্ঞান হচ্ছে ইনহেরেন্টলি অনিশ্চয়তায় ভরা। বিজ্ঞান চোখ হলে ওয়াহী হচ্ছে আলো। আর আলোর অনুপস্থিতিতে চোখের দৃষ্টি পথভ্রষ্ট হবে। এজন্যে রেনেসাঁকে পথভ্রষ্ট বললে সাথে সাথে চার্চের ওয়াহীও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কারণ চার্চের ওয়াহী আলোর বদলে অন্ধকারের নর্দমা তৈরি করেছিলো যেখানে রেনেসাঁর আলেয়া পথের দিশারী হয়ে উঠেছে। সেখানে বিবর্তনবাদের মতো মতবাদগুলোর আদতে কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ওয়াহীর সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক আসলে অনেক গভীর। ওয়াহীর দাবিদার সব এন্টিটিগুলোর মধ্যে যাচাই, বাছাই, বিচার, বিশ্লেষণ এবং সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রয়োজন যেমন আছে, তেমনি বিজ্ঞানকে অস্পষ্ট-অস্বচ্ছ পথে চলে সত্য ও জ্ঞানের মঞ্জিলে পৌঁছাতে সত্য ওয়াহীর কাছ থেকেই আলো ধার করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোরআন আসলেই অবিকৃত কিনা এবং একই প্রশ্নে বাইবেলের স্ট্যাটাস কী – তা জানতে চাইলে নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারস্থ হতে হবে। আবার ওয়াহীর আলো না থাকলে অস্পষ্টতায় পথ হারিয়ে বিজ্ঞান নিজেই কুসংস্কার ও গোঁড়ামিতে আক্রান্ত হবে। ‘কয়েক বিলিয়ন বছর আগে প্রথম জীবকোষের উদ্ভব বা অমুক তমুক তমুকের কমন এনসেস্টর’ এ ধরণের অলৌকিক প্রমাণ-অযোগ্য মনুষ্যবাণীও মূলধারার বিজ্ঞান বলে বিবেচিত হবে।
সত্য ধর্ম আর বিশুদ্ধ বিজ্ঞান, এর যে কোনো একটির অনুপস্থিতিতেই ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘর্ষ অনিবার্য। কিন্তু আমাদের সভ্যতার ইতিহাস ও উদাহরণ এমন নয়। বরং এখানে ধর্মের শৌর্যেই বিজ্ঞান বিকশিত হয়েছে। টুথব্রাশ থেকে হাসপাতাল, কফি থেকে জিপিএস, রোবোটিক্স থেকে এলগোরিদমিক্স, সার্জারি থেকে অপটিক্স, এলজেবরা থেকে ক্যামেরা, এক কথায় আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সলিড প্লাটফর্ম এবং দিকনির্দেশনা ইসলামী সভ্যতারই অবদান। কিন্তু যখন আমরা ধর্মের শৌর্য হারিয়েছি, তখন বিজ্ঞানও আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। তাই ধর্ম-বিজ্ঞানের সংঘাত নয় বরং তাওহীদী বনাম সেক্যুলার সভ্যতার সম্যক সংঘাতের এই যুগে আমাদেরকে সভ্যতার সৈনিক হতে হবে, হতে হবে তাওহীদের পতাকাবাহক। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে সৃষ্টির দাসত্ব থেকে মুক্ত করা আর সেক্যুলারিজম চায় সামগ্রিকভাবে সৃষ্টির দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। সভ্যতার এই দ্বন্দ্বে বিবর্তনবাদ ছোট একটি ডট মাত্র, তাওহীদের সূর্যের কাছে রেনেসাঁর আলেয়া যেমন অসহায়, তেমনি দুর্বল। সমুদ্র নিয়ে যার চিন্তা, তাকে কীভাবে এক ফোঁটা জল ধাঁধায় ফেলবে! সত্য সমাগত হলে মিথ্যা পর্যবসিত হবেই। তাই সামগ্রিক ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যান। জীববিজ্ঞানও এই সমগ্রতার বাইরে নয়। তাই আপনি জীববিজ্ঞানী হলে আপনার ময়দানে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আপনাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে, মাথা উঁচু করে তাওহীদের স্লোগান তুলুন। নিজেই দেখবেন বিবর্তনবাদীরা কতটা দুর্বল!
মানুষের বিজ্ঞানকে বিবর্তনবাদ তথা বৃহত্তর সেক্যুলারিজমের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে তার নিজস্ব স্বকীয়তা ফিরিয়ে দেওয়াই হচ্ছে আমাদের কাছে বিজ্ঞানের দাবি। আর এই দাবি পূরণের জন্যে আগে নিজেকে গোঁড়ামিমুক্ত হতে হবে। আসুন শুরু করি … !!!
[১] Wald, George. 1955. The Physics and Chemistry of Life, p. 12. Chicago, Illinois: Simon and Schuster.
[২] Crick F 1988 What Mad Pursuit: a Personal View of Scientific Discovery (New York: Basic Books)
[৩] Sabra, A. I. Ibn al-Haytham. Harvard Magazine (2003). Available at: http://harvardmagazine.com/2003/09/ibn-al-haytham-html
[৪] Ibn Al Haytham, Doubts Concerning Ptolemy, Translated by S. Pines, as quoted in Sambursky 1974, p. 139.
[৫] Plott, C. (2000), Global History of Philosophy: The Period of Scholasticism, Motilal Banarsidass, ISBN 8120805518, Pt. II, p. 465.
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।