শাইখ মুহাম্মাদ নাসির-উদ-দিন ইবনু নূহ ইবনু আদাম নাজাতি আল-আলবানি ১৩৩২ হিজরি সাল তথা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আলবেনিয়ার রাজধানী শহর আসকোদেরায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্জ নূহ নাজাতি আল-আলবানি সেসময় একজন বিখ্যাত হানাফি আলেম ছিলেন। নাসিরউদ্দিন আলবানি তাঁর পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন শাইখ এবং তাঁর পিতার বন্ধুদের কাছে কুরআন, তাজবিদ, আরবি ভাষা, হানাফি ফিকহ্ ও দ্বীলার অন্যান্য শাখায় দীক্ষা গ্রহণ করেন।

বিভিন্ন কারণে আলবেনিয়ায় মুসলিমদের বসবাস ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে দাঁড়ালে তাঁর পরিবার আলবেনিয়া থেকে শামে (দামেস্ক) হিজরত করে। তখন তাঁর বয়স নয় বছর। শামে এসে তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আরবি ভাষা শিখতে শুরু করলেন। সেখানে চার বছর পড়াশোনা করে তিনি আরবি ভাষা আয়ত্ত করেন। কিন্তু একাডেমিক পড়াশুনা তাঁর বাবার পছন্দ ছিলো না বিধায় ছেলেকে মাদরাসা থেকে ছাড়িয়ে এনে ঘড়ি মেরামত শেখাতে লাগলেন। বেশ দ্রুতই আলবানি এটা রপ্ত করে ফেললেন এবং তাঁর কাজের সুনামও ছড়িয়ে পড়লো।

IIRT Arabic Intensive

এদিকে পড়াশুনায় নাসিরউদ্দিন আলবানির আগ্রহ থেমে থাকলো না। বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন নিয়মিত পড়তেন। বয়স বিশ বছর, এমন সময় একদিন বিখ্যাত ‘আল-মানার’ পত্রিকা তাঁর হাতে এলো। সে সময়ের বিশিষ্ট আলিম রশিদ রিদা এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ইমাম গাযযালি রচিত বই ‘ইহইয়া উলুম আদ-দীন’-এর দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস যাচাইয়ের ওপর আল-হাফিয আল-ইরাকি লিখিত ‘আল-মুগনী আল হামলিল আসফার ফীল আসফার ফি তাখরিজ মা ফীল ইয়াহিয়া মিনাল আকবার’ বই থেকে সিরিজ আকারে নিবন্ধ পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হচ্ছিল। লেখাগুলো পড়ে তিনি হাদিস শাস্ত্র এবং হাদিসের বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। এমনকি বইটির তিনটি খণ্ডই পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন; কিন্তু বইটি অনেক দুর্লভ হওয়ায় কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিলো না। অবশেষে দামেস্কের বিখ্যাত লাইব্রেরি ‘আল মাকতাবাহ আল জাহিরিয়াহ’ থেকে বইটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেললেন। এভাবেই তাঁর গবেষণাভিত্তিক পড়াশোনার শুরু হলো।

যদিও তাঁর পিতা একজন পণ্ডিত আলিম ছিলেন, কিন্তু হাদিস গবেষণায় নাসিরুদ্দিন আলবানির এতো আগ্রহ তাঁর পছন্দ হলো না। কেননা, তিনি ছিলেন হানাফি মাযহাবের একজন অন্ধ অনুসারী এবং হাদিসের থেকে ফিক্বহই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্ব বহন করতো। এদিকে সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞানসুধা আলবানির আগ্রহকে বাড়ালো বৈ কমালো না। ফলত ধীরে ধীরে তাঁর ও তাঁর বাবার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। এক পর্যায়ে তাঁর বাবা তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। আলবানি আলাদা একটি ঘড়ি মেরামতের দোকান খুললেন। শুরু হলো তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়।

তিনি দিনে মাত্র তিন ঘণ্টা দোকানে কাটাতেন, বাকি সময় দামাস্কাসের বিখ্যাত ‘আল মাকতাবাহ আল জাহিরিয়াহ’ লাইব্রেরিতে হাদীসের জ্ঞানার্জনে অতিবাহিত করতেন। সপ্তাহে শুক্র ও মঙ্গলবার দোকান একদমই খুলতেন না। সম্পূর্ণ দাওয়াতের কাজে এই দু’দিন কাটাতেন তিনি। এরপর এমন দাঁড়ালো যে, দৈনিক বিশ ঘন্টা তিনি গবেষণায় কাটাতে শুরু করলেন। সকাল সাড়ে আটটায় লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতেন এবং রাত ৯টায় বের হতেন। তিনি শুধু সালাতের জন্য বিরতি নিতেন, তাছাড়া খাওয়ার জন্যও যেন বেরোতে না হয়, তাই হালকা নাস্তা নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকতেন। তাঁর জ্ঞানপিপাসা দেখে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ তাঁর অধ্যয়নের জন্য একটি বিশেষ কক্ষের বন্দোবস্ত করে দিলো এবং নিয়মমাফিক খোলার সময়ের আগেই গ্রন্থাগারে ঢোকার জন্য তাঁকে একটি চাবিও দিয়ে দেওয়া হলো। এসময় গুলোতেই অনেক বিখ্যাত বই লিখা শুরু করেন তিনি। বিভিন্ন স্থানীয় সূফি ইমাম, মিথ্যা নবী দাবিদার, এমনকি নাস্তিকরাও তাঁর বিরোধিতা শুরু করলো। তারপরও তিনি সত্যের ওপর অবিচল রইলেন; শাইখ বাহজাতুল বাইজার, শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ এবং তাওফিক আল বাজরাহ (রহিমাহুমুল্লাহ)-এর মতো বিখ্যাত আলেমদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে পথচলা অব্যাহত রাখলেন।

তিনি দুইদিন সাপ্তাহিক দারস দেওয়া শুরু করলেন। সেখানে আকিদাহ, ফিকহ, উসুল এবং হাদিসশাস্ত্রের বিভিন্ন বই পড়াতেন। সিরিয়া ও জর্ডানের বিভিন্ন শহরে দাওয়াতি সফরও শুরু করলেন। অতঃপর মাদিনাহ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁকে মনোনিত করা হলো। এভাবে তাঁর সুনাম ও খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো, এবং হাদিসশাস্ত্রের একজন নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত হিসেবে তাঁর সমকালীন আলিমদের মাঝে স্থান করে নিলেন।

তিনি হাদীস, এর শাখাসমূহ এবং ফিকহের বিবিধ বিধি-বিধানের ওপর শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য –
• হাদিসের ওপর “সিলসিলাহ আস-সাহিহাহ”এবং “সিলসিলাহ আয-যয়িফাহ”
• সহীহ ওয়া যয়িফ জামি আস-সগির
• আল ইরওয়া গালিল
• সহিহ ওয়া দ্বা’ঈফ আল আদাবুল মুফরাদ
• সহিহ আবু দাউদ, সহীহ ইবন্‌ মাজাহ, সহিহ তিরমিযি, সহিহ নাসাঈ
• যয়িফ আবু দাউদ, যয়িফ ইবন্‌ মাজাহ, যয়িফ তিরমিযি, যয়িফ নাসাঈ
• মিশকাত মাসাবিহ-এর সহিহ সংস্করণ
• তাকফিরের ফিতনাহ
• সালাফের পথ-আমাদের আহবান
• সালাফদের গ্রন্থ, সুন্নাহ ও বর্ণনার আলোকে হজ ও ওমরাহের রীতি নীতি
• বিয়ের আদব
• নবিজীর সালাতের বর্ণনা
• রমযানের রাতের সালাত
• ফাতাওয়াহ-শাইখ মুহাম্মদ নাসির উদ্-দিন আল-আলবানি
• চেহারার পর্দা ইত্যাদি।

সহিহ ও যয়িফ হাদিস যাচাই ও পৃথকীকরণের বই রচনায় শাইখ আল-আলবানির অবদান অতুলনীয়। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান এত সুস্পষ্ট যে তা কারো পক্ষেই অস্বীকার করা অসম্ভব, এমনকি যারা তাঁর মানহাজের চরম বিরোধিতা করে তাদের পক্ষেও। অনেক আলিম তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, পরিশ্রম এবং হাদিস গবেষণায় প্রচার ও প্রসারে অবদানের জন্য প্রভূত প্রশংসা করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ, শাইখ আব্দুল আযিয আল-হুদ্দা বলেন, “শাইখ, মহান বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানের মহাসাগর, মুহাম্মাদ আল-আমিন আশ-শানকিতি (রহিমাহুল্লাহ), তাফসীর শাস্ত্র এবং আরবি ভাষায় যার সমতুল্য তাঁর জীবদ্দশায় কেউ ছিল না, তিনি শাইখ আল-আলবানিকে এতটা সম্মান করতেন যে, মাদিনায় দারস দানকালে যখন তাঁর দারসের সামনে দিয়ে শাইখ আল-আলবানি হেঁটে যেতেন, তাঁর সম্মানে দারস বন্ধ করে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে সম্মান করতেন।”

শাইখ আব্দুল ‘আযিয ইবন্‌ বায (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “বর্তমানকালে এই আসমানের নিচে মুহাম্মদ নাসির-উদ-দিন আল-আলবানির মতো হাদিস শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে আমি পাইনি।”

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন্‌ সালেহ আল-‘উসাইমিন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “তাঁর সঙ্গে আমার কিছু মাজলিসে সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সুন্নাহর উপর তাঁর একান্ত আনুগত্য এবং বিদ’আহর বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছাড়া আর কিছু দেখিনি আমি। আক্বিদাহ-আমাল নির্বিশেষে এই ছিল তাঁর অবস্থান। তাঁর লেখাগুলো আমি পড়েছি এবং দেখেছি, হাদিস শাস্ত্র এবং হাদীসের বর্ণনা ও তাহকিকে তাঁর অগাধ জ্ঞান রয়েছে। ইলম, মানহাজ এবং হাদীস শাস্ত্রের প্রতি তাঁর একাত্মতা বিষয়ক লিখনীর দ্বারা আল্লাহ তাআ’লা বহু মানুষকে উপকৃত করেছেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যে, মানুষের মাঝে তাঁর কাজ যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।”

তাঁর ছাত্রদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শাইখ হামদি আব্দুল মজিদ, শাইখ মুহাম্মদ ঈদ আব্বাসি, ড. উমার সুলাইমান আল আসকার, শাইখ মুহাম্মদ ইব্রাহিম শাকরাহ, শাইখ মুকবিল ইবন্‌ হাদি আল ওয়াদি’ঈ, শাইখ মুহাম্মাদ জামিল জাইনু, শাইখ সালিম আল-হিলালি এবং আরও অনেকে। ছিয়াশি বছর পর্যন্ত শাইখ আল-আলবানি গ্রন্থ রচনা, বক্তৃতা, দারস, পত্র লিখন এবং হাদিস যাচাই অব্যাহত রাখেন। তাঁর জীবনের শেষ দুই মাস তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। অবশেষে শনিবার ২২ জুমাদা সানিয়াহ, ১৪২০ হিজরি (২ অক্টোবর ১৯৯৯) তারিখে সূর্যাস্তের (মাগরিব) পূর্বেই তিনি তাঁর মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরকালের পথে পা দিলেন।

সেদিন সন্ধ্যাতেই তাঁর জানাযার সালাত আয়োজন করা হয়। পাঁচ হাজারেরও অধিক লোক তাঁর জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর ওয়াসিয়াত অনুযায়ী এতটা দ্রুত তাঁর সমাধিকার্য সম্পন্ন করা হয়। এছাড়াও তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর সমগ্র লাইব্রেরি, সকল মুদ্রিত বই এবং পাণ্ডুলিপি মাদিনাহ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হয়। কোনো সন্দেহ নেই, এই মহান আলিমের মৃত্যু আলিম সমাজ, তালিবুল ইলম, সাধারণ জনতা- বিংশ শতাব্দির সবাইকে প্রভাবিত করেছিল।


তথ্যসূত্র:

১. “নাসিরুদ্দিন আলবানির জীবনী”, বাংলা লেকচার, শাইখ শহীদুল্লাহ খান মাদানী

২.“The Life & Times of Sheikh Muhammad Nasiruddin Albaani”, ইংলিশ লেকচার, শাইখ আবু উসামা আত-তহাবি

৩. www.immamalbani.blogspot.com

৪. www.shaykhalbani.wordpress.com

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive