মানুষের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলার একটি বিশেষ নিয়ামত হলো তার হৃদয়। যা দিয়ে সে সব কিছু উপলব্ধি করতে পারে। এই হৃদয় দিয়েই একজন আরেকজনকে ভালোবাসে, ঘৃণা করে, আবার নিজেকেও বুঝতে চেষ্টা করে। তাই এই উপলব্ধি সবসময়ই সুখকর হয় না, কখনো ভালো, আবার কখনো মন্দ হয়ে থাকে। আর এতে কিছু হৃদয় শুরুতেই মরে যায় আবার কিছু হৃদয় মরতে মরতে বেঁচে যায়। তবে আমি এখানে মৃত হৃদয় নিয়ে তেমন কিছু বলবো না, আমি শুধু মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া দু-একটি আহত হৃদয় নিয়েই বলার চেষ্টা করবো (ইনশা আল্লাহ্ তা’আলা)।
এক বর্তমান জবটা আমার তৃতীয় জব। এর আগের দু’টিতে কোন ফিমেইল কলিগ না থাকলেও এবার কিন্তু দু-একজন আছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এটা আমার জন্য একটি ভিন্নরকম পরিবেশও বটে। আর এই ভিন্ন পরিবেশে এসে অল্প সময়েই অর্জন হয়েছে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা; যা না বললেই নয়। এই যেমন অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকাল ৭:৩০ এর গাড়ি ধরতে ব্যস্ত হওয়া, মামার দোকানে নাস্তা করতে বসে গাড়ির টেনশন করা, আবার নির্দিষ্ট টাইমের ৫-১০ মিনিট পূর্বেই অফিসে পৌঁছে যাওয়া ইত্যাদি। তবে অফিসে ঢুকতেই মাথায় যে বিষয়টা বেশি কাজ করে তা হচ্ছে- কখন যে বস তার বসগিরি দেখাতে শাসানো শুরু করবে। কারণ বস তার সম্মান ধরে রাখতে হলেও যেন দু-একটা কথা বলতে হবে। আর আমিও যেন দিনদিন এসব শুনতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। তবে এই শাসানোটা যখন কোনো ফিমেইল কলিগের সাথে হয় তখন কেন জানি একটু বেশিই খারাপ লাগে।
দুই অফিস থেকে ফেরার পথে যে বাসটিতে বেশি উঠতে হয় সে বাসে প্রায় ২-৩ জন ফিমেইল আর ১৫-২০ জন মেইল থাকে। আর এই ২০-২৫ জনের মধ্যে ৩-৪ জনের আলোচনার টপিক প্রায়ই ১৮+ এর কাছাকাছি হয়ে যায়। যেখানে মেয়েদের নিয়েই বিশ্লেষণ বেশি হয়। আর তাদের এ কথাগুলো বেশি লাউড না হলেও ঐ ফিমেইলদের কানে পৌঁছতে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু এখানে বিরক্ত হলেও বলার তেমন স্কোপ থাকে না। কারণ সবাই এখানে ম্যাচিউরড (২৫+)। আর বর্তমান ম্যাচিউরডদের ভাষাই নাকি এমন! তাই হয়তো আমার মতোই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে এমনটা শুনতে হয়। কিন্তু এতটুকুই শেষ নয়, তারপর আবার হাসতেও হয়। আর এভাবেই হয়তো কিছু আহত হৃদয় ভালো থাকার অভিনয় করে।
তিন বৃষ্টির দিন। বাচ্চা দুটিকে স্কুলে যেতে হবে না তাই তারা খুব খুশি। সারাদিন খেলবে, মজার সব খাবার খাবে, আর সবচেয়ে খুশির বিষয় তাদের মা’কেও হয়তো সারাদিন পাশে পাবে। যেমনটি এখনও আমি উপলব্ধি করি। ছুটিতে বাড়িতে গেলে মা’র সাথে বসে থাকা সময়টাই যেন আমার সবচেয়ে ভালো যায়। এমনকি মা’কে স্বাভাবিক টাইমের চেয়ে একটু বেশি রাত করেই ঘুমাতে হয় (আল্লাহ্ আমার মা-কে উত্তম প্রতিদান দিন)। তাই ঐ বাচ্চাগুলো হয়তো আমার মতোই মা’র সাথে গল্প করবে ভেবে একটু বেশি আনন্দিত। কিন্তু ঘড়ির কাটা সকাল আটটা না বাজতেই বাবা-মা দু’জন অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি। আর শেষপর্যন্ত বাচ্চা দু’টির সঙ্গী হলো বাসার কাজের মেয়েটি। যে কি না এখনো মা হয়নি। এদিকে বাচ্চাদের আশায় ছাই দিয়ে মা যে খুব স্বাভাবিক আছে, তাও কিন্তু নয়। অফিসে একটু ফ্রি সময় পেলেই বাচ্চা দুটির কথা মনে পড়ে। তখন নিজেকেও খুব অপরাধী বোধ হয়। আবার হঠাৎ কোন কলিগের “কিছু ভাবছো?” প্রশ্নের উত্তরে ”না তো” বলে হাসতে হাসতে নিজের অনুভূতিকেও চাপা দিতে হয়। আর এভাবেই চলতে থাকে কিছু আহত হৃদয়ের যখন-তখন পালিয়ে বেড়ানো।
এতক্ষণে হয়তো বুঝতে বাকি নেই এই গল্পে ঠাঁই পাওয়া আহত হৃদয়গুলো কারা। হ্যাঁ, তারা আমাদের চাকরিজীবী মা, বোন এবং স্ত্রীরাই। যারা হয়তো আমাদের সহযোগিতা করতেই এই যুদ্ধে নেমেছেন। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় তাঁদেরকে বেশিরভাগ সময়ই এই জীবন-যুদ্ধে হার মানতে হয়। তাই তো মন খারাপের সময়েও কলিগদের সাথে হাসতে হয়, অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বসের কাছ থেকে ছুটি পাওয়া যায় না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে প্রদর্শন করতে হয়, এমনকি নিজের ৬ মাসের বাচ্চাটাকেও বাসায় ফেলে অফিসে আসতে হয়। আর এতসব বিসর্জনের বিপরীতে যদি কেউ একটা ক্যারিয়ার আর কিছু টাকা নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করে, তবে সে জীবিত থেকেও যেন অনুভূতিহীন একটি মৃত লাশেরই প্রতিনিধিত্ব করছে।
তাই বলে কি মেয়েদের চাকরি করা যাবে না? আমি এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তরে যাবো না। আমি শুধু কয়েকটি বিষয় আপনার সামনে উপস্থাপন করবো। যেগুলো সামনে নিয়ে একটু চিন্তা করলে হয়তো আপনি আপনার সিদ্ধান্ত নিতে পথ খুঁজে পাবেন (ইনশা আল্লাহ্ তা’আলা) –
আপনার জন্য চাকরিটা কতোটা প্রয়োজন? (যখন আপনার আয় ব্যতীত সংসার না চললেই তা প্রয়োজন বলে গণ্য হবে)
আপনি যেখানে চাকরি করতে যাচ্ছেন সেখানে আপনি কতটুকু নিরাপদ? (যখন আপনার দিকে কেউ খারাপ নজরে তাকালেও আপনাকে অনিরাপদ মনে করতে হবে)
আপনার সন্তানের দু’আয় আপনি কতটুকু চান? (যখন তারা এই দু’আ ই বেশি করবে- হে প্রতিপালক, আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া কর যেমনিভাবে তারা আমার প্রতি শৈশবে দয়া-মায়া করেছে)
সর্বোপরি আমার লেখার সাথে একমত না হওয়া বোনদের সংখ্যা বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও নিজেকে একজন প্রকৃত মুসলিমাহ্ হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে চিন্তা করে দেখুন। সত্যটা তখন হয়তো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাদের নিরাপত্তার জন্য বলেন:
“নারী হচ্ছে গোপন বস্তু। যখন সে বাড়ি থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাকে অশ্লীলতার প্রতি উৎসাহী করে তুলে।”
– [তিরমিযী, মিশকাত হা/ ৩১০৯]
তারপরও ভাবছেন আমার এতোদিনের লেখাপড়া আর মা-বাবার স্বপ্ন তাহলে কী হবে?
তাহলে বলছি- লেখাপড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য যদি আপনি চাকরি কিংবা টাকা উপার্জন ধরে নেন তাহলে আপনি অনেক আগেই লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছেন। কারণ আপনার শিক্ষা আপনার চেয়ে অন্যের দাসত্ব করতেই বেশি উৎসাহী। অথচ আপনি শিক্ষিত হয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে সার্ভিস দিয়ে ঐ প্রতিষ্ঠানকে যতটুকু এগিয়ে নিতে পারবেন, তার চেয়ে কম পরিশ্রম করেই আল্লাহ চাহেন তো আপনার পরিবার থেকে এরকম কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তৈরী করতে পারেন এবং একটি সুন্দর ও শৃঙ্খল সমাজের গোড়াপত্তনও আপনার হাত ধরে হতে পারে। প্রয়োজন শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রাখার, আর পরিবার থেকেই চারাগাছগুলোর পরিচর্যা করার।
এবার হয়তো বলবেন জীবন এতোটা সহজ নয়! আসলে জীবন এতোটা কঠিনও নয়। আপনি যখন ধৈর্যের সাথে আপনার প্রতিপালকের নিকট নিরাপদ কর্মসংস্থানের প্রার্থনা করবেন এবং নিজেকে দ্বীনের বিষয়ে ছাড় দেয়ার মনোভাব থেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, তখন দেখবেন আল্লাহ্ সুবাহানহু ওয়া তা’আলা আপনার জন্য কল্যাণকর কোনো পথ খুলে দিচ্ছেন। হয়তো আপনি এমন একটি জব পেয়েছেন যেখানে বসের নজর কাড়তে আপনাকে আলাদা কোনো প্রেশার নিতে হবে না, যেখানে আপনার প্রতিপালকের দাসত্ব করতে কোনো অনুমিত লাগবে না, যেখানে ননমাহরামদের ঝামেলা পোহাতে হবে না। আর আপনি এমন কিছু না পাওয়া কারণে যে আল্লাহর জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, তিনিই কিন্তু পুরো বিশ্ববাসীর রিযিকের ব্যবস্থা করে থাকেন। তাই আপনি যে অ্যামাউন্টটা আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিবেন কিংবা যে পথটা বর্জন করবেন, এর চেয়েও বেশি অ্যামাউন্ট কিংবা উত্তম পথ তিনি অন্য কোনো উপায়ে আপনার সামনে উপস্থিত করবেন। আর তা আমার-আপনার প্রতিপালকের পক্ষে খুবই সহজ। তাহলে কেন বাড়তি চাপ, মানুষের দাসত্ব আর নিরাপত্তাহীনতার কঠিন চক্রে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল মনে করার এই মিথ্যা চেষ্টা? যেখানে আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার কাজকে সহজ করে দেন।” – [সুরা ত্বালাক, আয়াত: ৪]
সবশেষে এতটুকুই বলবো- এই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে বারবার আহত না করে, আল্লাহর জন্য নিজেকে একবার কুরবান করুন। দেখবেন পুরো জীবনটা জুড়েই যেন প্রশান্তির বারিধারা বয়ে চলছে। আর আমাদের দায়িত্বশীলদের প্রতি রইল আমাদের মা-বোনদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরীর আহ্বান। যেখানে তারা তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে একটি সু-শৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। আর সেটা হতে পারে পারিবারিক শৃঙ্খলা থেকে রাষ্ট্রীয় সেবা পর্যন্ত। তবে অবশ্যই তা যেন মহান আল্লাহ তা’আলার সীমারেখার মধ্যেই হয়।
আল্লাহ্ আমাদের মা-বোনদের জন্য সহজ করুন (আমিন ইয়া রব্ব)।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।