ইসলামবিদ্বেষীদের জবাবে মুসলিম তরুণদের লেখালেখি করার ধারা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। লেখাগুলো ছোট গল্প আকারে প্রকাশিত হওয়ার ধারাটা সেই তুলনায় একটু দেরিতে জনপ্রিয় হয়েছে। বই আকারেও সেগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। ইসলামী সাহিত্যের এই নতুন ধারার ভালো লাগা দিকগুলো নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রকাশিত হওয়ার আগে থেকে শুরু করে প্রকাশিত হওয়ার পর পর্যন্ত আল্লাহ সবখানেই বারাকাহ দিচ্ছেন। যেগুলো নিয়ে কথা বলা বাকি আছে, তা হলো না পাওয়ার বেদনাগুলো আর কিছু ছোটখাটো অভিমান।
তথ্যে ভাসা গল্প আমি, শুধুই পেলাম ছলনা
একদম গোড়া থেকে শুরু করলে বলতে হয় যে, যেসব কড়া বিষয়বস্তু নিয়ে গল্পগুলো লেখা হচ্ছে সেগুলো আসলে গল্প আকারে লিখার বিষয় নয়। নন-ফিকশান বা প্রবন্ধ আকারেই সেগুলোকে বেশি মানায়। গল্প আকারে যদি এতগুলো তথ্য-উপাত্ত লিখতেই হয়, তাহলে লেখকের উপর অনেক অতিরিক্ত শর্ত আরোপ হয়ে যায়। গল্পটা হতে হবে অগভীর টলটলে পানির এক জলাশয়, যেখানে তাকালেই তলায় পড়ে থাকা লাল-নীল-সবুজ রত্ন আকারের তথ্য-উপাত্তগুলো দেখা যায়। আঁজলা ভরে গল্প তুলেও পান করতে ইচ্ছে হবে, আবার চাইলেই হাত ডুবিয়ে তথ্য-উপাত্তের রত্নগুলো তুলে আনা যাবে। ঝানু গল্পকার না হলে কাজটা একটু কঠিনই। সে জন্য অনেকের (সবার না) তথ্য-উপাত্তগুলোই হয়ে যাচ্ছে প্রমাণ সাইজের পুকুরের মতো, যেখানে শ্যাওলার মতো ভাসছে কিছু গল্প। তথ্য-উপাত্তে হাবুডুবু খেয়ে উঠে আসার পর শ্যাওলা ধুয়ে ফেলতে আবার গোসল করতে হচ্ছে। একই পরিমাণ ফায়দাটা কি আরেকটু কম কষ্ট করেই তুলে আনা যেত না?
যন্ত্রসাহিত্যিক
কলা অনুষদে পড়া বান্দরগুলো বিজ্ঞানী হওয়ার বৃথা চেষ্টা করলে সেটা আমার মতো কলা অনুষদে পড়া বনী আদমের জন্যও একটু বিব্রতকর বৈ কি! অর্থহীন লাফালাফি করে এরা যখন ‘কলাবিজ্ঞানী’ উপাধি অর্জন করে আসে, তখন শাকিব খানের মতো স্টেইজে উঠে আমাকে বলতে থাকে, “এই অ্যাওয়ার্ড আমার একার নয়, আপনাদের সবার।” কুরাইশ বংশের মুশরিকদেরকে ছেড়ে মদীনার আনসারদের পানে ছুটে যাওয়া মুসলিম কুরাইশদের কাছে তো ‘মুহাজির’ পরিচয়টাই বেশি প্রিয়। গায়ের সাথে সেঁটে আছে এক বংশের নাম, কিন্তু ভিন্ন বংশের আনসারদের সাথে মিলে কুরাইশ মুশরিকের বিরুদ্ধে বদরে লড়তে প্রস্তুত। একইভাবে, কলা অনুষদের বান্দরদের চেয়ে বিজ্ঞান অনুষদের বনী আদমদের প্রতিই আমার টানটা বেশি। সেই ভাইদের প্রতিই আমার একটা অনুরোধ, “কলাবিজ্ঞানীদের বিপরীতে যন্ত্রসাহিত্যিক হতে চেয়ে নিজের দামটা কমাবেন না!” গল্পসাহিত্যে যদি যান্ত্রিকতা থেকে যায়, তাহলে দরকার নেই সাহিত্য করার। আপনি যন্ত্রই করুন। যন্ত্র দিয়েই ইসলামকে ছড়িয়ে দিন। আল্লাহ এতেই বারাকাহ দেবেন। প্রবন্ধে যান্ত্রিকতা মানা যায়। কিন্তু গল্পে যান্ত্রিকতা থাকলে তা হয়ে যায় গল্প্রবন্ধ।
একটি আযানের ভুল জবাব
ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ও ইসলামের পক্ষে ছোট গল্প লেখার ধারা শুরু হয় যার শক্তিশালী লেখনীতে, তিনি বিনয়ের সাথে একটি আযান (আহ্বান) দিয়েছিলেন। “আমি আমার দুর্বল কলমে ধারাটি শুরু করে দিলাম, আপনারা আপনাদের সবলতর কলম দিয়ে সেটিকে সামনে এগিয়ে নিন। আমি দুর্বল হাতে ইঁট মারলাম, আপনারা মিসাইল ছুঁড়ে মারুন।” নির্জন প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে ইবরাহীমের (‘আলাইহিসসালাম) দেওয়া হাজ্জের আযানকে আল্লাহ আজ সারা বিশ্বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ওই ভাইয়ের আযানকেও আল্লাহ অনেক দূর ছড়িয়ে দিয়েছেন। একটু অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে আযানের জবাবদাতাদের পক্ষ থেকে। মুআযযিন ডাক দিয়েছিলেন ইসলামের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের। জবাবদাতারা ভাবলেন নাস্তিকতাবিরোধী গল্প লেখার আন্দোলন! কী আর করার?
একজন ডাক্তারের লেখা বই পড়ছিলাম। কী চমৎকার তাঁর ভাষা! কুরআন-সুন্নাহর অধীনে থেকেই কী অকাট্য নিরেট যুক্তি! স্টেইজে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেওয়া সেই ডাক্তারের মতোই ভালোবেসে ফেললাম পেইজে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখা এই ডাক্তারকে। কিন্তু এ কী? গল্পের ভেতরে প্রবন্ধের মতো পয়েন্ট! হাইফেন দিয়ে দিয়ে চলতে থাকা দুই ব্যক্তির কথোপকথনে হঠাৎ একই ব্যক্তির কথা চলে যাচ্ছে ভিন্ন হাইফেনে। থার্ড পার্সন ন্যারেটর গল্পের ভেতর নিজের মন্তব্য যোগ করে দিচ্ছে! গল্পের মধ্যে আঁটছে না বলে কিছু কথা চলে গেছে রেফারেন্সে! এমন একজন সম্ভাবনাময় প্রবন্ধকারকে গল্প লিখতে বাধ্য করায় অভিমান জন্মে গেলো এই অলস পাঠক সমাজের ওপর।
প্র(তি)বন্ধ(ক)
গল্প ফেলে প্রবন্ধ লিখলেই কিন্তু সব বাধা শেষ না। গল্প হোক বা প্রবন্ধ, সবখানেই কয়েকটি বিষয়ের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
তাওহীদের গল্প শুনি
আচ্ছা বলুন তো, ইসলামের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের প্রশ্ন কয়টি। না, না! এত সহজ হিসাব না। মোট প্রশ্নসংখ্যার সাথে হিসেব করুন কত রকমে সেই প্রশ্ন করা যায়, তার সংখ্যাও। তার সাথে হিসেব করুন একই প্রশ্ন কতজন করে তার সংখ্যাও। এবার পারম্যুটেশান-কম্বিনেশান করে মোট সংখ্যা বের করুন। এক জীবনে কয়টির উত্তর দেবেন? এরচেয়ে বরং মূলে ফিরে যান। তাওহীদের গল্প বলুন। নাস্তিকদের মনে এত এত প্রশ্ন, আমাদের মনে সেগুলো নেই কেন? কখনো মনে প্রশ্ন চলে আসলেও আমরা সহজে উত্তর পেয়ে যাই কেন? কারণ আমরা যে তাওহীদ বুঝেছি, তাওহীদ মেনেছি! চিন্তার কাঠামোটাই আমাদের পাল্টে গেছে। আল্লাহও তাঁর রাসূলকে ﷺ দিয়ে আগে তাওহীদ প্রচার করিয়েছেন। এভাবেই গড়ে উঠেছে “শুনলাম মানলাম” এর একটি জামা’ত। তাই আপনার টার্গেট অডিয়েন্সকেও তাওহীদ বোঝান।
পাল্টা আঘাত
ভাবছিলাম এই অংশটার শিরোনাম দেবো “পাশার দান উল্টে দেওয়া”। কিন্তু পাশা খেলা হালাল-হারাম হওয়া নিয়ে আবার নানারকম কথা থেকে যায়। যা-ই হোক। নাস্তিকদের প্রশ্নগুলোকে ধরে ধরে জবাব দেওয়ার পাশাপাশি আরেকটা কাজ পুরোদমে চলা উচিত, তা হলো ওদের আদর্শের ত্রুটিগুলো দেখানো। ইসলামকে ডিফেন্ড করে যাওয়াকে পাল্টা আঘাত বলে না। পাল্টা আঘাত হলো ওদের ধর্মের ত্রুটিগুলো দেখানো। নাস্তিকরা তো ধর্মে বিশ্বাস করে না, তো ভুল ধরবো কোত্থেকে? ওদের নিরীশ্বরবাদী আদর্শের কিছু অন্তর্নিহিত ত্রুটি আছে। নৈতিকতা ও বৈধ-অবৈধের কোনো মানদণ্ড না থাকা, এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস, বিশ্বজগতের কোনো তাৎপর্য না থাকায় এই সব তর্কাতর্কি-ব্লগিং-রিফিউটেশান সবই দিনশেষে অর্থহীন হয়ে যাওয়া, স্রষ্টার অনস্তিত্বের কোনো এম্পিরিকাল প্রমাণ না থাকা এসব নিয়ে প্রচুর কথা লেখা যায়। আবার শুধু ধর্ম হিসেবে নাস্তিকতা না, সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি ইত্যাদি ব্যাপারে তারা যেসব বিকল্প সেক্যুলার ব্যবস্থা সাজেস্ট করে (যেগুলো আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ব/পরস্পরবিরোধী), সেগুলোর ত্রুটিগুলো ধরে ধরে দেখানো। মুসলিম হিসেবে এটা আমাদের প্লাসপয়েন্ট। অন্যান্য যেসব ধর্মে শুধু আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা আছে কিন্তু জাগতিকতার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান নেই, তারা এটা পারবে না।
ব্যস্ত হবেন না
ইসলামের কিছু বিষয় যে যুক্তিতে ধরবে না, তা তো সব লেখকই স্বীকার করেন। কিন্তু কোন বিষয় যুক্তিতে ধরবে, আর কোন বিষয় যুক্তিতে ধরলেও বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া কখনোই বুঝানো সম্ভব না, এসব নিয়ে মাঝেমাঝে প্যাঁচ লেগে যায়। কিছু ব্যাপারে আল্লাহ বলেই দিয়েছেন যে, কাফির তো দূরের কথা, মুসলিমদেরও সেগুলো অপছন্দের। অপছন্দকে দমিয়ে রেখেই আখিরাতের কথা চিন্তা করে সেসব ইবাদাত করে যেতে হয়। এখন আপনি যদি আশা করেন আপনার লেখা একটা গল্প বা প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বিষয়টি কাফিরদেরকে পছন্দ করিয়েই ছাড়বেন, তাহলে সেটি কি অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততা নয়? বাস্তবতার নিরিখে সেসব ইবাদাতের যৌক্তিকতা নিয়ে লিখুন, কিন্তু এতে “মানিয়েই ছাড়বো” টাইপের ব্যস্ততাটা যাতে না আসে। এই মনোভাব চলে আসলেই কিন্তু আপনি আয়াত বা হাদীসের একাংশ গোপন করতে শুরু করবেন, ভুলভাল ব্যাখ্যা দিতে থাকবেন। এগুলো ইসলামকে ডিফেন্ড করার ভুল অ্যাপ্রোচ।
সীমার মাঝে অসীম
নিজের সীমা বুঝুন। কোনো বিষয় নিয়ে লেখার আগে যে আপনারা সে সম্পর্কে পড়াশোনা করেই লিখেন, এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করাকে আমি গুনাহ মনে করি। কিন্তু পড়াশোনাটা পর্যাপ্ত কি না, এটা একটু ডাবল চেক করা দরকার। হয়তো ইসলামবিদ্বেষীর কোনো একটা প্রশ্নকে আপনি যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে দিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেলো সে যে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো সেটি আসলে ইসলামের কোনো অংশই না, ইসলামের নামে প্রচলিত কোনো ভুল ধারণা মাত্র! আবার এর উল্টোটাও হতে পারে। ইসলামবিদ্বেষীর কোনো প্রশ্নের জবাবে আপনি বললেন যে সেটি ইসলামের কোনো অংশ না। কিন্তু পরে দেখা গেলো আসলেই সেটি ইসলামের অংশ। অথবা এমন ব্যাখ্যা দিলেন যা আসলে সালাফ আস-সালিহীনের বুঝের মানদণ্ডের সাথে মেলে না। তাহলে তো লজ্জার বিষয় হয়ে যাবে নাহ? এজন্য যতটুকু ক্লিয়ার কাট জানেন, এর মধ্যেই লিখুন।
এহহে…
উপরের এক্সপ্রেশানটা আমরা কখন দেই? যখন ভুল করে ফেলি। এমন হতেই পারে যে লেখা প্রকাশ হয়ে পাঠকদের হাতে হাতে পৌঁছে গিয়ে বেস্টসেলার হয়ে গেছে। ঠিক তারপর এমন একটা ভুল ধরা পড়লো, যা সংশোধন না করলেই না। তখন কিন্তু একেবারেই গোঁয়ার্তুমি করা যাবে না, ভাইয়েরা! একদমই না। শয়তান পাপ করে সে ব্যাপারে অহংকার করেছে, মানুষ ভুল করার পর তাওবাহ করেছে। আমাদের শত্রু নাস্তিকদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা এখানেই। ওরা মিশনারি ওয়েবসাইট থেকে কিছু একটা ভুলভাল কপি করে লিখে দিলেও সমস্যা নেই। পানিতে থাকা মাছের আর ভিজে যাওয়ার ভয় কীসের? কিন্তু আমরা ভুল কথা লিখে সেটার উপরই জমে থাকলে কিন্তু সমস্যা আছে। সংশোধন করতে হবে, প্রয়োজনে ব্যবসায় লস দিয়ে হলেও। আল্লাহর কাছে প্রতিদান আশাকারী একটা জাতির কখনোই এতে ক্লান্ত হওয়া উচিত না।
গল্প যদি লিখতে চাও…
তাহলে কি গল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাবে? আবার সব হয়ে যাবে রসহীন প্রবন্ধ? না, তা কেন? এটা তো ঠিক যে মানুষ কিচ্ছা শুনতে পছন্দ করে। কিচ্ছা মানেই কি মিথ্যা? খালি বিদ’আতি হুজুররাই কি কিচ্ছা বলে? আল্লাহ কি বলেননি? নবীদের কিচ্ছা? নবীবিরোধীদের কিচ্ছা? নেককারদের কিচ্ছা? বদকারদের কিচ্ছা? কিসসা’র বহুবচন ‘কাসাস’ নামে তো আলাদা সূরাহই আছে। তবে সমসাময়িক গল্প বলিয়েদের কাছে আমার কয়েকটা আবদার আছে। নাক উঁচু সাহিত্যসমালোচক হিসেবে না, ভক্ত পাঠক হিসেবে।
শুধু নাস্তিকতা নিয়েই কি লিখতে হবে?
আচার-আচরণ, লেনদেন, চরিত্র ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের শিক্ষাগুলো নিয়ে কিন্তু দুর্দান্ত গল্প লেখা যায়। এমন গল্প যে লেখা হয় না কোথাও, এমনও না। নাস্তিকতা বিষয়ক গল্পের তুলনায় এসব গল্পের সুবিধা হলো এখানে অনেকরকম বৈচিত্র্য আনা যায়। শুধু কথোপকথন বা বিতর্কনির্ভর কাহিনী না হয়ে নানারকম ঘটনা দিয়ে গল্প তৈরি করা যায়।
ভিলেইনে দয়া করে যেই জন
কাহিনীতে মজা আসে কখন? যখন সেখানে উত্থান-পতন থাকে। সেজন্য লাগে শক্তিশালী ভিলেইন। কিন্তু আমাদের নাস্তিক ভিলেইনগুলো কেন যেন বড় বেশি ভোদাই। কিছু ক্ষেত্রে যেন ভিলেইনগুলোকে আনাই হয় নায়ককে একটার পর একটা পয়েন্ট মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। এমন কি হতে পারে না যে দুই-একটা গল্পের ভিলেইন হবে এমন, যে নায়কের ঘাম ঝরিয়ে ছাড়বে? এছাড়া বাকি পর্বগুলোতে ভোদাই ভিলেইন বা সত্যান্বেষী অ্যান্টাগনিস্ট থাকলেও সমস্যা নেই।
বুলেটপ্রুফ নায়ক চাই নে!
সুপারম্যানও তো গল্পের রাইজিং অ্যাকশানে এসে একটু না একটু মাইর খায়। সেখানে আমাদের মুসলিম সুপারহিরোগুলো এতটাই ক্রেজি প্রিপেয়ার্ড থাকে যে, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়ার লাইন নাম্বার সহ রেফারেন্স, মানবদেহের প্রতিটি উপাদানের শতকরা পরিমাণ, আমেরিকায় গত দশ বছরে ধর্ষণের খতিয়ান সবকিছু তাদের ঠোঁটের আগায়! কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে তাদের একটু চিন্তা করে মনে করা লাগে না, পরে জেনে এসে জানাবে বলে সময় চায় না, হঠাৎ কিছু একটা দেখে ভুলে যাওয়া জিনিসটা মনে ওঠে না, এক্স্যাক্ট সংখ্যার বদলে ‘প্রায়’ বলে একটা রাউন্ড ফিগার বলে না, বিশাল বিশাল উদ্ধৃতি paraphrase করে নিজের ভাষায় বলে না। এ কেমন বিচার, অ্যাঁ?
নানানরকম প্যাটার্ন
নাস্তিকতা সংক্রান্ত গল্পগুলো একটা প্যাটার্নে পড়ে যাচ্ছে। সব গল্পে দুই ব্যক্তির কথোপকথনই থাকছে মূল অ্যাকশান। একজন মুসলিম নায়ক, আরেকজন ইসলামবিদ্বেষী ভিলেইন বা সত্যান্বেষী অ্যান্টাগনিস্ট। এই ধারাটা একটু বদলানো যায় না? যেমন- সবকিছু ডায়লগের মাধ্যমে তুলে না ধরে ঘটনার মাধ্যমেও কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো। তবে গল্পের ধরনে যে কেউ কোনো বৈচিত্র্যই আনেননি, এমনও নয়। এখন পর্যন্ত আমার পড়া গল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটা বৈচিত্র্যময় প্যাটার্ন হলো স্বপ্ন দেখা, ইমেইল চালাচালি, ডায়েরি থেকে পূর্বের স্মৃতি পড়া, নাস্তিকদের আচরণের সাথে ধার্মিকের আচরণের পার্থক্য দেখানো, সায়েন্স ফিকশান (যদিও টাইম ট্র্যাভেলিং বিষয়টা ইসলামী আকিদার সাথে যায় কি না, সেটা শিওর নই), স্টেইজে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া। এরকম আরো নতুন নতুন প্যাটার্ন আবিষ্কার হয় কি না, দেখুন না!
নানানরকম কথক
নাস্তিকবিরোধী গল্পগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নায়কের একজন সহচর গল্পের কথক হিসেবে কাজ করে। এসব গল্প ফার্স্ট পার্সনে বলাটা একটু অস্বস্তিকর। নায়ক নিজেই যদি গল্প বলে, তাহলে মনে হয় যেন লেখক নিজের জ্ঞান জাহির করছে। সেজন্যই মনে হয় লেখকেরা নিজেকে একটা পার্শ্ব চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে অন্য একজনকে নায়ক বানান। হে হে! সবগুলো এরকম না করে এমন করা যায় যে, একেকটা গল্পে একেকজন কথক থাকলো। কোনোটাতে নায়কের বন্ধু, কোনোটাতে নায়ক নিজে, কোনোটাতে ভিলেইন নিজে! কোনো গল্পে আবার একই গল্পের একেক অংশ একেকজন বললো। আবার থার্ড পার্সন কথকও থাকতে পারে। মানে যে গল্প বলছে, সে নিজে গল্পের কোনো চরিত্র না।
কার্টুন ধাঁচের গল্প লিখুন
কার্টুন বলতে বোঝাচ্ছি বাস্তবসম্মত গল্পের বদলে পুরো জিনিসটাকে অবাস্তব জগতে নিয়ে যাওয়া। এরকম গল্পে চরিত্রগুলোর নাম proper noun না হয়ে common noun হতে পারে। হয়তো ভিলেইনটার নাম এখানে জনি-রকি ইত্যাদি না হয়ে শুধু হলো কলাবিজ্ঞানী, অথবা মুক্তমনা। আর নায়কটার নাম হয়তো হলো হুজুর বা মোল্লা বা মধ্যযুগীয়। বাস্তবে মানুষ যেসব কথা মনে গোপন রাখে, কার্টুন চরিত্রগুলো সেগুলো মুখে বলতে থাকবে। যেমন মুক্তমনাটা হয়তো মুখেই বলে বসলো, “ওই মোল্লা! জার্মানির টিকেট পেতে আমাকে আরো ইসলামবিদ্বেষ দেখাতে হবে। সেজন্য চল, আরেকটু তর্ক করি।” তারপর তর্কে হেরে সে হয়তো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বা দৌড়ে পালিয়ে গেলো, যেমনটা বাস্তবে কেউ করবে না। এরকম গল্প কমেডি বা সার্কাজম টাইপের হয়ে যায়, তবে বাস্তবসম্মত গল্পের সীমাবদ্ধতাগুলোকে এখানে ইগ্নোর করা সম্ভব হয়।
লেখাপড়া করে যে…
এই নবীন লেখকদের অনেকেই গল্প লেখার জগতে কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়া হুট করেই চলে এসেছেন। যেকোনো লাইনে ঢোকার আগে কিন্তু মানুষ সেই লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া ব্যক্তিদের কাজগুলো অধ্যয়ন করে। এই বয়সে এসে ইসলাম চর্চা ঠিক রেখে এত এত সাহিত্য পড়ার দায়িত্ব মাথায় নেওয়াটা বোকামি। এরকম কোনো পরামর্শ দিয়ে গুনাহগার হওয়ার কোনো ইচ্ছাও আমার নেই। তারপরও দ্বীনি পড়াশোনা ঠিক রেখে মাঝেমাঝে কিছু সাহিত্য উল্টেপাল্টে দেখা যায়।
নবীন মাঝি হাল ধরেছি নরম করে
মাঝে মাঝে মনে হয়, মুসলিম পুরুষদের তো পিতা-মাতা আর বৌ-বাচ্চার প্রতি ইসলামী দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই হালাক হয়ে যাওয়ার কথা, অধীনস্থদের ভরণপোষণ জোগাড় করার যাঁতাকলে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার কথা, জিহাদে গিয়ে আর ফিরে না আসার কথা। সে তুলনায় লেখালেখির এই জগতে তো মুসলিমাহদের অংশগ্রহণ আরো বাড়ার কথা। ইউরোপে সাহিত্যকে একটা সময়ে মেয়েলি বিষয় বলেই ধরা হতো। অন্যান্য অনেক সেক্টরের মতো এখানেও নারীরা এমন চুপচাপ কেন, তা আমার বোধগম্য না। এমন অবস্থা চলতে থাকার মধ্যে বেশি কল্যাণ থাকলে আল্লাহ এমন অবস্থাই রাখুন। আর এই অবস্থা পরিবর্তনের মাঝে বেশি কল্যাণ থাকলে আল্লাহ এ অবস্থা পরিবর্তন করে দিন।
সহপাঠকদের প্রতি
লেখকদেরকে তো কিছু আবদার জানানো হলোই। এবার সহপাঠকদেরকে, মানে আমার মতো যারা সাধারণ পাঠক-পাঠিকা, তাঁদেরকে কিছু বলা যাক।
পড়ার মান বাড়ান
লেখার মান বাড়ানো যায়। পড়ার মান আবার বাড়ে-কমে কীভাবে? হুঁ হুঁ! সেটাই যদি বুঝতেন, তাহলে কি আর লেখক ভাইয়েরা গল্প লেখার চাপ অনুভব করতেন? আপনারা অ্যাক্টিভলি একটা জিনিস পড়তে চান না। মাথা খাটাতে খাটাতে পড়তে চান না। একটু শক্তি ব্যয় করতে চান না। চামচ দিয়ে মুখে তুলে দেওয়ার পরও আপনার থুতনি নাড়িয়ে দিয়ে চিবাতে সাহায্য করতে হয়। মাথাটা উঁচু করে ধরে গিলতে সাহায্য করতে হয়। কীভাবে পড়তে হয়, সেটা শিখুন। একটু ব্রেইনওয়ার্ক করুন। সবকিছু সহজভাবে গুলে খাওয়ানো যায় না। এই বাস্তবতাটুকু বুঝুন।
লেখকদের কাছে ওয়াহী আসে না
নাস্তিকদের দাবি খণ্ডন করা একটা লেখা পেলেই যেন আমরা হুড়মুড় করে দৌড়ে গিয়ে প্রশংসা করতে না শুরু করি। লেখকরা নবী নন। সেখানে ভুলও থাকতে পারে। সেই ভুল চোখে পড়ার জন্য আবার পাঠক হিসেবেও ন্যূনতম একটা লেভেল পর্যন্ত জ্ঞান লাগবে। সেই জ্ঞান না থাকলে সবর করতে হবে, আল্লাহর কাছে দু’আ করতে হবে।
সামনে আসছে কঠিন দিন
নাস্তিকতাকে রিফিউট করে দিলেই সব শেষ? তারপর সুখে-শান্তিতে বসবাস? না, সবে তো শুরু! সামনে আরো অনেক বিষয় আছে। নানানরকম শির্ক, নানানরকম বিদ’আত, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা, আল্লাহর জন্য দান করা, আল্লাহর জন্য দান করা থেকে বিরত থাকা, সাহাবাগণ ইসলামকে যেই পর্যায়ে রেখে গেছেন, সেই পর্যায়ে আবার ফিরে যেতে কী করতে হবে – এগুলোও কিন্তু জানতে হবে। সেসব যে হুমায়ূন আহমেদের মতো সহজপাচ্য সাহিত্য দিয়েই বুঝে ফেলা সম্ভব, এমনও না। আলিমদের, বিশেষ করে পূর্ববর্তী জামানার আলিমদের লেখা ও বক্তব্যগুলো পড়তে ও শুনতে হবে। আর রূঢ় বাস্তবতা হলো, নাস্তিকদের বিরোধিতায় মুসলিমদের যেই মহাঐক্য আমরা দেখলাম, সেটি তখন আর থাকবে না। মতপার্থক্য আসবে, মনোমালিন্য আসবে, আসবে ভাইয়ে ভাইয়ে ষড়যন্ত্র, কূটচাল। এগুলোই দুনিয়ার বাস্তবতা। আল্লাহ জানেন তাঁর বান্দাদের সামনে এমন অবস্থা আসবে, তিনি এর সমাধানও দিয়ে রেখেছেন। লা তাহযান!
জ্বলে?
আমাকে পেছনে ফেলে অন্যেরা ইসলামের এত বড় খিদমাত করে ফেলছে, একটু ঈর্ষা তো আছেই। কিন্তু বিপুল প্রশংসিত একটা আন্দোলনকে নিয়ে এই লেখাটা শুধুমাত্র কল্যাণকামিতা থেকেই লেখা, হিংসাবশত নয়। এই ময়দানের বেশ কয়েকজন সৈনিকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখান থেকে দুইজন আকিল, বালিগ, মুমিন, পুরুষ জাকারিয়া মাসুদ ও আশরাফুল আলমকে সাক্ষী হিসেবে হাজির রাখলাম।
আল্লাহ আমাদের উপকারী জ্ঞান দান করুন।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।