ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এই কথাটা শুনে আসছি এবং সাম্প্রতিক সময়ে উপলব্ধিও করে আসছি। ছোটবেলায় যখন ইতিহাস বলতে বুঝাতো মুঘল আমলের শাসনের বিস্তারিত পড়া, (কে কার বাবা আর কে কার ছেলে তা মুখস্থ করা) তখন তা পড়তে খুবই বিরক্ত লাগতো। অন্যদিকে আব্বু যখন রাতের বেলা ঘুমানোর আগে মূসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম, কারবালা ইত্যাদির গল্প শুনাতেন, তখন সেগুলো শুনতে যদিও ভালোই লাগতো, কিন্তু ‘গল্প’ ছাড়া আর কিছু মনে হতো না।
ছোটবেলা থেকেই আমি একটু যুক্তিবাদী টাইপ। যে কোনো কিছুই আমাকে করতে নিষেধ করা হলে বা করতে বলা হলে আমার সবার আগে মনে হতো ‘কেনো’! তাই খুব অনিয়মিতভাবে হলেও যখনই কুরআন পড়তাম, যেটুকুই পড়তাম, অর্থসহ পড়তাম। একটা ভাষা না বুঝে শুধুই তিলাওয়াত করাটা আমার কাছে খুবই অযৌক্তিক লাগতো। বহুবারই ভেবেছি যে কুরআন পুরাটা অর্থসহ একবার পড়ে ফেলবো। কিন্তু প্রতিবারই সূরা বাক্বারাতে গিয়েই আটকে গেছি, আর আগাতে পারিনি। এর একটা মূল কারণ ছিলো সূরা বাক্বারা জুড়ে রয়েছে মূসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ের নানা কাহিনী। সেগুলোর কোনটা কোথা থেকে শুরু হয়েছে বা আগে পরে কী আছে, কিছুই আমি বুঝতাম না, এক আয়াতের সাথে আরেক আয়াতের কোনো সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে পেতাম না। তাই সত্যি বলতে কী, আমি উৎসাহ ধরে রাখতে পারতাম না, আগ্রহ হারিয়ে ফেলতাম 🙁
খুব সম্ভবত এই ব্যাপারটা আমাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ঘটে। কারণ কুরআনের একটা বিশাল অংশ এভাবে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের কাহিনী দিয়ে ভর্তি। একটা লেকচারে একবার শুনেছিলাম- The Quran was about to be the story of Musa (A)। তাই আজকাল আমরা সবাইকে অর্থসহ কুরআন পড়তে উৎসাহিত করি বটে, কিন্তু পড়তে গিয়ে তারা আমার মতো কোনো বিরক্তি বা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে কি না, সেটার খোঁজ রাখি না! আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, কুরআন কোনো ইতিহাস গ্রন্থ না যে সব কাহিনী আমাদের ধারাবাহিকভাবে বলবে। এটা হলো আল্লাহর সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কথোপকথন। তাই একটা কাহিনীর যে বিষয়টা যখন প্রাসঙ্গিক, তখন সে অংশটা উল্লেখিত হয়েছে। পুরা কুরআনে বনী ইসরাঈলের কাহিনীটা এসেছে এই স্টাইলে। এইজন্য আপনি যদি অন্য কোথাও থেকে এই কাহিনী পুরাটা না জানেন, তাহলে কুরআন অর্থসহ পড়তে গিয়ে আমার মতো প্রতিক্রিয়া হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
এবার একটা কাহিনী বলি। একবার আমার এক পরিচিত আমাকে বলছিলেন আশুরার একটা রোযা রেখেই আমি কাহিল, আরেকটা রাখতে পারবো না। আল্লাহ জানেন যে আমি ইহুদী না! অথচ আমরা অনেকেই হয়তো জানি যে, ইহুদীদের সাথে আচার অনুষ্ঠানে পার্থক্য বজায় রাখার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আশুরার সময় ওদের মতো একদিন না রেখে দুই দিন রোযা রাখতে বলেছেন। অর্থাৎ, ইহুদীদের সাথে পার্থক্য বজায় রাখার নির্দেশটার তাৎপর্যই উনি বুঝে উঠতে পারেননি!
শুধু এটাই না, এই তো সেদিনও মালয়শিয়াতে ছোট বোনদের কয়েকজনকে নিয়ে বসেছি সূরা ফাতিহা নিয়ে আলোচনা করতে। শেষ আয়াতের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত হাদীসটা বললাম যে যাদেরকে আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন, তাদের মাঝে রয়েছে ইহুদীরা, আর পথভ্রষ্টদের উদাহরণ হলো খ্রীষ্টানরা … তখন এক বোন খুব সরলভাবে জিজ্ঞেস করলো, “আপু, ইহুদী কারা?” আমি একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি! কী বলবো? আমরা দিনের মধ্যে ১৭বার যাদের মতো হওয়া থেকে আশ্রয় চাইছি, তারা কে এটাই আমরা জানি না! আমরা যদি একজন সাধারণ মুসলিমকে জিজ্ঞেস করি তাহলে তারা কিন্তু আসলেই বলতে পারবে না যে ইহুদী বা খ্রীষ্টান কারা, কী-ই বা তাদের ধর্মবিশ্বাস। অথচ এদের সম্পর্কে না জানার অর্থ হলো ইসলামের অনেকগুলো মৌলিক বিষয়সমূহ অজানা রয়ে যাওয়া।
ইতিহাস জানার এটা একটা দারুণ উপকারিতা যে এর ফলে আমরা কুরআনটা ভালো করে বুঝবো। এর ফলে আরো যেটা উপকার হবে তা হলো, আমরা মুসলিমরা এখন ‘রোল মডেলের’ যে চরম সংকটে ভুগছি তা থেকে বের হয়ে আসতে পারবো। কুরআন আমাদের সামনে অসংখ্য শিক্ষণীয় কাহিনী উপস্থাপন করেছে। এগুলাকে যদি আমরা নিছক গল্প হিসেবে ভাবি বা ধরে নেই ‘আরে উনারা তো নবী ছিলেন,’ তাহলে উনাদের জীবন থেকে আমরা কখনো শিক্ষা নিতে পারবো না। আমাদের বাচ্চাদের রোল মডেল কুরআনের চরিত্র না হয়ে হবে সিনেমা/গল্পের বইয়ের চরিত্ররা। আমরা যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং উনার সাহাবীদের জীবনী পড়ি, তাহলে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করবো যে তাঁরা কুরআনের কাহিনীগুলো জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে ধারণ করতেন। যখন বদরের যুদ্ধের সময় আসলো, আনসাররা বলেছিলেন, “আমরা আপনার সাথে তেমন করবো না, যেমনটা বনী ইসরাঈলরা করেছিলো মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে!” আবার এক ব্যক্তি যখন গনীমাতের মাল বণ্টন করার সময় চরম ধৃষ্টতা সহকারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছিলো, “Be just,” তখন উনি প্রচণ্ড রেগে গেলেও নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন যে, মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর লোকজনদের দ্বারা এর চেয়েও বেশি নাজেহাল হয়েছিলেন!
২০১৩ সালে মিশরে যখন নির্বিচারে গণহত্যা চলছিলো, তখন সিসিকে নব্য ফেরাউন আখ্যায়িত করে একজন মন্তব্য করেছিলো যে সে যত মুসলিমকেই হত্যা করুক না কেন, একজন মূসা ঠিকই বেঁচে থাকবে যে ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করবে। কথাটা শুনে এত ভালো লেগেছিলো! কুরআন যখন আমাদের জীবনে জীবন্ত, এমন নাজুক সময়গুলোতে কি দারুণভাবে এটা সাহস যোগায়, তাই না?
কিন্তু আমাদের দেশে এভাবে প্রাঞ্জলভাবে কুরআনকে কখনো পড়ানো হয় না বলেই দেখা যায় ইসলামী ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স মাস্টার্স করেও মানুষের সংশয়বাদী মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয় না।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে সব ধরণের পড়াশোনার ইসলামীকরণ করা সম্ভব এবং করা খুব দরকার। আমার ইসলামী পড়াশোনার প্রাথমিক যুগে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। তখন লক্ষ্য করেছিলাম যে ‘ইতিহাস’ বিষয়টার ইসলামীকরণের দারুণ সুযোগ রয়েছে! যেমন ধরুন, আল্লাহ কুরআনে বলেছেন যে উনি দাঊদ আলাইহিস সালামকে রহমত স্বরূপ ‘লোহা’ দিয়েছেন । এখন আপনি যদি সাধারণ ইতিহাসের লৌহ যুগ নিয়ে পড়েন আর দাঊদ আলাইহিস সালাম এর সময়টা মিলান, দেখবেন যে তা মিলে যাচ্ছে। ইসলামই যে সত্য ধর্ম এ ব্যাপারে যখন আপনি নিশ্চিত এবং ইসলাম আপনার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে, তখন এই ছোট্ট তথ্যটা আপনার কাছে উল্লেখযোগ্য কিছুই মনে হবে না। কিন্তু যদি আমার মতো অনেক ঘাটের জল খেয়ে ইসলামে প্রবেশ করেন, তবে প্রাথমিকভাবে এই বিষয়গুলো দারুণ ঈমান উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
ইতিহাসের জ্ঞানকে সামনে রেখে কুরআন পড়তে গিয়ে যে অপার্থিব আনন্দ আমি পেয়েছি, তা অন্যদের সাথে কিছুটা শেয়ার করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই নোট লেখা। আমরা মুসলিমরা এখন এক কঠিন সময় পার করছি। মুসলিম দেশগুলার অবস্থা চোখের পলকে অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছ, জান মালের কোনো নিরাপত্তা নাই। সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান, ইরাক, মিশর সর্বত্র এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আমরা ক্রমাগত দু’আ করে যাচ্ছি আল্লাহর সাহায্যের জন্য, কিন্তু ভুলে যাচ্ছি যে যতদিন না কুরআনকে জীবন্ত হিদায়াতগ্রন্থ হিসেবে আমাদের জীবনের সাথে একীভূত করে ফেলতে পারবো, আল্লাহর সাহায্য আসবে না, এই সময়টাও ঈমানের সাথে পার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আমার এই লেখাটাকে আমি চেষ্টা করবো একটা সহায়ক ম্যাটেরিয়াল হিসেবে উপস্থাপন করতে, যাতে আমরা অর্থসহ কুরআন পড়তে গেলে সেটার ধারাবাহিকতাটা ধরতে পারি এবং সন্তানদের এই কাহিনীগুলো প্রাণবন্ত করে শুনাতে পারি। এখানে আমরা কুরআনে উল্লেখিত সবগুলো নবীদের কাহিনী সিরিয়ালি পড়বো এবং সেখান থেকে নেওয়া শিক্ষা কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করা যায়, সেটা বোঝার চেষ্টা করবো। এটা আমার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা- ‘শিকড়ের সন্ধানে’ লিপ্ত হবার।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।