মদীনায় যারা আসেন, তাঁরা এখানের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করতে ভোলেন না। আমরাও একদিন বাসের বহর নিয়ে সদলবলে মদীনা পরিভ্রমণে বের হলাম। আমাদের হোটেলের বাঙালিরা প্রায় সকলেই এই বাস বহরে যুক্ত হলাম। সেই সাথে আমাদের গাইড বাবাজিগণও সঙ্গী হলেন। যেসব স্থানের অধিকতর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে অথবা যেসব স্থানে ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে, আমরা সেই স্থানসমূহে নামলাম। তাছাড়া বেশ কিছু স্থান আমরা বাসের ভেতর থেকেই দেখে নিলাম। যেমন কিছু মাসজিদে আমরা নামলাম না, দূর থেকে দেখে নিলাম। খন্দকের যুদ্ধের স্থল বাসের ভেতর থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো, তাই সেখানেও নামলাম না।
আমাদের পাকিস্তানী বাস ড্রাইভার ছিলেন খুব অমায়িক ও মজার মানুষ। তাঁর গল্পের ঝুড়িতে কাহিনীর কোনও অভাব ছিলও না। কিন্তু তিনি উর্দু ছাড়া অন্য কোনও ভাষা পারতেন না। আমরা বাসের প্রথম সারিতে বসার কারণে তাঁর মজার মজার গল্প শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। যাত্রার কিছুক্ষণের মাঝে টের পেলাম, আমাদের গাইডদের তুলনায় এই ড্রাইভার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান সম্পর্কে অধিকতর ভালোভাবে জানেন। তাঁর গল্পের প্রচূর ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত। তাই আমরা তাঁকে অনুরোধ করলাম যেসব যায়গায় আমরা যাচ্ছি, সেসব স্থানের সাথে জড়িত বিষয়সমূহ যেন আমাদের বলা হয়। ড্রাইভার ব্যাপক উৎসাহে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলেন। আমি আর আমার বর চোখ বড় বড় করে কান খাড়া করে শুনছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে গল্পের আসরে ভাটা পড়ে গেলো।
কারণ ড্রাইভার উর্দুতে কথা বলছিলেন। আমাদের বাসের সিনিয়র সিটিজেনদের অনেক হইচই করে উঠলেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, তাঁরা কিছুই বুঝতে পারছেন না, সবকিছু বাংলায় বললে ভালো হয়। এই দিকটা এতক্ষণ মাথায় আসেনি। অতএব নতুন ব্যবস্থা নেয়া হলো, ড্রাইভার বলবেন এবং গাইড সাহেব সেসব বাংলায় অনুবাদ করে মাইক দিয়ে বাকিদের শোনাবেন। আমরা ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সারিতে বসার কারণে ড্রাইভার ও গাইড দুজনের কথাই শুনছিলাম। অর্থাৎ এক কাহিনী দুবার করে শোনা হচ্ছিলো।
বহুদিন ধরে মদীনায় বসবাস করার ফলে নিজেকেও তিনি মদীনাবাসী ভাবা শুরু করেছেন। মক্কার অধিবাসীদের তুলনায় মদীনাবাসীরা কত উত্তম, এই নিয়ে অনেক কথা হলো। তাঁর মতে, মদীনার লোকজন অনেক অতিথিপরায়ণ এবং অন্যদের তারা প্রাণ খুলে ভালোবাসতে জানে। মক্কার লোকেদের মতো রুক্ষ নয় এরা। মক্কার মানুষরা রাসূলকেই ﷺ সেখানে টিকতে দেয়নি, ফলে উনাকে হিজরত করতে হয়েছিলো। ওদিকে মদীনার স্থানীয়রা নবীজীকে ﷺ বুকে টেনে নিয়েছিলো, আশ্রয় দিয়েছিলো।
যেকোনো এলাকার পরিবেশ ও প্রকৃতির অবস্থা এলাকাবাসীর উপর জোরালো প্রভাব রাখে। মক্কার রুক্ষ, প্রাণহীন প্রকৃতির কথা তো আগেই বলেছি। হয়তোবা যুগ যুগ ধরে এই বৈরি প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে কষ্ট সহিষ্ণুতার পাশাপাশি মক্কাবাসীদের ব্যবহারে চলে এসেছে রুক্ষতার ছাপ। অপরদিকে মদীনা আল মুনাওয়ারা অপেক্ষাকৃত লালিত্যময় ও বসোবাসোপযোগী হওয়াতে এর বাসিন্দাদের আচরণ হয়েছে উষ্ণ ও লালিত্যপূর্ণ।
মাসজিদে কুবা
বাস ড্রাইভারের গল্প শুনতে শুনতে আমরা দুগ্ধ ফেননিভ সফেদ এক স্থাপনার সামনে যাত্রা বিরতি করলাম। মাসজিদে নববী থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এ মাসজিদটির নাম ‘কুবা মাসজিদ’। এখানে দুই রাক’আত সালাত পড়লে এক উমরাহ্র সওয়াব পাওয়া যায়। হাদীসটি আগেই পড়া ছিলো, তাই ড্রাইভার ভদ্রলোক আন্দাজের উপর কথা বলছেন না বুঝতে পারলাম। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমাদের গাইড ড্রাইভারের সকল কথা বাংলায় অনুবাদ করে দিলেও এই হাদীসটি এড়িয়ে গেলেন! ড্রাইভার খোদ তাজ্জব বনে গেলেন আমাদের যাত্রীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীস অনুবাদ করে না শোনানোর জন্য। গাইড বারবার এ জায়গাটি এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, সবশেষে কিছুটা জোর করার পর তিনি বাধ্য হয়ে সবাইকে হাদীসটি জানালেন।
তখন আমার আরো একবার মনে হলো, সরকারি হাজ্জ প্যাকেজে না এসে সহীহ আকিদায় শিক্ষিত গাইড আছে এমন গ্রুপের সাথে হাজ্জ করতে আসা কতটা প্রয়োজনীয়। কারণ সবার পক্ষে সহীহ রেফারেন্স থেকে ভালোমতো পড়াশোনা করে আসা সম্ভব না-ও হতে পারে। এখানে গাইডের দায়িত্ব প্রত্যেক হাজীকে উপযুক্ত তথ্যাদি দ্বারা সমৃদ্ধ করা এবং লক্ষ রাখা যেন সেই তথ্যাদি সঠিক সূত্র থেকে হয়, জয়িফ ও বানোয়াট হাদীস থেকে উদ্ভূত বিদ’আত পন্থার না হয়।
কুবা মাসজিদের উল্লেখ কুরআন মাজীদেও এসেছে। আল্লাহ্পাক বলেন,
তুমি ওর (মাসজিদে দ্বিরার) ভিতরে কক্ষনো দাঁড়াবে না। প্রথম দিন থেকেই যে মসজিদের ভিত্তি তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত, তোমার দাঁড়ানোর জন্য সেটাই অধিক উপযুক্ত। সেখানে এমন সব লোক আছে যারা পবিত্রতা লাভ করতে ভালোবাসে, আর আল্লাহ্ পবিত্রতা লাভকারীদের ভালোবাসেন। [সূরাহ আত-তাওবাহ (৯): ১০৮]
তৎকালীন সময়ে মদীনায় মুনাফিকরা একটি মাসজিদ তৈরি করেছিলো, যাকে বলা হয় মাসজিদে দ্বিরার। উপরোক্ত আয়াত নাযিলের মাধ্যমে সেই মাসজিদে রাসূলুল্লাহকে ﷺ সালাত আদায় করতে নিষেধ করা হয় ও তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্মিত কুবা মাসজিদে সালাত পড়তে বলা হয়।
উৎসাহী পাঠকদের জন্য কুবা মাসজিদ সংক্রান্ত কিছু হাদীস উল্লেখ করছি:
যে নিজ গৃহ হতে ওযু করে মাসজিদ কুবাতে গিয়ে সালাত পড়বে, সে এক উমরাহ্ এর সমান সওয়াব পাবে।
উক্ত হাদীসটি আহমেদ ইবন হাম্বাল, আন-নাসাঈ, ইবন মাজাহ এবং হাকিম আল নিশাবুরি হতে বর্ণিত।
রসুলুল্লাহ ﷺ আরো বলেছেন,
মাসজিদ কুবায় সালাত পড়া উমরাহ্র ন্যায়। (আত-তিরমিযি, ৩২৪)
হিজরি প্রথম সনে নির্মিত কুবা মাসজিদের কিছু বিশেষত্ব আছে-
■ মুসলমানদের দ্বারা সর্বপ্রথম নির্মিত মাসজিদ হলো কুবা মসজিদ।
■ ইবনে উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রতি শনিবার মাসজিদ কুবায় যেতেন, হেঁটে অথবা বাহনে চড়ে। (বুখারি , ১১৯৩; মুসলিম, ১৩৯৯)।
■ এ মাসজিদটি আগে কুবা নামের একটি গ্রামের অংশ ছিলো। কিন্তু মদীনা সম্প্রসারণের পর এটি এখন মদীনার অন্তর্গত হয়ে গেছে।
■ রাসূলুল্লাহ ﷺ যেদিন হিজরত করে মদীনায় আসেন, তখন তাঁর উট কুবা গ্রামের একটি কূপের পাশে বিশ্রাম নেয়। তিনি এ স্থানে কিছুদিন অবস্থান করেন। তখন মাসজিদটি নির্মিত হয়।
এখন অবশ্য মাসজিদের প্রাচীন স্থাপনার কিছুই অবশিষ্ট নেই। আধুনিক সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন করে নতুন করে মাসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। দেশ বিদেশ থেকে মদীনায় আগত মুসল্লিগণ প্রতিনিয়ত এ মাসজিদে আসেন ও সালাত আদায় করেন। প্রতিদিন ফজরের পর নববীর সামনে থেকে প্রচুর গাড়ি/মাইক্রোবাস কুবায় আসে। এসব গাড়ীর ড্রাইভাররা ‘কুবা’, ‘কুবা’ বলে চিৎকার করতে থাকে। তাই যারা বারবার উমরাহ্ এর সওয়াব অর্জন করতে চান, তাঁরা এক ফাঁকে এ সব গাড়িতে চড়ে কুবায় চলে যান এবং দুই রাক’আত নফল সালাত আদায় করে নেন। অনেকে আবার পায়ে হেঁটে যান, কারণ তিন কিলোমিটার এমন কোনো বিশাল দূরত্ব নয়। আমরা সকলে কুবা মসজিদে সালাত পড়ে আমাদের আগামী গন্তব্যের দিকে যাত্রা করলাম।
সালমান ফারসির খেজুর বাগান
কুবা মসজিদের নিকটে বিখ্যাত সাহাবী সালমান ফারসি (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর খেজুর বাগান অবস্থিত। দেয়াল ঘেরা এ বাগানটি দূর থেকে দেখে নিলাম। ভেতরে প্রবেশ করলাম না। সালমান ফারসির খেজুর বাগান নিয়ে সুন্দর একটি ঘটনা রয়েছে।
সালমান ফারসি একজন সম্মানিত সাহাবী ছিলেন। তিনি তাঁর বাল্যকাল থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত সত্য ধর্মের সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন। তাঁর জীবন পরিক্রমা পড়লে দেখা যায় যে, তিনি অগ্নি উপাসক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। নিজের ধর্মের অসারতা দেখে এক সময় খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু তাতেও তাঁর মন ভরে না। বিভিন্ন ধার্মিক লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে একসময় তিনি খোঁজ পান মদীনাতে একজন নবী আসবেন। তিনি যে ধর্মের প্রচার করবেন, সেই ধর্মই হবে একমাত্র সত্য ধর্ম।
ততদিনে উনার বয়স বার্ধক্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। তবুও ইসলাম অর্জনের বাসনায়, সত্য জানার তৃষ্ণায় তিনি মদীনা আগমন করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, মদীনায় আসার পর তাঁকে একদল দাস ব্যবসায়ী ধরে নিয়ে এক ইহুদীর কাছে বিক্রয় করে দেয়। শুরু হয় তাঁর জীবনের এক অন্যরকম পরীক্ষা।
এর মাঝে একদিন তিনি খবর পান, মক্কা থেকে এক ব্যক্তি হিজরত করে মদীনায় এসেছেন। লোকে বলছে, তিনি এক নতুন ধর্মের প্রচার করছেন। এই খবরে তাঁর বুক আনন্দে নেচে ওঠে। আবার আশার আলো দেখতে পান জীবনে, জীবদ্দশায় তাওহীদের বিশ্বাসকে আরো আপন করে নেবার উদগ্র বাসনা আবার হৃদয়ে জ্বলে ওঠে। যে ধর্মগুরুর কাছে তিনি মহানবী ﷺ এর আগমনের ভবিষ্যৎবাণী শুনেছিলেন, তিনি এই নতুন রাসূলকে চেনার তিনটি আলামত বা নিদর্শন বলে দিয়েছিলেন।
সেগুলো হল, এই নবী কারো সাদাকা গ্রহণ করেন না, উপহার গ্রহণ করেন এবং তাঁর কাঁধে নবুয়তের নিশানা স্বরূপ একটি চিহ্ন থাকবে। সালমান ফারসি এই চিহ্ন মেলানোর উদ্দেশ্যে একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট গেলেন। তাঁকে কিছু খেজুর দিয়ে বললেন, এগুলো সাদাকা হিসেবে নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ্র নবী সমস্ত খেজুর তাঁর সাহাবীদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন, কিন্তু নিজে কিছু খেলেন না। সালমান ফারসি মনে মনে খুশি হয়ে গেলেন। একটি চিহ্ন মিলে গেছে, তিনি সাদাকা নেননি।
পরে একদিন সালমান ফারসি আবার কিছু খেজুর নিয়ে গেলেন। এবার বললেন, এগুলো আপনার জন্য উপহার হিসেবে এনেছি। তখন রাসূলুল্লাহ কিছু নিজে খেলেন, কিছু সাহাবীদের দিলেন। সালমান ফারসির হৃদয় আশায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। এখন শেষ চিহ্নটি দেখা বাকি আছে। কিন্তু এটি কীভাবে দেখবেন!
আল্লাহ্ এই সুযোগও করে দিলেন। একদিন বাকি গোরস্তানে তিনি রাসূলের সাথে ছিলেন। নবীজীর গায়ে একটি চাদর জড়ানো ছিলো। তিনি শুধু উনার পেছন পেছন ঘুরছিলেন, যদি কাঁধের এক ঝলক দেখা যায় … নবীজি উনার মনের ইচ্ছা বুঝতে পেরে আস্তে করে কাঁধের এক দিকের চাদর খসে যেতে দিলেন। ডিম্বাকৃতির নবুয়তের চিহ্ন উন্মোচিত হয়ে পড়লো। এবার সালমান ফারসি আর আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। আনন্দাশ্রুতে প্লাবিত হলেন। তাঁর যুগ যুগ ধরে মনের গহীনে পোষণ করে আসা বাসনা এত দিনে বুঝি পূরণ হতে চললো। অবশেষে তিনি ইসলামের পেয়ালা থেকে ঈমানের সুমিষ্ট স্বাদ নিতে পারলেন।
কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরও ইহুদী মালিকের দাস হবার কারণে বেচারা ইসলামের খেদমতে সর্বস্ব নিয়োগ করতে পারছিলেন না। তখন মুহাম্মদ ﷺ তাঁকে উপদেশ দেন, মালিকের কাছে মুক্তির দরখাস্ত করতে এবং কীসের বিনিময়ে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে তা জিজ্ঞেস করতে। ইয়াহুদী মালিক সাঙ্ঘাতিক কঠিন এক শর্ত জুড়ে দেয়, যা কোনোকালেই তাঁর পক্ষে পালন করা সম্ভব ছিলো না। শর্তটি হলো, তিনশ খেজুর গাছ লাগাতে হবে ও চল্লিশ উখিয়া (তৎকালীন বিনিময় মুদ্রা) দিতে হবে। সব সাহাবীরা মিলে তিনশ খেজুর চারা যোগাড় করে দেন ও নবীজী ﷺ নিজের হাতে এই গাছগুলো লাগিয়ে দেন। আল্লাহ্ তাঁকে চল্লিশ উখিয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। এরপর থেকে সালমান ফারসি বাকি জীবন একাগ্রভাবে ইসলামের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
সালমান ফারসির বাগান পার হয়ে আমরা অন্য এক খেজুর বাগানে গেলাম, সেখানে বাগান সংলগ্ন দোকানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিভিন্ন স্বাদ, আকৃতি ও দামের খেজুর থরে থরে সাজানো রয়েছে। কোনো খেজুরের ভেতর বাদাম, আবার কোনো খেজুর টফির মতো। শুকনো খেজুর, মোটা খেজুর, কাঁচা খেজুর, পাকা খেজুর ইত্যাদি নানা ধরনের খেজুর দেখে আমাদের মতো এই সম্পর্কিত অজ্ঞ ব্যক্তিরা সহজেই কনফিউসড হয়ে গেলাম। কোনটা রাখবো ও কোনটা কিনবো, এই ব্যাপারে অনেকেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলো।
তবে একটি বিশেষ শ্রেণীর খেজুর কেনার ব্যাপারে সহজেই লোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বিশেষত যারা আগে থেকেই এই খেজুরের নাম শুনেছে, তারা এটি না কিনে ফেরত যায় না। এর নাম হল আজওয়া খেজুর। প্রচুর হাদীসে আজওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। সহীহ হাদীস মতে এ খেজুরে অনেক রোগের শেফা আছে। প্রতিদিন সকালে ৭ টি আজওয়া খেজুর খেলে সারাদিন আল্লাহ্ তাকে কালো জাদু থেকে সুরক্ষিত রাখেন। সাতটি আজওয়া খেজুরে ১২০ ক্যালরি পাওয়া যায়। কোনো নিয়ত করে উক্ত খেজুর খেলে সেই দু’আ কবুল হয়।
মাসজিদ কিবলাতাইন
মুসলমানগণ প্রথমে আল-আকসার দিকে মুখ করে সালাত পড়তেন। যখন ওয়াহী নাযিলের মাধ্যমে আমাদের কিবলা বদল করে আল-আকসা হতে মাসজিদুল হারামের দিকে করে দেওয়া হয়, তখন এই মসজিদে একজন সাহাবী ইমামতি করছিলেন। কিবলা বদলের খবর আসার পর ইমাম নতুন কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়ান এবং পুরো জামাত তাঁকে অনুসরণ করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মাসজিদের নতুন নামকরণ হয়, “মাসজিদ কিবলাতাইন”। এখানে আল-আকসার দিকে একটি এবং কাবার দিকে মুখ করে একটি, মোট দুটি সালাতের মিহরাব ছিলো। কিছুদিন আগে আল-আকসার দিকের মেহরাবটি সরিয়ে ফেলা হয়।
এ মাসজিদে বরকত হাসিলের জন্য আসা সহীহ নয়, বরং ঐতিহাসিক মূল্যের জন্য পরিদর্শনে আসা যায়।
উহুদের পাহাড় ও কবরস্থান
মাসজিদ কিবলাতাইন থেকে আমরা উহুদ পাহাড়ে আসলাম। এখানে উহুদের জিহাদ সঙ্ঘটিত হয়েছিলো, যেখানে বহু সাহাবা শহীদ হয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও আহত হয়েছিলেন। উহুদ পাহাড়েই শহীদদের কবর দেওয়া হয়েছিলো। এখনো মদীনায় আগতগণ উহুদ যুদ্ধের শহীদদের কবরস্থান দেখতে আসেন। আমরা সকলে কবরস্থানের সীমানার বাহির থেকে শহীদদের জন্য দু’আ করলাম। উহুদের কবরস্থানের প্রতিটি কবর আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা শহীদদের কবর। শহীদের কোনো মৃত্যু যন্ত্রণা হয় না, তাঁদের দেহ অবিকৃত রয়ে যায়। তাঁদেরকে আল্লাহ্ মৃত বলতে নিষেধ করেছেন। কারণ তাঁরা আল্লাহ্র কাছ থেকে রিযিক পান।
আর আল্লাহ্র পথে নিহতদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা বোঝো না। [সূরাহ আল-বাকারাহ (২): ১৫৪]
যারা আল্লাহ্র পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত ভেবো না; বরং তারা জীবিত। তাদের প্রতিপালকের সান্নিধ্যে থেকে তারা রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছে। [সূরাহ আলে ইমরান (৩): ১৬৯]
যেকোনো কবরস্থান যিয়ারতের আগে কিছু বিষয় লক্ষ রাখতে হবে:
■ “আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলুল কুবুর”, দু’আটি বিদ’আত। সহীহ দু’আটি হলো:
হে গৃহসমূহের অধিবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ! আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আর নিশ্চয় আমরা ইনশা আল্লাহ্ আপনাদের সাথে মিলিত হবো। [আল্লাহ্ আমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের উপর দয়া করুন।] আমি আল্লাহ্র নিকট আমাদের জন্য এবং আপনাদের জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করি। মুসলিম ২/৬৭১ (দুই ব্র্যাকেটের মধ্যবর্তী অংশটুকু আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) এর হাদীস হতে, যা সঙ্কলন করেছেন মুসলিম)
■ কবরবাসীর নিকট কিছু চাওয়া যাবে না বা বরকতের উদ্দেশ্যে কবরের মাটি নেয়া যাবে না।
■ কবর যিয়ারতের মূল উদ্দেশ্য হবে দুটো, এক) নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করা, ও দুই) কবরবাসীর জন্য দু’আ করা ও সালাম দেওয়া।
■ মহিলারা কবরস্থানের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে না।
কবর যিয়ারত শেষে সবাই পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে পড়লাম। পাহাড়ের নিচে অনেক দোকানী তাদের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। অনেকে তাদের নিকট থেকে টুকিটাকি জিনিস ক্রয় করছে। মক্কা-মদীনায় বিভিন্ন স্থান থেকে ইসলামের দাওয়াহর উদ্দেশ্যে বাংলা, ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত বই/বুকলেট বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। এখানেও এর ব্যতিক্রম দেখলাম না। আমরা সেখান থেকে তাফসিরুল উশরিল আখির নামের খুব উপকারী একটি বই সংগ্রহ করলাম।
মদীনার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে হোটেলে ফেরত এলাম। মক্কায় গেলে মক্কার দর্শনীয় স্থান দেখার অপেক্ষায় রইলো সবাই। আমি আর সাফির তখনো জানতাম না, সামনের দিনে এমন কিছু ঘটবে, যার ফলে আমরা দুজন মক্কার ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখতে পারবো না এবং মাসজিদে যাওয়াটাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে! যদিও এজন্য আফসোস করি না, কারণ হাজ্জের জন্য এ দেশে এসেছিলাম, আল্লাহ্ সহিসালামতে হাজ্জ করিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহ্ যেন আমাদের সকলের হাজ্জ কবুল করেন।
মদীনায় প্রায় দশ দিন অবস্থান করার পর একদিন ভোরে আবার মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। প্রথমে মদীনার অদূরে যুল হিলাইফা নামক স্থানের একটি মাসজিদে নেমে দ্বিতীয়বার উমরাহ্ করার জন্য ইহরামের নিয়ত করে নিলাম। মদীনা হতে যারা মক্কা যায়, তাদের মিকাত হল যুলো হিলাইফা। সুপ্রশস্ত এই মাসজিদে পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা অংশ রয়েছে। গোসলখানাতে গোসলের ব্যবস্থাও আছে। যারা ইহরাম বাঁধার আগে ভালো মতো পাক পবিত্র হতে চান, তাঁরা এখানে সাচ্ছন্দে স্নান পর্ব চুকিয়ে নিতে পারবেন। ইহরাম বাঁধার পর্ব শেষ করে সকলে আবার বাসে উঠে পড়লাম। সামনে দীর্ঘ যাত্রা। যাত্রা পথে সালাত ও খাবার জন্য বার কয়েক যাত্রা বিরতি হবে, যে কারণে মক্কায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।
বাসে ওঠার কিছুক্ষণের মাঝে আবিষ্কার হলো, বাসে এসি কাজ করছে না। যার অর্থ মদীনা থেকে মক্কা ৩৪০ কিলোমিটার রাস্তা আমাদের এসি ছাড়া যেতে হবে। এসি কখনো হালকা কাজ করে আবার কখনো করে না, এভাবে আমরা এগোতে লাগলাম। ধু ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে। মাইলের পর মাইল কোনো জনবসতির অস্তিত্ব নেই। যে দেশের ৯৫% মরুভূমি, সে দেশে এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়! মরুর পাথুরে রুক্ষ পথ যেন রুদ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলো।
এই ভয়ঙ্কর পথ দিয়ে রাসূল ﷺ ও তাঁর সাহাবাগণ নারী, শিশু নিয়ে উটে চড়ে পথ চলতেন, দিনের পর দিন কীভাবে পার করতেন জানি না। না জানি কত কষ্ট সহ্য করে উনারা সফর করতেন। এই অসম্ভব রুক্ষতা আর মায়া মমতাহীন শুষ্কতা নিজের চোখে না দেখলে ব্যাখ্যা করা কঠিন। চারদিকে সবুজের অভাব প্রকটভাবে চোখে পড়ে। মরু অঞ্চলের কিছু তৃণলতা ও স্বল্প পানিতে জন্মানো হালকা গাছ গাছালি, ধুসর ঝোপ ঝাড় দেখা যায় মাঝে মাঝে। শত শত বছর পূর্বে মরুর বুকে প্রচণ্ড রুদ্ধতাপের নিচে উটের কাফেলা নিয়ে যখন লোকে চলাচল করতো, দলের সবাই কি বেঁচে ফিরতো? আল্লাহু আ’লাম।
আমরা বাসে এত আরামের চেয়ারে বসে অভিযোগের পর অভিযোগ করে যাচ্ছি, এসি নষ্ট কেন, হেন তেন ইত্যাদি বলে। আমাদের যদি বাস না থাকতো, উটে করে বা পায়ে হেঁটে চলতে হতো, তাহলে কী করতাম আমরা? সে সময় আমাদের মতো আরামপ্রিয়, ভীরু, কাপুরুষ, অকৃতজ্ঞ ছিলো না লোকে। একটা উট পেলেই তারা কৃতজ্ঞ হয়ে যেতো, অন্তত হাঁটতে হবে না এই আনন্দে।
আমাদের অসহিষ্ণুতার পাশে তাদের সহনশীলতা আর ধৈর্যের তুলনা করা বাতুলতা ভিন্ন কিছু নয়। সারাদিন যাত্রার পর রাতে মক্কায় হাজির হলাম। তখনো কল্পনা করতে পারিনি, আমরা যেমন ভীড়মুক্ত, অল্প সংখ্যক হাজী পরিবেষ্টিত মক্কা রেখে গিয়েছিলাম, তা বর্তমানে কানায় কানায় পূর্ণ থাকবে। এখন হাজ্জের মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি আছে, দেশ বিদেশের হুজ্জাজগণের পদধ্বনিতে মক্কা উপত্যকা মুখরিত হওয়া শুরু হয়েছে।
আগামী পর্ব: বিপদ ও আল্লাহ্র অপার অনুগ্রহ
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।