এককথাটা আমাকেও ভাবায় মাঝে মাঝে। ধর্ম শব্দটা আসলেই বেশ সমস্যার। কুরআনের কোথাও এই ধর্ম শব্দের উল্লেখই নেই। তো ভাই ধর্মের দরকারটা কী? আসলে ধর্ম পালন বলতে আমরা যেটা বুঝি তা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার উপাসনা। হিন্দু হলে পূজা করা, মুসলিম হলে সালাত, হজ্ব, যাকাত আদায় করা ইত্যাদি। এই টার্মগুলো ধর্মের সাথে যায়। রোযা না রাখা ব্যক্তিকে কেউ যদি রোযা রাখতে নির্দেশ করে তাহলে কিন্তু কেউ উত্তরে বলবে না যে সবকিছুতে ধর্ম কেন টানছেন।
কিন্তু ধরেন, কোন মুসলিম অন্য ধর্মের উৎসব পালন করতে গেল, কেউ নিজের স্ত্রী-কন্যা-মাকে বেপর্দা ফেইসবুকে প্রকাশ করে দিল, কেউ নিজেই বেপর্দা নিজেকে প্রকাশ করতে লাগলো, কেউ মারা গেল আর মানুষ তার হারাম কাজ, ছবি শেয়ার করে বেড়ালো, কেউ গান গায়, ছবি আঁকে, কুকুর পালে, হারাম কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করে, সমকামীদের জন্য মানব ধর্ম গ্রহণ করে– ইত্যাদি বিষয়ে যদি কোন মুসলিম আরেক মুসলিমকে সাবধান করতে যায়, ফেইসবুকে কমেন্ট করে বসে বা মেসেজে দরদ মাখা কণ্ঠেও যদি কিছু বলতে যায় তাহলে অনেক সময়ই অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হয়। শুনতে হয় “সবখানে ধর্ম টেনে আনার কি দরকার ভাই?” কথা সত্য। কারণ এগুলা কোনকিছুই আগের প্যারায় উল্লেখ করা ধর্মের আইডিয়ার সাথে যায় না।
দুইসালাত শেষে সালাম ফিরিয়ে যেখানে ‘ধর্ম ইসলাম শেষ হয়, ঠিক এরপরেই উঠে দাঁড়িয়ে করতে যাওয়া কাজটা যার ভিত্তিতে করবো সেইখান থেকে ‘দ্বীন’ ইসলাম শুরু হয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ তা’আলা এটাকে দ্বীন হিসাবে ঘোষণা করেছেন , একটু খেয়াল করি! এটা কেবল উপাসনা কেন্দ্রিক কোন ধর্ম নয়, এটা দ্বীন, এটা চলার পথ, এটা পরিপূর্ণ জীবন বিধান। অর্থাৎ আপনি এই মুহুর্ত থেকে যা-ই করছেন সবই দ্বীন ইসলাম দিয়ে বিচার করা সম্ভব। নিজের জন্য কোনটা করণীয় আর কোনটা বর্জনীয়, অন্যকে কোনটার আদেশ দিব আর কোনটার নিষেধ করব সবই এর আওতাভুক্ত। আবার বলছি, ‘সবই’ এর আওতাভুক্ত।
এখন কেউ যদি কোন বিষয় নিয়ে বলে যে আরে এর ভিতরে আপনি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ধর্ম টেনে আনছেন কেন? তাহলে শুনুন, ধর্মকে যেভাবে অনেকে গ্রহণ করেছেন সেটা মসজিদে রাখার জিনিস। তাই এটাকে টেনে আনা সম্ভব না। কিন্তু অনেকেই এমন অনেক জিনিসই করছে যা আপনার আমার দ্বীনের বাইরের জিনিস। কিছু যদি টেনে আনাই হয়ে থাকে তাহলে তা হচ্ছে সীমালঙ্ঘন। কাজেই ধর্মকে না বরং নিজেদেরকে দ্বীনের বৃত্তের ভিতরে ফিরে আসার দাওয়াত দিচ্ছি। যেই বৃত্তের ব্যাপারে আমার নবী(সা) জিজ্ঞেস করেছিলেন,
আমাদের কিয়ামত দিবসে জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমাদেরও জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তোমরা আমার ব্যাপারে কী বলবে? আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি? উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম উত্তর দিলেন, আমরা সাক্ষ্য দেব যে আপনি আপনার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন। অতঃপর রাসুল (সা) আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন। আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন। আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন!
বুঝতে পারছেন? আল্লাহ্ সাক্ষী আছেন! কত বিশাল একটা কথা! আর আমরা কি করছি? আজকে প্রকাশ্যে গোপনে কত বড় বড় কথাই না বলে বেড়াচ্ছি। অথচ একদিন আল্লাহ্ বলবেন,
এতদিন তোমরা বলেছ, আমি চুপ থেকেছি। আজ আমি বলব, তোমরা চুপ থাকবে!
তিনওয়াল্লাহি, এমনটা হবেই! আজকের এই উদ্ধত জবান কাল আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলবে? ভাবতে পারেন আপনার বাবাকে আর আপনার মাকে আপনার সামনে জাহান্নামে টেনে হেঁচড়ে ফেলা হচ্ছে? সইতে পারবেন? পারবেন না। তাইতো উম্মাতের কেউ যদি একটু বেখেয়াল হয়ে যায়, চলার রাস্তা ভুলে দুনিয়ার ধোঁকায় পড়ে যায়, এই কথা ভুলে যায় যে দুনিয়ার জন্য করা প্রতিটি কাজই ধ্বংস হয়ে যাবে সেই ভাই বা বোনের জন্য ঈমানদারদের চিন্তা হয়। তাকে ফেরাবার দায়িত্ব কার?
নবী(সা) বলেন,
হে মানব জাতি! আমি তোমাদের কাছে দু’টি বস্তু রেখে গেলাম, যদি তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ, তবে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার মধ্যে একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমার সুন্নাত। যারা এখানে নেই তাদের কাছে আমার এই বাণীগুলো পৌঁছে দিবে।
কেউ যদি দ্বীনের জ্ঞান না জানে তার উপর তা অর্জন করা ফরয। আর যে দ্বীনের জ্ঞান জানে তার দায়িত্ব তখন সারা জীবন অন্যদেরকে তা জানানো। এটা না করলে সে নিঃসন্দেহে ভুল পথে আছে। “সবখানে ধর্ম টেনে আনার কী দরকার”– জাতীয় কথা এই ধরনের মানুষের মুখ থেকেই তো বের হবে। এটা বলা মাত্রই বুঝে নিতে হবে সে যা করছে তা দ্বীনের নিষিদ্ধ করা জিনিসের আওতায় পড়ে যায়। সে দ্বীনের নিরাপদ বৃত্ত ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছে, নিজের খেয়াল অনুসরণ করেছে আল্লাহ-রাসূলকে(সা) ছেড়ে। তাই কেউ যদি কিছু টেনেই এনে থাকে তাহলে তা হলো নিজের প্রবৃত্তি। এখন বলুন যে মানুষটি অপরজনকে সাবধান করে, প্রচার করে সে কি ভাল ছাড়া মন্দ কিছু চায়?
দ্বীনের নির্দেশনার বাইরে যাওয়াই পথভ্রষ্টতা। সুন্নাত ছেড়ে দেওয়া মানে বিদাতকে টেনে আনা। অথচ আমাদের কি বলা উচিৎ ছিল না, “সবখানে নফসকে টেনে আনার কি দরকার?” শয়তানের প্রতারণাকে ধরতে হবে, না হলে ধর্ম কোনদিন দ্বীন হয়ে উঠতে পারবে না। শেষোক্ত কথাটা শতবার বললেও মনে হয় এর গভীরতা বুঝানো সম্ভব হবে না। শয়তান করতে চায় এইরকম দ্বিতীয় একটা কাজের কথা বলুন তো? কেউ বলতে পারবে না কারণ তার প্রথম এবং শেষ দুই কাজই হচ্ছে মানুষ নফসের তাড়নায় যা করে তা সুশোভিত করে দেখাতে থাকা যাতে জাহান্নামের আগুন নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত মানুষের হুঁশ না হয় যে তাকে এই দিনটার পুঁজি সংগ্রহ করার জন্যই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। অথচ সে পৃথিবীর নেশায় মত্ত হয়ে মনগড়া কত ধারণাই না পোষণ করেছিল স্পষ্ট সাবধানতার পরেও।
চারজনাব, আল্লাহ যে রব এটা তো আরবের মুশরিকরাও মান্য করতো। তাহলে তাদের মুসলমান বলা হলো না কেন? কারণ তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনে আল্লাহকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। কী জনাব কাদের সাথে নিজের আদর্শ মিলে যায়? আবু বকর(রা), আলী(রা), উসমান(রা), উমার(রা) এর আদর্শের সাথে? যারা ইসলাম আসা মাত্র যে জীবনে তারা অভ্যস্ত ছিল ঐ জীবনের বিরুদ্ধে জিহাদ করে গেছে? নাকি আবু জেহেল, উম্মিয়া আর ওতবার আদর্শ যারা বৈষয়ক জীবনে আল্লাহর দেওয়া বিধান ও আল্লাহর রাসূলের(সা) সুন্নাতের কোন মূল্যই ছিল না? খেয়াল খুশির জীবন, অন্ধকারের জীবন, লিবারেল জীবন? কেউ দাওয়াত দিতে আসলে আমি যা করছি তা অন্যকে ইগনোর করতে বলে নিজের মতো চলতে বলার জীবন? আল্লাহ্ যেমন এক, আল্লাহর রাস্তাও এক। তাই তো আল্লাহর বান্দাও এক। যে ইবাদাতে এবং প্রায়োগিক উভয় জীবনেই এক আল্লাহকে মেনে চলে, আর কোন শরিক করেনা। ইবাদাতে এক, প্রায়োগিকে আরেক অনুসরণ করে না।
ধর্ম ইসলামে নিজেকে অভ্যস্ত করার আগে কোনদিন দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে না। অর্থাৎ ধর্মের মূল সালাত, রোযা, হজ্ব, যাকাত পালন না করলে কেউ কীভাবে দ্বীনের বুঝ পাবে? সালাতে যে নিজেকে আত্মসমর্পন করে না সে ব্যক্তি নিজের মনগড়া চিন্তা চেতনাকে কীভাবে সমর্পন করবে? ভাইজান, একটা সরল কথা কি জানেন? যেখানে ধর্মকে টেনে আনা যায় না ঐখানে আপনি পৌঁছুলেন কীভাবে? একদিনে? এক লাফে? ইবাদাতে মশগুল থেকে? দ্বীনি কিতাব, বন্ধু, পরিবেশের সংস্পর্শে থেকে? যে ব্যক্তি মুসলিমদের জামায়াতে থাকে আর যে ব্যক্তি দ্বীন থেকে দূরে থাকা মানুষদের মজলিশে থাকে, দিনরাত উঠা-বসা করে, অসার বই-পত্র পড়ে এদের ভিতর “সবখানে ধর্ম টেনে আনার কী দরকার” বলার সম্ভাবনা কার বেশি? শয়তান কখনো একলাফে মানুষকে পথভ্রষ্ট করেনা। এটা কি একদিনে গড়ে ওঠে নাকি? একের পর এক ফরয ছেড়ে দিতে দিতে, সুন্নাত ছেড়ে দিতে দিতে, সর্বশেষ হালাল ছেড়ে দিতে দিতে হয়। এক সময় এরেঞ্জড মেরেজকে হারাম আর লাভ মেরেজকে হালাল মনে হয়। কল-কারখানার মেশিনভিত্তিক ক্যারিয়ারকে প্রয়োজন আর জলজ্যান্ত মানব শিশুকে অপ্রয়োজন মনে হয়। হারাম-হালালের তোয়াক্কা না থাকা, হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম মনে করা পথভ্রষ্টতার পূর্ব লক্ষণ। আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি সবচেয়ে বড় প্রতারক অভিশপ্ত শয়তানের কথা। কি যেন মিশন ছিল তার? সবখানে ধর্ম টেনে কি আর সেই মিশন পূর্ণ করা সম্ভব?
হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহামহিম পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করল? [সুরাহ ইনফিতার: ৬]
পাঁচতাই আসুন শয়তান পুরোপুরি টেনে ধরার আগেই দ্বীনকে টেনে ধরি। সুন্নাতকে টেনে ধরি। তাহলে দ্বীনও আপনাকে টেনে ধরবে। আর দ্বীনের টান একবার যার অন্তরে পৌঁছে গেছে সেই জানে যে সাহাবীরা ইসলাম পূর্ববর্তী যে জীবনে নিজেরা অভ্যস্ত ছিল ঐ জীবনেরই বিপরীতে কেন মানুষকে সাবধান করে গেছে। তাঁরা নিজেরা তো বেঁচে গিয়েছিল তাও কেন মানুষকে বাঁচাতে তাঁরা এতো কষ্ট করতো? কালিমা, সালাত, রোযা, হজ্ব, যাকাত এগুলাতো ভিত্তি। একটা ভবনের রঙ কী, কয় তলা, লিফট রাখা, গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে কিনা ইত্যাদি ধর্ম কি মানুষ ভিত্তি দেখে বলে নাকি বাইরের অবস্থা দেখে? ঠিক তেমনি একজনের বাইরের অবস্থাও তার দ্বীনের উপর নির্ভরশীল। সে যা তার চাল চলনে, কথা বার্তায় তারই দাওয়াত প্রকাশ পেতে থাকবে।ডাঃ শামসুল আরেফীন এর একটা কথা আছে, “সুন্নাহ নিজেই দাওয়াত। আপাদমস্তক সুন্নাহ নিয়ে কেউ হাঁটবে, আশেপাশের লোকেরা দাওয়াত নিতে থাকবে। সে দাওয়াত জবানের চেয়ে স্পষ্ট, ভাষার চেয়ে শক্তিশালী।”
ভাইজান, যেখানে ধর্মকে টেনে আনা যায় না সেইটা কোন দ্বীন? কোন সে চলার পথ যেখানে ইসলাম বাদেও কোন আদর্শ চলে, আল্লাহ্ বাদেও কোন ইলাহর খায়েশ পূর্ণ হয়?
লা ইলাহা ইল্লালাহু, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (দঃ)
আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই, মুহাম্মাদ(দঃ) তাঁর প্রেরিত রাসূল।
লেখক: মুরসালিন নিলয়
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।