মনে করুন, বছরের পর বছর আপনি কোনো দা’ঈর নাসীহাহ বা ওয়াজ শুনে এসছেন, তাকে আদর্শ মেনে এসছেন। হুট করে জানতে পারলেন, তিনি বদলে গিয়েছেন বা এমনসব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করা শুরু করেছেন যা ইসলামের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। নিশ্চয় বিষয়টি আপনাকে তীব্রভাবে আঘাত করবে। আপনি যদি তার দ্বীনের পথ থেকে সরে আসার বিষয়টি ধরতে পারেন তবে নিজেকে ভাগ্যবান একজন বলে মনে করুন। কেননা ওই ব্যক্তির অধিকাংশ ভক্ত বিষয়টি বুঝতেই পারবেনা কারণ, তাদের দ্বীন শেখার মূল উৎসই ছিল দা’ঈ। তাছাড়া ভক্তদের কাছে এমন কোনো মানদন্ডও নেই যার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারবে যে, কোনটি ভালো কাজ আর কোনটি নীতিবিরোধী কাজ। তাদের দ্বীনের বুঝ তো সেই দা‘ঈর বাণী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। গুরুর বিচ্যুতি কিন্তু শিষ্যকেও পথভ্রষ্ট করে দেয়।
এই বিষাদের মধ্য দিয়ে আমিও পার হয়ে এসেছি। যাদেরকে দ্বীনের প্রথম কাতারের দা’ঈ ভেবে এসেছি, ভালোবেসেছি, শ্রদ্ধা করেছি তাদের কর্মকাণ্ডই একসময় এতটা হতাশ করেছে- যে সব শ্রদ্ধা ধুলোয় মিশে গেছে। কেবল দু’একজনের নীতিভ্রষ্টতা আমাকে এমন সিদ্ধান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে– ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। বরং তাদের আচরণ, সংগঠন বা ব্যক্তিগত সংস্থাগুলোর কর্মকান্ডের ব্যাপকতা আমাকে এমনটা ভাবতে বাধ্য করেছে। দা’ঈদের সাথে যখন আমি ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করতে চেয়েছি তখন আমার এই দুশ্চিন্তাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করার পরিবর্তে তারা আমাকে অপমান-অপদস্ত করেছে, নিজেদের আচরণের পক্ষে অজুহাত দাঁড় করিয়েছে, আমার বিরুদ্ধে নোংরা অভিযোগ এনেছে, আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে!
আমি লক্ষ্য করেছি, যখন কোনো ভক্ত তার পছন্দের আলিমের দুর্নীতি বা পথভ্রষ্টতার কথা জানতে পারে, তখন কষ্টের এই পাঁচটি ধাপের মধ্য দিয়ে তাদেরকে অতিক্রান্ত হতে হয়:
প্রথম পর্যায়: অস্বীকার
প্রথম যে চিন্তাটি মাথায় আসে তা হলো, “এগুলোর কোনোটিই সত্য না”। ভক্তরা নিজেদের দা’ঈর ব্যাপারে খারাপ কিছুই শুনতে চায় না। এজন্য তারা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে উটের মতো বালিতে মাথা গুঁজে নেতিবাচক সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে, যেন তাদের পছন্দের দা’ঈর ভালোরূপটিই আজীবনের জন্যে মনে গেঁথে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেকে এই পর্যায়টি পার হতে পারেনা। তাদের সামনে যত তথ্য-প্রমাণ আপনি উপস্থিত করুন না কেন সব-ই বৃথা।
দ্বিতীয় পর্যায়: ক্রোধ
এই পর্যায়ে যে বা যারা ভক্তদের কাছে উক্ত দা’ঈর দুর্নীতির কথা বলতে আসে সে-ই ভক্তের প্রবল ক্রোধের শিকার হয়। এমন মানুষদের কথা শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন তারা যে কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে – কেননা বিষয়টি মেনে নেয়া তাদের জন্য সহজ ব্যাপার নয়। খ্যাতিমান এ ধরনের দা’ঈকে কেউ কেউ নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মতো আপন মনে করে; কেউবা তাদের পরিবার থেকেও প্রাধান্য দিয়ে ফেলে। তবে, এ পর্যায়ে তারা দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায় এবং কিছু একটা সমস্যা যে হচ্ছে তা ধরতে পারে। এই দ্বিধার কারণে তারা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে আর এই যন্ত্রণার প্রতিফলন ঘটায়- মানুষের সাথে চেঁচামেচি করে। যেকোনো মূল্যে তারা তাদের পছন্দের দা’ঈকে সমর্থন করতে থাকে।
তৃতীয় পর্যায়: নিজেকে বুঝ দেয়া
এক সময় ভক্তরা বুঝতে পারে যে, তাদের পছন্দের দা’ঈর কাজগুলো আসলে ঠিক হচ্ছেনা। এর মাঝে বেশ কয়েক জায়গা থেকে হয়তো তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এসেছে। কিন্তু, তিনি হয়তো এগুলোর কোনোটারই যথোপযুক্ত জবাব বা সমাধান কোনোটিই দিতে পারেন নি। অনেকসময় দেখা গেছে, তিনি উল্টো খারাপ ব্যবহার করেছেন। ভক্তরা এক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের বোঝাতে শুরু করে, “আচ্ছা, নিশ্চয় এর পেছনে কোনো কারণ আছে। অপ্রাসঙ্গিক একটা ব্যাপার নিয়ে এত মাতামাতির কিছু নেই, তিনি হয়ত ভুলে কাজটি করে ফেলেছেন” ইত্যাদি। তারা নিজেকে বলতে থাকে, “যদি তিনি কাজটা ভুলে করেও ফেলেন, তাতে কি? কেউ তো আর নিখুঁত হতে পারেনা!” নিজেকে বলে বোঝান, “আমি শুধু তার ভালোকাজটুকু গ্রহণ করবো, খারাপগুলো করবো না। তাহলেই তো হলো!”
চতুর্থ পর্যায়: হতাশা
এই পর্যায়টি ভক্তের মাথায় একশ কেজি ওজনের পাথরের মতো এসে আঘাত করে। আগের পর্যায়ের অনর্থক বুঝ চূড়ান্ত উপলব্ধিকে আসতে বাধা দিতে পারেনা। এখন তাদের ভয়ংকর কুৎসিত সত্যের মুখোমুখি হতে হবে, যা তাদের কেবল একরাশ কষ্টের মাঝেই ছুড়ে ফেলবে। কারো জন্যে এই সময়টি তাদের দ্বীন পালনকে বিপন্ন করে তোলে। তারা হয়ত ইসলামের কাছাকাছি এসেছিল সেই দা’ঈর হাত ধরে। এখন দা’ঈর নীতিভ্রষ্টতা হয়ত তাকে ইসলাম, আলিমগণ, ইলম শিক্ষা- সবকিছু সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে বাধ্য করবে। কষ্টে অবগাহনে অনেক ভক্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে ফেলে, “আমি আর কক্ষনো কোনো আলিমের কথা শুনবো না!” এই পর্যায়টি বড়জোর কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত টিকে থাকে।
পঞ্চম পর্যায়: মেনে নেয়া
আল্লাহ চাইলে, একসময় এই প্রাক্তন ভক্তরা পরিণত চিন্তাভাবনা করার পর্যায়ে এসে পৌঁছে। তারা বুঝতে শিখে যে, বর্তমান যুগের সব দা’ঈ বিশ্বাসযোগ্য নয়। সত্যি বলতে, কয়েকজন হয়ত কেবল লেবাসে ইসলামকে ধারণ করে আছে কিন্তু বাস্তবে তাদেরকে লেবাসে মোড়া নেকড়ে বললেও ভুল হবে না। অন্ধ-ভক্তদের সমর্থন তাদেরকে এতটা পরিপুষ্ট করে তুলেছে যে তারা এখন দ্বীনের মৌলিক রীতিনীতিগুলো পরিবর্তন করার সাহস দেখায়। হাজার বছর ধরে চলে আসা দ্বীনকে তারা নিজেদের পছন্দসই আরামদায়ক সংস্করণে রূপান্তর করতে চায়। এ সমস্তকিছু জেনেশুনে কিছু ভক্তরা নিজ দায়িত্বে এমন অন্ধ-অনুকরণ থেকে সরে আসে। তাদের অন্তরে হয়ত ক্ষতের সৃষ্টি হয় কিন্তু ধীরেধীরে তারা তা কাটিয়ে উঠতে শেখে।
সালমান আল-ফারাসি রাঃ নামক এই সাহাবির কাছ থেকে এর এক অসাধারণ উদাহরণ পাওয়া যায়। তিনি তার জীবনের প্রথম সময়টুকু ব্যয় করেছেন অগ্নি-উপাসক থেকে খ্রিস্টান হওয়ার পেছনে। তিনি একজন খ্রিস্টান পন্ডিতের কাছে দীক্ষা নেয়া শুরু করলেন এবং পন্ডিতের মৃত্যু পর্যন্ত তার কাছেই থাকলেন। তার মৃত্যুর পর সালমান ফারসি আরও কয়েকজন পন্ডিতের শরণাপন্ন হলেন এবং দীক্ষা নেয়া শুরু করলেন। একসময় লক্ষ করলেন, তিনি দীক্ষা নিচ্ছেন এমন একজন খ্রিস্টান পন্ডিত চরমভাবে নীতিভ্রষ্ট, শুধু তা-ই নয় সেই পন্ডিত আক্ষরিক অর্থে মানুষের কাছ থেকে টাকা চুরি করছে। সালমান এটা দেখে হাল ছেড়ে দিলেন না বা বললেন না যে, “ঠিক আছে, তাহলে যে পন্ডিত মারা গেছেন আমি কেবল তাকেই অনুসরণ করব”! বরং তিনি সত্যের সন্ধান করা শুরু করলেন। একসময় এই সত্যকে খোঁজার ইচ্ছাই তাকে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সান্নিধ্যে নিয়ে এলো এবং তিনি রাসূলের বিশিষ্ট সাহাবিদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেলেন।
আপনিও সালমান রাঃ এর মতো হোন। কোনো দা’ঈর নীতিভ্রষ্টতা যদি আপনাকে কষ্ট দেয় তবুও ভেঙে পড়বেন না। বর্তমান যুগে অসংখ্য সৎ আলিম রয়েছেন, যাঁরা সত্যকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রাখে, পৃথিবী উল্টে গেলেও আল্লাহর কালামকে কোনোকিছুর বিনিময়ে বিক্রি করেন না। তাঁদের সন্ধান করুন তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন। বি-ইযনিল্লাহ।
উৎস: Muslim Skeptic (মূল আর্টিকেল লিঙ্ক)
অনুবাদকঃ শারিকা হাসান
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।