ইয়াজুজ ও মাজুজ আদম সন্তানের দুটি বিশাল জাতি। যারা শেষ সময়ে পৃথিবীতে চলে আসবে এবং ভায়ানক হত্যাযজ্ঞ চালাবে। কুরআন এবং সহিহ হাদিসে এদের সম্পর্কে অনেক বিবরণ রয়েছে কিন্তু তারা কোথায় অবস্থান করছে, তাদের প্রকৃতি কিরূপ এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা। এ প্রবন্ধটির মাধ্যমে কুরআন এবং সহিহ হাদিস এবং পূর্ববর্তী কিতাবের আলোকে তাদের বিস্তারিত স্বরূপ তুলে ধরা হল।

সূরা আম্বিয়াতে ইয়াজুজ-মাজুজ

সূরা আম্বিয়ার ৯৫ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে –

IIRT Arabic Intensive

وَحَرَامٌ عَلَىٰ قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا أَنَّهُمْ لَا يَرْجِعُونَ

অর্থ: যে সব জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি তার অধিবাসীদের ফিরে না আসা অবধারিত।

আয়াতে يَرْجِعُونَ শব্দের অর্থ তাদের ফিরে আসা। কিন্তু কোথায় ফিরে আসার কথা বলা হচ্ছে? আয়াতের অর্থের দিকে খেয়াল করলে বুঝা যায় এখানে পৃথিবীকে নির্দেশ করা হচ্ছে। পৃথিবীর কোন জনপদকে যখন ধ্বংস করে দেয়া হয় তারা আর পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে না। অর্থাৎ যেসকল জনপদকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন সেই জনপদের মানুষ এবং পৃথিবীর মাঝে অন্তরায় (barrier) তৈরি হয়েছে যেটাকে আরবিতে বলা হয় بَرْزَخْ (বারযাখ)। আর এই অন্তরায় ভেদ করে তাদের পক্ষে পৃথিবীতে আসা সম্ভবপর নয়।

সাধারণত মানুষ যখন এই পৃথিবী থেকে চলে যায় এবং তার ও পৃথিবীর মাঝে بَرْزَخْ (বারযাখ) সৃষ্টি হয়, তখন তার আত্মা দেহ থেকে পৃথক হয়ে যায়।[১] যেটাকে আমরা মৃত্যু বলি। কিন্তু ইয়াজুজ-মাজুজ যে সকল জনপদে থাকত ঐ জনপদসমূহকে আল্লাহ ধ্বংস করে بَرْزَخْ (বারযাখ) বা অন্তরায় তৈরি করে দিলেও তারা মৃত্যুবরন করেনি। যেটা এই সূরার পরের আয়াতে স্পষ্ট।

সূরা আম্বিয়ার ৯৬ নাম্বার আয়াত –

حَتَّىٰ إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُم مِّن كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ

অর্থ: যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ ও মা’জুজকে বন্ধনমুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যক উঁচু জায়গা থেকে নেমে আসবে।

এখানে আয়াতের শুরুতে حَتَّى (যে পর্যন্ত না) এই আয়াতের সাথে পূর্বের আয়াতের সংযুক্ততাকে নির্দেশ করে।

আয়াতে লক্ষণীয় অংশ হল كُل حَدَبٍ যার অর্থ সকল উঁচু জায়গা। নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের উঁচু জায়গা নয় বরং পৃথিবীর সকল উঁচু জায়গা যা দিয়ে পৃথিবীর উপর থেকে সহজে পৃথিবীতে নেমে আসা যায়। আর এখান থেকে তাদের বর্তমান অবস্থান বুঝা যায় যে তারা এই পৃথিবীর মধ্যে নয় বরং পৃথিবীর উপরে অবস্থান করছে এবং যখন তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া হবে তখন পৃথিবীতে সহজে নেমে আসতে حَدَب (উঁচু জায়গা) এর প্রয়োজন হবে।

তারা কিরূপে পৃথিবীপৃষ্ট থেকে উপরে অবস্থান করছে সে সম্পর্কিত আমার কিছু ভাবনা লেখার শেষে দেয়া থাকবে।

কুরআনে এই সূরার আগে সূরা কাহফে ইয়াজুজ-মাজুজ নিয়ে বর্ণিত আয়াতে[২] পৃথিবীতে তাদের বিপর্যয় সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তারা পৃথিবীতে প্রবেশ করার শক্তি রাখত। তাদের কাছে এমন ক্ষমতা ছিল যা দিয়ে তারা অন্তরায়কে ভেদ করে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারত।

এ পর্যায়ে ইয়াজুজ-মাজুজের সে ক্ষমতাকে বুঝতে আমরা দেখব তাদের মৌলিক প্রকৃতি কেমন।

ইয়াজুজ-মাজুজের মৌলিক গঠন প্রকৃতি

এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের মূল কারণ শয়তানের ছলনা। মানুষের মূল আবাসস্থল ছিল জান্নাত। সেখান থেকে মানুষকে প্রতারনার মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্য করে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসে।

অতীতকালে যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তানকে (জ্বিনের এক প্রকার) সঙ্গী করে নিত, শয়তানের আরাধনা করত, তারা শয়তানের দলভুক্ত হয়ে যেত এবং সম্পূর্ণরুপে শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। কুরআনে এ ব্যাপারকে ভৎসনা জানিয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা বলে দেয়া হয়েছে[৩]

আমরা যদি বাইবেলে চলে যাই। সেখানে ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিউ টেস্টামেন্টের প্রত্যাদেশ বইয়ের (book of revelation) ২০ অধ্যায়ের ৭ এবং ৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে –

৭. সেই হাজার বছর শেষ হলে পর শয়তানকে তার কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হবে।

৮. তখন সে ইয়াজুজ-মাজুজ, যারা পৃথিবীর চতুর্দিকে অবস্থিত থাকবে তাদেরকে প্রতারিত করে যুদ্ধ করার জন্য সমবেত করবে।

এখানে শয়তান হল দাজ্জাল। অর্থাৎ শয়তানের ভিন্ন এক রুপ। রাসূল (সঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এ শয়তান দাজ্জালের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষ দাজ্জালের বন্দীর কথা বলা রয়েছে[৪]। তাকে মুক্ত করে দিলে সে পৃথিবীতে চলে এসে মানুষকে প্রতারিত করবে, তখন ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ প্রেরন করবেন দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য। যখন তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন তখন শয়তান তার দলভুক্ত ইয়াজুজ-মাজুজকে পৃথিবীর পৃষ্টে নিয়ে আসবে ঈসা (আঃ) এর বিপক্ষে। তাদের সাথে যুদ্ধ করার মত সক্ষমতা কোন মানুষের থাকবে না[৫]। ঈসা (আঃ) কে বলা হবে তূর পাহাড়ের গুহাতে আশ্রয় নিতে[৬]। তখন আল্লাহ এই ইয়াজুজ-মাজুজকে পূর্বের মত জনপদ ধ্বংস করে নয় বরং তাদের ঘাড়ে এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ[৭] দিয়ে একসাথে নিঃশেষ করে দিবেন।

এখান থেকে ইয়াজুজ-মাজুজের মৌলিক প্রকৃতি বুঝা গেল যে তারা শয়তানের ইচ্ছা এবং শক্তির অধীন।

শয়তানের ইচ্ছা ও শক্তি এবং ইয়াজুজ-মাজুজের ইচ্ছা ও শক্তি একই সুতায় গাঁথা

আমরা বলি –

لَا حَوْلَ ولَا قُوًّةَ إلَّا بالله[৮]

এর ভাবার্থকে বাংলা করলে দাঁড়ায় – সকল ধরনের ইচ্ছা এবং সকল ধরনের শক্তি, আল্লাহ ইচ্ছা এবং শক্তির অধীন।

মানব জীবনের সকল ধরনের কাজ-কর্ম, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম-বিনোদন, আনন্দ-উচ্ছাস সহ যাবতীয় কার্যাবলীর মূলে চলে গেলে দেখা যাবে সেখানে মৌলিক ২টি বিষয় রয়েছে: এক – তার ইচ্ছা, দুই – তার শক্তি বা ক্ষমতা। ইচ্ছা এবং শক্তি ছাড়া জীবনে কিছুই সম্ভব নয়। যেকোন বিষয়ের জন্য ইচ্ছার ক্ষমতা এবং শক্তির ক্ষমতা আবশ্যক। মানুষ যখন মারা যায় তখন তারা দেহ থাকে কিন্তু সেখানে ইচ্ছা এবং শক্তির ক্ষমতা থাকে না। তাহলে মূল কথা হল মানুষ অর্থ হল কিছু ইচ্ছা এবং কিছু শক্তির সমন্বয়।

ঠিক একাইভাবে শয়তান অর্থাৎ জ্বিন এদেরও সকল কাজ-কর্মের কেন্দ্র এই মৌলিক ২টি বিষয় অর্থাৎ শয়তানও কিছু ইচ্ছা এবং কিছু শক্তির সমন্বয় ব্যতিত অন্য কিছু নয়।

যখন মানুষ শয়তানের আরাধনা করে তার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তখন তার সকল ইচ্ছা ও শক্তি, শয়তানের ইচ্ছা ও শক্তির অধীন হয়ে যায়। সে শয়তানের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে যা ইচ্ছা হয় তা করতে বা পেতে পারে। অপরদিকে শয়তান মানুষের সে শক্তিকে ব্যবহার করে অন্য মানুষের মাঝে যা করতে চায় তা করে।

এখানে লক্ষ্যনীয় পৃথিবীর বিষয়বলীতে মানুষ এবং শয়তান উভয়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক ব্যাপার রয়েছে যেখানে মানুষের ক্ষমতা আছে, শয়তানের নেই। আবার অনেক ইস্যু আছে যেখানে মানুষের ক্ষমতা নেই কিন্তু শয়তানের আছে। যেমনঃ মানুষ মানুষকে কোন কারণ ছাড়াই মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু শয়তান যদিও মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রনা দিতে পারে কিন্তু অকারণে মানুষকে মারতে পারে না। যখন কালো জাদু (ব্ল্যাক ম্যাজিক) করা হয় তখন শয়তান সে ক্ষমতা পেয়ে যায়।

আর ইয়াজুজ মাজুজ হল শয়তানের দোসর সে সম্প্রদায় যাদেরকে শয়তান যেভাবে ব্যবহার করতে চায় সেভাবে ব্যবহার করে। অপদিকে ইয়াজুজ মাজুজ শয়তানের ক্ষমতা থেকে নিজ ইচ্ছা-আকাঙ্খা হাসিল করে।

সূরা কাহফে ইয়াজুজ-মাজুজ

৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে জুল কারনাইন উপাধিতে একজন শক্তিশালী শাসক ছিল। সূরা কাহফে ইয়াজুজ-মাজুজের প্রবেশদ্বারে তাঁর প্রাচীর তৈরি করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে[৯]। এই ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায় এক নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পৃথিবীতে প্রবেশ করে বিপর্যয় সৃষ্টি করত। তখন সেই প্রবেশদ্বারে তিনি প্রাচীর তৈরি করে দেন।

কি ছিল এই প্রবেশদ্বার?

আমরা জানি শয়তানের অবস্থান এই পৃথিবীতে রয়েছে। সে তার ইচ্ছা এবং শক্তিকে পৃথিবীতে ব্যবহার করতে পারে। অপরদিকে ইয়াজুজ-মাজুজের জনপদকে আল্লাহ ধ্বংস করে অন্তরায় সৃষ্টি করে দেয়ায় ফলে পৃথিবীতে তারা অবস্থান করতে না পারাতে কারণে তাদের নিজস্ব ইচ্ছা ও ক্ষমতার ব্যবহার এখানে সম্ভব ছিল না। মুলত ঐ প্রবেশদ্বারই ছিল সেই পথ যেখান দিয়ে শয়তানের শক্তিকে ব্যবহার করে তারা পৃথিবীতে প্রবেশ করত। যখন প্রাচীর তৈরি করে দেয়া হয় তখন তাদের আর প্রবেশের সুযোগ থাকে না। আর এই প্রাচীর যেহেতু মানব শক্তির মাধ্যমে তৈরি হয়েছে তা ভাঙ্গার ক্ষেত্রে শয়তানের শক্তি সীমাবদ্ধ। শুধুমাত্র মানব শক্তির ব্যবহার দ্বারাই তা ভাঙ্গা সম্ভব।

ইয়াজুজ-মাজুজ পৃথিবীতে প্রবেশ করতে চাইত। এ কারণে তারা দিন-রাত সে দেয়াল ভাঙতে চেষ্টা করেছে[১০]।  এখানে বিবেচনীয় বিষয় হল তারা যতখানি সে দেয়ালকে ভাঙতে পারবে সে অনুপাতে তারা তাদের ইচ্ছা ও শক্তিকে পৃথিবীতে ব্যবহার করতে পারবে। আর শয়তানের দিক থেকে বিবেচনায় তদানুযায়ি সে ইয়াজুজ-মাজুজের শক্তিকে পৃথিবীতে ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।

রাসূল (সঃ) এর বর্ণীত হাদিস থেকে পাওয়া যায় তাঁর মদিনাতে শেষের দিকের সময়কালেই তারা সে দেয়ালে দেয়ালে ছোট ছিদ্র করতে সক্ষম হয়েছে[১১]। এবং তিনি সেখানে মুসলিমদের জন্য বিপদের কথা বলেছেন। হাদিসের বর্ণনাতে فَتَحَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ঠিক একই শব্দ সূরা আম্বিয়ার ৯৬ নাম্বর আয়াতে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন। এ থেকে স্পষ্ট তাদের এবং পৃথিবীর মাঝের অন্তরায়কে আল্লাহ যতখানি পরিমান খুলে দিবেন সে অনুযায়ী তারা পৃথিবীতে প্রবেশাধিকার পাবে। অর্থাৎ সমানুপাতে তাদের ইচ্ছা ও শক্তিকে পৃথিবীতে ব্যবহার করতে পারবে।

আর তাই বলাবাহুল্য অল্প মাত্রায় হলেও সমগ্র পৃথিবীতে তাদের প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর যেসকল ইস্যুতে শয়তানের ক্ষমতা রয়েছে তার প্রত্যেকক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি রয়েছে। মূলত শয়তান তাদের শক্তিকে ব্যবহার করছে।

আমাদের জন্য আবশ্যক মানুষের সাথে লেন-দেন, আচার-আচারনে সর্বচ্চো উত্তম পন্থা অবলম্বন করা। ঝগড়া-ঝাটি, ক্রোন্দল থেকে নিজেকে দূরে রাখা। অন্যের প্রতি রাগ, হিংসা, খারাপ নজর থেকে নিজেকে দূরে রাখা। কারো প্রতি নেতিবাচক কোন কথা বলা বা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সর্বচ্চো সতর্কতা অবলম্বন করা। বিশেষত যারা দায়ী, আলেম-ওলামা বা পরিচিত মুখ (পাবলিক ফিগার)। আপনার করা একটা নেতিবাচক মন্তব্য তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্তর সম্পর্কিত প্রতিটা বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক অন্যকে অহেতুক বিপদে ফেলা থেকে রক্ষা করতে। যথাসম্ভব অন্তরদিয়ে মানুষকে ভালোবাসতে, মানুষের ভালো প্রত্যাশা করতে চেষ্টা করতে হবে, এমনকি আপনি যদি কারো ঘোর বিরোধীও হন।

ইয়াজুজ-মাজুজকে পৃথিবীতে মুক্তকরন

সর্বোপরি ঈসা (আঃ) এর আগমনের পরে তাদের ও পৃথিবীর মাঝের অন্তরায়কে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দেয়া হবে[১২]। শয়তান তাদেরকে ঈসা (আঃ) এর বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য নিয়ে আসবে। তখন পৃথিবীর সকল অঞ্চলের উঁচু জায়গা ব্যবহার করে উপর থেকে তারা পৃথিবীতে নেমে আসবে।

যারা নিজেদেরকে দুর্গ, কেল্লার অন্তরালে আবদ্ধ করে ফেলতে পারবে তারা ব্যতিত সকলকে মেরে ফেলবে। পৃথিবীর সকল জায়গাতে দখল নেয়ার পর তারা আকাশে তীর ছুড়বে ফেরেশতাদের মারার জন্য[১৩]। এরপরে একটা নির্দিষ্ট সময় পর ঈসা (আঃ) এর দোয়াতে আল্লাহ তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিবেন।

ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পৃক্ত হাদিসসমূহ

১.ইয়াজুজ-মাজুজ সংখ্যায় চিন্তাতীত। সকল নবীর জাতি থেকে প্রতি এক হাজার মানুষে একজন জান্নাতি হবে। কিন্তু মুহাম্মাদ (সঃ) এর উম্মতের সকলে জান্নাতি হবে এবং এর বিপরীতে ইয়াজুজ-মাজুজ থাকবে। তাদের সংখ্যা বুঝার জন্য উদাহরণস্বরুপ আমরা যদি ধরি মুহাম্মাদ (সঃ) এর উম্মত ১০০ কোটি তবে এর বিপরীতে ৯৯৯০ কোটি ইয়াজুজ-মাজুজ জাহান্নামি।

ইসহাক ইবনু নাসর (রহঃ) … আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আল্লাহ (হাশরের দিন) ডাকবেন, হে আদম! তখন তিনি জবাব দিবেন, আমি হাযির, সকল কল্যাণ আপনার হাতেই। তখন আল্লাহ বলবেন জাহান্নামী দলকে বের করে দাও। আদম (আঃ) বলবেন, জাহান্নামী দল কারা? আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাজারে নয়শত নিরানব্বই জন। সাহাবাগণ বলবেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (প্রতি হাযারের মধ্যে একজন) আমাদের মধ্যে সেই একজন কে? তিনি বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা তোমাদের মধ্য থেকে একজন আর এক হাজারের অবশিষ্ট ইয়াজুজ-মাজুজ হবে। [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়ঃ আম্বিয়া কিরাম (আঃ) (كتاب أحاديث الأنبياء), হাদিস নাম্বার ৩১১১] [১৪]

২.তাদের এক দল এক অবস্থানে তাবারিয়া লেকের (Sea of Galilee) পানি খেয়ে ফেলবে, যা তাদের সংখ্যাধিক্যকে জানান দেয়।

আলী ইবন হুজর (রহঃ) …… নাওওয়ান ইবন সামআন কিলাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত।

আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)কে ওয়াহী পাঠাবেনঃ আমার বান্দাদেরকে তুর পাহাড়ে সরিয়ে নাও। আমি আমার এমন একদল বান্দা নামাচ্ছি যাদের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা কারো নেই। এরপর আল্লাহ তাআলা ইয়াজুজ-মাজুজের দল পাঠাবেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার বিবরণ মত প্রতি ’উচ্চ ভূমি থেকে তারা ছুটে আসবে’। তাদের প্রথম দলটি তাবারিয়া উপসাগর (ইসরাইলে অবস্থিত) অতিক্রম করা কালে এর মাঝে যা পানি আছে সব পান করে ফেলবে। এমন অবস্থা হবে যে, পরে তাদের শেষ দলটি যখন এই উপসাগর অতিক্রম করবে তখন তারা বলবে ’এখানে এক কালে হয়ত পানি ছিল’। [সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়ঃ ফিতনা (كتاب الفتن عن رسول الله ﷺ), হাদিস নাম্বার ২২৪৩][১৫]

৩.তাদেরকে আল্লাহ যখন ঘাড়ে পোকার আক্রমণ দিয়ে মেরে ফেলবে তখন পৃথিবীতে এক বিঘৎ জায়গা থাকবে না যেখানে তাদের মৃতদেহ ও লাশ নেই। যেটা আবারো তাদের সংখ্যাধিক্যকে বলে দেয়।

আলী ইবন হুজর (রহঃ) …… নাওওয়ান ইবন সামআন কিলাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তারপর ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে মিনতি জানাবেন। আল্লাহ তাআলা তাদের গর্দানে ’‘নাগাফ’’ জাতীয় এক জীবানু মহামারীরূপে প্রেরণ করবেন। তারা সব ধ্বংস হয়ে মরে যাবে যেন একটি মাত্র প্রাণের মৃত্যু হল। এরপর ঈসা (আঃ) ও তার সঙ্গীগণ পাহাড় থেকে নেমে আসবেন, কিন্তু তারা এব বিঘৎ জায়গাও এমন পাবেন না যেখানে ইয়জুজ-মাজুজের গলিত চর্বি, রক্ত ও দুগন্ধ ছড়িয়ে না আছে। [সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়ঃ ফিতনা (كتاب الفتن عن رسول الله ﷺ), হাদিস নাম্বার ২২৪৩] [১৫]

৪.তাদের ক্ষমতার সামনে কোন মানুষ দাঁড়াতে পারবে না। ঈসা (আঃ)কে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে নয় বরং তূর পাহাড়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য বলা হবে।

আলী ইবন হুজর (রহঃ) …… নাওওয়ান ইবন সামআন কিলাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত।

আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)কে ওয়াহী পাঠাবেনঃ আমার বান্দাদেরকে তুর পাহাড়ে সরিয়ে নাও। আমি আমার এমন একদল বান্দা নামাচ্ছি যাদের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা কারো নেই। এরপর আল্লাহ তাআলা ইয়াজুজ-মাজুজের দল পাঠাবেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার বিবরণ মত প্রতি ’উচ্চ ভূমি থেকে তারা ছুটে আসবে’। তাদের প্রথম দলটি তাবারিয়া উপসাগর (ইসরাইলে অবস্থিত) অতিক্রম করা কালে এর মাঝে যা পানি আছে সব পান করে ফেলবে। এমন অবস্থা হবে যে, পরে তাদের শেষ দলটি যখন এই উপসাগর অতিক্রম করবে তখন তারা বলবে ’এখানে এক কালে হয়ত পানি ছিল’। [সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়ঃ ফিতনা (كتاب الفتن عن رسول الله ﷺ), হাদিস নাম্বার ২২৪৩] [১৫]

৫.শয়তানের অধীনস্ততায় তাদের ক্ষমতা পৃথিবীর মানুষের ক্ষমতার থেকে ভিন্ন। শয়তানের শত্রু ফেরেশতাদের সাথে শয়তানের মিত্র হওয়াতে স্বভাবতই তাদের বিরোধিতা থাকায় তারা আকাশে তীর ছুঁড়বে তাদেরকে মারার জন্য।

আলী ইবন হুজর (রহঃ) …… নাওওয়ান ইবন সামআন কিলাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত।

মুক্তি পেয়ে ইয়াজুজ-মাজুজের বায়তুল মুকাদ্দাস অভিমুখী যাত্রা করবে। তারা পরস্পর বলবেঃ পৃথিবীতে যারা ছিল তাদেরকে তো বধ করেছি এস এবার আসমানে যারা আছে তাদের শেষ করে দেই। তারপর তারা আসমানের দিকে তাদের তীর ছুড়বে। আল্লাহ তাআলা তাদের তীরগুলোকে রক্ত রঞ্জিত করে ফিরিয়ে দিবেন। ঈসা ইবন মারয়াম (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকবেন। তাদের অবস্থা এমন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে যে, আজকে তোমাদের কাছে একশত স্বর্ণ মুদ্রার যে দাম তাদের কাছে তখন একটি ষাড়ের মাথাও তদপেক্ষা অনেক উত্তম বলে মনে হবে। [সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়ঃ ফিতনা (كتاب الفتن عن رسول الله ﷺ), হাদিস নাম্বার ২২৪৩] [১৫]

৬.তাদের মৃত্যু হবে একজন মানুষের মৃত্যুর মত (كمَوتِ نَفْسٍ واحِدَةٍ)। একজন মানুষের ঘাড়ে আল্লাহ ভাইরাস দিয়ে সে মানুষকে মেরে ফেলা অর্থ সকল ইয়াজুজ মাজুজের মৃত্যু। এটা হল শয়তানের শক্তি, যে শক্তির নিয়ন্ত্রণে সকলেই অন্তর্ভুক্ত। যেমনিভাবে সূরা লুকমানে (৩১:২৮) মানুষের সৃষ্টি এবং পুনরুথান সম্পর্কে আল্লাহ বলছেনে –

مَّا خَلْقُكُمْ وَلَا بَعْثُكُمْ إِلَّا كَنَفْسٍ وَاحِدَةٍ (তোমাদের সকলের সৃষ্টি ও পুনরুত্থান একটি মাত্র প্রাণীর সৃষ্টি ও পুনরুত্থানের অনুরূপ।)

আলী ইবন হুজর (রহঃ) …… নাওওয়ান ইবন সামআন কিলাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তারপর ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে মিনতি জানাবেন। আল্লাহ তাআলা তাদের গর্দানে এক প্রকার পোকা প্রেরণ করবেন। এতে একজন মানুষের মৃত্যুর ন্যায় তাদের সবাই মারা যাবে। এরপর ঈসা (আঃ) ও তার সঙ্গীগণ পাহাড় থেকে নেমে আসবেন, কিন্তু তারা এব বিঘৎ জায়গাও এমন পাবেন না যেখানে ইয়জুজ-মাজুজের গলিত চর্বি, রক্ত ও দুগন্ধ ছড়িয়ে না আছে। তারপ ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে আবার মিনতি জানাবেন। তখন আল্লাহ তাআলা উটের মত লম্বা গলা বিশিষ্ট এক প্রকার পাখি প্রেরণ করবেন। পাখিগুলি ইয়াজুজ-মাজুজদের লাশ উঠিয়ে নীচু গর্তে নিয়ে ফেলে দিবে। মুসলিমগণ তাদের ফেলে যাওয়া ধনুকে জ্যা, তীর এবং তুলীর সাত বছর পর্যন্ত জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করবে। আল্লাহ তাআলা প্রবল বৃষ্টি করবেন শহর বা গ্রামের কোন বাড়িঘরই তা থেকে রক্ষা পাবে না। সমস্ত যমীন ধৌত হয়ে যাবে এবং তা আয়নার মত ঝক ঝকে হয়ে উঠবে। [সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়ঃ ফিতনা (كتاب الفتن عن رسول الله ﷺ), হাদিস নাম্বার ২২৪৩] [১৫]

পৃথিবীর উপরে ইয়াজুজ-মাজুজের অবস্থান কিরূপ

ইয়াজুজ-মাজুজ পৃথিবীর উপরে অবস্থান করছে এটা কুরআনের আয়াত থেকে স্পষ্ট। কিন্তু কিরূপে তারা সেখানে অবস্থান করছে সেব্যাপারে কুরআন বা হাদিসে কিছুই বলা হয় নি। এখানে কুরআন হাদিস থেকে প্রাপ্ত আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা থেকে তুলে ধরছি।

ভাবনা ১. রাসুল (সঃ) থেকে সহিহ হাদিসে বর্ণীত আছে দাজ্জালের জান্নাত এবং জাহান্নাম থাকবে। স্বভাবতই জান্নাত, জাহান্নাম এই পৃথিবীতে নয় বরং পৃথিবীপৃষ্ট থেকে উপরে। ইয়াজুজ মাজুজ হতে পারে দাজ্জালের সে জান্নাতে রয়েছে।

হুযায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দাজ্জালের বাম চোখ কানা হবে। (তার দেহে) ঘন চুল হবে। তার কাছে জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে। (মুলতঃ) তার জাহান্নাম জান্নাত হবে এবং তার জান্নাত জাহান্নাম হবে। [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়ঃ ফিতনা সমূহ ও কিয়ামতের নিদর্শনাবলী (كتاب الفتن وأشراط الساعة), হাদিস নাম্বার ৭১০০] [১৬]

ভাবনা ২. সূরা আত-তালাকে (৬৫:১২) আল্লাহ বলেছেন ৭ আসমানের মত পৃথিবীতেও ৭ স্তর রয়েছে। যদি এক স্তরের পর আরেক স্তর এভাবে বিবেচনা করা হয় তাহলে তারা পৃথিবীর এই স্তরে নয় বরং হতে পারে পৃথিবীর উপরে অন্য কোন স্তরে রয়েছে।

ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ سَبْعَ سَمَـٰوَٰتٍ وَمِنَ ٱلْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ ٱلْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ (তিনি আল্লাহ্‌, যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন, তাদের মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ।)

তথ্যসূত্র

[১] কুরআন, ২৩:১০০

[২] কুরআন, ১৮:৯৪

[৩] কুরআন, ১৮:৫০-৫৩

[৪] সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নাম্বার ৭১১৯

[৫] সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নাম্বার ৭১০৭

[৬] সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নাম্বার ৭১০৭

[৭] সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নাম্বার ২২৪৩

[৮] সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), হাদিস নাম্বার ৬৩৮৪

[৯] কুরআন, ১৮:৯৪-৯৫

[১০] সুনান ইবনু মাজাহ, হাদিস নাম্বার ১০/৪০৮০

[১১] সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নাম্বার ৩৩৪৩

[১২] সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নাম্বার ৭১০৭

[১৩] সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নাম্বার ২২৪৩

[১৪] https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=3369

[১৫] https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=37598

[১৬] https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=19423

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive