: আপনার সন্তানদের সম্পর্কে যদি একটু বলতেন।

: আমার বড় মেয়ে এমবিবিএস (বিসিএস)। ছেলেটা একাউন্টিং-এ মাস্টার্স। এখন একটি কলেজে পড়ায়। আর ছোট মেয়ে ইকোনমিক্সে মাস্টার্স।

IIRT Arabic Intensive

আজ ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারী। অনেকদিন পর এফএম রেডিও শুনতে গিয়ে একটি চ্যানেলের “ভালবাসা দিবস” উপলক্ষ্যে বৃদ্ধাশ্রমের এক বাবার কথা শুনতে গিয়ে আটকে গেলাম।

অফিসে যাওয়ার সময় ছিল। সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাই আমি। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। চোখের পানি আটকাতে পারিনি। আমার লজ্জা লাগছিল রাস্তায় অনেকের সামনে চোখে পানি চলে এসেছে বলে। আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না আমি একজন বাবার আর্তনাদ শুনছি। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে সেই বাবার- যিনি তাঁর সন্তানকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বড় করেছিলেন। তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন।

“এই যে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হচ্ছে, আপনি এখানে কেমন আছেন?” রেডিওর কথাবন্ধু প্রশ্ন করলেন এক পর্যায়ে।

“সবাইকে ছেড়ে এই অবস্থায় থাকাটা তো অনেক কষ্টের। কিন্তু আমি সবকিছু ইতিবাচক ভাবেই নিই। নেওয়া ছাড়া উপায়ই বা কি?” চাপাকষ্টে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এই অবস্থাটা যখন এই সন্তানের হবে তখন কেমন লাগবে সন্তান নামের এই কলঙ্কগুলোর?

 যখন গান শুনতাম খুব, নচিকেতার এই গানটি নাড়া দিত প্রচণ্ড। (এখন মিউজিকসহ গান জায়েজ মনে করি না।)

 “ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার।

মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার

নানান-রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী।

সবচেয়ে কমদামী ছিলাম একমাত্র আমি।

ছেলের আবার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম।

আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।

…….

খোকারও হয়েছে ছেলে দু’বছর হল।

…….

আশ্রমের এই ঘরটা ছোট, জায়গা অনেক বেশি।

আমি খোকা দু’জনেতে থাকব পাশাপাশি।

সেইদিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম।

মুখোমুখি আমি খোকার বৃদ্ধাশ্রম।”

সেই বাবার কথাগুলো শুনতে গিয়ে আজ কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল। জানি, যদি এ পর্যন্ত পড়ে থাকেন তবে আপনারও ভাল লাগার কথা না। কিন্তু এখানেই শেষ না। অনেকেই মূভি দেখে চোখের পানি ফেলেন। ফেইসবুকে স্টাটাস দেন, “My mother is sick. Please pray for her.”

আমরা যখন ছোট ছিলাম, বাবা-মাকে যেই প্রশ্ন বারবার করেছি তার উত্তর তাঁরা বারবার দিয়েছেন। কত ভালবাসা! কতটা! কতটা! আর বাবা-মা বৃদ্ধ হলে? আমরা কি বাবা-মায়ের হক পালন করতে পেরেছি? কতটা করতে পেরেছি? না পারলে কেন পারছি না?

এক পর্যায়ে কথাবন্ধু প্রশ্ন করলেন- “আপনার কী মনে হয়? কী কারণে আজকে এই অবস্থা? কিংবা আপনার কি কোন দায়বদ্ধতা ছিল? কিংবা এই আমরা যারা তরুণ আছি, একদিন তো আমরাও বাবা-মা হব। তখন সন্তানদের কিভাবে গড়ে তোলা দরকার যাতে তারা বাবা-মাকে কষ্ট দিতে না পারে?”

“আসলে আমরা এই সমাজকে এমন এক অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছি যেখানে ধর্মকে খুব মাইনর করে দেখা হচ্ছে। নৈতিকতা এখানে বিসর্জিত। ছেলেমেয়েকে যদি ধর্মীয় শিক্ষা দিতাম তবে আজ এমনটা হতো না।”

আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। এই নির্মম সত্য কথা জীবনের এই পর্যায়ে বুঝতে পারা যায় সত্য। কিন্তু সময় থাকতে বুঝলে কি তা হত? ইসলাম কী বলে?

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে কয়েক জায়গায় বাবা-মায়ের অধিকারের ব্যাপারে আদেশ করেছেন-

১) “তোমার প্রতিপালক আদেশ করছেন, তোমরা তাকে ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করনা এবং তোমরা তোমাদের পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো; তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের সাথে বিরক্তিসূচক কিছু (উফ) বোলো না এবং ধমক দিও না, তাদের সাথে সম্মানসূচক নম্র কথা বলো।

অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো, এবং বলো, হে আমার মালিক তাদের প্রতি ঠিক সেভাবে দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন পালন করেছিলেন।” [সূরা বনি ইসরাইল ২৩, ২৪]

 ২) “আমি মানুষকে তাদের পিতা মাতার ব্যাপারে সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি, তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুই বছর পর সেই সন্তান বুকের দুধ খাওয়া ছেড়েছে, সুতরাং আমার শোকর আদায় করো এবং পিতা মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করো; তোমাদেরকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।” [সূরা লুকমান ১৪]

৩) আমি মানুষকে আদেশ দিয়েছি সে যেন নিজের পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করে; কেন না তার মা তাকে অত্যন্ত কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে প্রসব করেছে এবং এভাবে গর্ভে ধারণ করতে ও স্তন্য পান করানোর সময় তিরিশটি মাস; অতঃপর সে তার পূর্ণ শক্তি প্রাপ্ত হয় এবং ৪০ বছরে উপনীত হয়; তখন সে বলে, হে আমার মালিক, এবার তুমি আমাকে সমর্থ দাও …” [সূরা আহকাফ: ১৫]

আরেকটা প্রশ্ন করলেন কথাবন্ধু-“আজকের এই ভালবাসা দিবসে আপনাকে আমরা শুভেচ্ছা জানাই। এই যে ভালবাসা দিবস পালন হচ্ছে- ব্যাপারটা আপনি কিভাবে দেখছেন?”

“এই ভালবাসা তো প্রতিনিয়ত না। আসল ভালবাসা প্রতিনিয়ত হয়। আমাদের বর্তমান সমাজটা পাশ্চাত্যের ভাবধারা দিয়ে নির্মিত হয়ে গেছে। সবকিছুতে একটা মেকি ভাব চলে এসেছে। সন্তান ভালবেসে নিজের পছন্দে বিয়ে করে। এরপর স্ত্রীর কথা ফেলতে না পেরে বাবা-মাকে আলাদা করতেও পিছপা হয় না।”

রাস্তায় বেরিয়েছি। কিছু মানুষকে দেখতে পাচ্ছি লাল শাড়ি কিংবা লাল শার্ট, পাঞ্জাবি পরে বেরিয়েছেন। ভালবাসার কমোডিফিকেশন খুব ভালভাবেই হয়েছে। আজকের এই লাল রঙা মানুষগুলো এই লালের জন্য যেদিন নিজের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে তা ভাবতে আঁতকে উঠি। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ বাবা-মায়ের প্রতি করা সন্তানের আচরণের জবাবে আল্লাহ ঘটিয়ে থাকেন।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।”

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive