ইসলামের প্রতি মুসলিমের ভালোবাসাটা তার ফিতরাত থেকেই। তাই তো কেউ নিজেকে মুসলিম পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করে, কেউ ইসলামের প্রশংসা শুনলেই আনন্দিত হয়, কেউ ইসলামকে গালি দিতে শুনলেই রেগে যায়, আবার কোনো মুসলিমের উপর নির্যাতন দেখেও সে কষ্ট পায়। এতসব কিছুর পেছনে কারণ একটাই – সে ইসলামের প্রতি দুর্বল, সে ইসলামকে ভালোবাসে। তবে এই ভালোবাসাটাকে বাস্তবতায় পরিণত করা নিয়ে রয়েছে নানারকম ভ্রান্তি আর অবহেলা। আর এরকম বহু ভ্রান্তি আর অবহেলার মাঝ থেকে কিছুসংখ্যক সামনে নিয়ে আসতেই এই লিখা-

এক বাবা-মা’র আদরের সন্তান। সন্তানের কোনো প্রকার কষ্ট সহ্য করতে পারে না তারা। তাই সংসারের কোনো শ্রমসাধ্য কাজে সন্তানকে ডাকা হয় না। এমনকি সন্তান কোনো মানসিক চাপে পড়ুক, তাও তারা চায় না। তাই সন্তানের কোনো কিছুতেই আপত্তি করা হয় না। কিন্তু এই ভালোবাসা যখন ভ্রান্তির ভেড়াজালে আটকে যায়, তখন এত আদরের সন্তানকেও আগুনের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়। তাই তো সন্তানের ঘুম ভাঙার ভয়ে ফজরে ডাকা হয় না, সন্তান কষ্ট পাবে বলে মুভি-সিরিয়াল দেখতে নিষেধ করা হয় না, এমনকি শালীনতা আর শিষ্টাচারের শিক্ষাটাও দেওয়া হয় না। অথচ রাসূল ﷺ বলেন-

IIRT Arabic Intensive

সাবধান! তোমরা সকলেই অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে….। [বুখারী ও মুসলিম]

দুই ক্লাসের টপ ফাইভে থাকা স্টুডেন্ট। সবকিছুতেই গভীর জ্ঞান অর্জন করতে চায়। অজানা বিষয়ের প্রতি সবসময়ই কৌতূহল। স্যারদের চোখে মেধাবী তারাই। কিন্তু এই মেধাবীরা যখন ভ্রান্তিতে পড়ে থাকে, তখন দ্বীন চর্চাকে সময়ের অপচয় মনে করে। এমনকি কেউ তাদেরকে দ্বীনের ইলম অর্জনের কথা বললে বিরক্তি আর অবহেলার স্বরে বলে উঠে সামনে পরীক্ষা, ভার্সিটি পড়াটা শেষ হোক, চাকরিটা পেয়ে নেই ইত্যাদি নানারকম কথা। আর সময়ের সাথে সাথে এই ভ্রান্তি থেকে ফিরে আসা যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায়। তাই তারা যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টপ পজিশনে চলে যায়, তখন তারাই দ্বীন মেনে চলা ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে ভ্রু কুঁচকায়। অথচ আল্লাহ্ সুবাহানহু ওয়া তা’আলা বলেন-

….বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান। [সূরাহ আয-যুমার (৩৯): ৯]

তিন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। মানুষ ভয়ের সাথে তাকে সম্মান প্রদর্শন করে। আর সে এতেই নিজেকে অনেক বড় ক্ষমতাবান আর সম্মানী ভাবতে শুরু করে। সে তার ক্ষমতার বলে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানাতেও পিছপা হয় না। এমনকি সে তার নিকট ভবিষ্যৎটাকেও ক্ষমতার চাদরে আটকে নিতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা যে বড্ড ভিন্ন। তার প্রতিপালক কাউকে চিরস্থায়ী ক্ষমতা দেন না। একই সমীকরণে তারও ক্ষমতার দৌড় শেষ, বয়সের ভারে সে এখন বৃদ্ধ। সমাজ তাকে আর আগের মতো সম্মান দেখায় না। এমনকি আত্মীয়-স্বজনের নিকটও সে অবহেলিত। অথচ সে তাদের জন্য তার ক্ষমতার সবটুকুই দিয়েছিলো। আর এই ক্ষমতার ভ্রান্তিতে সে ভবিষ্যতের পরম সত্যকেও ভুলে ছিলো। তাই আজ মৃত্যু দুয়ারে এসে তার সঙ্গী অনেকগুলো অবহেলা আর নির্যাতিত মানুষের অভিশাপ। অথচ একটা সময় ক্ষমতার মোহে সে এগুলো কল্পনাও করতে পারতো না। সে ভেবেছিলো ক্ষমতা দিয়ে সবকিছু জয় করে ফেলবে। কিন্তু রাসূল ﷺ বলেন-

যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের ক্ষতি করবে, প্রতিদানে আল্লাহ তা’আলাও তার ক্ষতি করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেবে, আল্লাহ এর প্রতিদানে তাকে কষ্ট দিবেন।  [আবু দাউদ: ৩৬৩৫; তিরমিযী: ১৯৪০; বুলুগুল মারাম: ১৫০১]

চার সমাজের চোখে তারা স্মার্ট নামেই পরিচিত। সবকিছুতেই ভালো জ্ঞান রাখে বলে তাদেরও আত্মবিশ্বাস রয়েছে। তাই অনেকে তাদেরকে অলরাউন্ডার বলেও ডাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন মজলিশে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে অর্ধ-শিক্ষিত সমাজে তারা তাদের স্থান ভালোই শক্ত করে নিয়েছে। এমনকি ঐ সমাজে তাদের সাথে কোনো বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান রাখা কেউ পর্যন্ত পেরে উঠবে না। আর এরই ধারাবাহিকতায় তারা দ্বীন আল ইসলামের ব্যাপারেও তাদের বিশেষ মতামত দিয়ে থাকে এবং তা ঐ অর্ধ-শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সমাজে একপ্রকার প্রতিষ্ঠিতই করে ফেলে। অথচ এখনও তারা সত্যকে বুঝতে শেখেনি, সত্যকে মানতে শেখেনি। ফলে দিনদিন সত্য হয়ে উঠছে কনফিউজিং, আর মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত। তাই তো সমাজে মুভি-সিরিয়ালের নষ্টামি, বন্ধু-বান্ধবীর জাহেলিয়াত, আর সুন্দরী প্রতিযোগীতার মতো বেহায়াপনা হয়ে যাচ্ছে বৈধ ও জনপ্রিয়। এ ছাড়া তাদের মুখ থেকেই সার্টিফাইড হয়ে যায় একজন মুসলিমের চেয়ে একজন অমুসলিমই শ্রেষ্ঠ, দ্বীন মেনে চলা ছেলেটা উগ্রবাদী, ইসলাম এত কঠিন না ইত্যাদি নানান বিষয়। অথচ তারা এখনও নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবনীটা খুলে দেখেনি। তারা এটাও বুঝতে চেষ্টা করেনি তাদের প্রতিপালক আল্লাহ্ সুবাহানহু ওয়া তা’আলা তাঁর সর্বশেষ কিতাব কুরআনুল কারীমে কী বলছেন। তবুও নাকি তারাই জ্ঞানী, তারাই সমাজের কর্ণধার। বরং তারা ভ্রান্তিতেই রয়ে গেছে, আর ভ্রান্তিতে থেকেই স্বাধীনতা আর পূর্ণতার দাবি করে বেড়াচ্ছে। অথচ আল্লাহ্ সুবাহানহু ওয়া তা’আলা বলেন-

তাদের অবস্থা সে ব্যক্তির মতো, যে লোক কোথাও আগুন জ্বালালো এবং তার চারদিককার সবকিছুকে যখন আগুন স্পষ্ট করে তুললো, ঠিক এমনই সময় আল্লাহ তার চারদিকের আলোকে উঠিয়ে নিলেন এবং তাদেরকে অন্ধকারে ছেড়ে দিলেন। ফলে, তারা কিছুই দেখতে পায় না। [সূরাহ আল-বাকারাহ (২): ১৭]

পাঁচ ভদ্র ছেলে-মেয়ে। বাহ্যিক লেবাসটা দেখেই যে কেউ ভালো ধারণা করবে। দ্বীনের ব্যাপারেও অনেকটা সচেতন। তাই আশেপাশের মানুষগুলো তাদেরকে একটু বেশিই পছন্দ করে। আর এ পছন্দের সুযোগ নিয়েই শয়তান তাদের সামনে এসে হাজির হয়। আর তাদের সামনে খুলে দেয় নানান পথ। যে পথগুলো শুরুতে মসৃণ মনে হলেও কিছু দূর যাওয়ার পর আর মসৃণ থাকে না। যেমন লাইলি-মজনুর জুটি শুরুতে জান্নাতের স্বপ্ন দেখলেও পথিমধ্যে ঘটে যায় নানা নষ্টামি, আবার কারো নিকট হিজাব-নিকাব দিয়ে নিজের সৌন্দর্য ঢাকার পরিবর্তে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পারাই যেন বড় পাওয়া। এছাড়া কেউ দ্বীন চর্চার চেয়ে দ্বীন প্রচারেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে বসে, অথচ নিজেই থেকে যায় দ্বীন থেকে অনেক দূরে। আবার কারো নিকট দ্বীন চর্চার শুরুতে দ্বীন প্রচার লক্ষ্য হলেও কিছু দূর যেতেই তা হয়ে যায় কেবল কারো গীবত কিংবা কাউকে গালাগালি। আর এভাবেই হয়ে যায় তাদের পদস্খলন, তারা ছিটকে যায় বহু দূরে। যেখান থেকে ফিরে আসা হয়ে উঠে কঠিন থেকে কঠিনতর। অথচ তাদের বাহ্যিক লেবাসটা কখনোই তাদের ভেতর থেকে এমন আচরণ আশা করে না। তাই রাসূল ﷺ বলেন-

নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন। [সহীহুল বুখারী: ৫১৪৪, ৬০৬৬, মুসলিম: ২৫৬৪]

ছয় দানশীল ব্যক্তি। সামাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি গরীব-মিসকিনদেরকে আর্থিক সহযোগিতাও করে থাকেন। কিন্তু এই মহৎ কাজগুলোর সময়ে কেউ একজন তার নিয়্যাতকে পরিবর্তন করে দেয়। আর তখন সে তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টিকে উপেক্ষা করে নিজের সুনামের পেছনে ছুটে বেড়ায়। তাই তো সে বিপদগ্রস্তদের পাশে তখনই দাঁড়ায়, যখন তারা তাকে এর বিপরীতে কোনো কিছুর প্রতিশ্রুতি দেয়। সে তখনই কোনো উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে, যখন তা প্রচার করা হয়। এমনিভাবে সে ভুলে যায় তার এই মহৎ কাজের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যকে, আর দিনদিন সে হয়ে উঠে একজন দাম্ভিক ও অহংকারী ব্যক্তি। অথচ সে যদি এই ভ্রান্তিতে আটকে না যেত, তাহলে তার প্রতিটা দানই তার জন্য কল্যাণকর প্রতিদান নিয়ে অপেক্ষা করতো। কিন্তু শয়তান তা হতে দেয়নি, শয়তান তার পথ পরিবর্তন করে দিয়েছে। আর এ ব্যাপারে রাসূল ﷺ বলেন-

“যে বিষয়ে আমি তোমাদের উপরে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, তা হলো ছোট শিরক।” সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! ছোট শিরক কী?” তিনি বললেন, “ছোট শিরক হচ্ছে রিয়া (লোক দেখানো ইবাদাত)।” [মুসলিম]

উপরের পয়েন্টগুলো আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে মিলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক পয়েন্টগুলোকে (ভুলগুলোকে) শুধরে নিয়ে জীবনটাকে সাজানোর খুব প্রয়োজন আজ। আর তা না হলে ইসলামের প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা কিংবা দুর্বলতা সবই মিথ্যা হয়ে যাবে। কারণ ইসলাম সত্য ও বাস্তব ধর্ম, এখানে মিথ্যা আবেগ আর ভ্রান্তির কোনো মূল্য নেই। আর কেউ তা এপারেই বুঝে নেয়, আবার কেউ ওপারে গিয়ে বুঝে। তবে বুদ্ধিমান তারাই, যারা এপারেই বুঝতে পারে। আর তারাই এপারটাকে ব্যবহার করে ওপারটাকে সাজিয়ে নেয়। কারণ ওপারটা শেষ হবার নয় যে…

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive