কোরআনে যে নবীর নাম সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখিত হয়েছে, তিনি হলেন মূসা (আঃ)। কিছু আলেম তো এমনও বলেছেন যে কোরআন যেন মূসা (আঃ) সম্পর্কেই অবতীর্ণ। মূসার (আঃ) কাহিনী অত্যন্ত চমকপ্রদ। এর কোনো অংশ পড়লেই অন্তর প্রশান্ত হয়ে যায়। তিনি তাঁর জন্ম থেকে নিয়ে মিশর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত এমনকি তার পরেও বহুসংখ্যক বিপদে পড়েছেন। আর প্রতিবারই আল্লাহ তাঁকে উদ্ধার করেছেন।
এমনই এক উপলক্ষে মিশর থেকে বের হয়ে মাদইয়ানে প্রবেশ করার পর মূসা (আঃ) এক হৃদয়ছেঁড়া দুআ করলেন,
“হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার উপর যে কোনো কল্যাণই অবতীর্ণ করবেন, আমি তার অত্যন্ত মুখাপেক্ষী।” [সূরা ক্বাসাস (২৮):২৪]
দুআর কথাগুলো শুনলে বোঝা যায় কতটা মরিয়া অবস্থায় তা করা হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁডিয়েছে যে তিনি নির্দিষ্ট করে কিছু চাইতে পারছেন না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দেওয়া “যে কোনো” কল্যাণের জন্য তিনি দুআ করছেন।
একটু পেছনে তাকানো যাক। মূসা (আঃ) অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি খুন করেছেন। তৎকালীন মিশরের শাসকশ্রেণী ছিলো কিবতী জাতি। আর মূসা (আঃ) এর জাতি ইসরাঈলীয়রা ছিলো শাসিত। জনৈক কিবতী আরেক ইসরাঈলীয়কে নির্যাতন করার সময় মূসা (আঃ) তাকে নিবৃত্ত করতে গিয়েই এ হত্যা সংঘটিত হয়ে যায়। দাসশ্রেণীর কারো হাতে শাসকশ্রেণীর কেউ খুন হলে তার শাস্তি তো হবেই। মূসা (আঃ) যখন খবর পেলেন যে তাঁকে প্রতিশোধমূলকভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা চলছে, তখন তিনি মিশর ছেড়ে পালিয়ে যান।
চিন্তা করুন তাঁর অবস্থা। ভীত-সন্তস্ত্র, ফেরারী আসামী, একা। কী আছে তাঁর আর? সম্পূর্ণ অচেনা এক এলাকায়, অচেনা মানুষের ভিড়ে, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে তিনি আটকা পড়ে গেছেন। এমনই এক সময়ে আল্লাহ মূসার (আঃ) মুখ দিয়ে দুআ করালেন,
“হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার উপর যে কোনো কল্যাণই অবতীর্ণ করবেন, আমি তার অত্যন্ত মুখাপেক্ষী।” [সূরা ক্বাসাস (২৮):২৪]
গুনাহ যতই হোক, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখুন
এ ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, যত বড় গুনাহই আমাদের দ্বারা সংঘটিত হোক না কেন আল্লাহর সাথে সম্পর্ক শিথিল হতে দেওয়া যাবে না। বিরাট কোনো কবীরা গুনাহর পাপবোধও যদি আঁকড়ে ধরে, তাহলেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে নিতে হবে।
শয়তান অবশ্যই আমাদের মাথায় ভিন্নরকম চিন্তা ঢোকানোর চেষ্টা করবে। “আল্লাহর সাথে আমার সম্পর্ক আর ঠিক হবার নয়”, “বেশি গুনাহ হয়ে গেছে”, “খুব খারাপ হয়ে গেছি”, “অনেকবার তাওবাহ করেও তা ভেঙে ফেলেছি” এমন হাজারো কথা মাথায় আসবে।
মূসা (আঃ) একটি অনিচ্ছাকৃত হত্যা করে পাপবোধে ভুগছেন। কিন্তু তিনি অনুশোচনায় অতিরিক্ত কাতর না হয়ে গিয়ে আল্লাহকে ডেকেছেন। তিনি এমন পরিস্থিতিতে আছেন যখন তাঁর এ-ও জানা নেই যে কোনটা তাঁর জন্য ভালো। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার উপর তাঁর এই আস্থা আছে যে কোনটা তাঁর জন্য ভালো, তা আল্লাহ ঠিকই জানেন। কত সুন্দর দুআ!
যখনই আপনার এত অসহায় লাগবে যে কী চাইতে হবে তাও বুঝতে পারছেন না, তখন এই দুআটি করবেন। এটি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে আনে।
ভুল বা গুনাহ হয়ে গেলে দুনিয়া থেকে নিজেকে পৃথক করে ফেলবেন না
মূসার (আঃ) আরেকটি অসাধারণ কাজ হলো মাদইয়ানে আসা মাত্র বকরী নিয়ে বিপদে পড়া দুজন নারীকে সাহায্য করা। আগে যা কিছুই হয়ে গেছে, সেসবের জন্য তিনি বাকি দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। যেখানেই দেখেছেন তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেন, সেখানেই নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কোনো গুনাহই এত গুরুতর নয় যা আপনাকে অন্যান্য নেক আমল করা থেকে বিরত রাখতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যেখানেই থাকো আল্লাহকে ভয় করো। খারাপ কাজ হয়ে গেলে সাথে সাথে নেক আমল করে নাও যা (আগের) গুনাহ মুছে দিবে। আর মানুষের প্রতি সদাচরণ করো।” (তিরমিযী)
মূসা (আঃ) যেন এই হাদীসের মূর্ত রূপ। আমাদেরও ঠিক এমনটাই করা উচিত। গুনাহ বা ভুল হয়ে গেলে সাথে সাথে নেক আমল করতে হবে এবং মানুষের প্রতি সদাচরণ করতে হবে।
ভুল স্বীকার করুন, কিন্তু নেক আমল থামাবেন না
প্রায় এক দশক পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মূসাকে (আঃ) নবুওয়্যাত দান করলেন এবং ফিরআউনের কাছে গিয়ে দাওয়াহ দিতে ও বনী ইসরাঈলকে মুক্ত করার আদেশ দিলেন। মূসা (আঃ) তাঁর অতীতের ভুলের কথা ভেবে ইতস্তত করছিলেন। আল্লাহ তাঁকে ভয় পেতে নিষেধ করেন। মূসা (আঃ) ফিরআউনের দরবারে গেলেন। বনী ইসরাঈলের পুত্রসন্তানদের রক্তে হাত রঞ্জিত করা ফিরআউন তখন মূসার (আঃ) ওই এক অনিচ্ছাকৃত খুনের কথা স্মরণ করিয়ে খোঁটা দিতে চাইলো। মূসা (আঃ) সাহসী কণ্ঠে বললেন যে তা অজ্ঞতার কারণে এবং আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশনা পাওয়ার আগের ঘটনা। এর ফলে তাওহীদের দাওয়াহ মোটেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায় না। অতএব বোঝা গেলো যে নিজের ভুল স্বীকার করার মাঝে খারাপ কিছু নেই। কিন্তু এতে একেবারে পর্যদুস্ত হয়ে অন্যান্য নেক আমলে ঘাটতি হতে দেওয়া যাবে না।
আল্লাহর সাহায্যে সবই সম্ভব
আমরা কেউই দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। আমরা কেউই কখনো পারফেক্ট হতে পারবো না জেনেও উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাই। ব্যর্থতা আসবে, তা থেকে উঠে দাঁড়াতেও হবে। ইসলামে ভুল করার সবচেয়ে অসাধারণ দিকটা হলো, সংশোধন করে নেওয়ার ফলে গুনাহগারের মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। উপলব্ধি করা যায় যে আল্লাহর সাহায্য সাথে থাকলে একাই কতকিছু করে ফেলা যায়। কেউ আমাদের ব্যাপারে কুধারণা পোষণ করলে আমরা ঝট করে উত্তর দিয়ে দেই, “আল্লাহই আমার বিচারক।” অথচ আমাদের প্রকাশ্য শত্রু শয়তান যখন নেক আমল না করার ব্যাপারে ওয়াসওয়াসা দেয়, আমরা আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিই।
আমরা সকলেই সমস্যার সম্মুখীন হই। আমাদেরকেই ঠিক করে নিতে হবে আমরা কি আমাদের সমস্যা দিয়ে সংজ্ঞায়িত হবো নাকি আমাদের লক্ষ্য দিয়ে। মুসলিম হিসেবে আমাদের মূলনীতি হলো إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ [আমরা তোমারই (আল্লাহর) ইবাদাত করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য চাই]। এটিই আমাদের সংজ্ঞায়িত করবে এবং আমাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করবে।
লেখক এই দুআর দ্বারা অসংখ্যবার উপকৃত হয়েছে। পরকালে মূসার (আঃ) সাথে দেখা করে এই বিষয়টা তাঁকে জানানোটা কতই না আনন্দের মুহূর্ত হবে ইনশাআল্লাহ!
উৎস:ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি ব্লগ (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদক: আরমান নিলয়, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।
ZajhakAllahu Khoiron.