সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবি রহিমাহুল্লাহ্। শত শত যুদ্ধের মহানায়ক। যিনি টানা বিশ বছর যাবত ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন এবং পবিত্র ভূমি দখল করতে আসা সম্মিলিত ইউরোপীয় বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো বুকে সাহস ও অন্তরে দয়ার এমন সংমিশ্রণ আর খুব কম সেনাপতির মাঝেই দেখা গেছে।
মানব ইতিহাসের সবচাইতে দীর্ঘস্থায়ী এবং সর্বাপেক্ষা ক্রোধোন্মত্ত যুদ্ধ হিসেবে ক্রুসেডগুলোকে ধরা হয়। পশ্চিমা খ্রিষ্টানরা যেন এই যুদ্ধগুলোর ময়দানেই তাদের ধর্মকেন্দ্রিক যাবতীয় নোংরা রাগ, ক্ষোভ পশ্চিম এশিয়ার (মুসলিম অধ্যুষিত) দেশগুলোতে ঢেলে দিচ্ছিলো। পশ্চিমা এক লেখক লিখেন, “ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনাসমূহের একটি হলো এসব ক্রুসেড। খ্রিষ্টানরা তিন শতাব্দী ধরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করে। তাদের অভিযান ততদিন পর্যন্ত জারি ছিলো যতদিন পর্যন্ত না পরাজয় তাদের হতোদ্যম করে দেয় এবং অন্তঃসারশূন্যতার কারণে সেই কুসংস্কার নিজে থেকেই ধসে পড়ে। খ্রিষ্টানদের এই ধর্মান্ধতা শেষপর্যন্ত নিজের পায়ে কুড়াল মারায় পরিণত হয়। সেসময় ইউরোপ হয়ে পড়েছিলো প্রায় পুরুষশূন্য, ছিল ব্যাপক অর্থ সংকটে। সামাজিক দেউলিয়া হওয়ার হুমকি তো ছিলোই। যুদ্ধে গিয়ে, ক্ষুধায় বা রোগাক্রান্ত হয়ে, কিংবা সম্ভাব্য সবরকম দুর্ভোগে পড়ে লক্ষ লক্ষ ক্রুসেডার সৈনিক মারা গিয়েছিলো। মুসলিমদের কাছ থেকে পবিত্র ভূমি দখল করে নেওয়ার জন্য খ্রিষ্টানদের মাঝে যে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিলো, তার নেতৃত্বে ছিলো পিটার দ্য হারমিট এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। হ্যালাম বলেন, এই তীব্র উন্মত্ততায় জনগণকে উসকে দিতে সবরকম ব্যবস্থাই গৃহীত হয়েছিলো। ঐ সময় ক্রুশধারী প্রত্যেক ক্রুসেডারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো স্বয়ং চার্চ, যে কোনো ধরনের কর থেকে সে ছিলো মুক্ত। এমনকি সে যতো ইচ্ছা ততো পাপে লিপ্ত হতে পারতো।
চল্লিশ হাজার সদস্য বিশিষ্ট ক্রুসেডারদের দ্বিতীয় সেনাবহরের নেতৃত্বে ছিল পিটার দ্য হারমিট। ম্যালভিল-এ পৌঁছা মাত্রই তারা তাদের পূর্ববর্তীদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করে শহরের সাত হাজার অধিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে। তাদের অন্তরে দয়া বা উদারতার লেশমাত্র ছিলো না। ক্রুসেডার নামধারী ঐ জান্তব দলটি হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়াকে জনশূন্য বিরানভূমিতে পরিণত করেছিলো। মিকাউডের মতে, এশিয়া মাইনরে পৌঁছার পর তাদের করা অপরাধ প্রকৃতিকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিলো।
গিবনের মতে, “একজন জার্মান সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে থাকা ক্রুসেডারদের তৃতীয় বাহিনী ছিল চূড়ান্ত অপদার্থ কিছু লোক নিয়ে গড়া। তারা তাদের ধর্মীয় একনিষ্ঠতাকে লুণ্ঠন, পতিতালয়ে গমন আর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার সাথে গুলিয়ে ফেলে। এদিকে মিকাউড বলেন, “তারা কন্সটান্টিনোপল, জেরুযালেমের কথা ভুলে গিয়ে তাদের যাত্রাপথের সর্বত্র বেহায়াপনা, লুঠতরাজ, হত্যার ভয়ঙ্কর চিহ্ন রেখে গিয়েছিলো।“
পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা ক্রুসেডারদের চতুর্থ বড় দলটি সম্পর্কে মিলের অভিমত, “আরেকটি বুনো এবং পাগলাটে নিষ্ঠুরের দল… বিশাল এই বাহিনী দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হয় তাদের স্বভাবজাত হত্যা আর ডাকাতির রাজত্ব করতে করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূর্ববর্তী ক্রুসেডারদের অত্যাচারের শিকার বিক্ষুব্ধ হাঙ্গেরিয়ান আর্মি তাদেরকে একরকম নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
পরে অবশ্য ক্রুসেডাররা সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনের একটি বড় অংশ দখল করে নিতে সক্ষম হয়। যার মাঝে পবিত্র ভূমি জেরুযালেমও ছিলো। কিন্তু তাদের এ বিজয়ের পেছনে যে পাশবিকতা ছিলো তা চেঙ্গিস বা হালাকু খানদের অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে যায় বহুগুণ। মুসিলিম অধ্যুষিত শহর আতিয়ুচের পতনের সময় ব্যাপক মুসলিম নিধনের ব্যাপারটি খ্রিষ্টান ইতিহাসবিদ মিল স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেন, “বর্বর ল্যাটিনরা বৃদ্ধদের প্রাপ্য সম্মান যেমন দেয় নি, তেমনি কিশোরদের অসহায়ত্ব বা নারীদের দুর্বলতাকেও তারা উপেক্ষা করেছে সর্বতোভাবে। নিজের ঘরটাও কারো জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিলো না। পাশাপাশি কোথাও মসজিদের চিহ্নমাত্র দেখলেই খ্রিষ্টানদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যেত। মিকাউডের মতে, “হিসেব করলে দেখা যাবে স্কিওনদের ওপর বিজয়ী কুখ্যাত ব্যাবিলনের সমস্ত কুকীর্তি, ক্রুসেডাররা সিরিয়ার উন্নত শহরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে এখানকার অধিবাসীদের। শিল্প সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ পুড়িয়ে ফেলে। ত্রিশ লক্ষাধিক খণ্ডের বই সমৃদ্ধ সিরিয়ার বিখ্যাত ত্রিপলির লাইব্রেরিও রেহাই পায় নি সেসময়। মিল আরও বলেন, “ক্লান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাস্তায় রক্তের বন্যা বইয়েছে ক্রুসেডাররা। সবল পুরুষ আর সুন্দরী নারীদেরকে তারা বাঁচিয়ে রেখেছিলো আতিয়ুচের বাজারে দাস হিসেবে বিক্রির জন্য। এছাড়া সমস্ত বৃদ্ধ ও শিশু তাদের নির্মমতার বলি হয়েছে।“
দ্বাদশ শতকের শেষভাগে এসে ক্রুসেডাররা সবচাইতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। সেসময় তাদের নেতৃত্বে ছিল জার্মানি ও ফ্রান্সের সম্রাট, এবং ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড, দ্য লায়ন-হার্টেড কিং। তারা সশরীরে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয় পবিত্র ভূমি জয় করে নিতে। সেখানে তারা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর (রহিমাহুল্লাহ) মুখোমুখি হয়। তিনিই খ্রিষ্টবাদের ধারকদের উত্তাল স্রোতকে পবিত্র ভূমি থেকে হটিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি পুরোপুরিভাবে শত্রু মুক্ত করতে সক্ষম ছিলেননা , কিন্তু তাঁর মাঝেই ক্রুসেডাররা দেখেছিল অদম্য সংকল্প আর অকুতোভয় সাহস, যিনি পুরো পশ্চিমা খ্রিষ্টান বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একেবারে প্রস্তুত।
সালাহউদ্দীনের জন্ম ১১৩৭ সালে। তিনি যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন তাঁর কৃতি বাবা নাজমুদ্দীন আইয়ুব এবং নির্ভীক চাচা আসাদউদ্দীন শিরকুহ-এর কাছ থেকে। তাঁরা দুজনই ছিলেন সিরিয়ার তৎকালীন সম্রাট নূরুদ্দীন মাহমুদের সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত লেফটেনেন্ট। আসাদউদ্দীন শিরকুহ ছিলেন সিরিয়া এবং মিশরে ক্রুসেডারদের পরাজিতকারী সিরিয়ান বাহিনীর কমান্ডার। শিরকুহ ১১৬৭ সালে মিশরে প্রবেশ করেন। উদ্দেশ্য ছিলো ফ্রান্সের সাথে আঁতাত করা ফাতিমী মন্ত্রী শাওয়ির এর মোকাবেলা করা। মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ এবং বাবাইনে বীর শিরকুহ’র চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে মিকাউডের মন্তব্য “সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠ প্রদর্শনী”। ইবনে আসীর এ যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেন, “মাত্র একহাজার অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে মিশরীয় এবং ফরাসী বিশাল বাহিনীর পর্যুদস্ত হওয়ার মতো এমন ঘটনা ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।“
৮ই জানুয়ারি, ১১৬৯ সালে শিরকুহ কায়রো পৌঁছালে মিশরের খলিফা তাঁকে উজির এবং কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু এই উচ্চপদ তাঁর ভাগ্যে বেশিদিনের জন্য জোটে নি। মাত্র দুই মাস পরই তিনি মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেন। এরপর তাঁর ভাতিজা সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ন্যায়বিচার এবং উদারতার কারণে শীঘ্রই তিনি জনমনে জায়গা করে নেন। খলিফার মৃত্যুর পর মিশরের সর্বময় শাসনভার তাঁর হাতে চলে আসে।
এদিকে সিরিয়াতেও ১১৭৪ সালে মৃত্যু হয় নূরুদ্দীন মাহমুদের। ক্ষমতায় আসেন তাঁর এগারো বছর বয়সী ছেলে মালিক আস-সালেহ। সভাসদদের, বিশেষ করে গুমুশতাগীনের হাতের পুতুলে পরিণত হন তিনি। সালাহউদ্দীন মালিক আস-সালেহর কাছে চিঠি লিখে তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন। এমনকি মালিক আস-সালেহর নাম জুমুআর খুতবাতে উল্লেখ করতেন এবং তার নামে মুদ্রা প্রচলন অব্যাহত রাখেন। কিন্তু এতসব কিছুকেও তরুণ শাসক এবং তাঁর উচ্চাভিলাষী সভাসদবর্গ বিবেচনা করার কোনো প্রয়োজনই বোধ করেন নি। এইসব কার্যকলাপ ক্রুসেডারদের আবারও অনুপ্রাণিত করে তুললো। যাদেরকে গুমুশতাগিনের পরামর্শে এতোকাল যাবত দমিয়ে রাখা হয়েছিলো। তারা আলেপ্পোতে চলে যাওয়ায় দামেস্ক ফ্রাংকদের আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ক্রুসেডাররা তৎক্ষণাৎ রাজধানী শহর অবরোধ করে এবং প্রচুর মুক্তিপণের বিনিময়ে তা তুলে নেয়। এ ঘটনায় সালাহউদ্দীন এতটাই ক্রুদ্ধ হন যে, অল্প কিছু সৈন্য নিয়েই দামেস্ক আক্রমণ করে এর দখল নিয়ে নেন।
দামেস্ক বিজয়ের পরও তিনি তাঁর অনুগ্রাহক নূরুদ্দীনের প্রাসাদে প্রবেশ না করে নিজ বাবার বাড়িতেই অবস্থান করতে থাকেন। এদিকে মালিক আস-সালেহর কার্যক্রমের ওপর মুসলিমদের অসন্তোষ বাড়তে থাকে। একসময় তারা সালাহউদ্দীনকে আহ্বান জানায় তাদের অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করতে। কিন্তু সালাহউদ্দীন তরুণ খলিফার অধীনেই কাজ করে যেতে থাকেন। ১১৮১-৮২ সালে মালিকের মৃত্যু হলে সালাহউদ্দীনের শাসন সমগ্র পশ্চিম এশিয়া মেনে নেয়।
ফিলিস্তিনে সুলতান এবং ফ্রাঙ্কের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চলছিলো। ফরাসী ইতিহাসবিদ মিকাউড বলেন, “মুসলিমরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সচেষ্ট থাকলেও খ্রিষ্টানরা নতুন করে যুদ্ধ শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলো।” চুক্তির শর্তের বিপরীতে খ্রিষ্টান শাসক রিনোড বা শাটিলন এর রেজিনাল্ড তার দূর্গের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতে থাকা মুসলিমদের একটি কাফেলায় আক্রমণ করে বসে। ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজ চালায়। ফলে সুলতানেরও প্রতিক্রিয়া দেখাতে আর কোনো বাধা থাকলো না। সুদক্ষ রণকৌশল সাজিয়ে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী শক্তিশালী শত্রুপক্ষকে ফাঁদে ফেলে এক কথায় নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। ঘটনাটি ১১৮৭ সালে, হিত্তিনের পাহাড়ের কাছে ঘটেছিলো। খুব অল্প সময়েই তিনি অনেকগুলো শহর খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে পুনর্দখল করতে সক্ষম হন। যার মধ্যে নাবলুস, জেরিকো, রামলাহ, কায়যারাহ, আরসুফ এবং বৈরুত উল্লেখযোগ্য। সামান্য সময় অবরোধ করে রাখার পর আসকালোনও সুলতানের হস্তগত হয়। এখানেও তিনি তাঁর উদারতার নিদর্শন রাখেন।
এবার সুলতান নজর দেন জেরুযালেমের দিকে, যা দখল করে রেখেছিলো ষাট হাজারেরও বেশি ক্রুসেডার। সুলতানের প্রচণ্ড আক্রমণের বিপরীতে খ্রিষ্টানরা কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারে নি। ১১৮৭ সালে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এর ৯০ বছর আগে যখন তারা জেরুযালেম দখল করেছিলো, তখন মুসলিমদের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে খ্রিষ্টানরা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কারণ তারা দেখলো মুসলিমদের এই সেনাপতি বিজয়ী হওয়ার পরেও তাদের সাথে মানবিক আচরণ করছেন।
ফরাসী ইতিহাসবিদ মিকাউড ১০৯৯ সালে খ্রিষ্টানদের জেরুযালেম দখল সম্পর্কে বলেন, “আরবদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয়। কি ঘরে কি বাইরে। পরাজিতদের জন্য জেরুযালেম মোটেও আশ্রয়স্থল ছিলো না। কেউ কেউ দূর্গ থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। বাকিরা প্রাসাদে, টাওয়ারে সহ যে যেখানে পেরেছে আত্মগোপন করেছে। যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিলো না তারা মসজিদে গিয়ে খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে নিজেদের আড়াল করে। খ্রিস্টানরা যারা মসজিদে উমরের পরিচালক ছিল, যেখানে আরব বেদুইনদেরকে তাদের আত্মগোপন স্থল থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। তাদের এরূপ আচরণের ফলে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়েছে টাইটাস বিজয়। পদাতিক, অশ্বারোহী সৈন্যরা দ্রুতবেগে ধাওয়া করেছিলো পলায়নকারীদের দিকে। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুবরণকারীদের আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় নি। বিজয়ী খ্রিষ্টানরা লাশগুলোকে পদদলিত করছিলো, লাশের ওপর উঠে নাচছিলো। পালাতে ব্যর্থ হতভাগাদের লাশ। রেমন্ড দাগী, যিনি এই ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন, বলেন, “মসজিদের চত্বর হাঁটু সমান রক্তে ডুবে গিয়েছিলো। রক্তের স্রোত ঘোড়ার লাগাম পর্যন্ত স্পর্শ করেছিলো।”
যুদ্ধজয়ের পর ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপনের খুব সামান্য সময়টুকুর জন্য ক্রুসেডাররা হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকে। কিন্তু এর পরপরই তারা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলো। বড় অঙ্কের মুক্তিপণ পাওয়ার লোভে যাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো, তাদের সবাইকে ঠাণ্ডা মাথায় জবাই করে হত্যা করা হয়। তাদেরকে উঁচু টাওয়ার, দালানের ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করা হয়। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। ভূগর্ভস্থ আত্মগোপনস্থল থেকে টেনে তুলে জনসম্মুখে বলি দেওয়া হয়। নারীর অশ্রু, শিশুর কান্না কোনোকিছুই ক্রুসেডারদেরকে নিবৃত্ত রাখতে পারে নি। খ্রিষ্টানদের মন এতটুকুও নরম হয় নি সেই জায়গায় এসে, যেখানে (খ্রিস্টবাদ অনুসারে) যিশু তাঁর ঘাতকদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এই হত্যালীলা চলে দুই সপ্তাহব্যাপী। গুটিকয় যারা বেঁচে ছিল তাদেরকে বরণ করে নিতে হয় ভয়াবহ দাসত্বের জীবন।
খ্রিষ্টান ইতিহাসবেত্তা মিল বলেন, “মুসলিমদের প্রতি কোনোপ্রকার দয়া না দেখানোর ব্যাপারে খ্রিষ্টানরা ছিলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতএব পরাজিত লোকদেরকে প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিলো। নারী, দুগ্ধপোষ্য শিশু, বালক-বালিকা কাউকে ছাড় দেওয়া হয় নি। জেরুযালেমের সড়ক, চত্বর এমনকি বসতিহীন এলাকাগুলোও ভরে গিয়েছিলো নারী পুরুষের লাশে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিলো শিশুদের ছিন্নভিন্ন হাড়। কোনো ক্রুসেডারের হৃদয় করুণায় বিগলিত হয় নি, হয় নি দয়ায় সম্প্রসারিত।”
সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জেরুযালেম পুনর্দখলের নব্বই বছর আগে মুসলিমদের ওপর খ্রিষ্টানদের চালানো বিপুল হত্যাকাণ্ডের এ হলো কিছু খণ্ডচিত্র মাত্র। সত্তর হাজারেরও বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিলো সেসময়। অন্যদিকে যখন সুলতান সালাহউদ্দীন ১১৮৭ সালে জেরুযালেম জয় করেন, তিনি শহরের অধিবাসী খ্রিষ্টানদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। নামমাত্র মুক্তিপণের বিনিময়ে শুধু যোদ্ধাদেরকে শহর ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন। উপরন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিপণের টাকাটাও সুলতান নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন। এমনকি তাদের জন্য পরিবহণের ব্যবস্থাও তিনিই করে দেন। বহু সংখ্যক খ্রিষ্টান নারী কোলে শিশু নিয়ে আসে সুলতানের দরবারে। তারা আরজ করে, “দেখুন, আমরা হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছি। আমরা আপনার কারাগারে বন্দী যোদ্ধাদের স্ত্রী, মা, বোন। আমরা এই দেশ ছেড়ে চিরতরে চলে যাবো, তারা আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতো। তাদের হারিয়ে আমরা জীবনের শেষ ভরসাও হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু যদি তাদেরকে আপনি আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন, তারা আমাদেরকে এই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করতে পারবে এবং আমরাও পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সহায় পাবো।” তাদের আর্তনাদ সুলতানকে এতটাই ছুঁয়ে যায় যে, তিনি সব বন্দীকে মুক্ত করে দেন। যারা শহর ছেড়ে পালিয়েছিলো, তাদেরকেও ফিরে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সুলতানের এমন মানবিক ব্যবহার ও বদান্যতা নব্বই বছর আগে দেখানো খ্রিষ্টানদের আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। এমনকি সুলতানের অধীনস্থ কমান্ডারগণও পরাজিত ক্রুসেডারদের প্রতি দয়া দেখানোর ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করেন।
এদিকে জেরুযালেম ত্যাগ করা খ্রিষ্টান শরণার্থীরা খ্রিষ্টান শাসিত শহরগুলোতেও আশ্রয় পায় নি। মিল বলেন, “আতিয়ুচে আশ্রয়প্রত্যাশী খ্রিষ্টানদেরকে বোহেমন্ড শুধু প্রত্যাখ্যানই করে নি, তাদের মালামাল ছিনতাই পর্যন্ত করে। পরে তারা মুসলিমদের অঞ্চলে গেলে সাদরে গৃহীত হয়।” মিকাউড জেরুযালেম থেকে আসা খ্রিষ্টান শরণার্থীদের প্রতি খ্রিষ্টান শাসকদের অমানবিক আচরণের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। ত্রিপলির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মিকাউড জানান যে, হতাশাগ্রস্ত এক নারী তার শিশুকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে না আসা খ্রিষ্টানদের অভিশাপ দিতে থাকে।
কিন্তু পরাজিত ক্রুসেডারদের প্রতি সুলতান ছিলেন যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। তাদের আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে যতক্ষণ না তারা শহর ত্যাগ করে চলে যায়, তিনি শহরে প্রবেশ করেন নি।
উৎস: Sultan Slahuddin
অনুবাদক: মাহমুদ বিন আমান, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।