এক আরাফাত থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার এবং মক্কা থেকে প্রায় চৌদ্দ কিলোমিটার দূরে, ১২.২৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে, মাশআরুল হারামের পাদদেশে মুযদালিফা অবস্থিত। সেখানে আমরা আজ খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাবো।

আমাদের দলের সকলে স্টেশনের লাইনে দাঁড়ালাম। স্টেশনের কাছাকাছি এসে সিঁড়ি বেয়ে অনেকক্ষণ উপরে উঠতে হয়। যারা হুইল চেয়ারে আছে, তাদেরকে লিফটের সুবিধা দেওয়া হয়। আমাদের সাথে হুইল চেয়ার থাকায় আমরা লিফটের লাইনে দাঁড়ালাম, যার ফলে দলছাড়া হয়ে গেলাম। এই বিপুল জনারণ্যে একবার দলছুট হওয়ার অর্থ নিকট ভবিষ্যতে দলের দেখা না পাওয়া। লিফট ব্যবহারের কারণে অন্যদের চেয়ে অনেক দ্রুত ট্রেনে উঠে পড়তে পারলাম। আরো দীর্ঘক্ষণ লাইনে অপেক্ষা করার থেকে মুক্তি পেলাম।

IIRT Arabic Intensive

একবার ট্রেনে উঠে গেলে যেকোনো জায়গায় পৌঁছতে আর দেরী হয় না। পাঁচ/দশ মিনিটে মুযদালিফার প্রান্তরে চলে এলাম। এবং বিপুল জনস্রোত থেকে যেন অকূল জনসমুদ্রে এসে পড়লাম। যতদূর দু চোখ যায়, উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়ানো মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সবাই মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত। স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরাও জনারণ্যে মিশে গেলাম। যেভাবেই হোক, রাতে শোবার কোনো জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে হাজীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সব জায়গা কারো না কারো দ্বারা দখল হয়ে আছে। যারা আগে চলে এসেছেন, মুযদালিফার প্রবেশের পর যেখানে জায়গা পেয়েছেন, বসে গেছেন। আমরা কিছুটা পরে আসাতে আমাদের এই প্রান্তরের আরো ভেতরে প্রবেশ করতে হচ্ছে, সুবিধাজনক জায়গার খোঁজে।

এবার আমাদের সাথে নতুন দুজন সঙ্গী হলেন, একজন আশির কাছাকাছি বয়সের বৃদ্ধা মাতা ও তাঁর পুত্র। পুত্রের বয়স চল্লিশের ঘরে হবে। তিনি একা তাঁর মাকে নিয়ে হাজ্জে চলে এসেছেন। মহিলার হাঁটার শক্তি নেই। তাই ছেলে, মাকে হুইল চেয়ারে নিয়ে সব কাজ করিয়েছেন। মায়ের যত্ন তিনি একাই নিচ্ছেন আলহামদুলিল্লাহ্‌। মিনাতে দেখেছি, মায়ের হয়ে ভদ্রলোককে জামারাতেও পাথর মেরে আসতে। কারণ উনার পক্ষে জামারাতের ভিড়ের মাঝে গিয়ে পাথর মারা সম্ভব নয়। আমাদের সাথে তাঁরা বেশ অনেকটা সময় ছিলেন।

সারাদিনের ধকলে মহিলা খুব ক্লান্ত ছিলেন। চুপ করে বসে ছিলেন চেয়ারে। তাঁর মুখ থেকে একটি শব্দও শুনিনি আমরা। হয়তো মায়ের জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিলো একবার হলেও আল্লাহ্‌র ঘরে এসে হাজ্জ করা … জানি না। দেশে আসার পর জানতে পেরেছি, ফিরতি ফ্লাইটে বৃদ্ধা মহিলাটি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেশে অবতরণের পরপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই খবর শুনে একাধারে মন খারাপ হয়েছিলো, আবার ভালো লাগাও কাজ করেছিলো। উনি কতই না সৌভাগ্যবতী! আল্লাহ্‌ তাঁকে জীবনের শেষ সময়ে উনার ঘরের সফর করার ভাগ্য দিয়েছিলেন। আশা করি ওই মহিলার হাজ্জ কবুল হয়েছে এবং নিষ্পাপ শিশুর মতো পবিত্র হয়ে সর্বশক্তিমান প্রভুর কাছে ফেরত গেছেন, যেখানে একদিন আমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে।

দুই বহু হাঁটাহাঁটির পর আমরা কিছু বাঙালি হাজীর কাছে জায়গা পেয়ে তল্পিতল্পা নিয়ে বসে পড়লাম। তখন রাত প্রায় দশটা। সেখানে আমরা তায়াম্মুম করে, আশেপাশের হুজ্জাজরা মিলে জামাতে দুই ওয়াক্তের সালাত আদায় করে নিলাম। আজ রাতে আর কোনো খাবার দেওয়া হবে না, একবারে ভোরে মিনাতে ক্যাম্পে যাবার পর নাস্তা পাবো।

মুযদালিফায় রাত্রি যাপন ও ফজর পর্যন্ত অবস্থান করা হাজ্জের অন্যতম অনুষঙ্গ। অসুস্থ, দুর্বল, নারী, অথবা বৃদ্ধ, যাদের পক্ষে এখানে রাত্রি যাপন একেবারেই অসম্ভব, তাদের জন্য কিছুটা ছাড় দেওয়া আছে। তারা ইচ্ছা করলে চন্দ্র অস্ত যাবার পর, অর্থাৎ মধ্যরাতের পর মিনাতে ফেরত যেতে পারে। যে কারণে মাঝরাতের দিকে অনেককে মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনাতে যেতে দেখলাম।

সালাত শেষ করার পর, নতুন এক সমস্যা দেখা দিলো। তা হলো, সবার ‘ফ্রেশ’ হয়ে নিতে হবে। কিন্তু এখানে ফ্রেশ হবার জায়গা কী করে পাওয়া যাবে, জানি না। নিরুপায় হয়ে আমাদের দখলকৃত স্থান ফেলে উঠে পড়তে হলো। মুযদালিফার রাস্তা আরাফাত বা মিনার রাস্তার মতো নয়। এখানে প্রায় সময় দেখা যায়, হয় আমরা ঢালু পথ বেয়ে নামছি, অথবা হালকা উঁচু পথ দিয়ে উঠছি। বেচারা শামছু ভাই অনেকক্ষণ ধরে সাফিরের চেয়ার পুশ করছেন।

রাস্তার দু ধারে বেশ কয়েকটি বাথরুমের কম্পাউন্ড দেখলাম, এসব কম্পাউন্ডের ভেতর সাধারণত সারি সারি বাথরুম থাকে। কিন্তু দুঃখের কাহিনী হলো, সেসব এলাকা বাহির থেকে তালা দেওয়া এবং উপরে কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা পেট্রোল পাম্পের নাম লেখা। পাবলিক টয়লেটের দেখা সহজে পেলাম না। কী মুসিবতে পড়া গেলো! সারা রাত লাখ লাখ মানুষ টয়লেটে না গিয়ে থাকতে পারবে, এটি অসম্ভব অতি কল্পনা!! নিশ্চয় ব্যবস্থা কিছু আছে, যা আমাদের চোখে পড়ছে না।

অবশেষে সরকারি বাথরুম কম্পাউন্ডের দেখা পেলাম। এটারও প্রবেশদ্বার ভেতর থেকে বন্ধ করা। কারণ ভেতরে কয়েক শ মানুষ ঢুকে পড়েছে, এত মানুষের চাপে তারা বাধ্য হয়ে গেট বন্ধ করে দিয়েছে। গেট বন্ধ না করলে ধাক্কাধাক্কিতে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কিছুদূর পরপর বেশ কটি কম্পাউন্ড দেখলাম, কিন্তু সবগুলোতেই সেই একই অবস্থা। গার্ডরা দ্বার বন্ধ করে রেখেছে। গেটের বাইরে মানুষের প্রচণ্ড ভীড়, কিন্তু কোনো গেট খোলা হচ্ছে না। ভেতরের সবার প্রয়োজন শেষ না হলে হয়তো খোলা হবে না। ভেতরের শত শত মানুষ কবে বের হবে, তার কোনো ঠিক নেই। এক গেটের সামনে দেখলাম, বুড়ি মা আর স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের উপমহাদেশীয় এক ভদ্রলোক হাজ্জ করতে এসেছেন। তাঁর মায়ের বাথরুম যাওয়া খুব প্রয়োজন, অনেক অনুরোধ উপরোধ করছেন গার্ডদের, যদিও এতে লাভ হলো না কিছুই।

আমরা সামনে এগুতে থাকলাম, আশা করি পুরো মুযদালিফা প্রান্তরে একই অবস্থা নয় এবং রাত গভীর হলে এই অবস্থার উন্নতি হবে। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে আবার স্টেশনে ফিরে এলাম। স্টেশনের কর্তৃপক্ষের অফিসে নিশ্চয় শৌচাগার থাকবে। তবে সেখানে আমাদের প্রবেশ করতে দেবে কি না, সেটাই বুঝতে পারছি না। কিন্তু একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। প্রথমে অবশ্যই তারা রাজি হলো না, সাফিরকে দেখে কেন জানি রাজি হয়ে গেলো। হুইল চেয়ার থাকায় আরো একবার সুবিধা পেলাম। সম্পূর্ণ ভীড়মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন স্থানে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলো।

তিন এখন আমাদের আবার নতুন করে রাতে ঘুমানোর জায়গা বের করতে হবে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। ভালো জায়গা পেলেই ঘুমিয়ে পড়বো। অনেকে অনেক রকম ফাতওয়া দিলেও আসলে আজকের রাতে কোনো বিশেষ ইবাদাতের কথা বলা নেই। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসূল ﷺ এ  রাতে ঈশা পড়ে শুয়ে পড়েন ও ওয়াক্ত হলে ফজরের সালাত পড়েন। এ হাদীস দ্বারা বোঝা যায় উনি মুযদালিফায় তাহাজ্জুদ পড়েননি, অথবা রাত জেগে কোনো ইবাদাত করেননি। অতএব, আজকের রাতে শুয়ে পড়লেই উনার সুন্নাত পালন করা হবে।

স্টেশনের সীমানার ভেতর দেখলাম অল্প সংখ্যক হাজী শোবার বন্দোবস্ত করেছেন। এ জায়গাটি অন্যদের নজরে পড়েনি বিধায় একদম ফাঁকা। আমাদের মন আনন্দে নেচে উঠলো। ফ্রেশ হবার জন্য হাঁটাতে হাঁটাতে আল্লাহ্‌ এত সুন্দর স্থানে নিয়ে আসবেন, ভাবিনি। রাজরাজড়া আর ভিআইপি ছাড়া, সাধারণ মানুষের মাঝে, আমরা আর এই অল্প সংখ্যক হাজীগণ বোধ হয় সবচেয়ে আরামদায়ক স্থানে রাত্রি যাপন করতে পেরেছি।

জায়গাটি রাস্তার উপরে নয়। কোনো ভীড় নেই। এক পাশে পানি, খাবার ও উযু করার সুব্যবস্থা আছে। এক কথায় চমৎকার জায়গা। পরবর্তী দিন জামারাতে পাথর মারার জন্য আমরা পাথর সংগ্রহ করে নিলাম। বাকি দিনের পাথর মিনা থেকে জোগাড় করবো। পিচ ঢালা মাটির ওপর চাদর বিছিয়ে ছোট্ট বালিশ খানা মাথার নিচে দিয়ে দিলাম। ব্যস, আর কী চাই! শামছু ভাই দূরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। সাফির আমার মাথা আর পায়ের পাশে আমাদের ছাতা দুটো খুলে দিয়ে, অন্য পাশে আমাদের ব্যাগ রেখে সুন্দর আড়ালের ব্যবস্থা করে দিলো।

শুয়ে পড়লাম আমরা। চাদরের নিচের নুড়ি পাথরের দানা গায়ে লাগছে, মাথার উপর খোলা আসমান, মৃদু মন্দ হাওয়া বইছে। আজ খাট নেই, তোষক নেই, নিজের কামরাও নেই। রাস্তার হত দরিদ্র মানুষটি প্রতিদিন যেভাবে ঘুমাতে যায়, তার সাথে আমাদের কি কোনো ফারাক আছে এখন?

আছে বোধ হয়। মাটিতে বেছানোর চাদর আছে আমাদের, তুলতুলে বালিশ আছে। সবচেয়ে বড় যে জিনিস আছে, তা হলো আমরা জানি আজকের একটি রাতের জন্য আমরা বিলাসিতা ছেড়ে ভূমিতে শয্যা পেতেছি। এক রাতের জন্য আমরা বিত্তহীনদের জীবনের স্বাদ নিচ্ছি। অথচ কমলাপুর স্টেশনের টোকাই ছেলেটি, ভিটেমাটিহীন অসুস্থ বৃদ্ধটি, কিংবা গরীব রিকশাচালকটির জীবনের প্রতি রাত হয়তো কেটে যায় খোলা আকাশের নিচে। ওম পাবার জন্য দুস্থ ছেলেটি আর কিছু না পেয়ে নেড়ি কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরে। সামান্য বিছানার ওপর শোবার স্বপ্ন দেখাও যেন তাদের জন্য কল্পনাতীত।

জীবনে কখনো এভাবে রাত্রি যাপনের কথা চিন্তা করিনি। রাস্তার পাশে শীতের রাতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তো কত লোকই এভাবে রাত কাটায়। তাদের দেখেও এত দিন দেখিনি। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখলে আমাদের অনেকের কাছে সহজতম সমাধান হয়তো গাড়ির কাঁচ তুলে দেওয়া বা মুখ ফিরিয়ে নেয়া। কারণ জঞ্জাল দেখতে কে চায়? দরিদ্র এ মানুষগুলো জঞ্জাল ছাড়া আর কী!!

আজ আমরা এই জঞ্জালদের মতো করে রাত কাটাবো। এতেও যদি আমাদের কিছু বোধদয় হয়। দেশে ফিরে গিয়ে অন্তত সহমর্মিতার চোখে যেন তাকাই এ জঞ্জাল-রুপী মানুষগুলোর দিকে। হাড়-কাঁপানো শীতে কম্বল যেন পরিয়ে দিতে পারি নেড়ি কুকুর জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা সেই শীতার্ত ছেলেটির গায়ে। তাও যদি না পারি, আমাদের পায়ের কাছে শুয়ে থাকা গৃহকর্মীটিকে একটা তোষক হলেও যেন বানিয়ে দেই!!! বেশি দূরে যাবার দরকার কী? কাছের মানুষের জন্যই আগে করি!!!


পরবর্তী পর্ব- কুরবানি ও জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive