নীচের এই ভাবনায় যদি কোন ভুল থাকে তার সবটুকুই আমার পক্ষ হতে এবং সঠিক যা আছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহই সব জানেন, আমি নই। আমার এই ভয়ংকর দুঃসাহসকে আল্লাহ ক্ষমা করুন এবং এই কাজের পেছনের নিয়্যাতটাকে কবুল করে নিন। আমাদের সবাইকে কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী চলার সামর্থ্য দিন আর দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা করুন। প্রত্যেক পাঠকের কাছে অনুরোধ রইলো নিজে নিজে অবশ্যই এই ব্যাপারে পড়াশোনা করবেন এবং এই ব্যাপারে যেসব স্কলারগণ গবেষণা করেছেন তাদের মতামত জেনে নিবেন।

সূরা কাহাফ।

৪টা মাত্র ঘটনা। মাত্র এই ৪টা ঘটনা দিয়েই আল্লাহ বুঝিয়ে দিয়েছেন দাজ্জালের সময়ে (অর্থাৎ সম্ভবত বর্তমান সময়েই) আমাদের কী নিয়ে ভাবা উচিৎ এবং কী করা উচিৎ!

একপ্রথম ঘটনায় (আয়াত নং ৯-২৬) বুঝিয়ে দিয়েছেন ঈমান রক্ষার জন্যে দু’আ করতে হবে। দরকার হলে ঈমান রক্ষায় সব বস্তু ফেলে ছুঁড়ে চলে যেতে হবে দূরে কোথাও। সবার আগে ঈমান। এই ঈমান রক্ষায় সঙ্গী-সাথীর গুরুত্বও অপরিসীম। এমন বন্ধু-সাথী যারা বিশ্বাসে-কাজে নিজেরা সচেতন, সাথীর বিশ্বাস-কার্যে সাহায্য-স্মরণিকাতেও জাগ্রত। একা একা থাকার মাধ্যমে পরাজিত না হয়ে এইরকম আধ্যাত্মিকতায় সচেতন সাথীদের সঙ্গের মাধ্যমে অশুভ ঋণাত্মক শক্তির বিরুদ্ধে নিজ নিজ বিশ্বাস-কর্মের সংরক্ষণে সদা-তৎপর থাকা একসাথে আল্লাহর আশ্রয় আর রাহমাত প্রার্থনা করে স্থান-সময়ের তথাকথিত বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন এই হচ্ছে প্রথম ঘটনার শিক্ষা।

এছাড়াও সময় আপেক্ষিক (ফলে, স্থানও)! সময়ের স্রষ্টা যিনি, তিনি সময়ের আপক্ষিকতার কথা পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই ঘটনার মাধ্যমে আজ হতে আরো দেড় হাজার বছর আগে। আইনস্টাইনেরও প্রায় ১৩০০ বছর আগে।

এই ঘটনায় পরিস্কারভাবেই আল্লাহ বুঝিয়ে দিয়েছেন যে একই বস্তু (যেমন দাজ্জাল) অস্তিত্বে আসার পরেও সময়ের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করা সম্ভব। এমনকি অনেক বিশাল সময় পার করার পরে আমাদের মাত্রায় আত্মপ্রকাশ করে আবার দেখা দেওয়াও সম্ভব। অর্থাৎ দাজ্জাল যদি এই মূহুর্তে অস্তিত্বে থেকে থাকে, আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তবু তাকে আমরা দেখবো না। কারণ সে রয়েছে সময়ের অন্য মাত্রায়, যেখানে তার একটা সময়কাল আমাদের এক হাজার সময়কালের সমান হতে পারে। যখন আমাদের এক দিন, তার একদিনের সমান হবে তখনই তাকে আমরা দেখবো। এর আগে নয়। [দাজ্জালের সময় সংক্রান্ত হাদীসসমূহের বিশ্লেষণ দ্রষ্টব্য]

দুইদ্বিতীয় ঘটনায় (আয়াত নং ৩২-৪৪) আল্লাহ আমাদের সামনে এক ধনী আর এক গরীবের কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের অন্তরের অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন সত্যিকারের সফলতা কোনটা আর আমাদের অন্তরটা কার মতো হওয়া উচিৎ।

উল্লেখ্য যে ধনী ব্যক্তিটি (বর্তমান সমাজের মানুষগুলোর মতোই) নিজের ধন সম্পদ তথা বস্তু-সামগ্রীকেই সফলতা মনে করেছিলো নিজেকে সফল মনে করেছিলো। পরবর্তীতে সে সব কিছু হারায়, সব ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদেরও তাই এখুনি সাবধান হওয়া উচিৎ। দাজ্জালের দেখানো সফলতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে সত্যিকারের সফলতাকে চিনে নেয়া উচিৎ। সেইভাবেই জীবন যাপন করা উচিৎ। নচেৎ পরিণতি হবে ধনী মানুষটার মতোই ভয়ংকর।

খেয়াল করলে দেখবো ধনী ব্যক্তিটি মুখে আল্লাহকে প্রতিপালক বললেও তার অন্তরে প্রতিপালক হিসেবে স্থান ছিলো নিজের ধন-সম্পদ আর বস্তুসামগ্রীর জন্য (যেমন বাগান)। সে কিন্তু মূর্তি পূজা করতো না সরাসরি, অথচ খুঁটিয়ে ভাবলেই ধরতে পারবো যে তার চরম ভালবাসা, আনুগত্য, আগ্রহ আর পরম মনোযোগের জায়গাটা ছিলো বস্তুর (তথা বাগানের) জন্য, যা কিনা কেবলই ইলাহের জন্য হওয়ার কথা! মুখে ইলাহ আর প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহর কথা বললেও তার অন্তরে কিন্তু ইলাহের জায়গায় স্রষ্টার স্থান ছিলো না, ছিলো সৃষ্টির। আল্লাহ শাস্তি হিসেবে তার বাগান ধ্বংস করে দেয়ার পর তাই ৪২ নং আয়াতের শেষাংশে তার মন্তব্য পড়লে অবাক হতেই হবে। ভাবনায় হাবুডুবু খেতে খেতে নিজেকেও এই প্রশ্নটা করলে ধরা খেয়ে যেতে হবে:

আমি তাহলে আমার রাব্বের সাথে কী কী শরীক করি?

ঘটনাটা বুঝলে, প্রশ্নটার উত্তর নিয়ে ভাবতে জানলে, করুণ আর ক্রমাগত পরীক্ষার এই সময়ে নিজের ঈমান-তাওহীদের ভঙ্গুর অগভীর আলোহীন বুঝ নিয়ে কান্নায়-আফসোসে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। তবে এই ব্যাপারটা আসলে খুব বেশি মানুষ বুঝে হজম করতে পারবে না, এটাও একটা শঙ্কা!

“শেষ সময়ে মানুষ সকালে সন্ধ্যায় ঈমান হারা হবে, কিন্তু বুঝতেও পারবে না”- এই কথাটার মানে কি এখন কিছুটা হলেও ধরতে পারছি আমরা? অন্তত নিজের অজ্ঞতাকে চেনার মাধ্যমে হলেও? আমি কি সত্যিই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো যে ঈমান কী জিনিস, তাওহীদ কী জিনিস তা আমি ঠিকঠাক বুঝে নিয়েছি গভীরভাবে, যেভাবে প্রথম প্রজন্মের মানুষগুলো বুঝে নিয়েছিলেন?

তিন তৃতীয়  ঘটনাটা (আয়াত নং ৬০-৮২) নবী মুসা (আ) এর সাথে একজন প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী ব্যক্তির কথোপকথন নিয়ে। মুসা (আ) নিজের বাহ্যিক জ্ঞান আর দৃষ্টি দিয়েই সবকিছু বিচার করতেন। এবং ভাবতেন তিনি অনেক জ্ঞানী। তাই উনার ভুল ভাঙ্গাতে উনাকে এক জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে আল্লাহ দেখা করতে বলেন। সেই প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী ব্যক্তি যাই করেন, মুসা (আ) এর কাছে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাই ভুল মনে হয়। শেষে জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের কাজগুলোর ব্যাখ্যা মুসাকে (আ) বুঝিয়ে বলেন। হতভম্ব মুসা (আ) বুঝতে পারেন বাহ্যিক জ্ঞানের পাশাপাশি অন্তর্জ্ঞান না থাকলে ভ্রান্তি আর সত্যের ফারাক বুঝা যায় না কখনোই।

এই ঘটনার সাথে দাজ্জালের সম্পর্কটা কী? আল্লাহ এর মাধ্যমে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন দাজ্জালের সময়ে মানুষ শুধু বাহ্যিক জ্ঞানকেই অর্থাৎ চর্মচক্ষুর পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক বস্তুবাদী জ্ঞানকেই শুধু মূল্যায়ন করবে, আর অন্তর্চক্ষুর অন্ধত্বের ফলে অন্তর্জ্ঞানহীন হয়ে গিয়ে অন্ধ আর দাজ্জালের মতোই এক চোখা (ম্যাটেরিয়ালিস্টিক) হয়ে যাবে। সত্য মিথ্যা আলাদা করতে পারবে না। তাই অন্তর্জ্ঞান থাকাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সবচাইতে সরাসরি বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎসে (তথা আল-কুরআনে) ফিরে যাওয়া, নিজের ঈমান রক্ষার জন্যে, খাঁটিটা চেনার জন্যে।

চারসর্বশেষ অর্থাৎ চতুর্থ ঘটনায় (আয়াত নং ৮৩-৯৯) যুলকারনাইনের ঘটনা বর্ণিত আছে। আল্লাহর আদেশে যুলকারনাইন ইয়াজুজ মাজুজ নামক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী আর ভয়ংকর এক জাতিকে বিশাল এক দেয়াল তৈরী করে, সেই দেয়াল দিয়ে ঘিরে বন্দী করে ফেলেছিলেন এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন,

এ আমার রবের অনুগ্রহ। কিন্তু যখন আমার রবের প্রতিশ্রুতির নির্দিষ্ট সময় আসবে তখন তিনি একে ধুলিস্মাৎ করে দেবেন আর আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য। (আয়াত নং ৯৮)

শেষ সময়ে একটা ভয়ংকর জাতির আবির্ভাব ঘটার বিশদ বর্ণণা আমরা হাদীসে পাই যারা পুরো পৃথিবীতে যুদ্ধ, রক্ত আর অশান্তির বন্যা বইয়ে দেবে। মারা যাবে অসংখ্য নিরাপরাধ প্রাণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে গণণা শুরু করলে বর্তমান পর্যন্ত চালু থাকা সেই ধ্বংসযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করলে ভবিষ্যত ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে হালকা-পাতলা কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

শেষ কথা

দাজ্জালের সাথে সম্পর্কিত হাদীসগুলো এবং সুরা কাহাফ উপমা আর বাস্তবতার মিশেলে পরিপূর্ণ। ম্যাটেরিয়ালিস্টিক সেক্যুলার পড়াশোনা, স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির অগভীর জ্ঞানচর্চা এবং মিডিয়া আমাদেরকে শুধু বাহ্যিক চামড়ার চোখেই দেখতে শিখিয়েছে। আমরা গভীরভাবে ভাবতে ভুলে গেছি। ভুলে গেছি বলছি কেন, শিখতেই তো যাইনি কখনো, ঠিক না? জানিইতো না যে গভীরভাবে দেখা, ভাবা বলতে আসলে কী বুঝায়? অন্ধ হয়ে গেছে আমাদের অন্তর্জ্ঞানের চোখ। এক চোখা (যে নিজে শুধুই ম্যাটেরিয়ালিস্টিক চোখে দেখে এবং অন্যকেও সেইভাবেই দেখতে শেখায় সেই) দাজ্জালের সাথে আমাদের আজ তাই ভয়াবহ মিল।

বাঁচতে হলে আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে গুহাবাসীদের মতোই, দলেবলে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হবে আল্লাহর কাছেই। সেটাই সুরা কাহাফে আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন।

বলে দিয়েছেন, বাঁচতে হলে, সফল হতে হলে কর্ম করতে হবে, জীবনটাকে যাপন করতে হবে, দেখতে শিখতে হবে, ভাবতে-বুঝতে হবে আল-কুরআনের বর্ণিত পথেই। ফিরতে হবে আল-কুরআনের দিকেই। এরই ইঙ্গিত আছে এই সুরার একদম শুরুতে এবং সবার শেষে (আয়াত নং ১-৮ এবং ১০৩-১১০)।

এইবার সুরা কাহাফ বুঝে পড়ুন। অর্থ সহ পড়ুন। প্লিজ। প্রতি জুমায় হলেও নিজে পড়ুন, অন্যকেও পড়তে দিন।

অন্যকেও বাঁচার সুযোগ করে দিন। নিজে বাঁচুন।

আসুন মন থেকে পরিপূর্ণ তাওবা করে আল্লাহর কাছে এখুনই ফিরে যাই, তাঁর কাছেই নিজেকে সঁপে দিয়ে সাহায্য কামনা করি।

আজ হতেই।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

About The Author

আমি মুহাম্মাদ তোয়াহা আকবর। একাডেমিক পরিচয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন বায়োটেকনোলজিস্ট। আগ্রহ বিজ্ঞানে এবং গবেষণায়। তারচেয়েও বেশি আগ্রহ পড়ানোতে। নৈতিক এবং আদর্শিক জীবনে একজন মনেপ্রাণে মুসলিম। নাস্তিকতা ছেড়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অশেষ করুণা আর দয়ায় ইসলামের আলো চিনে এ পথে আসতে পেরেছি ২০১২ তে। এখন শিখছি। আরো বহু দূর পথ পাড়ি দিতে হবে জানি। অনন্তের জীবনের পাথেয় কুড়োতে বড্ড দেরী করে ফেলা একজন দূর্ভাগা হিসেবে নয়, বাঁচতে চাই সোনালি দিন গড়ার প্রত্যয়ে। ক্ষণিকের বালুবেলায় যে কটা মুক্তো কুড়োতে পারি সেই তো আমার লাভের খাতার শব্দমালা। হাঁটার পথে একটা দুটো মুক্তোর কথা, উপলব্ধির কথা লিখবো বলে এখানে পতাকা পুঁতেছি। আমি থাকবোনা একদিন। আমার খুঁজে পাওয়া কিছু মুক্তো হয়তো থেকে যাবে প্রজন্ম ছুঁয়ে প্রজন্মে। হয়তো হবে কারো আলোর মশাল। আর সে আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে।

Related Posts

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive