ঋতুবতী নারীদের ইসলাম না-কি অবজ্ঞার চোখে দেখেছে! আমরা জানি না, এ কথাটা নাস্তিকরা কোন দলীলের ভিত্তিতে বলে। সেদিন এক স্বঘোষিত নাস্তিকের বই পড়ছিলাম, যিনি নিজেকে শুধু নাস্তিকই নন বরং একজন শ্রেষ্ঠ (!) ভাষাবিদও মনে করেন। এই শ্রেষ্ঠ (!) ভাষাবিদের বই পড়ে চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেলো। এ লোকটাও দাবি করেছে, ইসলাম ঋতুবতী নারীদের অবজ্ঞার চোখে দেখেছে, ঋতুবতী অবস্থাকে দানবিক মনে করেছে, ঋতুবতীকে অপয়া মনে করেছে। আরেকদিন ওদের ব্লগেও এমন একটা লেখা নজরে পড়লো। তারা যেভাবে বিষয়টা নিয়ে মিথ্যাচার করে, তা প্রত্যক্ষ করলেই কুরআন কারীমের একটি আয়াতের কথা বারবার মনে হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُّنِيرٍ [٢٢:٨] ثَانِيَ عِطْفِهِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۖ لَهُ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ ۖ وَنُذِيقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَذَابَ الْحَرِيقِ [٢٢:٩]
মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে। তাদের কাছে না আছে জ্ঞান, না আছে পথনির্দেশ, না আছে দীপ্তিমান কোনো কিতাব। সে বিতণ্ডা করে ঘাড় বাঁকিয়ে। লোকদেরকে আল্লাহর পথ হতে ভ্রষ্ট করার জন্যে। তার জন্যে দুনিয়াতে রয়েছে লাঞ্ছনা এবং কিয়ামাতের দিন আমি তাকে আস্বাদন করাবো দহন যন্ত্রণা। [সূরাহ আল-হাজ্জ (২২) : ৮-৯]
ঋতুবতী নারীদের সম্পর্কে ইসলামের বিধান কি সত্যিই অমানবিক – যেমনটা নাস্তিকরা প্রচার করে থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে চলুন হায়েয/ঋতু/Menstruation কাকে বলে, সেটা জেনে নিই।
শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) হায়েয সম্পর্কে বলেন,
“হায়েযের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে—কোনো বস্তু নির্গত ও প্রবাহিত হওয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় হায়েয বলা হয় ওই প্রাকৃতিক রক্তকে, যা বাহ্যিক কার্যকারণ ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে নারীর যৌনাঙ্গ থেকে নির্গত হয়। হায়েয প্রাকৃতিক রক্ত। অসুস্থতা, আঘাত পাওয়া, পড়ে যাওয়া এবং প্রসবের সাথে এর কোনো সম্পর্কে নেই। এই প্রাকৃতিক রক্ত নারীর অবস্থা ও পরিবেশ-পরিস্থিতির বিভিন্নতার কারণে নানান রকম হয়ে থাকে। আর এই কারণেই ঋতুস্রাবের দিক থেকে নারীদের মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখা যায়।”[১]
মেডিকেল সায়েন্স অনুযায়ী Menstruation হলো—উচ্চতর প্রাইমেট (Primate) বর্গের স্তন্যপায়ী (Mammalian) স্ত্রীদের একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা প্রজননের সাথে সম্পর্কিত। প্রতি মাসে হয় বলে বাংলায় এটিকে ‘মাসিক’ নামেও অভিহিত করা হয়। প্রজননের উদ্দেশ্যে নারীদের ডিম্বাশয়ে (Ovum) ডিম্বস্ফুটন হয় এবং তা ফ্যালোপিয়ান টিউব (Fallopeian Tube) দিয়ে জরায়ুতে চলে আসে। এই পরিস্ফুটিত ডিম্ব জরায়ুতে ৩-৪ দিন অবস্থান করে। এ সময়ের মধ্যে যদি কোনো শুক্রাণু জরায়ুতে প্রবেশ না করে, তাহলে সে ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে যায়। আর যদি পুরুষের শুক্রাণু (Sperm) সেখানে পৌঁছায়, তাহলে তা নিষিক্ত হয়ে ভ্রূণের (Zygote) সূচনা ঘটায়।
নারীদের ঋতু শুরু হলে তঞ্চিত এবং অর্ধ-তঞ্চিত তরল কদিন ধরে লাগাতার যোনি পথে নির্গত হয়। এ ক্ষরণই হায়েয/ঋতু/Menstruation নামে পরিচিত। কখনও কখনও একে ‘গর্ভস্রাব’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। যদি জরায়ুতে অবমুক্ত ডিম্বটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়, তবে Implantation শুরু হয়। Implantation শুরু হলে আর হায়েয হয় না। তাই মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মেয়েদের গর্ভধারণের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঋতুস্রাব যুবতীদের ক্ষেত্রে সাধারণত ২১-৪৫ দিন পর পর ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে ২১-৩১ দিন পর পর সংগঠিত হয়। মেয়েদের ১১ বা ১৩ বছর বয়স থেকে শুরু ঋতুস্রাব শুরু হয়। মহিলাদের হায়েয একেবারে বন্ধ হলে Menopause শুরু হয়।[২]
এই হলো ঋতুস্রাবের অতি সংক্ষেপ বিবরণ। এবার আমরা সে আয়াতটি দেখবো, সেটা নাস্তিকরা ঋতুস্রাব বিষয়ক আলোচনায় ব্যবহার করে থাকে। আয়াতটি হলো,
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ ۖ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ ۖ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطْهُرْنَ ۖ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ [٢:٢٢٢]
প্রথমেই বলে রাখি, এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নারীদের হায়েযকালীন সময়ের কথা বর্ণনা করেছেন। হায়েযকালীন সময় যে কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ক, তা উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি এ সময়ে তাদের সাথে যৌনমিলন করতে নিষেধ করেছেন। আয়াতটির ভাবানুবাদ হলো,
আর তারা তোমাকে হায়েয সম্পর্কে প্রশ্ন করে, বলো তা কষ্টদায়ক। সুতরাং তোমরা হায়েযকালে স্ত্রী সঙ্গম (যৌনমিলন) বর্জন করবে, এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত সঙ্গম করবে না। অতঃপর তারা যখন পবিত্র হবে, তখন তাদের নিকট ঠিক সেভাবে গমন করবে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। [সূরাহ আল-বাকারাহ (২) : ২২২]
চলুন, এবার আয়াতটির শানে-নুযুল জেনে নিই। এই আয়াতটি মূলত ইয়াহুদীদের লক্ষ্য করে নাযিল হয়। ইহুদীরা হায়েযা মেয়েলোকদের সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করতো। তাদেরকে ঘোড়ার আস্তাবলে রেখে দিতো। ভালো খাবার গ্রহণ করতে দিতো না। এমনকি তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ পর্যন্ত বন্ধ রাখতো। এভাবে ঋতু চলাকালীন ইয়াহুদী মেয়েরা অবহেলিত হতো। মক্কার পৌত্তলিকরাও ঋতুবতী মহিলাদেরকে অবজ্ঞা করতো। তাদের খারাপ চোখে দেখতো। তাদেরকে আলাদা ঘরে রাখতো। কিন্তু এ সময়ে তাদের সাথে যৌনমিলন করতো। এমন অবস্থায় সাহাবারা ঋতু সম্পর্কে জানতে চাইলে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। বিষয়টি নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়।
وَحَدَّثَنِي زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مَهْدِيٍّ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، حَدَّثَنَا ثَابِتٌ، عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ الْيَهُودَ، كَانُوا إِذَا حَاضَتِ الْمَرْأَةُ فِيهِمْ لَمْ يُؤَاكِلُوهَا وَلَمْ يُجَامِعُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ فَسَأَلَ أَصْحَابُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى { وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ} إِلَى آخِرِ الآيَةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” اصْنَعُوا كُلَّ شَىْءٍ إِلاَّ النِّكَاحَ ” . فَبَلَغَ ذَلِكَ الْيَهُودَ فَقَالُوا مَا يُرِيدُ هَذَا الرَّجُلُ أَنْ يَدَعَ مِنْ أَمْرِنَا شَيْئًا إِلاَّ خَالَفَنَا فِيهِ فَجَاءَ أُسَيْدُ بْنُ حُضَيْرٍ وَعَبَّادُ بْنُ بِشْرٍ فَقَالاَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ الْيَهُودَ تَقُولُ كَذَا وَكَذَا . فَلاَ نُجَامِعُهُنَّ فَتَغَيَّرَ وَجْهُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَتَّى ظَنَنَّا أَنْ قَدْ وَجَدَ عَلَيْهِمَا فَخَرَجَا فَاسْتَقْبَلَهُمَا هَدِيَّةٌ مِنْ لَبَنٍ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَأَرْسَلَ فِي آثَارِهِمَا فَسَقَاهُمَا فَعَرَفَا أَنْ لَمْ يَجِدْ عَلَيْهِمَا .
“আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত। ইয়াহুদীরা তাদের মহিলাদের হায়েয হলে, তার সঙ্গে এক সাথে আহার করতো না এবং এক ঘরে বাস করতো না। সাহাবায়ে কিরাম এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন : “তারা তোমার কাছে হায়েয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, তা কষ্টদায়ক…।” এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন,
তোমরা (সে সময় তাদের সাথে) শুধু সহবাস ছাড়া অন্যান্য সব কাজ কোরো।
এ খবর ইয়াহুদীদের কাছে পৌঁছলে তারা বললো, এ লোকটি সব কাজেই কেবল আমাদের বিরোধিতা করতে চায়। অতঃপর উসায়দ ইবন হুযায়র (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) ও আববাদ ইবন বিশর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এসে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইয়াহুদীরা এ রকম এ রকম বলছে। আমরা কি তাদের সাথে (হায়িয অবস্থায়) সহবাস করবো না?” (তাঁদের কথা শুনে) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেলো। এতে আমরা ধারণা করলাম যে, তিনি তাদের ওপর ভীষণ রাগান্বিত হয়েছেন। তাঁরা (উভয়ে) বেরিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যেই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে দুধ হাদিয়া এলো। তিনি ﷺ তাঁদেরকে ডেকে আনার জন্যে লোক পাঠালেন। (তাঁরা এলে) তিনি ﷺ তাঁদেরকে দুধ পান করালেন। তখন তাঁরা বুঝলেন যে, তিনি ﷺ তাঁদের ওপর রাগ করেননি।” [মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৬০১; ইবনু কাসীর, ইসমাঈল ইবনু উমার, তাফসীরুল কোরআনীল আযীম, ১/৬০৯; ইবনু হাজার আসকালানী, বুলুগুল মারাম, অধ্যায় : ঋতুবতী মহিলাদের যে সকল কাজ বৈধ, হাদীস : ১৪৩]
এই হলো এই উপর্যুক্ত আয়াতটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট। এখন সমস্যাটা হলো أَذًى শব্দটি নিয়ে। নাস্তিকরা একটি জায়গায় মারাত্মক ভুল করে, আর তা হলো — এই আয়াতের أَذًى শব্দের ভুল অর্থ করে। তাই আমরা প্রসিদ্ধ অভিধান থেকে দেখতে চাই, أَذًى শব্দটির অর্থ কী কী হতে পারে।
‘A dictionary of modern written Arabic language’ অনুযায়ী أَذًى শব্দের অর্থ গুলো হলো : To suffer damage, be harmed, hurt, wrong, to molest, annoy, irritable, trouble.[৩]
‘Al-Mawrid’ ( A modern Arabic to English dictionary) অনুসারে أَذًى শব্দের অর্থ হলো : harm, damage, injury, wrong, detriment, lesion, grievance, nuisance, annoyance, harassment.[৪]
‘আল–মু’জামুল ওয়াফী’ অনুসারে أَذًى শব্দের অর্থ হলো : কষ্ট, ক্ষতি, অনিষ্ট, আঘাত।[৫]
সম্মানিত পাঠক! লক্ষ করুন, কোনো অভিধানেই কিন্তু أَذًى শব্দের অর্থ ‘দানবিক, অপয়া, পশুর মতো, নিষিদ্ধ, দূষিত’ ইত্যাদি বলা নেই। ইসলামে ঋতুকালীন অবস্থায় নারীদের যে অবহেলা করা হয়, এই মিথ্যে কাহিনিটি নাস্তিকরা কোন দলীলের (কুরআন ও সুন্নাহ) মাধ্যমে সাজায়, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কেননা أَذًى শব্দের অর্থগুলো আমরা প্রসিদ্ধ অভিধানগ্রন্থ থেকে দেখেছি। সেখনে কোথাও এই কথা বলা নেই যে, أَذًى শব্দের অর্থ অপয়া, দানবিক, অশুচি ইত্যাদি। আর কুরআনে এমন কোনো আয়াতও নেই, যার দ্বারা নাস্তিকদের কল্পনাপ্রসূত দাবীর সত্যতা পরিলক্ষিত হয়।
এখন হয়তো নাস্তিকরা বলতে পারে — ইসলাম তাদেরকে অপয়া, অশুচি না বললে কী হবে, তাদেরকে তো এই সময়ে অপবিত্র বলেছে।
আমরা তাদেরকে বলতে চাই, ইসলাম কি শুধু নারীদেরকে পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে অপবিত্র ঘোষণা করেছে? না-কি ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষদেরকেও অপবিত্র ঘোষণা করেছে? ইসলাম যেমন ঋতুকালীন সময়ে নারীদেকে অপবিত্র বলেছে, ঠিক তেমনি পুষদেরকেও তো বীর্যপাতের পর অপবিত্র ঘোষণা করেছে।[৬] তাহলে ইসলাম কোথায় নারীদেরকে অপমান করলো?
এবার চলুন, নবী ﷺ এর সহীহ হাদীস থেকে আমরা দেখি—ঋতুবতী নারীদের সাথে ইসলাম কেমন আচরণের নির্দেশ দিয়েছে। ।
১. ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় শোয়া
আল্লাহর রাসূল ﷺ তাঁর সহধর্মিণীদের ঋতু চলাকালীন সময়ে একই বিছানায় শয়ন করতেন। একই সাথে ঘুমাতেন। এ নিয়ে কোনো সঙ্কোচবোধ করতেন না।
حَدَّثَنَا الْمَكِّيُّ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ حَدَّثَنَا هِشَامٌ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، أَنَّ زَيْنَبَ ابْنَةَ أُمِّ سَلَمَةَ، حَدَّثَتْهُ أَنَّ أُمَّ سَلَمَةَ حَدَّثَتْهَا قَالَتْ، بَيْنَا أَنَا مَعَ النَّبِيِّ، صلى الله عليه وسلم مُضْطَجِعَةً فِي خَمِيصَةٍ إِذْ حِضْتُ، فَانْسَلَلْتُ فَأَخَذْتُ ثِيَابَ حِيضَتِي قَالَ “ أَنُفِسْتِ ”. قُلْتُ نَعَمْ. فَدَعَانِي فَاضْطَجَعْتُ مَعَهُ فِي الْخَمِيلَةِ.
“উম্মে সালমা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী ﷺ এর সাথে একই চাদরের নিচে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমার হায়েয দেখা দিলে আমি চুপি চুপি বেরিয়ে গিয়ে হায়েযের কাপড় পড়ে নিলাম। তিনি ﷺ বললেন, তোমার কি নিফাস দেখা দিয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি ﷺ আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর ﷺ সঙ্গে চাদরের ভিতর শুয়ে পড়লাম।” [বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস–সহীহ, অধ্যায় : হায়য, পরিচ্ছেদ (২০৭) : হায়য অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মিলামেশা করা, ১/২৯৪, ৩১৬,৩১৭; মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৫৮১ , আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায় : হায়য-ইস্তিহাযা ও নিফাস, পরিচ্ছেদ (৪) : …তাদের সাথে শোয়া ও খাওয়া দাওয়া বৈধ, ১/৩২৬, ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, ১/৬৩৭]
حَدَّثَنِي أَبُو الطَّاهِرِ، أَخْبَرَنَا ابْنُ وَهْبٍ، عَنْ مَخْرَمَةَ، ح وَحَدَّثَنَا هَارُونُ بْنُ سَعِيدٍ الأَيْلِيُّ، وَأَحْمَدُ بْنُ عِيسَى، قَالاَ حَدَّثَنَا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي مَخْرَمَةُ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ كُرَيْبٍ، مَوْلَى ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ سَمِعْتُ مَيْمُونَةَ، زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَضْطَجِعُ مَعِي وَأَنَا حَائِضٌ وَبَيْنِي وَبَيْنَهُ ثَوْبٌ
“আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর আযাদকৃত গোলাম কুয়াইব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি নবী ﷺ এর স্ত্রী মায়মুনা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা)-কে বলতে শুনেছি, তিনি (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেছেন — ঋতুবতী অবস্থায় রাসূল ﷺ আমার সাথে একই বিছানায় ঘুমাতেন। এই সময় আমার ও তাঁর ﷺ মাঝে কেবলমাত্র একখানা কাপড় আড়াল থাকতো।” [মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৫৮৯, ৫৯০; আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, সহীহ আত-তিরমিযী, ১/১৩২; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায় : হায়য-ইস্তিহাযা ও নিফাস, পরিচ্ছেদ (৪) : …তাদের সাথে শোয়া ও খাওয়া দাওয়া বৈধ, ১/৩২৪, আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, সহীহ আত-তিরমিযী, ১/১৩২]
২. ঋতুবতী নারীদের সাথে যৌনমিলন ছাড়া সব ধরণের মেলামেশা করা
এই সময়টাতে যৌনমিলন ছাড়া তাদের সাথে সব ধরণের মেলামেশা করা যায়। তাদের সাথে খাবার খাওয়া, চলাফেরা, স্বাভাবিক সকল কাজ কর্ম পরিচালনা প্রভৃতি কোনো কাজই ইসলাম নিষেধ করেনি।
وَحَدَّثَنِي زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مَهْدِيٍّ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، حَدَّثَنَا ثَابِتٌ، عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ الْيَهُودَ، كَانُوا إِذَا حَاضَتِ الْمَرْأَةُ فِيهِمْ لَمْ يُؤَاكِلُوهَا وَلَمْ يُجَامِعُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ فَسَأَلَ أَصْحَابُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى { وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ} إِلَى آخِرِ الآيَةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” اصْنَعُوا كُلَّ شَىْءٍ إِلاَّ النِّكَاحَ
“আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত। ইয়াহুদীরা তাদের মহিলাদের হায়েয হলে তার সঙ্গে এক সাথে আহার করতো না এবং এক ঘরে বাস করতো না। সাহাবায়ে কিরাম এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন : “তারা তোমার কাছে হায়েয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও যে, তা হলো….।” এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমরা (সে সময় তাদের সাথে) শুধু সহবাস ছাড়া অন্যান্য সব কাজ কোরো।” [মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৬০১, ইবনু হাজার আসকালানী, বুলুগুল মারাম, অধ্যায় : ঋতুবতী মহিলাদের যে সকল কাজ বৈধ, হাদীস : ১৪৩, আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায় : হায়য-ইস্তিহাযা ও নিফাস, পরিচ্ছেদ (১) : হায়েয অবস্থায় যা করা নিষিদ্ধ, ১/৩২২]
৩. ঋতুবতী স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা
রাসূল ﷺ তাঁর ঋতুবতী স্ত্রীকে আলিঙ্গন করতেন। তাদের গায়ের সাথে গা মিশিয়ে শুতেন, যা নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা যায়।
وَحَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ مُسْهِرٍ، عَنِ الشَّيْبَانِيِّ، ح وَحَدَّثَنِي عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ السَّعْدِيُّ، – وَاللَّفْظُ لَهُ – أَخْبَرَنَا عَلِيُّ بْنُ مُسْهِرٍ، أَخْبَرَنَا أَبُو إِسْحَاقَ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الأَسْوَدِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ إِحْدَانَا إِذَا كَانَتْ حَائِضًا أَمَرَهَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ تَأْتَزِرَ فِي فَوْرِ حَيْضَتِهَا ثُمَّ يُبَاشِرُهَا . قَالَتْ وَأَيُّكُمْ يَمْلِكُ إِرْبَهُ كَمَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَمْلِكُ إِرْبَهُ
“আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, আমাদের কেউ যখন ঋতুবতী হয়ে পড়তো, তখন তার পূর্ণ হায়েযের সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে পরিধেয় বস্ত্র বেঁধে নেয়ার হুকুম দিতেন। তারপর তার সাথে মেলামেশা করতেন। আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, তোমাদের মধ্যে কে তার কামভাব সেরুপ আয়ত্তে রাখতে সক্ষম, রাসূলুল্লাহ ﷺ যেরূপ তাঁর কামভাব আয়ত্তে রাখতে সক্ষম ছিলেন?” [মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩), : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৫৮৬, ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, ১/৬৩৫; বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস–সহীহ, অধ্যায় : হায়য, পরিচ্ছেদ (২০৭) : হায়য অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মিলামেশা করা, ১/২৯৬,২৯৭। আরও দেখুন : মালিক বিন আনাস, আল-মুয়াত্তা, অধ্যায় (২) : পবিত্রতা অর্জন, পরিচ্ছেদ (২৬) : স্ত্রী ঋতুমতী থাকলে…, ১/৯৩, ৯৪, ৯৫; নাসাঈ, আহমাদ ইবনু শুয়াইব, আস-সুনান, ১/২৮৫, আবু দাউদ, সুলাইমান ইবনু আশয়াস, আস-সুনান, ১/২৬৮; ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, অধ্যায় : পবিত্রতা ও তার পন্থাসমূহ, ১/৬৩৫,৬৩৬]
৪. স্ত্রীর সাথে একই পাত্রে খাবার খাওয়া
আল্লাহর রাসূল ﷺ এই সময়ে তাঁদেরকে সাথে নিয়ে একই থালায় খাবার গ্রহণ করতেন। শুধু এক সাথে খাবারই নয়, রাসূল ﷺ এ সময়ে ওইদিকে ঠোঁট লাগিয়ে পানি খেতেন, যেদিক দিয়ে মা আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) হায়িযা অবস্থায় পানি পান করতেন। রাসূল ﷺ হাড়কে ওই দিক থেকেই চিবোতেন, যেদিক থেকে আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) ঋতুবতী অবস্থায় চিবোতেন।
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَزُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، قَالاَ حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ مِسْعَرٍ، وَسُفْيَانَ،
عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ شُرَيْحٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كُنْتُ أَشْرَبُ وَأَنَا حَائِضٌ، ثُمَّ أُنَاوِلُهُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَيَضَعُ فَاهُ عَلَى مَوْضِعِ فِيَّ فَيَشْرَبُ وَأَتَعَرَّقُ الْعَرْقَ وَأَنَا حَائِضٌ ثُمَّ أُنَاوِلُهُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَيَضَعُ فَاهُ عَلَى مَوْضِعِ فِيَّ . وَلَمْ يَذْكُرْ زُهَيْرٌ فَيَشْرَبُ .
“আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি পান করতাম এবং পরে নবী ﷺ-কে অবশিষ্টটুকু প্রদান করলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম, তিনিও সে স্থানেই মুখ লাগিয়ে পান করতেন। আবার আমি ঋতুবতী অবস্থায় হাড় খেয়ে তা নবীকে ﷺ দিলে, আমি যেখানে মুখ লাগিয়েছিলাম, তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে খেতেন।” [মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৫৯৯, আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায় : হায়য-ইস্তিহাযা ও নিফাস, অনুচ্ছেদ : ঋতুবতী মহিলাদের সাথে খাওয়া দাওয়া…, ১/৩২৭, ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, ১/৬৩৪, আবু দাউদ, সুলাইমান ইবনু আশয়াস, আস-সুনান, ১/২৫৯। আরও দেখুন : আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, সহীহ আত-তিরমিযী, ১/১৩৩, ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, ১/৬৫১, নাসাঈ, আহমাদ ইবনু শুয়াইব, আস-সুনান, ১/৭৬৮]
৫. ঋতুবতী স্ত্রীর দ্বারা মাথা আঁচড়িয়ে নেয়া
আল্লাহর নবী ﷺ তাঁর ঋতুবতী স্ত্রীদের দিয়ে মাথাকে পরিপাটি করে নিতেন। এমনকি তিনি ﷺ যখন মাসজিদে ই’তিকাফ করতেন, তখনও মা আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) রাসূলুল্লাহর ﷺ মাথা আঁচড়িয়ে দিতেন। আমরা নিম্নে উল্লেখিত সহীহ হাদিসের মাধ্যমে তার প্রমাণ পাই।
حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى، قَالَ أَخْبَرَنَا هِشَامُ بْنُ يُوسُفَ، أَنَّ ابْنَ جُرَيْجٍ، أَخْبَرَهُمْ قَالَ أَخْبَرَنِي هِشَامٌ، عَنْ عُرْوَةَ، أَنَّهُ سُئِلَ أَتَخْدُمُنِي الْحَائِضُ أَوْ تَدْنُو مِنِّي الْمَرْأَةُ وَهْىَ جُنُبٌ فَقَالَ عُرْوَةُ كُلُّ ذَلِكَ عَلَىَّ هَيِّنٌ، وَكُلُّ ذَلِكَ تَخْدُمُنِي، وَلَيْسَ عَلَى أَحَدٍ فِي ذَلِكَ بَأْسٌ، أَخْبَرَتْنِي عَائِشَةُ أَنَّهَا كَانَتْ تُرَجِّلُ ـ تَعْنِي ـ رَأْسَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهِيَ حَائِضٌ، وَرَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حِينَئِذٍ مُجَاوِرٌ فِي الْمَسْجِدِ، يُدْنِي لَهَا رَأْسَهُ وَهْىَ فِي حُجْرَتِهَا، فَتُرَجِّلُهُ وَهْىَ حَائِضٌ.
“উরওয়া (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “ঋতুবতী স্ত্রী কি স্বামীর খেদমত করতে পারবে? অথবা গোসল ফরয হওয়ার অবস্থায় কি স্বামীর নিকটবর্তী হতে পারবে?” উরওয়া জবাব দিলেন, “এ সবই আমার কাছে সহজ। এ ধরণের সকল মহিলাই স্বামীর খেদমত করতে পারে। এ ব্যাপারে কারও অসুবিধা থাকার কথা নয়। আমাকে আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেছেন, তিনি ঋতুবতী অবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চুল আঁচড়ে দিতেন। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ মু’তাকিফ অবস্থায় মাসজিদ থেকে হুজরার দিকে মাথাটা বাড়িয়ে দিতেন। তখন তিনি ﷺ মাথার চুল আঁচড়াতেন, অথচ তিনি ছিলেন ঋতুবতী।” [বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস-সহীহ,অধ্যায় : হায়য,পরিচ্ছেদ (২০৪) : হায়েযের সময় স্বামীর মাথা ধুয়ে দেওয়া, ১/২৯২; মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৫৯২-৫৯৫, মালিক বিন আনাস, আল-মুয়াত্তা, অধ্যায় (২) : পবিত্রতা অর্জন, পরিচ্ছেদ(২৮), ঋতু সম্পর্কীয় বিবিধ হুকুম, ১/১০২]
৬. স্ত্রীর সাথে একই পাত্রে গোসল করা
হায়েযা স্ত্রীর সাথে একই পাত্রের পানি থেকে গোসল করা ইসলাম সমর্থিত বিষয়, যা আমরা নবীর ﷺ সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণ পাই।
حَدَّثَنَا سَعْدُ بْنُ حَفْصٍ، قَالَ حَدَّثَنَا شَيْبَانُ، عَنْ يَحْيَى، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ زَيْنَبَ ابْنَةِ أَبِي سَلَمَةَ، حَدَّثَتْهُ أَنَّ أُمَّ سَلَمَةَ قَالَتْ حِضْتُ وَأَنَا مَعَ النَّبِيِّ، صلى الله عليه وسلم فِي الْخَمِيلَةِ، فَانْسَلَلْتُ فَخَرَجْتُ مِنْهَا، فَأَخَذْتُ ثِيَابَ حِيضَتِي فَلَبِسْتُهَا، فَقَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ أَنُفِسْتِ ”. قُلْتُ نَعَمْ، فَدَعَانِي فَأَدْخَلَنِي مَعَهُ فِي الْخَمِيلَةِ. قَالَتْ وَحَدَّثَتْنِي أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُقَبِّلُهَا وَهُوَ صَائِمٌ، وَكُنْتُ أَغْتَسِلُ أَنَا وَالنَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم مِنْ إِنَاءٍ وَاحِدٍ مِنَ الْجَنَابَةِ
“উম্মে সালমা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ এর সঙ্গে একই চাদরের নিচে শায়িত অবস্থায় আমার হায়িয দেখা দিলো। তখন আমি চুপিসারে বেরিয়ে এসে হায়িযের কাপড় পরে নিলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বললেন, তোমার কি হায়িয শুরু হয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি ﷺ আমকে ডেকে নিয়ে তাঁর ﷺ চাদরের নিচে স্থান দিলেন। বর্ণনাকারী যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, আমাকে উম্মে সালমা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) এও বলেছেন যে, আমি ও রাসূলুল্লাহ ﷺ একই পাত্র থেকে পানি নিয়ে জানাবাতের গোসল করতাম।” [বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস–সহীহ, অধ্যায় : হায়য, পরিচ্ছেদ (২২৩) : ঋতুবতী মহিলার সাথে কাপড় পরিহিত অবস্থায় একত্রে শয়ন, ১/৩১৬, পরিচ্ছেদ (২০৭) : হায়য অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করা, ১/২৯৫]
৭. ঋতুবতী স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা
আল্লাহর রাসূল ﷺ এই সময়ে তাঁর ﷺ স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে কুরআন তিলাওয়াত করতেন, কিন্তু এতে কোনো সমস্যাবোধ করতেন না।
حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ الْفَضْلُ بْنُ دُكَيْنٍ، سَمِعَ زُهَيْرًا، عَنْ مَنْصُورٍ ابْنِ صَفِيَّةَ، أَنَّ أُمَّهُ، حَدَّثَتْهُ أَنَّ عَائِشَةَ حَدَّثَتْهَا أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَتَّكِئُ فِي حَجْرِي وَأَنَا حَائِضٌ، ثُمَّ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ
“আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েযের অবস্থায় ছিলাম।” বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস–সহীহ, অধ্যায় : হায়য,পরিচ্ছেদ (২০৫) : স্ত্রীর হায়য অবস্থায় তার কোলে মাথা রেখে…, ১/২৯৩; মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৬০০; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায় : হায়য-ইস্তিহাযা ও নিফাস, পরিচ্ছেদ (৫) : ঋতুবতী মহিলার কোলে কুরআন তিলাওয়াত করা…, ১/৩২৭-৩২৮, ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, ১/৬৩৪, আবু দাউদ, সুলাইমান ইবনু আশয়াস, আস-সুনান, ১/২৬০, নাসাঈ, আহমাদ ইবনু শুয়াইব, আস-সুনান, ১/২৭৪]
৮. ঋতুবতী স্ত্রীকে পাশে নিয়ে সালাত আদায় করা
রাসূল ﷺ এর হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, তিনি ﷺ ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে রাত্রিযাপনকালীন সময় কিলামুল লাইল আদায় করতেন। কিয়ামুল লাইল আদায় করার সময় ঋতুবতী স্ত্রী তাঁর ﷺ সিজদার জায়গায় সোজাসুজি শুয়ে থাকতেন। এমনকি তিনি ﷺ যখন সিজদায় যেতেন, তাঁর ﷺ কাপড়ের কিছু অংশ ঋতুবতী স্ত্রীর গায়ে লাগতো; কিন্তু তিনি ﷺ কিছুই মনে করতেন না।
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ مُدْرِكٍ، قَالَ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ حَمَّادٍ، قَالَ أَخْبَرَنَا أَبُو عَوَانَةَ ـ اسْمُهُ الْوَضَّاحُ ـ مِنْ كِتَابِهِ قَالَ أَخْبَرَنَا سُلَيْمَانُ الشَّيْبَانِيُّ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ شَدَّادٍ، قَالَ سَمِعْتُ خَالَتِي، مَيْمُونَةَ ـ زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهَا كَانَتْ تَكُونُ حَائِضًا لاَ تُصَلِّي، وَهْىَ مُفْتَرِشَةٌ بِحِذَاءِ مَسْجِدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ يُصَلِّي عَلَى خُمْرَتِهِ، إِذَا سَجَدَ أَصَابَنِي بَعْضُ ثَوْبِهِ
“আবদুল্লাহ ইবন শাদ্দাত (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আমার খালা নবী ﷺ এর পত্নী মায়মূনা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে শুনেছি যে, তিনি হায়িয অবস্থায় সালাত আদায় করতেন না। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সিজদার জায়গায় সোজাসুজি শুয়ে থাকতেন। নবী ﷺ তাঁর চাটাইয়ে সালাত আদায় করতেন। সিজদা করার সময় তাঁর কাপড়ের অংশ রাসূলের ﷺ গায়ে লাগতো।” [মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৫৯৭, ৫৯৮; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায় : হায়য-ইস্তিহাযা ও নিফাস, পরিচ্ছেদ (৬) : ঋতুবতী মহিলার কাপড় চোপড় পবিত্র …, ১/৩২৯]
৯. প্রাত্যহিক কোনো কাজে ঋতুবতী স্ত্রীর সাহায্য নেওয়া
উল্লেখিত কাজ ছাড়াও আপনি আপনার প্রাত্যহিক যে কোনো ধরণের কাজে আপনার ঋতুবতী স্ত্রীর সহায়তা নিতে পারবেন।
وَحَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ يَحْيَى، وَأَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ وَأَبُو كُرَيْبٍ قَالَ يَحْيَى أَخْبَرَنَا وَقَالَ الآخَرَانِ، حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ ثَابِتِ بْنِ عُبَيْدٍ، عَنِ الْقَاسِمِ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” نَاوِلِينِي الْخُمْرَةَ مِنَ الْمَسْجِدِ ” . قَالَتْ فَقُلْتُ إِنِّي حَائِضٌ . فَقَالَ ” إِنَّ حَيْضَتَكِ لَيْسَتْ فِي يَدِكِ ”
“আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ই’তিকাফ থাকা অবস্থায় মাসজিদ থেকে আমাকে (হাত বাড়িয়ে) জায়নামাযটি দেওয়ার জন্যে আদেশ করলেন। আমি বললাম, আমি তো ঋতুবতী। তিনি ﷺ আবার বললেন, তা আমাকে দাও। ঋতু তো আর হাতে লেগে নেই।” [মুসলিম, আবুল হোসাইন ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ, অধ্যায় (৩) : হায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনা, ২/৫৯৭, ৫৯৮; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায় : হায়য-ইস্তিহাযা ও নিফাস, পরিচ্ছেদ (৫) : ঋতুবতী মহিলার কোলে কুরআন তিলাওয়াত করা…, ১/৩২৮, আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, সহীহ আত-তিরমিযী, ১/১৩৪, ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, ১/৬৩২]
সম্মানিত পাঠক! এবার আপনিই বলুন, ইসলাম কোথায় ঋতুবতী নারীদেরকে অবজ্ঞা করলো? ইসলাম ঋতুবতী নারীকে কখনওই অবজ্ঞা করেনি। বরং এই সময়ে শারীরিক ও মানসিক কষ্টের কথা বিবেচনা করে সালাতের মতো ফরয ইবাদাতকেও মাফ করে দিয়েছে।[৭] তাদের পাশে এনে তাদের স্বামী ও পরিবারকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাদের সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে, একসাথে খাবার খেতে, ইবাদাতের সময় পাশে রাখতে আদেশ দিয়েছে। যাতে করে ঋতুবতী নারী এই সময়টাতে বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে পতিত না হয়। সে যাতে অন্যান্য সময়ের মতো এ সময়টাতেও সাধারণ জীবন-যাপন করতে পারে। তাই নাস্তিকদের এ দাবি করার কোনো সুযোগ নেই যে, ইসলাম ঋতুবতী নারীকে অবজ্ঞা করে দূরে ঠেলে দিয়েছে কিংবা ঋতুবতী নারীকে অপয়া মনে করেছে।
বস্তুত মহান আল্লাহই সর্বজ্ঞানী।
[১] উসাইমিন, মুহাম্মাদ বিন সালেহ, নারীর প্রাকৃতিক রক্তস্রাব, পৃষ্ঠা : ৪; (ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদি আরব, ১৪২৯ হিজরি)।
[২] “Menstruation and the menstrual cycle fact sheet”. Office of Women’s Health. December 23, 2014. Retrieved 25 June 2015.
[৩] Hans wehr, Edited by : J Milton Cowan, A dictionary of modern written arabic, p.12; (Spoken language servibe, Inc., Ithaca, New York, 3rd edition, 1976).
[৪]Dr. Rohi Baalbaki, Al-Mawrid, p.67; ( Dar-el-ilm, Lilmalayin, seventh ed., Beirut, Lebanon, 1995).
[৫] ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আল–মু’জামুল ওয়াফী, পৃষ্ঠা : ৬২; (রিয়াদ প্রকাশনী, ৩৪ নর্থ ব্রুকহল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা, ১৩শ সংস্করণ, ২০১৩)।
[৬] আবূ আইউব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “বীর্যপাত হলে গোসল ওয়াজিব হয়।” [ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ, আস-সুনান, অধ্যায় : পবিত্রতা ও তার পন্থাসমূহ, ১/৬০৭; আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, সহীহ আত-তিরমিযী, ১/১১০]
[৭] আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফাতিমা বিনত আবূ হূবায়শ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) রাসূলুল্লাহ ﷺ–কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কখনও পবিত্র হই না। এমতাবস্থায় আমি কি সালাত ছেড়ে দেবো?’ রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ‘এ হলো এক ধরনের বিশেষ রক্ত, হায়যের রক্ত নয়। যখন তোমার হায়য শুরু হয়, তখন তুমি সালাত ছেড়ে দাও। আর হায়য শেষ হলে রক্ত ধুয়ে সালাত আদায় কোরো।’ [বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস–সহীহ, অধ্যায় : হায়য,পরিচ্ছেদ (২১০) : ইসতিহাযা, ১/৩০০]।
মু’আয (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, এক মহিলা আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা)–কে বললেন, ‘আমাদের জন্য হায়যকালীন কাযা সালাত পবিত্র হওয়ার পর আদায় করলে চলবে কি-না?’ আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বললেন, ‘তুমি কি হারুরিইয়্যা? আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময়ে ঋতুবতী হতাম কিন্তু আমাদের সালাত কাযার নির্দেশ দিতেন না।’ [বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস–সহীহ, অধ্যায় : হায়য, পরিচ্ছেদ (২২২) : হায়যকালীন সালাতে কাযা নেই, ১/৩১৫]
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।