দীর্ঘ যাত্রা শুরু

হাজ্জের সফর শুরু করার সময় আনন্দের পাশাপাশি কেমন অন্যরকম এক অনুভূতি হতে লাগলো। উৎসাহ-উৎকণ্ঠা মিলিয়ে  যেকোনো ‘বিদেশ’ ভ্রমণের তুলনায় এবারের অনুভূতি যেন একেবারেই আলাদা! এ যাত্রা অনেকটা ইহজগতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে অনন্তের পথে যাত্রা করার সাথে তুলনীয়। রব্বের সাথে তো কেবল তারাই দেখা করবে, যারা রব্বের ক্ষমা পাবেন। কিন্তু এ নশ্বর পৃথিবীতে বাস করে, জীবিত অবস্থায় রবের সান্নিধ্যের স্বাদ পাবার জন্য হাজ্জের কোনো বিকল্প নেই।

হাজ্জ ফর্ম পূরণ করার সময় সকলকে বন্ড সই করতে হয়। কারণ, কোনো হাজী যদি সৌদিতে অবস্থান কালে মারা যায়, তাহলে তার লাশ কোনোক্রমে দেশে ফেরত আনা হবে না, ওই দেশেই দাফন করা হবে। অর্থাৎ হাজ্জে যাওয়া অনেকটা চিরবিদায় নেবার মতোন! শত শত বছর আগে হাজ্জ যাত্রা এত কঠিন ছিলো যে, কেউ জানতো না সে আবার ফিরে আসতে পারবে কি না। তারা সেই আমলে যেভাবে বিদায় নিয়ে যেতো, এই এত শতাব্দী পরেও আমরা অনেকটা একইভাবে বিদায় নিয়ে যাই। এখন সবকিছু আল্লাহ্‌ আগের তুলনায় কত সহজ করে দিয়েছেন, তবুও এখনো মানুষ এই সফরে যায় ফেরত না আশার সম্ভাবনা নিয়ে।

IIRT Arabic Intensive

মক্কায় ইহরামরত অবস্থায় যখন কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদেরকে সেই ইহরামের কাপড় পরিহিত অবস্থাতেই, বিনা গোসলে দাফন করা হয়। পুনরুত্থানের দিন তাঁরা “লাব্বাইক আল্লাহ্‌” বলতে বলতে উত্থিত হবেন। হাজ্জের সময় ঈমানের সাথে মৃত্যু যাদের হয়, তাঁরা কতই না সৌভাগ্যবান।

তাছাড়া পুরুষদের ইহরামের কাপড় আর কাফনের কাপড়ে কোনো ফারাকও নেই। ধনী, গরীব, রাজা, প্রজা সবাই এই কাফনের কাপড় পরে লাব্বাইক ধ্বনি করতে করতে পবিত্র এ সফরে রওনা হয়। তখন সকল বর্ণের, সকল দেশের মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আল্লাহ্‌র কাছে কেউ তার সামাজিক মর্যাদা বা প্রতিপত্তি নিয়ে যায় না, সেখানে কে ধনী কে গরিব বোঝার কোনো উপায় নেই। আলহামদুলিল্লাহ্, সকল প্রশংসা অবশ্যই শুধুমাত্র রাব্বুল ‘আলামিনের প্রাপ্য!

ফ্লাইটের দিন ভোরে আমরা দু’জন পরিষ্কার কাপড় পরে তৈরি হলাম যাত্রার জন্য। নিয়ত বাঁধবো প্লেনে উঠে মিকাত অতিক্রমের আগে। সাফির গোসল করে সুন্নত অনুযায়ী গায়ে আতর দিয়ে, ইহরামের সাদা দু টুকরো কাপড় পেঁচিয়ে নিলো। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমরা আসলেই যাচ্ছি আল্লাহ্‌র ঘরে। আহ, এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এ আবেগ বলে বোঝানোর নয়।

৭ই সেপ্টেম্বর দুপুর ১:৪৫ এ ফ্লাইট। আজ থেকে আমাদের তেতাল্লিশ দিনের সফর শুরু হবে। আমরা প্রথম ফ্লাইটে যাচ্ছি বিধায় হাজ্জ শেষ হবার পর পরই দেশে ফেরত আসবো। হাজ্জের আগের এক মাস সময়টুকু মাসজিদুল হারাম ও মাসজিদুন নববীতে কাটাবো।

সকাল ১০টার দিকে বাসার সবাই মিলে রওনা হলাম। গতকাল বিকেলে ক্যাম্পে এসে আমরা সৌদি মোবিলি কোম্পানির সিম নিয়ে গিয়েছিলাম, যা সরকার থেকে প্রতি  হাজ্জ যাত্রীকে ফ্রি বিতরণ করা হচ্ছিলো, পাঁচ রিয়াল ব্যালেন্স সহকারে। তখন হাজ্জ ক্যাম্পে ছিল লোকে লোকারণ্য।

আজও তার ব্যতিক্রম নয়। হাজ্জ যাত্রীদের ইমিগ্রেশন ক্যাম্প থেকেই সম্পন্ন করা হয়, অতঃপর সরকারি বাসে সরাসরি এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তাই হাজ্জ ক্যাম্পে বরাবরই অবিশ্বাস্য লম্বা লাইন থাকে!  লোকজন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রা শুরুর আগেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গেছে। এর মাঝে হোমড়া-চোমড়া কিছু মানুষ লাইন ক্রস করে আগে আগে ঢুকে যাচ্ছে। এখানেও দুর্নীতি! এসব দেখে অনেকের ধৈর্যভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। কেউ চিৎকার করে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিয়েছে। চারদিকে হৈচৈ, চেঁচামেচি, সে এক তুমুল হট্টগোল।

বহু প্রতীক্ষার পর অবশেষে ইমিগ্রেশনে ঢুকে পড়লাম।  দূরে দেখি এনটিভির ক্যামেরাম্যান হাজ্জ যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ ভিডিও করছে। আমাদের সাংঘাতিক সাংবাদিক ভাইয়েরা আজ ভালো একটা নিউজ পেলো। পরে শুনেছি হাজ্জযাত্রীদের হেনস্থামূলক অবস্থা দেখানোর সময় আমাদেরকেও টিভিতে দেখিয়েছে। দেখা যাচ্ছে বাঙালির পক্ষে আসলেই লোক না শুনিয়ে হাজ্জে যাওয়া প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। আমাদের অতি উৎসাহী মাতৃকূলের পাশাপাশি টিভি রিপোর্টাররাও খবর ছড়ানোর ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে।

ওদিকে আমরা ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, এ লাইন কচ্ছপের চেয়েও যেন ধীর গতিসম্পন্ন!  যদি জানতাম আজকে থেকে সবে লাইনে দাঁড়ানো শুরু হলো মাত্র! অদূর ভবিষ্যতে দাঁড়িয়ে থাকার আরো প্রচুর পরীক্ষা দিতে হবে! আসলে  হাজ্জে গেলে সৌদি আরবে যাওয়া-আসা ও থাকাকালীন পুরো সময়টাতেই ধৈর্যের নানারকম পরীক্ষা দিতে হয়। দেখা যায়, এ সময়গুলোতে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা অনেকের জন্যই ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যাত্রার শুরুতেই কিছু লোকের যে মেজাজের অবস্থা দেখছি, বাকি যাত্রায় এদের কী হবে আল্লাহ্‌ই জানেন।

এর ভিতর এক অতি ছটফটে রিটায়ার্ড ভদ্রলোক পাঞ্জাবি পরে এসে আবিষ্কার করেন সব (পুরুষ) যাত্রী সাদা ইহরামের কাপড় পরে আছেন। যাবতীয় মহিলাদের সাথে তিনিই একমাত্র পুরুষ যিনি কিনা রেগুলার কাপড় পরে আছেন। বেচারা খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে “হংস মাঝে বক যথা”। কেন উনাকে আগে জানানো হয়নি ঘর থেকে ইহরামের কাপড় পরে আসার কথা, এই দোষটা কারো ঘাড়ে চাপাতে পারছেন না সেটিও মনে হয় তাঁর দুঃখের একটি বড় কারণ।

এয়ারপোর্টের বাথরুমে কাপড় বদলানোর ঝামেলা এড়াতেই সবাই ঘর থেকে কাপড় পরে আসে। যা-ই হোক, বেচারা কোন ফাঁকে কাপড় বদলেছেন জানি না। কিন্তু পরে এই অস্থির-মতি ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রীর সাথে আমাদের অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো, বিপদ-আপদে আল্লাহ্‌ এই দম্পতিকে আমাদের পাশে এনে  দিয়েছিলেন। শেষের দিকে উনি আমাদের সাথে এমন স্নেহশীল ভঙ্গিতে কথা বলতেন, যেন আমরা তাঁর সন্তান তুল্য।

পৌনে দুটোর ফ্লাইট ছিলো আমাদের। যখন ইমিগ্রেশন ক্রস করলাম, তখন আড়াইটার বেশি বাজে। আমাদের জানানো হলো, আমরা ফার্স্ট ফ্লাইটের যাত্রী হওয়া সত্বেও আমাদের ফেলে ‘ফার্স্ট ফ্লাইট’ চলে গেছে! বিমান কর্তৃপক্ষ কথা দিয়েছিলো বিশাল এক দোতালা প্লেন ভাড়া করবে। কিন্তু জানি না কেন (হয়তো পয়সায় কুলোতে পারেনি) তারা ছোট দুটো আদ্দি কালের প্লেন ভাড়া করেছে, যেসব প্লেন আজকাল আর কোনো দেশে চালায় না। জাদুঘরে স্থানান্তরযোগ্য এসব প্লেনের নাম শুনে চড়তেও ভয় লাগছে। ডিসকভারি চ্যানেলের প্লেন এক্সিডেন্টের মতো আকাশেই যদি প্লেন কয়েক টুকরা হয়ে যায়, তাহলে মাঝ আকাশেই আমাদের হাজ্জযাত্রীদের সলীল সমাধি, থুক্কু আকাশ সমাধি ঘটবে।

আমরা এখন সেকেন্ড ফ্লাইটের যাত্রী। আমাদের ফ্লাইট বিকাল ৫টায়। এর মাঝে আমি আর আমার স্বামী বাদে বাকি সবাই এয়ারপোর্টে যোহরের নামাজের পর ইহরাম বেধে ফেললো, অর্থাৎ হাজ্জের উমরাহর নিয়ত করে ফেললো। আমরা দুজন অপেক্ষা করছিলাম মিকাতে ইহরাম বাঁধবো বলে।

বিকালের দিকে সবাইকে এয়ারপোর্টের দামী একটা রেস্টুরেন্টে ফ্রি দুপুরের খাবার দিলো। যাক, বিমানের এইটুকু সৌজন্যতাবোধ আছে দেখে ভালো লাগলো। খাবার পেয়ে আমরা সবাই ক্ষুধার্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারের উপর। এর মাঝে ফ্লাইটের টাইম হয়ে গেলো। হাজ্জ ফ্লাইটের একটা মজার ব্যাপার হলো, শেষ যাত্রীটি না উঠা পর্যন্ত তারা প্লেন ছাড়ে না। এখানে প্লেনের টাইম ধরার জন্য আমাদের তাড়াতাড়ি খেতে হবে না। বরং প্লেনের লোক এসে আমাদের বলে গেলো, আমরা যেন চিন্তা না করি। আমাদের ফেলে প্লেন উড়বে না। কাজেই সবাই আরাম করে খেয়ে ফ্রেশ হয়ে, তারপর প্লেনে উঠলাম। প্লেন শেষ পর্যন্ত ছাড়লো ৬টার দিকে। অর্থাৎ যাত্রা শুরুতেই চার ঘণ্টা পনের মিনিট লেট!

অনেকের জন্য আজ জীবনে প্রথমবারের মতো প্লেনে ওঠা, প্রথমবারের জন্য বিদেশ যাওয়া। এমন মানুষ এখানে আছেন জীবনে ঢাকা শহরেই এসেছেন হাতে গোণা কয়েকবার, অথবা হাজ্জ গমন হেতু এবারই প্রথম রাজধানী আগমন। তাঁদের তথৈবচ অবস্থা দেখে মায়া হওয়া অস্বাভাবিক না। হঠাৎ করে অপরিচিত পরিবেশে এসে অনেকেই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন এবং কী করতে হবে অথবা কীভাবে করতে হবে, কোনো খেই পাচ্ছেন না। তাঁরা হাজ্জ ক্যাম্পের নামে মাত্র ট্রেনিং নিয়েছেন হয়তো, যেটি নেয়া না নেয়া সমতুল্য!

বাংলাদেশে দায়সারা গোছের একদিনের ট্রেনিং দেয় হাজ্জ ক্যাম্পে, তবে সেই ট্রেনিং কেবলমাত্র লেকচার সর্বস্ব। কিন্তু কে না জানে, ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়া শুধু উপদেশ নামায় কোনো কাজ হয় না? তাই যারা আমাদের ন্যায় প্রথমবারের মতো হাজ্জে যাবেন, তাঁরা সবাই নিশ্চয় হাড়ে হাড়ে অনুভব করেন সরকারের উচিত প্রতিটি হাজ্জযাত্রীকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করা। হাজ্জের নিয়ম-কানুন থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান, শৌচাগার ব্যবহার, অপরের সাথে বিনয়ী ব্যবহার করা, ভিড়ের ভেতর অন্যের প্রতি সহৃদয় আচরণ করা (‘আমি আগে’ ‘আমি আগে’ না করে, ‘আপনি আগে’ বলা) ইত্যাদি নিয়মাবলী জানা আমাদের সবার জন্য খুব দরকার।

যেমন, ইন্দোনেশিয়াতে প্রতি বছর হাজ্জ গমনেচ্ছুদের ৩ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাকে তারা বলে “মানাসিক হাজ্জ”। সে পরীক্ষায় পাশ করলে, তাদের হাজ্জের অনুমতি দেওয়া হয়। এখানে নকল কাবা ঘর থেকে শুরু করে কাবার আশেপাশের প্রয়োজনীয় স্থাপনাসমূহের নকল স্থাপনা তৈরি করা হয়। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, সাফা- মারওয়ার নকল প্রতিরূপ নির্মিত হয়। এই স্থাপনাসমূহকে একত্রে বলা হয়, “Littile Mecca”। হাজ্জের আগে আগে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন শহর “Littile Mecca”-তে ভরে যায়।

সেখানে হাজ্জযাত্রীগণ তওয়াফ, সা’ঈ থেকে শুরু করে হজ্জের যাবতীয় কার্যাবলী হাতে কলমে প্র্যাকটিস করেন। যতবার তাঁরা কোনো একটি ধাপে পাশ করতে না পারেন ততবার তাঁদের পুনরায় সেই কাজ করতে হয়। সবশেষে সব যাত্রীকে হুবহু একরকম দেখতে বস্ত্রসামগ্রী ও নাম-পরিচয় লেখা ব্রেসলেট প্রদান করা হয়। প্রত্যেক এজেন্সি থেকে ছোট রুমাল বা কাপড়ের টুকরো দেওয়া হয় যা তারা তাদের কাপড়ের সাথে লাগিয়ে রাখে, যেন দূর থেকে দেখে বোঝা যায় কে কোন এজেন্সির যাত্রী।

ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রতিবছর প্রচুর নাগরিক হাজ্জে যান। এঁদের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ আসেন কৃষক, বা দরিদ্র পরিবার থেকে, যারা অনেকেই কখনো প্লেনে চড়েননি বা বিদেশ যাননি। তাই এদেশের ধর্ম-মন্ত্রণালয় সকলের সুবিধার্থে প্রতি বছর এই মানাসিক হজ্জের আয়োজন করে।

এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁরা হাজ্জের নিয়মাবলীর সাথে সাথে পরিচ্ছন্নতা, নিয়মানুবর্তিতা শেখেন, যার কারণে পদদলিত হওয়া বা পথ হারিয়ে ফেলার মতো বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে তাঁরা আগেই সাবধান থাকতে পারেন। তাঁদের প্রত্যেকের স্যুটকেসে হাজ্জযাত্রীর বিশালাকারের রঙিন ছবি সাঁটানো থাকে, তাই মালপত্র হারাবার সম্ভাবনা কমে যায়। এই ইন্দোনেশিয়ানদের দূর থেকে দেখলেই চেনা যায়। তাদের ব্যবহার আর বিনয় হয় দেখার মতো। সফেদ, পরিচ্ছন্ন, ধোপদুরস্ত অভিন্ন ধরনের কাপড় পরে তারা একসাথে মসজিদে আসে, একসাথে তওয়াফ করে, সবসময় একত্রে থাকে। যেন কোনো সুনিয়ন্ত্রিত সামরিক বাহিনী! তাদের নিয়মতান্ত্রিকতা দেখে নিজেদের খুব লাগাম ছাড়া uncivilized মনে হয়।

আমাদের দেশ থেকে যারা প্রথমবার হাজ্জে যায়, তাদের হতচকিত ভাব কেটে উঠতে বেশ কিছু দিন লেগে যায়, তা তারা শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক। কারণ শিক্ষিতরাও অনেকে হাজ্জের নিয়ম-কানুন সঠিক ভাবে না জেনে হাজ্জে চলে আসে। কেউ আবার ভাবে এত শিখে কী হবে, পাশের মানুষ থেকে অথবা দলপতি কিংবা হাজ্জ গাইড থেকে দেখে দেখে হাজ্জ করে নেয়া যাবে। কিন্তু, না আমাদের বেশিরভাগ হাজ্জ গাইডরা হয় সুশিক্ষিত, আর না আমরা হই প্রশিক্ষিত। যার ফলাফল হিসাবে আমাদেরও দূর থেকে দেখলেই চেনা যায়, তবে অবশ্যই আমাদের আর ইন্দোনেশিয়ানদের দূর থেকে চেনা যাবার কারণ আক্ষরিকভাবেই সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের চেনা যায় কোলাহলপ্রিয়তা, অপরিচ্ছন্নতা, শৌচাগার ব্যবহারের নিয়ম না জানা অথবা অনিয়মতান্ত্রিক আচরণ করার মতো নেতিবাচক কারণে।

আমরা সুতি কাপড় নেবার ফলে অতি দ্রুত কাপড় তার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে ও পুরনো কাপড় সদৃশ হয়ে যায়। কিছু হাজ্জ এজেন্সি তার যাত্রীদের একই ধরনের কাপড় দেয়, তবে সেসব এতটাই নিম্নমানের হয় যে তার চেয়ে না দিলেই ভালো করতো। এক্ষেত্রে অনেকে বলতে পারেন, বাংলাদেশ অতি দরিদ্র দেশ, আমাদের পক্ষে এত বিলাসিতা করা কী করে সম্ভব। সবাই এক্ষেত্রে একটা কথা ভুলে যান, হাজ্জে যাবার আগে নিদেনপক্ষে কয়েক লাখ টাকা সরকারকে অথবা এজেন্সিকে দিতে হয়, যার মাঝে অনেকের টাকা সমগ্র জীবন ধরে তিলে তিলে জমানো সঞ্চয়। আমাদের দেশের হাজ্জ যাত্রীদের আর কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিতে সরকারের নিজস্ব কোনো খরচ হবার কথা নয়। বরং হাজিদের নিজেদের অর্থ দিয়েই তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে, এখানে প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার।

আবার বিমানের গল্পে ফেরত আসি। বিমানের ব্যাপারে শত অভিযোগ থাকলেও, তাদের একটি বিষয় ভালো। তা হলো খাবারের মান। কিছুক্ষণ পর পর বিমান বালারা সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশন করতে লাগলো। যাত্রীরা অধিকাংশই ইহরামের নিয়ত করে ফেলেছে, তাই খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো। এর মাঝে আসর ও মাগরিবের সালাত সকলে তায়াম্মুম করে প্লেনে আদায় করে নিয়েছে।  আমরা সাথে করে তায়াম্মুমের মাটি এনেছিলাম। কিন্তু বিমান বালারা বড় একতাল মাটি দিয়ে জনে জনে গিয়ে সবাইকে তায়াম্মুম করার ব্যবস্থা করে দিলো।

বারবার বলা হলো, কেউ যেন প্লেনে পানি খরচ করে ওজু না করেন। কারণ, প্লেনের টাঙ্কিতে সীমিত পানি ধারণ থাকে। ওযুতে পানি খরচ করে ফেললে প্রয়োজনে পানি পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্লেনে ওঠার কিছুক্ষণের মাঝে বাথরুমের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেলো। শোচনীয় অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে রুচিতে লাগছে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি কথা আবার মনে হলো, অন্তত শৌচাগার ব্যবহারের নিয়ম নিয়ে সবাইকে ট্রেনিং দেওয়া অবশ্যই দরকার ছিলো। কারণ, কেউ স্বেচ্ছায় টয়লেট অপরিচ্ছন্ন করছে না। যা হচ্ছে তা পুরোটাই অজ্ঞতাপ্রসূত।

এদিকে আমরা দু’জন মিকাতে পৌঁছবার জন্য বসে আছি। ভয়ে আরাম করে ঘুমাতে পারছি না, যদি মিকাত অতিক্রমের সময় ঘুম থাকি, আর ইহরামের নিয়ত না করে জেদ্দা পৌঁছে যাই, তাহলে দম (হাজ্জে ভুল করলে যে কোরবানি দেওয়া হয়) দিতে হবে। নিজ দেশ থেকে ইহরামের নিয়ত করলেও সেই নিয়ত গ্রহণযোগ্য হয়, তাই অনেকে দেশের বিমানবন্দর থেকে ইহরাম বেঁধে ফেলেন। কিন্তু আমাদের নবীজীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নত হলো মিকাতে পৌঁছে নিয়ত করা। তাই আমরা ভাবছিলাম, কী দরকার কোনো সুন্নত পালনের সুযোগ পেয়ে তা হাতছাড়া করার! তাই মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধাই উত্তম।

মিকাত হলো কাবার চতুর্দিকের দূরত্ব পরিমাপ করে নির্ধারিত করা মোট ৫ টি স্থান। হাজ্জ ও উমরাহ্‌ যাত্রীরা এই জায়গাগুলোতে এসে ইহরাম বাঁধেন। বাংলাদেশী যাত্রীদের জন্য মিকাত হলো ইয়ালামলাম নামক একটি স্থান। ঢাকা থেকে জেদ্দা ৭ ঘণ্টার যাত্রা, জেদ্দায় নামার ২০-২৫ মিনিট আগে প্লেন মিকাত অতিক্রম করবে। তাই আমরা অ্যালার্ম দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

জেদ্দায় নামার অল্পসময় পূর্বে পাইলট ঘোষণা করলেন আর কিছুক্ষণের মাঝে আমরা মিকাত অতিক্রম করছি। তখন আমরা ইহরাম বাঁধলাম, “লাব্বাইকা উমরাতান” বলে। তিনভাবে হাজ্জ করা যায়। আমরা তামাত্তু হাজ্জ করতে চাই। হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুল (সাঃ) এর নিজেরও এই প্রকারের হাজ্জ করার ইচ্ছা ছিলো। অবস্থার প্রেক্ষিতে করতে পারেননি।  হাজ্জে তামাত্তুতে প্রথমে উমরাহ্‌ করতে হয়, তারপর ইহরাম মুক্ত হয়ে আবার হজ্জের সময় ইহরাম বাঁধতে হয়। তাই আমরা কেবল উমরাহ্‌র নিয়ত করলাম। নিয়ত করার পর বেশ কিছু নিয়ম মানতে হবে উমরাহ্‌ শেষ করার আগ পর্যন্ত। যেমন নখ কাটা যাবে না, খাবারে বা শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না, কোনো পশুপাখি হত্যা করা যাবে না, কারো সাথে দুর্ব্যবহার করা যাবে না, মেজাজ যতই খারাপ হোক না কেন!

তার চেয়ে বড় কথা এখন থেকে আমাদের তালবিয়া পাঠ করতে হবে। তালবিয়া হলো এমন কিছু শব্দ, যেগুলো উচ্চারণ করলে আবেগে একজন মুসলমানের শরীর কাঁপতে থাকে, অশ্রু সংবরণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। উমরাহ্‌র নিয়ত করে মিকাত অতিক্রম করার সাথে সাথে কাবা ঘর নজরে আসার আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে হয়।

তালবিয়া হলো-

“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়া নি’মাতা, লাকাওয়াল মূলক, লা শারিকালাকা, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।”

তালবিয়ার অর্থ হলো-

“আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ্‌। আমি হাজির হয়েছি, (তোমার ডাকে)। নিশ্চয় তোমার কোনো শরীক নেই, নিশ্চয় তুমি সকল প্রশংসা, নিয়ামত এবং সমগ্র জাহানের মালিক এবং তোমার কোনো শরীক নেই।” এভাবে আল্লাহ্‌র একত্ববাদের ঘোষণা দিতে দিতে হাজির হতে হয় কাবার সামনে।

এতদিন “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক……লা শারিকালাকা”- বাক্যসমূহ শুধু টিভিতেই শুনেছি। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্‌ আজ প্রাণ খুলে নিজ মুখে  বলতে পারবো “ইয়া আল্লাহ্‌ আমি হাজির, আমি হাজির, আমার সমগ্র সত্ত্বা নিয়ে আমি হাজির। আপনার ইবাদতে হাজির!” বিশ্বাস হচ্ছিলো না আর অল্প কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। মাত্র আর অল্প কিছুক্ষণ! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, “হে আমার আল্লাহ্‌! আমি হাজির হয়েছি।” ছেলেদের জন্য জোরে তালবিয়া পড়ার নিয়ম, কিন্তু মেয়েদের পড়তে হয় অনুচ্চস্বরে। তাই আস্তে আস্তে পড়ছি। থাক, জোরে পড়ি আর আস্তে পড়ি যাকে শোনাতে চাচ্ছি তিনি তো নিশ্চয় শুনবেন।

প্লেন থেকে জেদ্দা দেখা যাচ্ছে। অসম্ভব আলোকোজ্জ্বল সাজানো গুছানো ঝলমলে একটি শহর। মনে হচ্ছে পুরো শহরটাই একটি বিয়েবাড়ি, শহর জুড়ে সোনালী বাতি ঝকমক করছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এখন বাংলাদেশ সময় রাত বারোটার মতো, শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করেছে, কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি রাত মাত্র নটা বাজে (সৌদি সময় অনুযায়ী)।

মাঝপথে

সবাই এখানে এশার সালাত আদায় করে নিলো। সবার ওযু ও প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের পর কীভাবে যেন এয়ারপোর্টের টয়লেটে ছোটখাটো বন্যার সৃষ্টি হলো। অর্থাৎ, সবাই মিলে পানি ছড়িয়ে স্থানটি বরবাদ করে দিলো। আমাদের সবার কিছু বিষয় সর্বদা স্মরণে রাখা উচিত। প্রথমত, হাজ্জে যাবার পর যে কোনো নতুন জায়গায় গেলে বাথরুম পরিচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় ওযু করা ও ফ্রেশ হয়ে নেয়া উচিত এবং পরবর্তীজনের ব্যবহারের উপযোগী করে তারপর বের হওয়া উচিত। এই উপদেশ (আমি সহ) আমাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য।

এশার সালাতের পর সবাই বসে আছি কখন বের হতে পারবো এই আশায়। মক্কার এত  কাছে এসে এমন আটকে যাবো তা কেউ ভাবিনি। এয়ারপোর্টের ভিতর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা এসির বাতাস। আমরা প্রথম দিকের ফ্লাইটে এসেছি, তাই সব এখনো খালি খালি। কাউন্টারগুলো হাহাকার করছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে এয়ারপোর্টের লোকজন ঠিকমতো জবাব দিতে পারছে না। কখন কাউন্টারে লোক আসবে, কখন আমাদের কাগজপত্র ভেরিফাই করে আমাদের বের হতে দেবে, তার কোনো ঠিক নেই। সৌদিতে এয়ারপোর্টের চারটি টার্মিনাল। এর একটি টার্মিনাল শুধু হাজ্জের সময় হাজ্জযাত্রীদের জন্য ব্যবহার করা হয়। সারা বছর খালি থাকে। এ সময় সাময়িকভাবে তারা কাজ করার জন্য বোধহয় যেখান থেকে পারে মানুষজন ধরে ধরে নিয়ে আসে। তাই এখানে বেশিরভাগ কর্মচারীরা চূড়ান্ত অদক্ষ। তারা নির্বিকার হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা যে এতগুলো মানুষ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে অনির্দিষ্ট সময় ধরে বসে আছি, এতে তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।

গরমের দেশে আসবো বলে কেউ শীতের কাপড় আনিনি। এখন মনে হচ্ছে একটা শাল অন্তত আনা উচিত ছিলো। কয়েক ঘন্টা শীতে অস্থির হয়ে যখন আমাদের পাগল পাগল দশা, তখন আমাদের বলা হলো লাইনে দাঁড়াতে। সে এক সুদীর্ঘ লাইন। হাজ্জ করতে আসলে অসংখ্যবার এমন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এয়ারপোর্টে, বাসে বা ট্রেনে ওঠার সময়, লিফটে, এস্কেলেটরে, মসজিদে প্রবেশের দরজায়, খাবারের দোকানের সামনে,  টয়লেটের সামনে, যখন সরকার থেকে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হয় সেই খাবার গাড়ীর সামনে, আরাফাতের ময়দানে, মিনায়, মুজদালিফায়, হোটেলের নিচে, দোকানে … এক কথায় কারণে-অকারণে লাইনে দাঁড়াতে হয়।

সেই লাইন আবার কোনো স্বাভাবিক লাইন হয় না। অধিকাংশ সময় তা হবে ধাক্কাধাক্কি, ক্লান্তি, মানুষের বিরক্তি প্রকাশমূলক কথোপকথন ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ। এর মাঝে আবার অতি অস্থির কেউ যদি থাকেন, তিনি দেখা যাবে এত ঝামেলার মাঝে চাটনিস্বরূপ আশে পাশে কারো না কারোর সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দেবেন। অথচ এই লাইনে দাঁড়ানোর সময়টাকেও চাইলে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে কাজে লাগানো যায়। বুদ্ধিমানদের দেখা যায়, তাঁরা সুযোগ পেলেই ওযু করে নেন এবং ছোট পকেট কোরআন বের করে লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে বসে তিলাওয়াত করতে থাকেন। চাইলে কেউ অর্থ পড়তে পারেন আবার মুখস্থও করতে পারেন।

কোরআন তিলাওয়াত বা কোনো ইসলামিক অডিও লেকচার শুনে খুব productive ভাবে এই সময়গুলো কাটানো যায়। এ ধরনের অপেক্ষার সময়ে সবচাইতে পরিশ্রমহীন ভাবে যে অসীম বরকতময় কাজটি করা যায়, তা হলো আল্লাহ্‌র জিকির করা। হাজ্জ যাত্রার পুরো সময়টাই ইবাদতের সমতুল্য। তাই লাইনে দাঁড়ানোকে সময়ের অপচয় বা বিরক্তি উদ্রেককারী কর্মকাণ্ড হিসাবে না নিয়ে হাজ্জযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিলে পুরো ব্যাপারটি সহজতর হয়ে যায় ও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া যায়। এর মানে এই নয় যে আমি সব সময় অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি অথবা প্রতিটি মুহূর্তকে উৎপাদনশীলতার সাথে ব্যবহার করেছি। তবে অন্যদের দেখে এবং নিজের বিভিন্ন ভুলত্রুটির মাধ্যমে যেসব উপলব্ধি করেছি, উপরে শুধু তার উল্লেখ করেছি মাত্র।

এদিকে জানি না কতক্ষণ আমরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। বাংলাদেশি সময়ে এতক্ষণে মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়েছে। সকলে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরে মুক্তির প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান। আর কাউন্টারের লোকগুলো এমন অদক্ষ যে, তারা পাসপোর্টের কোনদিকে সিল মারতে হবে তা-ই বুঝতে পারছে না। বেকুব বেকুব চেহারা নিয়ে একবার পাসপোর্টের দিকে আর একবার একজন অন্য জনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। যাহোক, অনেকক্ষণ এই সব কাহিনী করে তারা আমাদের অবশেষে মুক্তি দিলো। এয়ারপোর্টের বাইরের টার্মিনালে এসে আমরা মালপত্র নিয়ে বসলাম। শুরু হলো মক্কা যাবার বাসের জন্য প্রতীক্ষা।

এতক্ষণ শীতে আমরা জমে যাচ্ছিলাম আর এখন গরমে সবার নাস্তানাবুদ অবস্থা। বাইরের টার্মিনাল বা যাকে বলা হয় বাংলাদেশ প্লাজা, সেখানে কোনো এসি নেই। সারাদিনের ধকলে সবাই যে যেখানে পারছে বসে পড়েছে। অনেকে শৌচালয়ের সামনে লাইন লাগিয়েছেন। যারা আরবী বোঝে না, তাদের জন্য টার্মিনালের বাথরুমের সামনে ‘মহিলা’ কথাটি ছবি দিয়ে বোঝানো হয়েছে। তা দেখার পরও পুরুষগুলো মহিলাদের  বাথরুমে ঢুকে পড়ছে। বাঙালি পুরুষ মানুষের এই সমস্যাটি আমি আরো অনেক জায়গায় দেখেছি। হাজ্জ করতে এসেও তারা মহিলাদের সাথে তাদের পর্দার সম্পর্ককে সম্মান দেখাতে চায় না! আমি অনেককে বলার চেষ্টা করলাম এটা মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করা এলাকা। কিন্তু কত জনকে বলবো? এত বড় করে দরজার উপর ছবি থাকা সত্বেও কেন এরা চোখে দেখে না বুঝি না।

মদিনাতেও দেখেছি হোটেলে মেয়েদের টয়লেটে ছেলেরা ঢুকে পড়ছে। প্রথমে আমি ভাবতাম এরা না বুঝে এমন করছে। জীবনে প্রথমবার বিদেশে এসেছে, এসব শহুরে কায়দার সাথে পরিচিত নয়। কিন্তু এক পর্যায়ে খেয়াল করলাম এদের ভুল ধরিয়ে দিলে তারা অপমানিত বোধ করে এবং অনেককেই বলার পরও নিতান্ত অবজ্ঞার ভাব দেখিয়ে আবার মহিলাদের টয়লেটেই ঢুকে পড়ে। যারা না বুঝে করে, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা বলার পর পুনরায় একই কাজ করে, তাদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এরকম ন্যূনতম সিভিক সেন্সের অভাব মানুষের কী করে হয়, ভাবতে অবাক লাগে! মদিনাতে একবার আমি এ ব্যপারে হোটেলের রিসেপশনেও কমপ্লেইন করেছিলাম।

এসব ব্যাপারে অনেকের সিভিক সেন্সের সাথে সাথে কমন সেন্সের অভাবটাও বেশ চোখে পড়ে। হোটেলের রুমে আমরা কয়েকজন মহিলা এক সাথে থাকতাম। পুরুষদের রুমে কয়েকজন পুরুষ এক সাথে থাকতেন। তারা আমাদের কামরায় যখন যার যার স্ত্রীর খোঁজে আসতেন, তখন অনেকেই ভুলে যেতেন যে এই রুমে অন্যদের স্ত্রীগণও থাকেন এবং এই মহিলারা তাঁদের সাথে পর্দা করেন। প্রায়ই তাঁরা অন্যান্য মহিলাদের মাথায় ঠিকমতো কাপড় দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই রুমে ঢুকে পড়তেন এবং এঁরা সবাই সমাজের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত শিক্ষিত ভদ্রলোক! এই ভদ্রলোকদের কিছু বলতে হলে, অনেক চিন্তা ভাবনা করে কৌশলের সাথে বলতে হয়। কারণ, স্বামীদের কিছু বললে পাছে যদি তাদের অর্ধাঙ্গিনীরা মাইন্ড করেন!! দরজায় ধাক্কা দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর যে প্রবেশ করতে হয়, সব পুরুষগুলোকে এই সাধারণ জিনিস বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো!!

দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে বাস আসলো। তারপর আরো অনেকক্ষণ ধরে বাসের উপর মাল উঠানো হলো। শেষ পর্যন্ত লাগেজ উঠানো কখন শেষ হলো জানি না, আমি ততক্ষণে বাসের ভিতর এসি পেয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি। সবাই এত বিধ্বস্ত, কাল মক্কায় পৌঁছে মাত্র উমরাহ্‌ করা কীভাবে সম্ভব হবে জানি না। পুরো যাত্রায় এত ক্লান্ত হইনি যতটা হয়েছি জেদ্দায় বসে থেকে। কিন্তু সব কিছুর ভেতর অবশ্যই ভালো কিছু অন্তর্হিত থাকে, তা পরে বোধগম্য হয়।

ঘুম ভাঙলো যখন, তখন সকাল। মক্কায় সীমানার ভেতর পৌঁছে গেছি। চারিদিকে ভয়ঙ্কর রুক্ষতা। দূরে সারি বাঁধা পাথুরে পাহাড়। মাঝে মাঝে ধুলা বিজড়িত শীর্ণ তরুলতা দেখা যাচ্ছে। এই মরুদেশের সীমাহীন শুষ্কতার মাঝে দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সংখ্যায় অল্প বৃক্ষসমূহ যেন নিদারুণ করুণার পাত্র। তারা তাদের সকরুণ অস্তিত্ব নিয়ে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকে যেন এই অন্য পৃথিবীতে। এখানে প্রকৃতি এক সুকঠিন রূপ নিয়ে বিদ্যমান। কাবা ঘর যদি না থাকতো, তাহলে শুধুমাত্র বেড়ানোর জন্য এই দেশে কখনোই কেউ আসতো বলে মনে হয় না।

কিন্তু আল্লাহ্‌র কী অনুপম ইচ্ছা, এমন স্থানেই তিনি কাবা ঘর নির্মাণ করান। এর ফলে মক্কা পরিণত হয় পৃথিবীর যাবতীয় মুসলমানের প্রাণকেন্দ্রে এবং ধীরে ধীরে মক্কা রূপান্তরিত হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন শহরে। মক্কা যদি অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার হতো, তাহলে কাবা ঘরের গুরুত্বের সাথে সেই সব প্রাকৃতিক রূপ দেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ মক্কা আসার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কিন্তু আল্লাহ্‌র হয়তো ইচ্ছা, উনার ঘরে মানুষ কেবলমাত্র উনার ইবাদতের জন্যই আসবে। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা উনিই জানেন, তাঁর জ্ঞান বা কুদরত বোঝার শক্তি আমাদের নেই।

প্রাচীন কালে মক্কার আবহাওয়া শিশু প্রতিপালনের জন্য উপযোগী ছিলো না, যে কারণে রাসুল (সাঃ) এর সময়ে অত্র এলাকায়  শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে দুধ মাতাদের কাছে প্রতিপালিত হবার জন্য দিয়ে দেওয়া হতো। এতদিন আমার কাছে এই ব্যবস্থাটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনে হলেও, আজ বুঝতে পারছি কেন এমন করা হতো। এরকম পরিবেশে নিশ্চয় সে সময়ের অভিভাবকগণ তাঁদের সন্তানদের বড় করতে চাইতেন না। যদিও এখনের কথা ভিন্ন। অভাবনীয় বিলাস-ব্যসন ও অর্থের মাঝে ডুবে থাকে আরবরা। তাদের ঘরে ঘরে এসি, দামী গাড়ি ইত্যাদি কোনো কিছুর অভাব নেই। তাছাড়া সরকার থেকে পরিকল্পিত সবুজায়নের প্রচেষ্টায় এখন আর মক্কার রুক্ষ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে আরববাসীদের বেঁচে থাকতে হয় না। বরং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়েও আরামে তারা এই নগরে বসবাস করতে পারে।

কাকডাকা ভোরে মোয়াল্লেমের অফিসে বাস থামলো। সকলকে এক বাক্স খাবার দিলো, যা দিয়ে সকালের নাস্তা হয়ে যাবে। আমাদের পাসপোর্ট জমা নিয়ে নিলো যেন কেউ এই দেশে হাজ্জের নাম করে এসে অবৈধ অভিবাসী হয়ে থেকে না যায়। কেউ কেউ নতুন উদ্যোগে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলছে। জেদ্দা থেকে মক্কার দূরত্ব বেশি হলে এক ঘণ্টা। কিন্তু আমাদের পৌঁছতে ৬/৭ ঘণ্টার বেশি লাগলো।

এই সাত সকালে একটা হোটেলের সামনে এসে সবাইকে নামিয়ে দেওয়া হলো বাস থেকে। গাইড বললো ফ্রেশ হয়ে নিতে। একটু পরই আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। উমরাহ্‌ করার আগে কেউ যদি চায়, যাত্রার ক্লান্তি দূর করার জন্য হোটেলে বিশ্রাম করে নিতে পারে। কিন্তু মনে হয় না কারো বিশ্রাম করার মত ধৈর্য হবে। সবাই লাগেজ নিয়ে রুম নাম্বার দেখে যার যার রুমের দিকে রওনা হলো।

আমাদের রুম ছিলো ফিফথ ফ্লোরে। আমার রুমে দুজন মাঝবয়েসি মহিলা আছেন, যাদের একজন সরকারী চাকুরিজীবী ও অপরজন অবসরপ্রাপ্তা সরকারি কর্মকর্তা। আর সাফিরের রুমে এ মহিলাদের স্বামীসহ মোট ৪ জন রয়েছে। আমাদের কক্ষে তিনজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অন্তত নামাজ পড়ার জায়গা আছে। কিন্তু সাফিরদের রুমে সেই জায়গাও নেই। তাও হোটেলওয়ালারা যদি পারত সেখানে আরো একটা খাট ফেলে দিতো। আমাদের রুমের সাথে বাথরুম ভালোই, তবে রুমে আলো বাতাস ঢোকার তেমন ব্যবস্থা নেই। এসির জন্য এখানে জানালা খোলা হয় না। ভারী পর্দায় ঢাকা ছোট জানালাটি সবসময় অব্যবহৃত পড়ে থাকে। বহুদিনের পুরনো এই হোটেলে দিনে-রাতে সব সময় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়, কিন্তু বিছানাটা বড্ড আরামের। পুরু নরম ফোমে গা লাগালে অনাবিল প্রশান্তির ঘুম হতো। মক্কায় নতুন আবাস আমার ভালোই লাগলো।

বাইতুল্লাহর যিয়ারত

আমরা রেডি হয়ে হোটেলের লবিতে নেমে দেখলাম, গাইড অন্যদের নিয়ে ততক্ষণে চলে গেছে কাবার দিকে। যার অর্থ, এই অচেনা দেশে এখন আমাদের নিজেদের পথ খুঁজে বের করতে হবে। চারদিকে দোকানপাট বেশিরভাগের এখনো ঝাঁপ বন্ধ। হাজ্জের সময় এগিয়ে আসলে এই সব দোকান ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। আশে পাশের গলিগুলোর দুপাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা অসংখ্য উঁচু উঁচু দালানকোঠা, একটির গায়ে অন্যটি লাগানো। এক অর্থে শ্রীহীন বলা চলে এদের। সব বিল্ডিংই বিভিন্ন মানের ও দামের হোটেল। আবাসিক এলাকা চোখে পড়লো না।

হারাম শরিফের আশে পাশের এলাকা হলো বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান এলাকা। বিদেশী নাগরিককে কখনো এখানে জমি কিনতে দেওয়া হয় না। শুধু মাত্র সৌদি নাগরিকরা জমি কিনতে পারে। এখানে জমির দাম পৃথিবীতে সর্বাধিক। জমি কেনার পর একচ্ছত্র আধিপত্য কাউকে দেওয়া হয় না। দেশের রাজা যখন দাবি করবে, তৎক্ষণাৎ এই জমি রাজাকে হস্তান্তর করতে জনগণ বাধ্য। যদিও এর বিনিময়ে জমির মালিকদের জমির প্রাপ্য মূল্যের থেকে অনেক বেশি অর্থ দেওয়া হয়। তাই তাদের মনঃক্ষুণ্ণ হবার অবকাশ থাকে না।

সৌদি রাজবংশের অর্থের কোনো অভাব নেই। এর ফলে দেখা যায়, একদম আনকোরা, মাত্র কিছুদিন আগে গড়ে ওঠা কোনো বিল্ডিং যখন খুশি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলা হয়। অতঃপর রাজ পরিবারের পছন্দ অনুযায়ী আবার নতুন করে কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়। তাই প্রতিনিয়ত এখানে চলতে থাকে ভাঙ্গা গড়ার খেলা।

বর্তমানে কনসট্রাকশনের কাজ জোরেসোরে চলছে। কারণ, হারাম শরীফের চতুর্দিকে প্রায় মাইলখানেক পরিসীমায় যত শত শত দালান কোঠা আছে, তার সব ভেঙে ফেলা হবে। আমাদের হোটেলটিও এই তালিকায় আছে। পুরাতন দালানগুলোর স্থলে পরিকল্পিতভাবে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন হোটেল নির্মিত হবে। বড় বড় বিল বোর্ডে ভবিষ্যতের স্থাপনার গ্রাফিক্সের ছবি দেওয়া আছে। ইনশা আল্লাহ, আর কয়েক বছর পর যারা হাজ্জে আসবেন, তাঁরা নিজেদের আবিষ্কার করবেন বিশ্বের অন্যতম আধুনিক এক জনপদে।

আরবী জানি না দেখে রাস্তায় একজন লোককে মুখের ভাষা ও ইশারার ভাষা মিলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম  হারাম শরীফ কোন দিকে। তখন তো আর জানতাম না এখানে বাঙালির কোনো অভাব নেই। বিশেষত সব দোকানে, রেস্তোরাঁয়, রাস্তাঘাটে এত বেশি পরিমাণে চট্টগ্রামের মানুষ যে, হঠাৎ করে কেউ যদি মনে করে সে মক্কায় না বরং চিটাগাঙে চলে এসেছে, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হতো চাটগাঁর ভাষাকে মনে হয় মক্কার 2nd language হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে।

আমরা চারপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। এখানেও কেমন একটা রুক্ষতার ছাপ। সবুজের বড় অভাব। প্রখর রৌদ্রতাপ উপেক্ষা করে মানুষ ছোট ছোট দলে অথবা একা একা হারাম শরীফের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকের পরনেই ইহরামের কাপড়। রাস্তার এক পাশের চত্বরে প্রচুর জালালী কবুতর। তারা মানুষকে ভয় করছে না মোটেও। বরং চত্বরের ধারে প্যাকেট করা কবুতরের খাবার বিক্রি হচ্ছে। সওয়াবের আশায় মানুষ সেই খাবার কিনে কবুতরের ঝাঁকের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। রোদ হতে রক্ষা পাবার জন্য ছাতাগুলো খুলে নিলাম আমরা দুজন। প্রচন্ড রোদ হওয়া সত্বেও আর্দ্রতার অভাবে ঘাম হচ্ছিলো না সেরকম।

দূর থেকে হারাম শরীফের মিনার দেখা যাচ্ছে। আমার ধারণা ছিলো, অনেক দূর থেকে কাবা ঘর দেখা যায়। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, কাবা ঘরের চারদিকে মসজিদ ও মসজিদের চারদিকে একাধিক ৫ তারা হোটেল। এইসব হোটেলের বাসিন্দারা হোটেল থেকে নামলেই হারাম শরীফের চত্বরে ঢুকে পড়তে পারে। তাই দূর থেকে দেখলে দেখা যায় মক্কা টাওয়ার ও হোটেল হিলটনের মত সুউচ্চ সব দালানকোঠা।

উঁচু উঁচু দালানের পাশ দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম। আমাদের হোটেল থেকে কাবা প্রায় ১ কি.মি. দূরে। ১৫/২০ মিনিটের মতো লাগে পৌঁছাতে। কম্পিত হৃদয়ে ও কম্পিত কণ্ঠে লাব্বাইক আল্লাহ্‌ বলা শুরু করলাম। সারা জীবন যে দিকে মুখ করে সিজদা করেছি, অবশেষে আল্লাহ্‌ আমাদের সেখানে নিয়ে এসেছেন। আজকের দিনটা কি আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি নয়? সারা জীবন সিজদায় পড়ে থাকলেও কি এখানে আসতে পারার জন্য পর্যাপ্ত শুকরিয়া আদায় করা সম্ভব?

মসজিদের বাইরের দিকে মেয়েদের ওযু করার স্থানে ওযু করে নিলাম। জুতাগুলো শেলফে রেখে মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। মসজিদের প্রায় কোয়ার্টার কি.মি. আগে থেকেই হাল্কা কিন্তু সুমিষ্ট এক সুগন্ধে মন ভরে যাচ্ছিলো। এখানে এসে বুঝলাম হারাম শরীফ এই সুবাসের উৎস। অনেকটা ধুপ জ্বালিয়ে যে পদ্ধতিতে ধোঁয়া দেয়, এখানের কর্মীবাহিনী সেভাবে মসজিদের ভেতর মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত ধোঁয়া দিয়ে সুবাসিত করে রাখেন। আরব দেশসমূহে ঘরে অতিথি আসলে তাদের এই সুগন্ধি ধোঁয়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়।

অদ্ভুত আলো ঝলমলে দিন ছিলো সেদিন। আশেপাশের পরিবেশ যেন পবিত্র এক উজ্জ্বল নূরে আচ্ছাদিত ছিলো। সুবিশাল এই মসজিদের অভ্যন্তরের পরিচ্ছন্নতার বর্ণনা কিংবা এই ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ পবিত্র আবহের বর্ণনা দেবার জন্য উপযুক্ত বাক্যাবলী আমার সীমিত শব্দভাণ্ডারে নেই। যেন সর্বত্র এক চাপা আনন্দের উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা। এ বিশ্বের পঙ্কিলতা থেকে যোজন যোজন দূরে, আশ্চর্য মহিমায় উদ্ভাসিত এই হারাম সীমানা। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন, অবশ্যই এই পবিত্র কাবা এক আশিসপ্রাপ্ত গৃহ। এমন প্রশান্তিময় পরিবেশ এ ধরনীতে আর কোথাও কি আছে? এখানেই এমন হলে, না জানি জান্নাতে কেমন!! না জানি সেখানে আরো কত শান্তি, সৌন্দর্য, আনন্দ ও পবিত্রতা।

সবাই এখানে এক অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। আর তা হলো আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন। রব্বের প্রতি নিখাদ ভালবাসা এখানে বাঁধভাঙা। বাইরে যেমন তীব্র খরতাপ, মসজিদের ভেতর তেমন শান্তি আর আরামদায়ক শীতলতা। মেঝেতে নরম কার্পেট, সিলিঙে অগুনতি স্ফটিক-সম ঝকমকে ঝাড়বাতির আলোতে ও এসির সুশীতল হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ক্লান্তি যেন পরিণত হয় সুদূর পরাহতে। মসজিদে কিছুদূর পর পর দেখা যাচ্ছে, নামাযীরা রাকাতের পর রাকাত নফল নামায পড়ছে। এখানে প্রতি রাকাত নামাযের সওয়াব বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্তে আদায় করা নামাযের চেয়ে এক লাখ গুণ বেশি। আমরা মসজিদে প্রবেশ করেই আগে দু রাকাত সালাত আদায় করলাম। যেকোনো মসজিদে প্রবেশের পর দু রাকাত সালাত আদায় করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন মসজিদে বসে পড়ার আগেই এই সালাত আদায় করে নিতে।

তখন প্রায় এগারটার মতো বাজে। কিছুক্ষণ পর যোহরের আযান হবে। তাই আমরা ঠিক করলাম, এখন তওয়াফ করে যোহরের পর উমরাহর বাকি কাজ সম্পন্ন করবো। উমরাহ্‌র কাজগুলো হলো যথাক্রমে তাওয়াফ করা, দু রাকাত তাওয়াফের সালাত আদায় করা, সাফা-মারওয়া সা’ঈ করা ও সব শেষে ছেলেদের মস্তক মুণ্ডন করা বা মেয়েদের ক্ষেত্রে চুলের নিম্নভাগের অল্প অংশ কর্তন করা।

মসজিদুল হারামের বিশালত্ব স্বচক্ষে না দেখলে আন্দাজ করা অসম্ভব। নয় লাখ নামাজী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ মসজিদে হাজ্জের সময় অতিরিক্ত আরো চার লক্ষ নামাজীর স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে প্রবেশ করার গেটের সংখ্যা পঁচানব্বইর অধিক। এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হাঁটতে গেলে পা ব্যথা হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। আর কাবা ঘর পর্যন্ত যেতে হলে মসজিদের ভেতরে বেশ কিছুদূর যেতে হয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর কাবা ঘরের হালকা আভাস চোখে পড়লো। আরো কিছুটা সামনে গেলে পুরো কাবাই নজরে চলে এলো।

কালো সিল্কের উপর সোনালী সুতার কাজ করা কাবা ঘর আমার একদম চোখের সামনে!! সত্যি সত্যি আমরা এখানে!! চর্মচক্ষুতে কাবা প্রথম দেখার অনুভূতি একেক জনের একেক রকম, কেউ আবেগে উদ্বেলিত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে, কারো অনুভূতি অবশ হয়ে যায়, আবার কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। এ পবিত্র গৃহের সামনে নিজের অস্তিত্বের উপস্থিতির সত্যতা বিশ্বাস করাটাই যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! কাবার প্রতি ভালবাসা আর আবেগ তীব্র ভাবে বোঝা যায়, যখন দেশে ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসে অথবা বিদায়ী তওয়াফের পর কাবার সীমানা ছেড়ে চলে আসার পরে কিংবা স্বদেশে প্রত্যাগমনের পর যখন হৃদয় জুড়ে এক অদ্ভুত শূন্যতার হাহাকার সৃষ্টি হয়।

সাফির ও আমি তওয়াফের জায়গায় চলে এলাম। উমরাহ্‌ ও হাজ্জের অন্যতম ফরয কাজ হলো এই তওয়াফ করা। এছাড়া অন্যান্য সময়েও লোকে প্রচুর নফল তওয়াফ করে। প্রতিটি নফল তওয়াফের সওয়াব, দাস মুক্তির সওয়াবের অনুরূপ। কাবাঘরকে ঘিরে সাতবার চক্কর দেওয়াকে তওয়াফ বলে ও তওয়াফের জায়গাকে মাতাফ বলে। মাতাফের মাটি তাপ নিরোধক শুভ্র টাইলসে মোড়ানো যা প্রচন্ড উষ্ণ তাপমাত্রাতেও কখনো গরম হয় না। যেহেতু জুতো পরে মাতাফে আসা যায় না, তাই তওয়াফকারীদের গরমে কষ্ট না হবার জন্য এ বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগের কালে তওয়াফ করার সময় তপ্ত বালুতে পা রেখে না জানি কত কষ্ট করতেন মুসল্লিরা!!

আমরা যখন পৌঁছেছি, তখন হাজ্জের প্রায় মাসখানেকের বেশি বাকি। এই সময়টায় ভীড় খুব কম থাকে। পরবর্তী সময়গুলোর তুলনায় অকল্পনীয় দ্রুততায় আমাদের তওয়াফ হয়ে গেলো। যখন ভীড় শুরু হয়ে গিয়েছিলো, তখন তওয়াফের এক চক্কর দিতে মানুষের ভীড়ে চিড়ে চেপ্টা হয়ে যাবার জোগাড় হতো। কিন্তু আজ অল্প সময়ের মাঝেই তওয়াফ শেষ হয়ে গেলো। তারপর দেখলাম হাজরে আসওয়াদে (কালো পাথর) চুমু খাবার জন্য গার্ডরা মানুষদের লাইনে দাঁড়া করিয়েছে। আমিও মহিলাদের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তওয়াফ এর প্রতি চক্করে যদি সম্ভব হয় তাহলে এই পাথরে চুমু খাওয়া সুন্নত। আমি প্রতি চক্করের পর না পারলেও তওয়াফ শেষে স্পর্শ করতে পারলাম। একবার অন্তত স্পর্শ করতে না পারলে নিশ্চয় আফসোস রয়ে যেতো মনে।

যেমন ভীড় যখন কম ছিলো, তখন সাফির হাতিমে নামাজ পড়ে নিয়েছিলো। আমি ভেবেছিলাম পরে সুযোগ পাবো হাতিমে ঢোকার। হাতিম হলো কাবা ঘরের সামনের অর্ধ গোলাকৃতি অংশটুকু, যা কি না এক সময় কাবা ঘরের অংশ ছিলো। হাতিমের মাঝে নামায পড়া, কাবা ঘরের ভেতরে নামায পড়ার সমতুল্য। কিন্তু পরবর্তীতে ভীড় বেড়ে যাওয়াতে সে যাত্রায় আমি আর হাতিমে ঢোকার সুযোগ পাইনি। ভাগ্যে না থাকলে কী আর করা। হাজ্জে বা উমরাহ্‌তে আসলে হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া, হাতিমে নামায পড়ার মতো কাজগুলো প্রথম সুযোগেই করে ফেলা উচিৎ। না হলে পরে সুযোগ না-ও পাওয়া যেতে পারে।

তওয়াফের পর সুন্নত হল জমজম কুয়ার পানি পান করা এবং কিছুটা পানি হাতে নিয়ে মাথা একটু ভিজিয়ে দেওয়া। এরকম করা যদি সুন্নত না হতো, তাহলেও হয়তো মানুষ এমনটি করতো। কারণ, এই শুষ্ক এবং রুক্ষ পরিবেশে তওয়াফ করার পর তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়। প্রখর রৌদ্রে মাথায় পানি ছোঁয়ালে শরীর জুড়িয়ে যায়। জমজম কুয়ার পানি দেহ ও মন উভয়ের পরিতৃপ্তি সাধন করে। যতদিন মক্কায় ছিলাম, দেখেছি এখানে কলের পানি দিন রাত ২৪ ঘণ্টা গরম থাকে। কখনো বেশী গরম আবার কখনো কুমকুম গরম। শুধু মাত্র জমজমের পানি আমি কখনোই গরম পাইনি। এই পানি সবসময় তৃপ্তিদায়ক ও ক্লান্তি দূরীকরণে অনন্য।

জমজমের পানি পান করার আগে নিয়ত করে নেওয়া সুন্নত। কারণ, এ সময় যা দুআ করা হয়, তা কবুল হয়। এই পানি আল্লাহ্‌র বিশেষ নিয়ামতের পানি ও সে কারণেই ধরিত্রীর বিশুদ্ধতম পানীয়। তওয়াফের পর মাকামে ইব্রাহীম এবং কাবা ঘরকে সামনে রেখে দুই রাকাত সুন্নত সালাত পড়তে হয়। যদি এখানে জায়গা না পাওয়া যায়, তবে মসজিদের যেকোনো স্থানেই এই সালাত আদায় করা যায়। মাকামে ইব্রাহীম হলো সেই পাথর, যার উপর দাঁড়িয়ে ইব্রাহীম (আঃ) কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন।

সাফা মারওয়ার প্রবেশ পথে বসে পড়লাম জোহরের জামাত ধরার জন্য। জোহরের পর সা’ঈ করা শুরু করলাম। সা’ঈ করার সময় সব সময় মনে রাখতে হবে, এটি একটি ইবাদত এবং অন্যান্য সকল ইবাদতের মতো আল্লাহ্‌কে স্মরণ করাই এই ইবাদতের মূল লক্ষ্য। এ সময় বিবি হাজেরা যেমন কাতর ও বিনয়ী হয়ে দুআ করেছিলেন, সেরূপ ঐকান্তিকতার সাথে দুআ করার চেষ্টা করতে হয় ও আল্লাহ্‌কে অধিক হারে স্মরণ করতে হয়। সা’ঈর সময় কুরআন পড়া, বিভিন্ন দুআ ও জিকির করা যায়।

সাফা-মারওয়া এই পাহাড় দুটো মানুষের হাঁটাহাঁটির ফলে ক্ষয়ে গেছে অনেকটাই। বিবি হাজেরার সময়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আকার ধারণ করেছে এ পাহাড়-দ্বয়। ভাগ্যিস সা’ঈ করার পুরো রাস্তা এখন টাইলস দিয়ে বাঁধানো, তা না হলে সমতল হয়ে যেতো এতদিনে সাফা-মারওয়া। এসির শীতলতায় ভীড়মুক্ত পরিবেশে সহজে আমরা সা’ঈ সম্পন্ন করে ফেললাম। ৭ বার দুই পাহাড়ের মাঝে আসা যাওয়া করতে প্রায় সাড়ে ৩ কি.মি. পথ হাঁটতে হয়। পুরো রাস্তা জুড়ে একটু পরপর জমজমের পানি পানের ব্যবস্থা রয়েছে। কল ছাড়লেই প্রাণ জুড়ানো জমজমের প্রবাহ শুরু হয়ে যায়।

দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি অংশ রমল করে বা দৌড়ে (ছেলেদের জন্য) পার হবার নিয়ম। কারণ, রাস্তার এ অংশ থেকে দূরে রেখে আসা শিশু সন্তান ইসমাইলকে দেখা যাচ্ছিলো না। তাই এই পথ টুকু বিবি হাজেরা ছুটে পার হয়েছিলেন। না জানি কত কষ্ট করে প্রচণ্ড রোদে, পাথুরে রুক্ষ দুই পাহাড়ের মাঝে সন্তানের প্রাণ রক্ষার্থে, সন্তানের মুখে এক ফোঁটা পানি দেবার জন্য পাগলের মতো ছুটে চলেছিলেন তিনি। মায়ের এই মমতাকে আল্লাহ্‌ তা’আলা কত মর্যাদা দিয়েছেন, এই পৃথিবীতে যত মানুষ যত বার হাজ্জ ও উমরাহ্‌ করবেন, প্রত্যেককে এই সাফা মারওয়ার একপাশ থেকে অন্য পার্শ্বে বার বার সা’ঈ করতে হবে।

সা’ঈ করার সময় কেন যেন আমার মায়ের কথা বার বার মনে পড়ে যায়। বিবি হাজেরার সাথে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ তুলনীয় না হলেও, আমার  বিধবা মা-ও তো উনার মতো ছুটে চলেছেন সারা জীবন, তাঁর দু সন্তানকে মানুষ করার জন্য। কত কষ্ট, কত ব্যথা, কত ধৈর্যের পরীক্ষা তিনি দিয়েছেন, তার প্রতিদান আমরা কখনোই দিতে পারবো না। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র পক্ষেই সম্ভব এর উত্তম প্রতিদান দেওয়া। হতে পারে সা’ঈ করার অনেক রকম তাৎপর্য আছে, কিন্তু আমার কাছে সা’ঈ করাকে মনে হয়েছে এ যেন সন্তানদের জন্য মায়েদের অসামান্য ত্যাগের এক জ্বলন্ত প্রতীক।

উমরাহ্‌ করার পর সাফির নিয়মানুযায়ী মাথা ন্যাড়া করে ফেললো। ওকে এই প্রথম আমি ন্যাড়া মাথায় দেখলাম। ন্যাড়া মাথায় সানগ্লাস পরে ওকে যা একখান লাগছিলো, সে আর কী বলবো! কিন্তু এখানে যেহেতু সকল হাজ্জযাত্রী পুরুষদের টাক মাথা, অথবা খুলি আঁকড়ানো ছোট ছোট চুল, তাই কিছুক্ষণের মাঝে চোখে সয়ে গেল। এবং মজার ব্যাপার হলো, আমাদের যত পুরুষ হাজীর সাথে সেখানে পরিচয় হয়েছে, তাদেরকে কখনো দেশের রাস্তাঘাটে দেখলে সহজে চিনতে পারবো কি না সন্দেহ। কারণ, সবাইকে আমরা দেখেছি চুল ছাড়া। তাই চুলসহ তাদের দেখলে নিশ্চয় অচেনা লাগবে, লাগাটাই স্বাভাবিক।

উমরাহ শেষে ইহরাম থেকে মুক্ত হবার জন্য আমিও চুলের আগা থেকে অল্প কিছু অংশ ছেঁটে ফেললাম। সাফির তার ইহরামের কাপড় ছেড়ে ফের সাধারণ বস্ত্র ধারণ করলো।  এর সাথে শুরু হলো হারামাইনের দেশে আমাদের বসবাসের দিনগুলো, রচিত হতে থাকলো  মাসজিদুল হারামকে কাছে পাবার গল্প!

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive