প্রিয় বন্ধু, তুমি কি ব্যস্ত? আমার কিছু কথা শোনার সময় হবে কি? একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখবে কি? সময় করে একবার পড়েই দেখো না! তোমাকে যে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলার সুযোগ পাইনি, সেগুলোই লেখার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না।
বন্ধু, বাল্যকালের কথা মনে আছে? একসাথে স্কুল যাওয়ার কথা? অ্যাসেমব্লিতে দাঁড়ানোর কথা? একসাথে ক্লাস করার কথা? স্যারের কাছে একসাথে মার খাওয়ার কথা? সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলার কথা? বৃষ্টিতে ভেজার কথা? টিফিন ভাগ করে খাওয়ার কথা?
বন্ধু, কৈশোরের কথা মনে আছে তোমার? জাফর ইকবালের বই পড়ার কথা? স্কুল শেষে আড্ডা দেওয়ার কথা? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একসাথে স্টেজে গান গাওয়ার কথা? জন্মদিনে উইশ করার কথা?
কলেজে ওঠার পরেও আমি এমনই ছিলাম। হয়তো খুব একটা এক্সট্রোভার্ট ছিলাম না। তারপরও একেবারে যে কারো সাথে মিশতাম না, এমনও ছিলাম না। তখনও তোমার জন্মদিনে আমি উইশ করতাম। তখনও হুমায়ূন আহমেদের বই পড়তাম, তোমাকেও পড়তে দিতাম। কিশোর কুমারের গান শুনতাম, গাইতাম। শাহরুখ খানের সিনেমা দেখতাম। তোমার সাথে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যেতাম। এভাবেই চলছিলো।
কিন্তু হঠাৎ কী যেন হলো। হঠাৎ করেই তুমিই দেখতে পেলে, আমি যেন অনেকটা বদলে গেছি। আমি আর আগের মতো জন্মদিনে উইশ করছি না। আর আগের মতো গান গাইছি না। বরং ক্লাস শেষে প্রথমেই মাসজিদের দিকে ছুটছি। তোমাকেও ডাকছি। একসময় দেখা গেলো, প্যান্টটাও টাখনুর উপরে উঠে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই এসব খেয়াল করেছো।
কেন এত কঠোরতা সে প্রশ্ন তোমার মনে আসতেই পারে। কেন আমি এমন কঠিন জীবন বেছে নিলাম সে কথা তুমি ভাবতেই পারো। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো ভাই, আল্লাহ তা’আলা যাকে দয়া করে ঈমানের স্বাদ কিছুটা বোঝার সুযোগ দিয়েছেন, তার কাছে এসব কঠিন নয়। আল্লাহর সাহায্য থাকলে সবই সহজ।
শুধু যে আমিই বদলেছি তা কিন্তু নয়। তুমি খেয়াল করেছো কি না জানি না, তুমি নিজেও অনেক পাল্টেছো। প্রথম যেদিন তোমার হাতে সিগারেট দেখেছিলাম, সেদিন কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না, ভাই। তুমি যখন মেয়েদের সাথে ঘোরাফেরা করো, তখনও আমি কষ্ট পাই। ফেসবুকে মেয়েদের সাথে তোমার ছবি দেখলে বুকভরা কষ্ট নিয়ে তোমাকে আনফলো করা ছাড়া উপায় থাকে না। তুমি যখন নাচ-গানের অনুষ্ঠানে যাও আর আমাকেও ডাকো, তখন আমি শুধু আল্লাহর কাছে তোমার জন্য দু’আ করি। আমার যে আর কিছু করার সামর্থ্য নেই।
ভাই, তুমি বিশ্বাস করো, যে তোমাকে নাচ-গানের অনুষ্ঠানে ডাকে, সে তোমার প্রকৃত বন্ধু নয়। যে তোমার সাথে মুভি দেখে জীবন উপভোগ করে, সে তোমার ভালো বন্ধু নয়। যে তোমাকে মাদকের পথে ডাকে, সে তোমার ভালো চায় না। যে বন্ধুর সাথে থাকলে তুমি নামায পড়তে পারো না, সে বন্ধু তোমার কোনো উপকারে আসবে না। যে মেয়েটা তোমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসার দাবী করে, সে তোমার জাহান্নামের কারণ হতে পারে। ভাই, তুমি বিশ্বাস করো, পুরোপুরি ইসলাম মেনে না চললে দুনিয়া ও আখিরাতের কোথাও শান্তি নেই। ঈমান ও ইসলামের মধ্যেই আছে সাফল্য।
ছোটবেলায় তোমার সাথেই পড়েছিলাম, “ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।” আমাদের সমাজের ভুলের কারণে বাক্যটিকে কেবল বইয়ের পাতা আর পরীক্ষার খাতায় সীমাবদ্ধ রেখেই সন্তুষ্ট হয়ে গেছি আমরা। কিন্তু এটা যে বাস্তবে পরিণত করতে হবে, সে কথা তোমাকে জানার সুযোগ দেওয়া হয়নি। জেনে রাখো ভাই, ইসলাম কেবল সালাত ও সাওমের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। সালাত ও সাওম যেমন অবশ্য কর্তব্য, ঠিক তেমনই ইসলামের অন্যান্য বিধান মেনে চলাও আমাদের জন্য আবশ্যক।
গুটিকয়েক আনুষ্ঠানিকতার বাইরে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ইসলাম সমভাবে প্রযোজ্য বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি এবং কিছুটা মেনে চলার চেষ্টা করি বলে তুমি আমায় গোঁড়া ভাবছো? কিন্তু তোমার দিকে একবার দেখো, ভাই। তুমি নিজে গোঁড়ামি থেকে কতটা মুক্ত তা কি ভেবে দেখেছো? আচ্ছা, গোঁড়ামি কাকে বলে? ভুল স্বীকার করে ঠিক পথে ফিরে আসাকে কি গোঁড়ামি বলে? সারাজীবন ইসলাম সম্পর্কে ভুল জেনে এসেছি। আল্লাহ তা’আলা যখন দয়া করে কুরআন-হাদীস কিছুটা বুঝিয়ে দিলেন, তখন আমার ভুলটা ধরা পড়লো। আল্লাহর দয়ায় আমি ভুলটা স্বীকার করে নিলাম। এই ভুল স্বীকার করে নতুনকে বরণ করে নেয়ার নামই কি গোঁড়ামি? নাকি সত্যটা জেনেও আগের ভুলের ওপর বহাল থাকার নাম গোঁড়ামি? গোঁড়ামিটা কে করছে? ভাই, তুমি সাবধান হয়ে যাও। দুনিয়া তোমাকে গোঁড়ামিতে ডুবিয়ে রাখতে চায়। সমাজ তোমাকে ইসলাম থেকে দূরে রাখতে চায়। তোমার ভুল যাতে বুঝতে না পারো, সেজন্য শয়তান তোমাকে অন্ধ করে রাখতে চায়। তুমি আর অন্ধ হয়ে থেকো না, ভাই। এবার তুমি চোখ খোলো।
তোমার জন্মদিনে আমি উইশ করি না দেখে হয়তো তুমি ভাবছো, আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না। কিন্তু তুমি সারাজীবন যাতে ভালো থাকো এমন দু’আ আমি করেছি কি না সেটা তুমি জানো না। নাচ-গানের অনুষ্ঠানে যাই না দেখে তুমি হয়তো ভাবছো, আমি আর তোমাকে আপন ভাবি না। কিন্তু আল্লাহ যেন তোমাকে হারাম থেকে বাঁচিয়ে রাখেন এমন দু’আ করেছি কি না সেটা তুমি জানো না। যারা তোমার ভুলগুলো ধরিয়ে না দিয়ে বরং তোমাকে আরও ভুলের প্রতি উৎসাহ দেয়, তাদেরকেই তুমি বন্ধু ভাবতে শুরু করেছো? এটা একটা বড় ভুল, ভাই। তুমি এ পথ থেকে ফিরে এসো।
ভাই, তুমি বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এখনও ভালোবাসি। আগের মতোই ভালোবাসি। তুমি বিশ্বাস করো, আমি তোমার ভালো চাই। তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত ক্ষোভ নেই। তোমার কাছ থেকে আমি দূরে সরে যেতে চাই না। যতদূর মনে পড়ে, তোমার সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি। আশা করি, এখনও তোমার সাথে আমার যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক আছে। তোমার সাথে কথা বলার সময় যেমন অন্য বন্ধুদের সম্পর্কে গীবত করি না, তেমনই তোমার নামেও আমি অন্যদের কাছে গীবত করি না। আমার সাথে কথা বলার সময় অন্য কোনো বন্ধুর নামে তুমি গীবত করতে চাইলে তোমাকে আমি যেমন থামিয়ে দিই, তেমনই অন্য কেউ আমার সামনে তোমার নামে গীবত করতে চাইলেও আমি তাকে থামিয়ে দিই। আলহামদুলিল্লাহ। আমি কেবল এটুকু বলতে চাইছি যে, বন্ধুত্ব সম্পর্কে আমাদের একটু নতুন করে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
পরীক্ষার আগের দিন পড়া বাকি রেখে তোমাকে খেলতে দেখলে বন্ধু হিসেবে আমার কী করণীয়? আমি তোমার সত্যিকারের বন্ধু হয়ে থাকলে তোমার ভুল ধরিয়ে দেবো, তোমাকে খেলা বাদ দিয়ে পড়তে বসতে বলবো। ঠিক এই কাজটাই আমি করতে চাইছি। দুনিয়ার জীবনটা একটা পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় আমরা প্রতিনিয়ত ভুল করে চলছি। বন্ধুত্বের দাবী হলো, আমরা একে অপরের ভুলগুলো শুধরে দেবো। তোমাকে ভুল পথে যেতে দেখার পরও আমি যদি তোমাকে ঠিক পথে না ডাকি, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে, আমি তোমার ভালো চাই না। তোমার ভালো চাইলে অবশ্যই আমি তোমাকে ঠিক পথের দিকে ডাকবো।
তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার জন্মদিনের পার্টিতে যাই না। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার সাথে পহেলা বৈশাখে ঘুরতে বেরোই না। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার সাথে নাচ-গানে যোগ দিই না। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমাকে গুনাহর কাজে সাহায্য করি না। তোমাকে ভালোবাসি বলেই আল্লাহর কাছে তোমার জন্য দু’আ করি।
আল্লাহ বলেন, “সেদিন (দুনিয়ার) বন্ধুরা সবাই একে অপরের দুশমন হয়ে যাবে, অবশ্য যারা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করেছে তাদের কথা আলাদা।” [সূরা যুখরুফ (৪৩):৬৭]
ভাই, তুমি কি ব্যাপারটা কল্পনা করতে পারছো? যারা দুনিয়াতে তোমার বন্ধু, সেদিন তারা তোমার শত্রু হয়ে যাবে। কেবল যারা আল্লাহকে ভয় করে চলেছে, তারাই সেদিন বন্ধু থাকবে। আমি তোমার শত্রু হতে চাই না, ভাই। আমি তোমার বন্ধু থাকতে চাই। আমি জাহান্নামে পুড়তে চাই না। আমি তোমার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। আমি জান্নাতে তোমার সাথে ক্রিকেট খেলতে চাই। আমি জান্নাতে তোমার সাথে গান গাইতে চাই। আমি জান্নাতে তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। আমি জান্নাতে তোমার সাথে বছরের পর বছর আড্ডা দিতে চাই।
সেজন্য আমার প্রথম কর্তব্য হলো নিজে আল্লাহকে ভয় করে চলা। আর দ্বিতীয় কর্তব্য হলো তোমাকেও এ ব্যাপারে উপদেশ দেওয়া। আমি নিজে খুব দ্বীনদার হয়ে গেছি এমন নয়। তবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার প্রিয় বন্ধু, তোমাকেও আমি ডাকছি আল্লাহর পথে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো পথে। ইসলামের পথে। আখিরাতকে প্রাধান্য দিয়ে চলা আদর্শ মুসলিমের জীবনের পথে। তুমি ফিরে এসো, বন্ধু। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।
তুমি ভাবতে পারো, এই বয়সেই এত কঠিনভাবে দ্বীন মেনে চলার কী দরকার? ভাই, তোমার মৃত্যু কখন হবে তা কি তুমি জানো? তবে কেন এত নির্লিপ্ততা? কেন এ উদাসীনতা? বৃদ্ধ হবার সুযোগ পাবার কোথায় এত নিশ্চয়তা? আজই কি তোমার শেষ দিন হতে পারে না? উপরন্তু যৌবন কোন পথে ব্যয় করছো সে ব্যাপারে তুমি জিজ্ঞাসিত হবে, ভাই। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি দুই পা সরাতে পারবে না। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।
আল্লাহ যেন তোমাকে আর আমাকে প্রকৃত মুত্তাকী বানিয়ে দেন। আল্লাহ যেন তোমাকে আর আমাকে সারা জীবন সরল পথে অটল থাকার তাওফীক দেন। আল্লাহ যেন তোমার-আমার বন্ধুত্বকে জান্নাত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন। আমীন।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।