“চেতনা”। – হ্যাঁ, শব্দটি খুব পরিচিত। আমরা প্রায়শই চেতনা নিয়ে নানা কথা শুনতে পাই। যেমন, একুশের চেতনা, ৭১’র চেতনা-এমনি আরও অনেক ধরনের চেতনা। বস্তুতঃ আবহমানকাল ধরেই চেতনার গুরুত্ব অনেক। ইসলাম সার্বজনীন, বিশ্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। এর মধ্যে একটি স্বতন্ত্র চেতনা পরিলক্ষিত হয়। আধ্যাত্মিক জবাবদিহিতামূলক চিন্তা চেতনাই এর বৈশিষ্ট্য। তাই ইসলাম একজন মুসলিমকে একটি মহৎ, সার্বজনীন অথচ স্বতন্ত্র চেতনার অধিকারী করে তোলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস হতে আমরা জানি, প্রত্যেক শিশুই স্বভাব ধর্মের (ফিতরাত) উপর তথা ইসলাম এর উপর জন্ম নেয়। কারন ইসলাম মানেই হচ্ছে আত্মসমর্পণ। আর একটি শিশু নিজ সত্তার স্বাধীনতা পায় না এবং অক্ষম থাকার কারনে সে সম্পূর্ণরূপে পরাধীন থাকে। এ সময় সে সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ করে মুসলিম হয়। আর মহান রবই তো পিতা মাতার মনে শিশুর জন্য অনুগ্রহের সৃষ্টি করেন। নয়ত এ শিশুর জন্য জীবন দেয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতঃপর এই শিশু নিজ নিজ পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে গঠন করে। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কোন শিশু স্বভাব ধর্মেই বহাল থাকে আবার কোন শিশু বল্গাহারা হয়ে বিপথগামি হয়। তাই একটি মানবশিশুকে কোন মুসলিম মাতা পিতা যদি তার সন্তানকে স্বভাব ধর্মের উপর চালিত করতে চান তবে যে জিনিসটি সর্বপ্রথম প্রয়োজন সেটি হচ্ছে শিশুমনে ইসলামি চেতনার সৃষ্টি করে তার বিকাশ সাধনে পরিচর্যায় নিযুক্ত হওয়া। এক্ষেত্রে অনেক পিতা মাতা মনে করতে পারেন চেতনা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী বড় গোঁফওয়ালাদের ব্যাপার! প্রকৃতপক্ষে সঙ্কীর্ণ চিন্তার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হয় এ পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি স্থূল হয়েছে এবং এরা চেতনার অর্থটাই হারিয়ে বসেছেন। কিন্তু আসলে তা নয়। ‘চেতনা’ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। শিশুই হোক আর প্রৌঢ়- সকলেরই নিজ নিজ স্তরে একটি চেতনা আছে। তাই প্রথমত অভিভাবক সমাজকে চেতনার অর্থ বুঝতে হবে। অতঃপর এর গুরুত্ব আপনাতেই বুঝে আসবে। তদুপরি বিষয়বস্তুর স্বার্থে শিশুমনে ইসলামি চেতনার গুরুত্বটা কি এ সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন।

একটি শিশুর জীবনে চেতনার গুরুত্ব অনেক। পরিবার ও পরিবেশ হতেই শিশু একটি পথ পায় ও সেটি ধরে অগ্রসর হয়। সুতরাং পিতামাতা তাকে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা বলে, যা শোনায় তাকে লক্ষ্য করেই অধিকাংশ সময় সে অগ্রসর হয়। যেমন আমার পরিচিত এক গরীব মহিলার কাছ থেকে শুনেছিলাম সে তার ছেলেকে হাফেয বানাতে চায়। কিন্তু এর পশ্চাতে উদ্দেশ্য ছিল যে হাফেয হয়ে তার ছেলে মসজিদের ইমাম হবে এবং মানুষের বাসায় ভাল খেতে পাবে। অর্থাৎ এখানে হাফেয হওয়া বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে উদ্দেশ্য। তদ্রুপ আপনি আপনার সন্তানকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার যা-ই বানান না কেন তার অন্তরে এই কথাটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। আর শিশুমনে এই চেতনাটা ঢুকিয়ে দিতে হবে যেন সে তার কর্মক্ষেত্রের সমগ্র কর্মসূচিকেই ইসলামের কাজে লাগায়। এটা হচ্ছে চেতনার পরিণতি। তবে পরিণতির মাঝেই গুরুত্ব লুকিয়ে আছে।

IIRT Arabic Intensive

শিশুকাল থেকেই জীবন পরিক্রমা শুরু হয়। এ পর্যায়ে শিশু যদি ইসলামের আলোকে জীবনের উদ্দেশ্য জেনে নেয় তবে ধীরে ধীরে তার মনে ইসলামি চেতনার সৃষ্টি হবে। তাই শিশু যখন একটু একটু বুঝতে শেখে তখনই পিতা মাতাকে বলতে হবে সুরা আয-যারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াত যেখানে আল্লাহ বলেন- “আমি জিন ও মানবজাতিকে আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করি নাই”।

এ আয়াতটি শোনামাত্র শিশুমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। যেমন-এই আয়াতে “আমি” দ্বারা কাকে বোঝানো হয়েছে। ইবাদাত কী? ইত্যাদি প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাবা-মা শিশুকে পাথেয় দান করবে। আর এই ধাপের প্রথমেই শিশুকে তার “রব” সম্বন্ধে জানাতে হবে। অর্থাৎ তাকে উপরোক্ত আয়াতের আল্লাহ সম্পর্কে বলতে হবে। তবে শিশুমনের অন্যতম একটু বৈশিষ্ট হল সে যখন একটি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে তখন একে সে তার দেখা অন্যান্য পার্থিব বিষয়ের সাথে মিলিয়ে নিতে চায়। তাই আল্লাহ সম্পর্কে তার কাছে বললে হয়তো সে অবচেতন মনে পার্থিব কোন বিষয়ের সাথে তুলনা করতে পারে। তাই তাকে এক্ষেত্রে বলতে হবে “এবং তাঁর (আল্লাহর) সমতুল্য কেউ নেই”। [সূরা আল ইখলাস(১১২): ৪]

শিশুকে আল্লাহর পরিচয় দানে সুরা ইখলাস ও আয়াতুল কুরসির সহজ ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। আল্লাহর সামগ্রিক পরিচয় পাওয়াটা একটি শিশুর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারন শিশুমনেই যদি আল্লাহকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তবে সে তার সমগ্র জীবন এ পথেই পরিচালিত করবে। এমতাবস্থায় পিতামাতার কর্তব্য হল আল্লাহ মানবজাতি সম্পর্কে কি পছন্দ ও কি অপছন্দ করেন তার ধারনা দেয়া। আর এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম শিশুকে যে টার্মটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তা হচ্ছে “ইসলাম”। অর্থাৎ ইসলাম এর পথে চললে আল্লাহ খুশি আর বিপথে চললেই আল্লাহ নারাজ। এক্ষনে এ কথা শোনার পরই শিশুর মনে প্রশ্ন জাগবে। কেন ইসলাম? ইসলামই কী শ্রেষ্ঠ? এ পথে চললেই বা কেন সাফল্য? তখন আপনি (পিতামাতা) কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলবেন, “তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য ধর্ম (ইসলাম) সহ প্রেরণ করেছেন যাতে একএ অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহই যথেষ্ট”। [সূরা আল ফাতহ(৪৮): ২৮]

এমতাবস্থায় শিশু জানতে পারবে তার জীবনের পথ কী, সত্য ধর্ম কী। তখন সে স্বতঃই বলে উঠবে, “ইন্নাদ্দিনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম”।

এই বিষয়াদি জানার পর শিশুমনে প্রশ্ন জাগবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে। কারন এতক্ষণ তো সে রাসূলকে দেখতে পায়নি। শুধু দেখেছে আল্লাহ ও ইসলাম। আবার সত্যধর্মকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন রাসূলের মাধ্যমে। তাই সে রাসূল সম্পর্কে জানতে তো চাইবেই। এই প্রেক্ষাপটে তাকে প্রথমে বোঝাতে হবে তিনি জিন বা ফেরেশতাদের মত কেউ নন। তিনি একজন মানুষ। আল্লাহ বলেন, “বলুন (হে মুহাম্মাদ), আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। (আল কাহফ-১১০) [সূরা আল কাহফ(১৮): ১১০]

অর্থাৎ এখানে সাধারন মানুষ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাঝে পার্থক্যকারী হচ্ছে ওহী যার মাধ্যমে তাঁর চরিত্র গঠিত হয়েছিল। আর সেই চরিত্রের গুনেই তিনিই মানবজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষ লোকের পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। [সূরা আল আহযাব(৩৩): ৪০]

আল্লাহ আরও বলেন, “আমি আপনাকে সারা বিশ্বের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি”। [সূরা আল আম্বিয়া(২১): ১০৭]

আবার তাঁর মর্যাদার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগন নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর প্রতি রহমতের তরে দোয়া কর এবং সালাম প্রেরণ কর”। [সূরা আল আহযাব(৩৩): ৫৬]

এভাবে শিশু যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে প্রাথমিক পরিচয় লাভ করবে তখন তাকে সহজ সরল সিরাত গ্রন্থগুলো পড়তে দিতে হবে। ফলে অনিবার্যভাবে শিশুটি ইসলামের অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে জানবে এবং তার মাঝে বিদ্যমান ইসলামি চেতনাটুকু আরো পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে। শিশুকে আরও জানাতে হবে জ্ঞানের রাজ্যে মুসলমানদের অদম্য পদচারনা। ইবনে সিনার “কানুন ফিত-তিব্ব”, জাবির ইবনে হাইয়ানের “আল কিমিয়া” এবং মুসা আল খোয়ারিজমির “আল জিবর ওয়াল মুকাবিলার” কথা তাকে বলতে হবে। তখন সে আর আইন্সটাইনকে দেখে ঈর্ষান্বিত হবে না। স্টিফেন হকিংস এর নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানকে সে আমলে নিবে না। আর পরিণত বয়সে কম্যুনিজম আর ফ্যাসিজম এর মত মতবাদগুলোকে সে ডাস্টবিনে পড়ে থাকা ময়লা ন্যাকড়া হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। শিশুকে আরও বলতে হবে শৌর্যে-বীর্যে মুসলমানের অতীত গৌরব সম্পর্কে। সালাউদ্দিন আইয়ুবি, জামালুদ্দিন আফগানি সকলেই তার মনে ইসলামি চেতনাকে সমৃদ্ধ করবে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে একজন মুসলমান বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করবে। আর তখনই তার সন্তুষ্টির জন্যে পিতামাতা কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলবেন, “তার কথা অপেক্ষা আর কার কথা উত্তম যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে সৎকর্ম করে এবং বলে আমি মুসলমান। [সূরা হা-মীম সাজদাহ(৪১): ৩৩]

এভাবে সে ভবিষ্যৎ জীবনে একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠার শিক্ষা পায়। এমতাবস্থায় স্বাভাবিক মানবসুলভ চাহিদা অনুযায়ী সে আল্লাহর কাছ থেকে কিছু চায়। তখন আল্লাহ বলেন, “হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। [সূরা আল ফাজর(৮৯): ২৭-৩০]। এভাবে সে তার জীবনের সকল সময় সিরাতুল মুস্তাকিমে থাকে।

এ থেকে আমরা জানতে পারলাম শিশুমনে ইসলামি চেতনা কিভাবে সৃষ্টি হয় এবং এর গুরুত্ব ও পরিণতি। আজকের এই যুগে যখন মুসলমান জাতি চরম নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার তখন কেবল শিশুমনে ইসলামি চেতনা সৃষ্টিই পারে আমাদের মুক্তি দিতে। কারন ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে।

একটি শিশুকে এ চেতনার শিক্ষাধীন করলে সেও একদিন শিশুর পিতা হয়ে তার সন্তানকে স্বভাবধর্মের উপরই চালিত করবে আর এই প্রক্রিয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলতে থাকবে। যেমন একটি বটবৃক্ষ। একবার বীজটা বুনে দিন। দেখতে থাকুন তার স্থায়িত্ব। ছোট্ট একটা ভ্রুন সুবিশাল বহুকোষী বটবৃক্ষে পরিণত হবে এবং শাখা প্রশাখা বিস্তার করবে। শুধু তাই নয় এ বৃক্ষ পথিকের ক্লান্তিও দূর করবে। তদ্রুপ ইসলামি চেতনার পরিণতি অকল্পনীয়। এই চেতনাই কবি নজরুলের আশাকে পূর্ণতা দেবে। কবি বলেছিলেন,

“উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিন বাহু

আহবান নয়, রুপ ধরে এস- গ্রাসে অন্ধতা রাহু

তাই সম্মানিত অভিভাবকবৃন্দের নিকট আকুল আবেদন আপনারা হয়তো শৈশব কৈশোরে ইসলামের জন্য অবদান রাখতে পারেন নাই কিন্তু এখন সময় এসেছে; সন্তানকে ইসলাম সম্পর্কে জানিয়ে দিন আর অপেক্ষা করুন। কারণ আল্লাহর কৌশলই বিজয়ের মুকুট পরবে।

Purity belongs to You, O Allaah, with Your praises, I bear witness that there is none worthy of worship except You. I seek forgiveness from You and I repent to You.

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive