একম্যাসলোর হাইরার্কি অব নিডস’ সম্পর্কে শোনেননি, এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। তবে ‘ইসলামিক ম্যানেজমেন্ট’ পড়তে গিয়ে এই থিওরির একটা ক্রিটিসিজম বেশ ভালো লেগেছে। সেই ক্রিটিসজমটিই আজকের আলোচনা-
১৯৪৩ সালে মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম ম্যাসলো ‘হিউম্যান মোটিভেশান থিওরি’ এর উপর লেখা একটা আর্টিকেলে এই মডেলটি তুলে আনেন। এখানে মানুষের বিভিন্ন চাহিদাকে একটি পিরামিড আকারে দেখানো হয়েছে। এই পিরামিডকে মোটামুটি নিচ থেকে উপরে ৫ টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে-
১. শারীরবৃত্তীয় চাহিদা (Physiological needs): খাদ্য, বস্ত্র, পানীয়, বাতাস, সেক্স, ঘুম, রেচন ইত্যাদি।
২. নিরাপত্তাজনিত চাহিদা (Safety needs): নিরাপদ বাসস্থান, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, চাকুরি ইত্যাদি।
৩. ভালোবাসাজনিত চাহিদা (Love needs): বন্ধুত্ব, পরিবার, যৌন চাহিদা ইত্যাদি।
৪. মর্যাদা ও সম্মানজনিত চাহিদা (Esteem needs): আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস, বৈষয়িক অর্জন, অন্যদের প্রতি সম্মান, অন্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্মান ইত্যাদি।
৫. আধ্যাত্মিক/ আত্মোন্নয়নমূলক চাহিদা (Self-actualization needs): নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সৃজনশীলতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা, বাস্তববাদিতা ইত্যাদি।
এটিকে আরেকটু সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়-
১. শারীরবৃত্তীয় + নিরাপত্তাজনিত চাহিদা ⇨ মৌলিক চাহিদা (Basic needs)
২. ভালোবাসা + মর্যাদাজনিত চাহিদা ⇨ মনোসামাজিক চাহিদা (Socio-psychological needs)
৩. আধ্যাত্মিক চাহিদা (Self-fulfillment needs)
মনোবিজ্ঞানী ম্যাসলো তার এই পিরামিডে দেখিয়েছেন যে, শারীরবৃত্তীয় চাহিদা মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা, এরপর সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার চাহিদা, আর সবশেষে আছে আধ্যাত্মিক চাহিদা। অর্থাৎ, পেটে ভাত থাকলে তখন সামাজিকতার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তা পূরণ হলে আত্মসম্মানবোধ জাগে, তা পূরণ হলে সে ধর্ম কিংনা নৈতিকতা অর্জনে সচেষ্ট হয়। বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থায় এই পিরামিড একদমই সত্য।
দুইকিন্তু ইসলামী চিন্তাধারার সাথে এই পিরামিড অনেকটাই সাংঘর্ষিক, এজন্য মুসলিম মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই এটাকে অপূর্ণ বা একপেশে বলে মত দিয়েছেন। কারণ, চাহিদার এই পিরামিডে সেল্ফ-একচুয়ালাইজেশন বলে যা বোঝানো হচ্ছে, আক্ষরিক অর্থে তা ‘ধর্ম’ কিংবা মানুষের ফিতরাতকেই নির্দেশ করে, যেটি ম্যাসলো সাহেব চেপে গিয়েছেন। ইসলাম কখনোই বলেনি যে, পেটে ভাত না থাকলে ধর্মের বাধ্যবাধকতা শিথিল হয়ে যায়। বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য Self-actualization তথা ফিতরাতের উপর চলা, ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কথাটি অন্যভাবেও বলা যায়- প্রতিটি মানুষের ভেতরেই একটা শূন্যতার অনুভূতি থাকে, যা কেবল আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনেই পূর্ণ হয়। এই প্রয়োজনই মানব জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন, যা পূরণ হলে বাকিগুলো পূরণ না হলেও বান্দা আত্মিকভাবে পরিতৃপ্ত থাকতে পারে।
সূরা ইবরাহীমের ৩৭ নং আয়াত লক্ষ করলে আমরা বিষয়টি সুন্দরভাবে দেখতে পাই। আল্লাহর নির্দেশে নবী ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম স্ত্রী হাজার ও শিশুপুত্র ইসমাইল আলাইহিমাস সালামকে নির্জন মরুতে একাকী রেখে চলে যাচ্ছিলেন। স্ত্রী-পুত্রের সমস্ত প্রয়োজন আল্লাহর উপর সপে দিয়ে দু’আ করলেন-
হে আমাদের রব্ব! আমি আমার সন্তানকে পানি ও তৃনহীন ভূমিতে আপনার পবিত্র গৃহের নিকট বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। হে আমার রব্ব! তারা যেন যথাযথভাবে নামাজ কায়েম করে। আপনি কিছু লোকের *অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফলফলাদি দ্বারা তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করুন, যেন তারা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। [সূরা ইবরাহীম: ৩৭]
খেয়াল করে দেখুন, ইব্রাহীম আ. তার স্ত্রী-সন্তানের কোন কোন চাহিদা মেটানোর জন্য রবের কাছে আকুতি জানালেন?
১। তারা যেন নামাজী হয়, আল্লাহর সাথে বান্দাহর আত্মিক সম্পর্কের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম এই নামাজ।
➤ Self-fulfillment needs
২। তাদের প্রতি মানুষের অন্তর অনুরাগী করে দিন।
➤ Social & Psychological needs
৩। ফলফলাদি দিয়ে ওদের রিযিকের ব্যবস্থা করুন।
➤ Basic needs
ইবরাহীম আ. এর এই ‘Hierarchy of Needs’ ম্যাসলোর পিরামিডের একদম উল্টো নয় কি? যেখানে একদম শুরুতেই বলা হচ্ছে আধ্যাত্মিক প্রয়োজনের কথা! আর সবশেষে বলেছেন রুজির কথা, এর সাথে আরেকটি ইবাদাতের কথাও জুড়ে দিয়েছেন- ‘লা’আল্লাহুম ইয়াশকুরূন’- যেন তারা শোকরগুজার হয়। আর সেই দু’আর ফলাফল তো আমাদের জানাই আছে- জনহীন সেই অনুর্বর উপত্যকা পরিণত হয়েছিলো উর্বর জনবহুল এক জনপদে, যা আজ কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার কেন্দ্র। রিযিকের ব্যবস্থা হয়েছিলো জমজম দিয়ে, তা আজো অফুরন্ত বরকতের উৎস হয়ে আছে।
এখানেই একজন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী কিংবা বস্তুবাদীর চিন্তার তফাৎ। গুরুত্বের বিবেচনায় আমাদের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’। কেননা আমাদের রিযিক দেয়ার মালিক আল্লাহ, সামাজিক কিংবা মানসিক প্রয়োজন পূরণের মালিকও তিনিই। তাই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন আমাদের প্রয়োজনের পিরামিডের ভিত্তি স্থাপন করে। এই ভিত্তি ঠিক থাকলে বাকিগুলো পূরণে আবার আল্লাহই সাহায্য করেন, আর যদি কোনটা পূরণ না হয়, আত্মিক কিংবা আধ্যাত্মিক পূর্ণতার (Self-fulfillment) কারণে বান্দাহ সেই অভাব সত্ত্বেও আল্লাহর শোকর করে, সবর ও তাওয়াক্কুলের পথ বেছে নেয়।
ইবরাহীম আ. এর hierarchy pyramid এ দেখুন, একটা চাহিদা মিসিং আছে- Security/ Safety needs (নিরাপত্তার প্রয়োজন)। নির্জন মরুভূমিতে তিনি যখন স্ত্রী-পুত্রকে ফেলে রেখে যান, সেখানে ‘নিরাপত্তা’র নিশ্চয়তা একেবারেই ‘শূন্য’। কিন্তু সেই প্রয়োজনটা পূরণ করে দিয়েছে তাওয়াক্কুল, যেটির উৎস আবারো ‘Self-fulfillment’।
একইভাবে, নবী আইয়্যুব আলাইহিস সালাম দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন- তার শারীরবৃত্তীয় চাহিদার পয়েন্ট মিসিং ছিলো। নূহ আলাইহিস সালাম পুরো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন- ভালোবাসা কিংবা সামাজিক চাহিদার পয়েন্ট মিসিং…. তারপরেও তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর শোকরগুজার ছিলেন, কারণ আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ভিত্তি ছিলো মজবুত। একজন বিশ্বাসীর জীবনের পুরোটা সুখ-সমৃদ্ধি, শান্তি, পরিতৃপ্তির অনুভূতির নিয়ন্তা এই ভিত্তিমূল। ব্যাপারটা দারুন না??
লেখক: নিশাত তামমিম
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।