আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, আমরা ভুল করবোই। ভুল না করা মানুষের বৈশিষ্ট্য নয়। কাজেই আমরা যে বারবার ভুল করে যাবো, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে নিজের ভুলকে আমরা যতটা সহজভাবে নিতে পারি, অন্যের ভুলকে ততটা সহজে নিতে পারি না। নিজের হাজারটা ভুল চোখে পড়ে না, কিন্তু অন্যের দুই-একটা ভুলও আমাদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। আবার কেউ আমাদের ভুল ধরিয়ে দিলে আমরা অহংকার প্রকাশ করে ফেলি। সত্যিই আমাদের ভুল ছিলো কি না, কিংবা আমাদের ভুল থেকে থাকলে কীভাবে তা সংশোধন করা যায়, সে ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম। কীভাবে প্রতিপক্ষকে পাল্টা জবাব দেওয়া যায়, সেদিকেই যেন আমাদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু মুসলিম হিসেবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত?

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে। পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম, যারা তাওবাহ করে।’’ (তিরমিযী)

IIRT Arabic Intensive

সুতরাং আমরা যখনই গুনাহ করে ফেলবো, তখনই সাথে সাথে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করবো। আল্লাহ তা’আলা তাওবাহকারীকে ভালোবাসেন।

এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, তাওবাহ শুধু আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া এবং মুখে ভুল স্বীকার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাওবাহ কবুল হবার শর্ত হলো, অন্তরে অনুশোচনা আসতে হবে। আমি সত্যিই ভুল করেছি এই উপলব্ধি আসতে হবে। ভবিষ্যতে আর কখনো এ গুনাহ না করার সঙ্কল্প করতে হবে।

গুনাহকে ছোট মনে করা যাবে না। কেননা গুনাহকে ছোট মনে করলে বড় গুনাহর পথও একটু একটু করে খুলে যেতে পারে। শয়তান খুব সূক্ষ্মভাবে কাজ করে। সে আমাদেরকে প্রথমেই বড় গুনাহ করতে প্ররোচিত করবে না। ছোট গুনাহ করতে করতে ধীরে ধীরে কখন যে বড় গুনাহর কাছাকাছি পৌঁছে যাবো, তা সে আমাদেরকে বুঝতেই দেবে না। তাই ছোট-বড় সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। হাজারটা মুস্তাহাব কাজ করার চেয়ে একটা গুনাহ থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব বেশি।

গোপন গুনাহ করা যাবে না। যখন আমাকে কেউ দেখছে না, তখনও আল্লাহ আমাকে ঠিকই দেখছেন। তাই তাকওয়ার দাবী হলো গোপন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ আমাকে দেখছেন এটা জেনেও কি আমরা গুনাহ করতে পারি? প্রকাশ্য গুনাহ অবশ্য আরো মারাত্মক। কেননা প্রকাশ্যে গুনাহ করার অর্থ হলো, আমরা গুনাহকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি এবং গুনাহ করার পরেও আমাদের মধ্যে লজ্জাবোধ নেই। এমন গুনাহগারকে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করবেন না বলে ঘোষণা করা হয়েছে। (বুখারী)

সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা গোপন ও প্রকাশ্য উভয় প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে সচেষ্ট হবো। কিন্তু ভুলক্রমে গুনাহ হয়ে গেলে সেটা পারতপক্ষে গোপন রাখবো। পরে যেন আবার একই ভুল না করি, সেজন্য উপযুক্ত পদক্ষেপে নেবো।

এ তো গেলো নিজের গুনাহর কথা। এবার অন্যের গুনাহর ব্যাপারে আমাদের কী অবস্থান হবে সে প্রসঙ্গে আসি। মুসলিম ভাইকে কোনো গুনাহ করতে দেখলে আমরা চেষ্টা করবো ভালো ধারণা রাখতে। আমরা ধরে নেবো, ঐ ভাই এটা না জেনে করছেন, কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে করছেন, কিংবা তিনি এখন গুনাহ করলেও তা ছেড়ে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ইত্যাদি। অর্থাৎ তাঁর পক্ষে অজুহাত দাঁড় করাবো।

তবে অজুহাত দাঁড় করানোটাই শেষ নয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের আদেশ করেছেন ভালো কাজের আদেশ দিতে এবং খারাপ কাজে বাধা দিতে। কাজেই কোনো মুসলিমকে গুনাহ করতে দেখলে তার পক্ষে অজুহাত দাঁড় করানোর পাশাপাশি আমাদের উচিত হবে তাঁকে সংশোধন করে দেওয়া। বিনয়ের সাথে তাঁর ভুলটা ধরিয়ে দিতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ এবং আলিমদের বক্তব্য অনুযায়ী কেন তাঁর কাজটা ভুল, সে কথা বুঝিয়ে দিতে হবে। তাঁকে বোঝাতে হবে যে, আমরা তাঁর ভালো চাই। তাকে বোঝাতে হবে যে, ভুল ধরাটাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এরপরও যদি তিনি ভুল সংশোধন না করেন, তাহলে তাঁকে তাঁর মতো ছেড়ে দেবো। তাঁর ব্যাপারে আমরা আর জিজ্ঞাসিত হবো না ইনশা আল্লাহ। আমাদের দায়িত্ব শুধু কুরআন-সুন্নাহ পৌঁছে দেওয়া। তবে হ্যাঁ, তিনি যেন সঠিক পথে চলেন সেজন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে হবে। তাঁর গুনাহর কথা অন্যদের সামনে আলোচনা করা যাবে না, অর্থাৎ গীবত করা যাবে না। অবশ্য তাঁর মাধ্যমে অন্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা বিভ্রান্তিতে পড়লে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকুই বলবো। ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে মিথ্যা তথ্য ছড়াবো না।

আমরা নিজেরাও ভুল করি, করবো। কেউ যদি আমাদের ভুল ধরিয়ে দেন, তখন আমাদের কী করা উচিত? আমাদের উচিত তাঁর বক্তব্য শোনা এবং সত্য জানতে চেষ্টা করা। তিনি যদি ভুল কিছু বলে থাকেন কিংবা আমাদের ব্যাপারে ভুল বুঝে থাকেন, তাহলে সেটা তাঁকে বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে দেবো। কিন্তু যদি সত্যিই আমাদের ভুল হয়ে থাকে, তাহলে তা স্বীকার করে নেবো। ভুল সংশোধন করে নেবো। সংশোধনকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। তাঁর দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বিবাদ ডেকে আনবো না। এমনকি তিনি যদি আমাদের সামান্য ভুল নিয়ে বাড়াবাড়িও করেন, তবুও বিবাদে যাবো না। নিজের ভুল সামান্য হলেও স্বীকার করে নেবো। তার বাড়াবাড়ির জন্য আমাদেরকে দায়ী করা হবে না ইনশা আল্লাহ।

আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো এর ভারসাম্য। এই ভারসাম্য রক্ষা করে চলা ঈমানের দাবী। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টাও যেমন করতে হবে, তেমন গুনাহ হয়ে গেলে হতাশ না হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাও চাইতে হবে। আরেক ভাইয়ের ভুল দেখে তার পক্ষে অজুহাতও যেমন দাঁড় করাতে হবে, তেমন তার সংশোধনের জন্য হিকমাতের সাথে চেষ্টাও করে যেতে হবে। কখনো নম্র হতে হবে, কখনো কঠোর হতে হবে।

বিশেষ করে নিজের সংশোধনের দিকটা যেন আমরা খেয়াল করি। ইবলিস প্রথমত অন্যায় করেছিলো আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। কিন্তু অহংকারের কারণে সে নিজের ভুলকে ভুল বলে মেনে নেয়নি; ফলে সে হয়েছিলো অভিশপ্ত। আমরা যেন শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করি। আমরা যেন অহংকার না করি। অন্তরে সামান্য পরিমাণে অহংকার থাকলেও তা জান্নাতে যাবার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমরা যেন জান্নাতের আশায় এবং জাহান্নামের ভয়ে অহংকার থেকে বেঁচে থাকি। আমরা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই নিজেদের ভুল সংশোধন করে নিই। আল্লাহ আমাদের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার এবং সত্য গ্রহণ করার মানসিকতা দান করুন। আমীন।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive