আমরা দাই’ জাতি। আমাদের জন্য দাওয়াহ ফরজে কিফায়া। আমরা যারা নিজেদের আল্লাহর দ্বীনের ধারক-বাহক মনে করি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আদর্শ রাসূল ﷺ ও তাঁর সাহাবীরা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। জ্ঞান আছে কিন্তু তার মধ্যে তাকওয়া বা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা নাই, সে অহংকারী হবে, কখনোই ঈমানের স্বাদ পাবে না। আবার যার মধ্যে emotion, তাকওয়া বা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা আছে কিন্তু জ্ঞান নাই, সে বিভ্রান্ত-কুসংস্কারাচ্ছন্ন বা অন্ধ হবে। সে দিন শেষে আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে অসন্তুষ্টি অর্জন করবে, অথচ সে জানবেও না। তাদরেকে সহজেই অল্প যুক্তি দিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করা সম্ভব। আবার কারও মধ্যে এই দুইটি বিষয়ই আছে কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা নেই, সেও নিজে ভুল আদর্শ গ্রহণ করবে ও মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যাবে। জীবন আদর্শ হিসেবে দাই’ বা কোনো আলেম যাতে আমাদের আদর্শ না হয়, আল্লাহর রাসূলই শুধু আমাদের আদর্শ হবেন। বাহ্যত দাই’ যত বড় জ্ঞানী আলেম, উত্তম আখলাক ও আল্লাহ ভক্ত ব্যক্তি হোন না কেন, তিনি কখনোই perfect নন। আমাদের অজানা অনেক আল্লাহর হুকুম বা উপদেশ সে দাই’ পালন করেন না অথবা সেই আদেশের গুরুত্ব বা মর্ম বুঝেন না; সুতরাং আদর্শ হিসেবে আল্লাহর প্রদত্ত আদর্শ অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তিনি ﷺ ছিলেন আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী, তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো দুনিয়ার মানুষকে মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত করে কেবল আল্লাহর গোলামিতে ন্যস্ত করতে ।
মূল আলোচনায় ঢোকার আগে কয়েকটি শব্দের সাথে পরিচিত হয়ে নিই।
contact = যিনি দাওয়াহ গ্রহণ করবেন।
দাই’ = যিনি দাওয়াহ দেন।
reality = contact তার ব্যক্তিজীবনে কেমন; কী খায়, করে, পরে; পারিবারিক অবস্থা, জীবন দর্শন, স্বভাব, চরিত্র, তার পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা, চাহিদা, সমাজকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, তার জীবনের লক্ষ্য, স্বপ্ন ইত্যাদি।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। দাওয়াহ ও দাই’র বৈশিষ্ট্য কী কী হওয়া উচিৎ?
■ রাসূল ﷺ এর একটি গুণ ছিলো যে, তিনি গুছিয়ে অল্প কথায় যেকোনো বিষয় বুঝাতে পারতেন।
■ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে চিন্তা করা : contact এর realityকে analyze করা, এবং কোন concept থেকে প্রশ্ন করছে তা বিবেচনা করা। প্রথমে তার concept এর উত্তর দেওয়া, তারপর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া।
■ সমাজের সকল প্রকার প্রশ্ন নির্দিষ্ট সংখ্যক। আগেই এগুলোর উত্তর তৈরি করে রাখা।
■ গুছিয়ে দাওয়াহ করা, contact এর reality অনুযায়ী যে concept আগে দেওয়া উচিৎ, তা দেওয়া। Contact প্রশ্ন অন্য দিকে নিলেও ঘুরে-ফিরে মূল concept-এ অটল থাকা। আলোচনা ততক্ষণ করা, যতক্ষণ contact, concept গ্রহণ করে। Reality অনুযায়ী আনন্দ দিয়ে আলোচনা করা। বুঝতে হবে যে, আমরা তর্কে জিততে আসিনাই। বরং contact কে concept বোঝানোই মূল উদ্দেশ্য। Contact তর্ক করলেও দাই’র তর্ক করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বুঝাতে ব্যর্থ হলে বা প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে স্বীকার করতে হবে। বলতে হবে, পরে জেনে জানাবো। একজনকে তখনই কিছু বুঝানো সম্ভব, যখন সে দাই’কে বিশ্বাস করবে ও তার কথা উন্মুক্ত মনে শুনবে এবং যখন দাই’ও contact এর যুক্তি উন্মুক্ত মনে শুনবে। প্রতি আলোচনার শেষে contact-কে তার জীবনের উদ্দেশ্য ও আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, হাদীস দিয়ে motivation দিতে হবে।
■ যে ব্যক্তিত্ববান, তার সাথে নিজ ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে দাওয়াহ করতে হবে। যে উদার মনের, তার সাথে উদার মনে হাসিখুশিভাবে দাওয়াহ করতে হবে। তাছাড়া হাসিমুখে সম্মান দিয়ে কথা বলা রাসূলের সুন্নাহ, এবং এটা দান হিসেবে কবুল হয়।
■ কথা বলার সময় contact এর মুখ বরাবর তাকিয়ে ও সেদিকে ফিরে কথা বলা এবং মনযোগ সহকারে contact এর কথা শোনা। এতে contact দাই’র সাথে নৈকট্য অনুভব করে।
■ কমপক্ষে তিনদিন পরপর contact এর খোঁজ-খবর নেয়া ও তার ব্যক্তিজীবনের সমস্যা শোনা ও সামর্থ্য মতো সাহায্য করা। এটা মুসলিম ভ্রার্তৃত্ব ও নেতৃত্বের পরিচয়। অনেক দিন পরপর সাক্ষাত করলে contact পূর্বের আলোচনা ভুলে যায়, এটাই স্বাভাবিক।
■ আভিজাত্য নিয়ে অহংকার নিয়ে দাওয়াহ করা যাবে না। নিজের সুপথপ্রাপ্তি নিয়ে অহংকার করা যাবে না। Contact ভুল বললেও তাকে অপমান করা যাবে না, বরং তার চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করবো।
■ পূর্ণ গ্লাসে পানি ঢাললে তাতে পানি ঢুকে না। প্রথমে ময়লা পানি ফেলতে হবে, তারপর পরিষ্কার পানি ভরতে হবে। দাওয়াহর প্রথম ধাপ হলো contact এর ভুল concept দূর করা, তারপর সঠিক concept দেওয়া।
■ দাওয়াহ দুই ধরনের। প্রথমত, সাধারণ মানুষের জন্য দাওয়াহ, যা দিয়ে কোনো দল ও ইসলামী আদর্শের উপর সমর্থন আদায় করা হয়। অথবা মানুষকে ইসলামের উপর আকৃষ্ট করা, আমলে নিয়ে আসা ও জীবনের উদ্দেশ্য বুঝানো ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, সহকর্মী ভাই খোঁজা। যার ঈমান দুর্বল, তাকে সহজ কাজ দেওয়া। তার জন্য ইসলামকে সহজ করে দেওয়া এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ইসলামকে বা আল্লাহকে সাহায্য করার জন্য অনুপ্রাণিত করা। প্রথমেই কঠিন দায়িত্ব দেখলে যে কেউই ভয় পাবে। কেউ কোনো দলে থাকলে দলের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে দাওয়াহর বাইরেও ইসলামের সাধারণ বিষয় নিয়ে দাওয়াহ করা ও মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখানোর চেষ্টা করা। ইবাদাতের সাধারণ আমলগুলো করা ও সবাইকে করতে অনুপ্রাণিত করা দাই’র নিজের ইসলামের ও মুসলিমত্বের পরিচয় বহন করে। ইসলামের আদর্শিক চিন্তা সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, মানুষকে চিন্তা করতে শিখানো। শুধুই politics করা বা politics এর দাওয়াত দেওয়া ইসলাম নয়, এটা করলে মুনাফিকির পরিচয় প্রকাশ পায়।
■ প্রতিটি আলোচনাকে দিন শেষে আল্লাহর দিকে ধাবিত করতে হবে, না হলে এটা ইসলামের দাওয়াহ হবে না। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো আদর্শের দাওয়াহ হবে।
■ সমাজের যে ভুল আদর্শ ধ্বংস করতে চাই, যদি সে সম্বন্ধে পরিষ্কারভাবে না জানি, তাহলে তা দূর করা সম্ভব হবে না। এ কারণে যে আদর্শকে বা মতকে ধ্বংস করবো, সে সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা এবং যে আদর্শকে বা মতকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই সে সম্বন্ধেও পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠার উপায় বা পদ্ধতি সম্বন্ধে সঠিক দিকনির্দেশনা জানতে হবে। না হলে আমরা কোনো দলের অন্ধ অনুসারী হয়ে যাবো।
■ সাধারণত মানুষ তিন ধরনের লোকের দাওয়াহ গ্রহণ করে।
(১) Charismatic মানুষ : এদের ব্যক্তিত্ব এমন, যাদের দেখে মানুষ তাদের মতো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, তাদের সান্নিধ্য পছন্দ করে, তাদের অনুসরণ করতে চায়। এই ধরনের ব্যক্তির মধ্যে রাসূল ﷺ এর সব চারিত্রিক গুণাগুণ বিরাজমান থাকে।
(২) যারা contact এর realityতে ঢুকে যেতে পারে এবং বন্ধুত্ব বা বিশ্বাস অর্জন করতে পারে।
(৩) বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা : এরা সমাজের নেতা না হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা; আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর মতো। মানুষ তাদের কাছে সমস্যার সমাধান নিতে আসে। মানুষ তার গোছানো ও বাস্তবতা বুঝে করা আলোচনা পছন্দ করে। এ ধরনের লোক মানুষের কোনো সমস্যা দেখলে সবার আগে সমাধান দিতে যায়, সব আলোচনা ও আড্ডার মূল আলোচক ও মধ্যমনি হয়। নিজ ব্যক্তিত্ব বজায় রাখে; কিন্তু মানুষ না বললেও নিজ থেকে খোঁজ করে সেই মানুষের সমস্যার সমাধান করে। আলোচনা বা যেকোনো বিষয়ে উপস্থিত সবার দিকে খেয়াল রাখে। এরা মানুষের বুদ্ধিজগতের নেতা ও দিকনির্দেশক হয়। তার অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবেই তার যেকোনো চিন্তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। সাদ ইবনে মুয়াজ, তুফাইল ইবনে আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) এ ধরনের লোক ছিলেন।
রাসূল ﷺ এর মধ্যে উপরের তিন প্রকার লোকের বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিলো। তিনি যার সাথেই কথা বলতেন, সে-ই মনে করতো যেন সে রাসূলের সবচেয়ে আপন লোক। একজন দাই’র উচিৎ রাসূল ﷺ এর মতো হওয়ার চেষ্টা করা।
■ আমাদের দায়িত্ব sincerely দাওয়াহ করা, কিন্তু হিদায়াত দেওয়ার মালিক আল্লাহ। Contact যদি দাওয়াহ accept না করে, এতে মনঃকষ্টে আত্মঘাতী না হতে আল্লাহ উপদেশ দিয়েছেন। কারণ এটা আল্লাহর ইচ্ছা যে, সে দাওয়াহ গ্রহণ করেনাই। আমাদের শুধু এটা লক্ষ রাখতে হবে যে আমরা নিয়মিত sincerely চিন্তা-পরিকল্পনা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে দাওয়াহ করছি কি না। অবহেলা করে দাওয়াহ করে নিজেকে আল্লাহর কাছে দাই’ হিসেবে দাবী করা সম্ভব না। আর আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। কেউ যদি দাওয়াহ গ্রহণ না করে, তবে বুঝতে হবে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে দাই’র জন্য পরীক্ষা। যেমন পরীক্ষা আল্লাহ নূহ (‘আলাইহিসসালাম)-কে করেছিলেন, তায়েফে রাসূলকে ﷺ করেছিলেন।
কেউ জ্ঞানী হলেই যে সে দাওয়াহ গ্রহণ করবে, এটা ধারণা করা ভুল। আবু জাহল মক্কার সবচেয়ে জ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃত ছিলো, অথচ সব দাই’র চেয়ে উত্তম দাই’ আল্লাহর রাসূলও তাকে দিনের পর দিন দাওয়াহ করে ইসলাম গ্রহণ করাতে পারেননি। আবু জাহল ঈমান তো গ্রহণ করেইনি, বরং উল্টো সে ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে যায়।
হে মানুষ ! তুমি তোমার রবের নিকট পৌঁছা পর্যন্ত কঠোর সাধনা করে থাকো, অতঃপর তুমি তাঁর সামনাসামনি হবে। তখন যার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, তার সহজ হিসাব নেয়া হবে। আর সে (হিসাব থেকে অবসর হয়ে) সংশ্লিষ্ট স্বজনদের নিকট আনন্দের সাথে আগমন করবে। আর যার আমলনামা পিছন দিকে দেওয়া হবে, সে মৃত্যুকে ডাকতে থাকবে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করবে। দুনিয়াতে তার অবস্থা ছিলো, (আখিরাতকে নিয়ে চিন্তা না করে) সে নিজ পরিবার পরিজনদের মাঝে আনন্দের সাথে কাটিয়েছে; চিন্তা করে রেখেছিলো আল্লাহর নিকট আর ফিরে যেতে হবে না। হাঁ (ফিরে তো যেতেই হবে), আল্লাহ তাকে ভালো করে দেখছিলেন। [সূরাহ আল-ইনশিকাক (৮৪): ৬-১৫]
যে ইসলামকে পুনর্জীবিত করার জন্য জ্ঞানার্জন করে এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়, তবে তার ও নবীগণের মধ্যে জান্নাতে মাত্র এক ধাপের ব্যবধান থাকবে। (তিরমিযী, দারিমী)
লেখক: মো. আশরাফুল ইসলাম
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।