ইন্টারগ্যালাক্টিক সভ্যতার হাইপার ইনটেলিজেন্ট এলিয়েন নিয়ে আমাদের গল্প নয়, এই গল্পের এলিয়েন খুব নিরীহ। বড় বড় চোখ আর ছোট ছোট পায়ের ক্লোরোফিল যুক্ত এলিয়েন’ও সে নয়, আমাদের এলিয়েন খুব সাদাসিদে। ফিবোনাক্কি সিরিজ বা নিউট্রন স্টারের ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি কিছুই বোঝে না আমাদের এলিয়েন, সে খুব ছাপোষা প্রাণী। নাসার নাম হয়ত সে জীবনেও শোনেনাই, তবুও সে আমাদের গল্পের মূল চরিত্র, আমাদের এলিয়েন।

সভ্যতাকে নিরঙ্কুশ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সুপারম্যানের মত মারদাঙ্গা হিরো হতে চায় না আমাদের এলিয়েন, পৃথিবীর ত্রাণকর্তা সেজে হাততালি পাওয়ার আগ্রহ তার নেই। তার বেঁচে থাকাটা পানসে, ছাপোষা, একঘেয়ে তবুও জান্তব মানুষদের থেকে একটু আলাদা। লালসার আস্তাকুড়ে সে বাস করে না, তাকে ঘিরে নেই কোনো অটোগ্রাফ শিকারীদের ভিড়। এখানে বলে রাখাই ভালো যে, আমাদের এলিয়েন কোনো ভিন গ্রহের বাসিন্দা নয়, এই গ্রহের আলো বাতাসেই বড় হয়েছে সে। তবুও গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে না যাওয়াই তাকে বানিয়ে তুলেছে নিজ গ্রহে এলিয়েন, তবুও নিজের বিশ্বাস ও ধারণাকে দূষিত হওয়া থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করার কারণে তাকে বেশ আলাদাই মনে হয়, চারপাশের হযবরল থেকে একটু আলাদা বলে তাকে স্টেরিওটিপিক বলে গালমন্দ করা হয়, এভাবেই তৈরি হয়েছে আমাদের স্টেরিওটিপিক এলিয়েনের গল্প, সাদামাটা কিন্তু অসার নয়।

IIRT Arabic Intensive

এই স্টেরিওটিপিক এলিয়েন তার গুরুত্বের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, পৃথিবীর স্বার্থে সে কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্যারেক্টার। তাই নিজের আত্মপরিচয় না জানা পর্যন্ত সে নিজের কাছেও যেমন অগুরুত্বপূর্ণ ছিলো, তেমনি খুব বেশি গুরুত্বের সাথে তার নিজের পরিচয় জেনে নেয়াটাও সভ্যতার স্বার্থেই খুব জরুরী। কারণ, জান্তব নিহিলিস্টরা যখন এই পৃথিবীকে খুবলে খাচ্ছে, আকাশ, মাটি, পানি, বায়ু, জীব আর জড় সবাই তখন চিৎকার করে বলছে – আমাদের বাঁচাও – আর এই ডাক কেবল সেই স্টেরিওটিপিক এলিয়েনরাই শুনতে পারবে (যদি তারা চায়) কারণ তাদের কানগুলোতে হেডফোন পরানো নেই। তবুও আমাদের এলিয়েন অসহায়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভার, অপমান আর অপাঙ্কতেয়তার গ্লানি তার মেরুদণ্ডকে অনেকটাই কুঁজো করে দিয়েছে। তার নিজের মতো দেখতে অনেকেই নাম লিখিয়ে নিয়েছে স্রোতের তালে – তবুও এলিয়েনের জীবন চলছে অপরিচিতের মতোই – বাজারদরে মূল্যহীন হলেও অমূল্য ।

আপাত ভাবলেশহীন এই এলিয়েনরাই ইতিহাসের অনাদিকাল থেকে যখনই সভ্য পৃথিবী অসভ্যতার গণ্ডী পেরিয়ে গেছে, তখনই সভ্যতার পতাকা হাতে নিয়ে হয়ে উঠেছে জানবাজ, বদলে দিয়েছে সমাজের গতি, পাল্টে দিয়েছে দুনিয়ার স্ট্যাটাস-কো। ওরা যেন ওঁত পেতে থাকা সিংহ, সাড়া শব্দহীন – উপস্থিতির কোনো ছাপ না থাকায় অনুপস্থিত মনে হয়, দাম পাওয়ার তাড়া না থাকায় যেমন ওরা দামহীন ঘুরে বেড়ায়। তবুও ওরা আছে, ওদের কাঁধেই সভ্যতা রক্ষার মহাদায়িত্ব। বিশৃঙ্খলা আর অশান্তির পর শান্তির যে চক্র চলে, তার মধ্যে তাই আমাদের এলিয়েনের অবস্থান বাস্তবিকই পিভোটাল।

আসুন এবারে আপনাদের সামনে আমাদের এলিয়েনের পরিচয় আরও খোলাসা করি। প্রথম যখন মানুষ অণুজীবদের এক্সট্রিমোফাইল শাখার সন্ধান পেলো, তখন অনেকেই মনে করেছিলো – এই এক্সট্রিম লাইফ-ফর্ম এক্সট্রাটেরিস্টেরিয়াল লিভিং সিস্টেমের টেরিস্টেরিয়াল মডেল হতে পারে … এক্সট্রিমোফাইল হচ্ছে এমন সব অণুজীব যারা কঠিন পরিবেশ, যেমন সমুদ্রগর্ভে উদ্গীরিত লাভার সংস্পর্শের উত্তপ্ত পানিতে বাস করে যেখানে পৃথিবীপৃষ্ঠের যেকোনো সাধারণ জীব বা অণুজীবের পক্ষে জীবনধারণ সম্ভব নয়। পৃথিবী এখন এক এক্সট্রিম কন্ডিশনেই আছে। নীলচে আকাশের নিচে এই সুন্দর সবুজ পৃথিবীটাকে মানুষেরা তাদের আক্রোশ, অহংকার, অপব্যবহার আর অপব্যয়ে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। বায়ুমণ্ডলের ওপরে ওজোন স্তর থেকে সমুদ্রের তলদেশ আর ভূগর্ভ পর্যন্ত দূষিত হয়ে গেছে। রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে মহামারি আকারে আর তার চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে দীর্ঘ যুদ্ধের ক্লেদ – ধ্বংস, মৃত্যু, অনাহার। রক্ত, অস্ত্র, রোগ আর অভাবের টানাপোড়নের জীবন হয়ে উঠেছে নৈরাশ্যবাদী – নিহিলিস্টিক, ফলে মানুষের হিংস্রতা বেড়েছে আর বেড়েছে ধ্বংসের আক্রোশ। সব কিছুই ধ্বংস হয়েছে আর যা কিছু বাকি আছে তাও অন্য কিছু ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবেই টিকে আছে। কিন্তু এই অবস্থাতেও টিকে আছে কিছু এক্সট্রিমোফাইল – যখন আর সবাই স্রোতে গা ভাসিয়ে ভেসে গেছে অসভ্যতার জগতে, হারিয়ে ফেলেছে টিকে থাকার যোগ্যতা, বেঁচে থাকছে মৃতের মতো, কারণ এই এক্সট্রিম পৃথিবীতে নিজের স্বকীয়তা ধরে রেখে চলা তাদের জন্যে আর সম্ভব নয় – তখন সভ্যতার কাণ্ডারি হয়ে এই অসভ্য জগতে টিকে আছে কিছু স্টেরিওটিপিক এলিয়েন ।

আমাদের চারপাশেই এরা বাস করে, কাটিয়ে দেয় এদের ছাপোষা জীবন – আমরা টের পাই না তাদের গুরুত্ব, হয়ত তাদের অনেকেও টের পায় না। তবুও ওরা আলাদাই বটে। সবার বাচ্চারা যখন গেমস আর কার্টুন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ওদের বাচ্চারা কুরআন হিফয করে, নামী দামী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে বাবা মায়েরা যখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তখন মাদ্রাসায়, এতিমখানায় কুরআন হাদীস পড়ে ওরা বড় হয়। সবাই যখন বড় বড় চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরে, তখন মাত্র পনেরশ টাকাতেও ওরা মক্তবে পড়াতে বা মসজিদে আযান দিতে রাজি থাকে যদিও ওই সামান্য টাকাটারও কোনো গ্যারান্টি থাকে না … তবুও ওরা আলাদাই থাকে অন্যদের থেকে, পোশাকটা যেমন অন্য সবার থেকে আলাদা তেমনি আচরণটাও, ওদের ক্যাম্পাসে কক্ষনো নারীর শ্লীলতাহানি হয় না যদিও নাম করা স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কোনোটাই এর থেকে বাদ যায় না। ওদের শিক্ষকেরা ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হয় না, ছেলেরা ইয়াবাও খায় না। আযান শুনে ওরা সব নামাযে যায়, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্করা নাস্তিক হয়ে নিজেদের স্মার্ট মনে করে। লম্বা জামা, দাড়ি, টুপি নিয়ে ওরা মুসলিম থেকে যায় যদিও অনেকেই মোরালি মডার্ন হয়ে যাচ্ছে আজকাল। ওদের মেয়েগুলো ঘরেই থেকে যায়, মুক্ত নারীর মিছিলে বা হিজাবী বার্বিদের ঢলে যোগ দেয় না। মনে হয় চিনতে পারছেন, ওরা গোঁড়া আর স্টেরিওটিপিক তাই সবাই ওদেরকে ‘হুজুর’ বলে। হুজুর কথাটা বলা হয় একটু কম গুরুত্বের মানুষ বোঝাতে, সমাজ পরিচালনায় যাদের গুরুত্ব শুধু মসজিদের মিম্বর পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন, ওই মিম্বরটাই যে এখনো মানুষের পরকালের চিন্তা করে, প্রধানমন্ত্রী থেকে পিওন পর্যন্ত যখন সাধারণকে জাহান্নামের দিকেই ঠেলছে তখন এই হুজুররাই মানুষের মুক্তির কথা বলে, দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হওয়ার রাস্তা বলে দেয়। আর সমস্ত মিথ্যা, সমস্ত অবিচার, সমস্ত যুদ্ধ, সমস্ত ধ্বংসের শেষে এরাই পৃথিবীতে আবার নতুন শান্তির, নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়, জাহিলিয়াতের পরে মুক্তির সূর্য এদের হাত ধরেই ওঠে। নূহ (আ) এর দাওয়াত কবুল করা সেই দরিদ্র, ভুখা জনাকয়েক হুজুর আর হুজুরনিই যেমন নতুন পৃথিবীর পত্তন করেছিলো, তেমনি মুসা (আ) এর অনুসারী হতদরিদ্র, নিরীহ, অসহায়, নির্যাতিত হুজুরেরাই দাঊদ (আ) আর সুলাইমানের (আ) তিলোত্তমা রাজ্যের ভিত গড়েছিল । আবার মুহাম্মাদ (স) এর সাথে থাকা কতক ভুখা, ছেঁড়া জামা পরা হুজুরেরাই এক নতুন সূর্য টেনে এনেছিলেন চরম অন্ধকারের পর। পরিশেষে এই হুজুরেরাই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে – সত্য ও ন্যায় বারবার ফিরে এসেছে এবং আবার আসবে এই হুজুরদের জানবাজি রাখা তাকবীর ধ্বনির সাথে। কিন্তু আত্মপরিচয় নিয়ে শ্লাঘায় ভোগা আমাদের হুজুর গোত্রের অনেকেই জানে না নিজের সামর্থ্যের কথা, সব যুগের হুজুরেরাই দুর্বল, অভাবী আর সংখ্যায় কম ছিলো, কিন্তু তারা যখনই নিজেদের পরিচয়ে গর্ববোধ করে সত্যের স্বার্থে জানবাজ হয়েছে তখনই পৃথিবী বদলেছে তাদের ইচ্ছে মতো। এই স্টেরিওটিপিক এলিয়েনরাই পৃথিবীতে তাওহীদের পতাকা উড্ডীন করেছে, ধরে রেখেছে, রাখছে, রাখবে – এই গুরাবাদের দলই তো সফল, কারণ এই অপরিচিতদের হাতেই রয়েছে নতুনকে শুরু করার চাবি। এরা চাইলেই দুনিয়া বদলায়, এরা চাইলেই চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়, এরা চাইলেই সূর্য থেমে যায়, এরা চাইলেই সমুদ্রের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটে যায়, এরা চাইলেই মানচিত্র বদলায়, চাইলেই হয়, তাই চাইতে হয় আর হুজুরদের থেকে ভালো করে কে চাইতে পারে … এদের চলনে সুন্নাত বাঁচে, এদের বলনে ইসলাম জাগে। কিন্তু ওরা তবু সাদামাটা, বোকাসোকা, হালের তালে চলে না তাই স্টেরিওটাইপ।

পৃথিবী বদলে দেবার স্বপ্ন দেখে অনেকেই, কিন্তু বাস্তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে কাজ করার সামর্থ্য আল্লাহ শুধুমাত্র এই স্টেরিওটাইপ এলিয়েনদেরকেই দিয়েছেন – অন্য কাউকে নয়, অন্য কেউ তাই বদলাতে গেলে কেবল বিশৃঙ্খলাই বাড়ে। ইতিহাস ও বর্তমান এর স্বাক্ষী – তাই আপনি যে-ই হোন না কেন, পৃথিবীর ভালো চাইলে এই এলিয়েনদের দলেই যোগ দিতে হবে, নিজের দাম কমিয়ে কম দামী হুজুর হতে হবে। এলিয়েনদের গল্প নিয়ে অনেকেই মাতে, কিন্তু বাস্তবে নিজেকে এলিয়েন বানিয়ে ফেলাটা ট্রাই করে দেখুন না, দেখবেন আড্ডার বান্ধবেরা সিগারেট শেয়ার করতে না পেরে কেমন দূরে সরে যায়, দেখবেন পরিবারের লোকেরা কেমন উদ্বেগের চোখে তাকায়, দেখবেন হারাম টাকা কীভাবে আপনার থেকে পালায়। দেখবেন চারপাশের মানুষগুলো কেমন আলাদা, দিনার আর দিরহামের গোলামদের চেহারা দেখবেন কেমন বিচিত্র, দেখবেন ইয়ো আর ইয়াবা জেনারেশন কতটা ফ্যাকাসে, দেখবেন নষ্ট পৃথিবীর আবর্জনা চারপাশে। সভ্যতার রোগটা ভাসছে সামনে, কুরআন খুলুন, সভ্যতার সার্জারি তো আর সবার কাজ না! তবে হুজুর বলুন, গুরাবা বলুন, বিজয়ী বলুন, এই স্টেরিওটিপিক এলিয়েনরাই এই সার্জারি কোর্সের ছাত্র। প্যান্টটা টাখনুর উপর তুলেই ফেলুন, দেখবেন কেমন এলিয়েন এলিয়েন লাগে – নিজের ভেতরে টের না পেলেও অন্যদের বাঁকা চোখই আপনাকে টের পাইয়ে দেবে, টুপিটা নিয়ে চলে যান না ফজরের জামাতে – যদি এলিয়েন মনে না হয়, আমার গল্পের নামটাই পাল্টে দিতে পারি! কিন্তু আমি, আপনি সবাই জানি এর প্রয়োজন হবে না। কারণ আপনি নিজেও এতক্ষণে এলিয়েন হয়ে উঠেছেন, একজন হুজুর হয়ে উঠেছেন, যেনতেন হুজুর না – খোদ মানব সভ্যতার কাণ্ডারি, চারপাশের জগত থেকে ভিন্ন একজন, আপনিই আমাদের গল্পের সেই এলিয়েন, মহাজাগতিক কল্পনা নয় – জাগতিক বাস্তব এক স্টেরিওটিপিক এলিয়েন, দেখুন না সত্যের জন্যে দুনিয়া পাল্টে দেয়া এক বিপ্লবী হতে কেমন শিহরণ তৈরী হয় বুকের ভেতরে – সাথে সাথে আল্লাহর বাণীগুলোকে ছেড়ে দেই আমাদের অন্তরকে প্রকম্পিত করতে! তাকওয়ার প্রকম্পনের সাথে বিপ্লবী শিহরণ মিলে তৈরি হোক জীবনের সত্যিকারের অর্থ, ভাবলেশহীন সামান্য মানুষ কিন্তু অদম্য শক্তির রক্ত মাংসের এলিয়েন – অজেয়, অবিচল – স্টেরিওটিপিক এলিয়েন কিংবা গুরাবা কিংবা হুজুর … … … !!! … … …

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive