ইনফিনিটি ওয়ার। ওয়ার অ্যাগেইন্সট ইভিল ডিজায়ারস, ওয়ার অ্যাগেইন্সট নাফস। এই যুদ্ধ চিরকালের; যেখানে যোদ্ধা হলাম আমরা আর আর্টিলারি রমাদ্বান, যার শিল্ড হলো অভেদ্য সিয়াম। রমাদ্বান এই যুদ্ধ করতে শেখায়, জিততে শেখায়। কার যুদ্ধ কী রকম যাচ্ছে জানি না; তবে সাধারণ সমস্যা যদি সিনেমা, সিরিজ আর গান হয়, তাহলে একটা সহজ উপায় বলে দিচ্ছি এই রমাদ্বানে। অসুখ যদি এতটাই মারাত্মক পর্যায়ের হয় যে সিয়ামও আপনাকে এ থেকে বিরত রাখতে পারছে না, তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। নিজেকে আবারও মনে করিয়ে দিই, সিয়ামকে না খেয়ে থাকা বানাবো না। নিজের যেখানে দুর্বলতা, ঐটা না করাই আমার জন্য সংযম।

সবার আগে যা-ই করছেন, সেটা যে গুনাহের কাজ এটা স্বীকার করে নিন। দেখছেন শুনছেন এটা এক জিনিস। আর এগুলো করছেন আবার মানুষের সামনে গর্ব করে ছড়িয়েও দিচ্ছেন, এর অর্থ আপনার কাছে মনেই হয় না এটার কোনো খারাপ প্রভাব আছে। বরং এটাকে আরো মহিমান্বিত করতে সদা ব্যস্ত। গুনাহ জায়েজ করার সবচেয়ে বড় চালাকি হচ্ছে অন্যকেও তাতে শামিল করে নিজের পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং তার গুণকীর্তন করতে থাকা। কেউ এই বৃত্তের স্রষ্টা, কেউবা শিকার। মনে রাখবেন সংখ্যাধিক্য কখনো কালোকে সাদা বানিয়ে দেয় না। কুরআন অন্তত সেই শিক্ষাই দেয়-

IIRT Arabic Intensive

আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে; তারা অনুমান করে ছাড়া চলে না, আর মিথ্যা ছাড়া বলে না। [সূরাহ আল-আন’আম (৬):১১৬]

আপনি সিনেমা দেখে যখনই ফেইসবুকে তা ছড়ানো থেকে বিরত থাকবেন; আপনার প্রিয় সিরিজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বন্ধুদের মধ্যে, আপনি সবচেয়ে ভালো জানেন অথচ নিজেকে আল্লাহর জন্য সংযত রেখে চুপ করে বসে থাকলেন; চেনা গান চলছে, আপনি গাইতে পারেন নাচতে পারেন অথচ অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছেন; জেনে রাখবেন, এই যে সংযত থাকলেন, গুনাহকে সবার মাঝে মহিমান্বিত করার লোক দেখানো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসলেন, পরেরবার যখন এই গুনাহ একা একা করতে যাবেন, আগের মতো ইচ্ছা পাবেন না। কারণ এই বিষয়গুলার মূল জায়গাটাই হচ্ছে লোক দেখানো, অতঃপর জাতে ওঠা। আপনি যদি এগুলা দেখে একটা কথা কাউকে বলতেই না পারলেন; এ বিষয়ে উচ্চমার্গীয় আলোচনা তো পরে, কোনো ধরনের আলোচনাই করতে না পারলেন একটা শব্দও উচ্চারণ না করলেন; ওয়াচিং, লিসেনিং, রিভিউয়িং, শেয়ারিং কিছুই না করলেন; আপনি আর জাতে উঠতে পারলেন কই? আপনার ইচ্ছা আপনা আপনিই মরে যাবে। শয়তানেরও বন্ধু বান্ধব আছে, আপনার এই অবস্থা দেখে আপনাকে ছেড়ে হতাশ হয়ে নিজের স্টেটাস বাঁচাতে এমনিই ছেড়ে চলে যাবে।

গানের ব্যাপারটা এই দুই থেকে একটু ভিন্ন। আপনি কাউকে না বললেও গান আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারে। এর কারণ আমাদের অন্তরের কাজ হচ্ছে ইবাদাত করা, ইবাদাত সে করবেই আর ইবাদাতের স্থান একটাই। আপনি যখন কুরআন ভুলে, আল্লাহকে ভুলে দুনিয়াকে ইলাহ বানিয়ে নিবেন, জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দিবেন, সালাত-কুরআনের ধারে কাছেও থাকবেন না, তখন ইবাদাতের ঐ স্থানটা পূরণ হবে কী দিয়ে? মনে রাখতে হবে মুসলিমের ইবাদাত কেবল জায়নামাযে সীমাবদ্ধ না, তার পুরো জীবন পদ্ধতিরই একটা বলে দেওয়া তরিকা আছে। আপনি যখন আল্লাহর রাস্তায় চলবেন না কাজেই বাকি থাকে আরেক, শয়তানের রাস্তা। আর বিশ্বাস করেন, গান শয়তানের অত্যধিক প্রিয় জিনিস। আপনি এটা শুনে এবং তিলাওয়াত করে তার বন্দনা করলে সে অনেক খুশি হয় এবং অন্তর তার বন্দনা করতে করতে মশগুল হয়ে কুরআনকে বাতিল ঘোষণা করে ঐ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়। তাই গান আর কুরআন কোনোদিন এক অন্তরে থাকতে পারে না, একটা থাকা মানেই আরেকটি অনুপস্থিত। উম্মাতের ভিতর কিছু লোক যে বাদ্য-বাজনাকে হালাল জ্ঞান করবে, তা শোনার যন্ত্র শেষ জামানায় থাকবে মাথার উপর, সেটা আল্লাহর রাসূল ﷺ আগেই বলে গেছেন। কাজেই এই তিনের ভিতর গান সবচেয়ে ভয়ানক রোগ। তবে এটাও আগের পদ্ধতি অনুসরণ করলে চলে যাবে ইনশা আল্লাহ। চেষ্টার কাজ আমাদের, দেওয়ার কাজ আল্লাহর। মানুষের সাথে গান নিয়ে কথা বলবেন না, নতুন গান কারো কাছে নিতে যাবেন না, গান গাইবেন না, সাজেস্ট করবেন না – এভাবে একা একা লোক না দেখিয়ে কতদিন চলবে? কেউ হারাম রেখে হালালের পথে আসবে আর আল্লাহ সাহায্য করবে না – এমনটা হয় না।

আপনি ডিসি ফ্রীক, মার্ভেল লাভার, টিকেটের জন্য জান কুরবান বা পরের সিজন কবে আসবে, ও মাই গড একই সময়ে এতগুলা সিরিয়াল কীভাবে খাবেন, কয় বেলা খাবেন, কনসার্ট হচ্ছে, আপনি মেটাল হেড, মেলোডি ভাল্লাগে না, এদিকে মেলোডিয়ানরা বলবে আপনি সঙ্গীতের কী বুঝেন, চিল্লাইলেই গান হয়? কত উচ্চমার্গীয় আলাপ, কারণ আপনি ফ্যান, ভক্ত, আপনার রক্তে মিশে আছে ভক্তি। রাসূলুল্লাহর ﷺ তরফ থেকে একটা সংবাদ আপনাদের জন্য জনাব/জনাবা, খুশির কি না আপনিই ভালো বুঝেন। কাল হাশরের ময়দানে আপনাকে আমাকে উঠানো হবে আমাদের ভালোবাসার মানুষদের সাথে, যাদের আমরা এই দুনিয়াতে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতাম। জনাব-জনাবারা, সেই দিন এই দিনের মতো হবে না। মুখ থাকবে চুপ, গলায় থাকবে বই – গল্পের? হ্যাঁ আপনার আমার জীবনের, যেই গল্পের ভক্ত আপনি আর যাদের ভক্তি করতেন আজ তারাই আপনাকে ঘিরে আছে একই সারিতে টিকিট ছাড়াই, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে! অথচ আজ আপনি নিশ্চিত না কেন এই সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার ইলাহরা আজ আপনার পাশেই অথচ আপনার শরীর কাঁপছে ভয়ে। দিশেহারা লাগছে? আরেকটা সুযোগ চান? যেহেতু লেখাটা এখনো পড়ছেন আর আমিও লিখছি, সুসংবাদ নিন, সুযোগ আমাদের পায়ের কাছে এসে ভিড়ে আছে। মাস চলছে রমাদ্বান। আহা দেখুন বাইরে, ভেতরেও দেখুন, একদম অন্তরের ভিতরে, অনুভব করুন কী সুন্দর এই নিয়ামাত। বিশ্বাস করুন সব আপনারই জন্য। আর কত ভুলে থাকবো আমরা বলুন, কাছে আসতেই হবে।

গুনাহ থামানোর আগে দেখানো বন্ধ করতে হবে। এই যে ওয়াচিং, এই যে লিসেনিং, এই যে একটা কাভার, একটা রিভিউ – নিজের হাতে গুনাহের প্রমাণ রেখে যাচ্ছি। আজ যারা আমাদের জন্য তালি বাজায়, লাইক দেয়, লাভ দেয়, কালকে এরাই হবে আমাদের প্রধান সাক্ষী যা আমরা নিজের হাতে সাজিয়ে যাচ্ছি। উপর্যুক্ত সবই নিরেট বিনোদনের অসার উৎস। আর বিনোদন যদি চলিত জীবনে অক্সিজেনের মতো স্থান দখল করে নেয়, একদিন নিজের জীবনই একটা বিনোদনের উৎসে পরিণত না হয়ে যায়! শুধু এগুলোই না সম্মানিত মুসলিমীন, রমাদ্বানেও যদি নিজের স্বভাব পরিবর্তন না করতে পারলাম, ইফতার শেষেই আবার হারামকে হালাল বানালাম, সংযমটা কোথায় করলাম? অন্যের হারাম আমার সংযম না; আমার হারাম আমার সংযম, কথাটা বুঝাতে পারলাম? সবচেয়ে বড় ভয়ের কথা কী জানেন? এই মাসে পুরোটাই আমরা আর আমাদের নাফস। এখানে শয়তান নেই। তার প্ররোচনায় যা করতাম, তা থেকে মুক্তি দিতে আল্লাহ একটা মাস আমাদের প্রশিক্ষণ দেন অবিরত। প্রশিক্ষণের ফলাফল কীরূপ হলো, তা প্রাথমিকভাবে দেখা যায় ইফতারের পর, আর সামগ্রিকভাবে দেখা যায় মাস শেষে। আর যদি প্রশিক্ষণই না নিতে পারলাম, তাহলে শুধু পেটের ক্ষুধাটাই বাড়ালাম, নাফসকে তার ইচ্ছামতো ইলাহের সিজদা করতে দিলাম। প্রশিক্ষক হিসাবে শয়তানকে নবী বানালাম। নবী না থাকলেও অনুসরণ তো করাই যায়, নাকি? নাউযুবিল্লাহ (আল্লাহর কাছে পানাহ চাই), শয়তানের অবর্তমানে তার কাজ নিজের হাতে তুলে নিবো না।

ভুল করাটা নিন্দনীয় নয়। দোষ তখনই, যখন ভুল জেনেও মানুষ তা আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। রমাদ্বান চলে যাবে, শয়তান এসে যাবে। এরপর সেও স্বাধীন, আপনিও স্বাধীন। এই দুইজনের মাঝে একটা পার্থক্য তো থাকা উচিত, আর পার্থক্য তৈরির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, শয়তানের না আপনার? ঐ অভিশপ্ত সত্তা যে মানুষকে সৃষ্টির পর সিজদা করেনি সে স্বাধীন এগারো, আপনি স্বাধীন বারো, একটি সম্পূর্ণ মাস আপনারই জন্য। হে সৃষ্টির সেরা, তারপরও হেরে যাবো? হে বলবান সৈনিক, আছেন তো এই যুদ্ধে?

আল্লাহ মাফ করুন। এই লেখার, লেখক ও পাঠকের ভুল-ত্রুটি আলাহ ক্ষমা করুন এবং রমাদ্বানের বারাকাত আস্বাদন করার তাওফীক্ব দিন।

প্রিয় পাঠক, দেখতে পাচ্ছেন? করতে পারছেন? শুনতে পাচ্ছেন? বলতে পারছেন? পারছেন তো? এগুলো সবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার জন্য তাওফীক্ব। এখান থেকে যা-ই পারছেন, সবই আপনার চয়েস। আজকে পারছেন, কাল পারবেন তো?


লেখক: মুরসালিন নিলয়

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive