আমরা যারা খানিকটা ইসলাম বুঝতে পেরেছি তাদের ক্ষেত্রে একটা সাধারণ ঘটনা ঘটে। আমরা যখনি ইসলামের একটা বিধান জানি, বা কুরআনের একটা আয়াত অর্থসহ বুঝে পড়ি বা হাতের সামনে যখন হাদিসের কোন কিতাব থাকে প্রায়ই আমরা পড়তে থাকি আর অবাক হয়ে যাই। ‘দারুণ তো’ ‘কী সুন্দর যুক্তি!” এগুলো হয় আমাদের তখনকার অনুভূতি। প্রায়ই আমরা আনন্দে গদগদ হয়ে যাই এবং সবাইকে জানিয়ে আনন্দ ভাগ করে নেয়ার চিন্তায় অস্থির হয়ে যাই। হ্যাঁ! এমনটি অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে। কিন্তু এর বিপরীতে একটি ঘটনা ঘটে থাকে যা আমাদের কষ্ট দেয়, অস্থির করে তোলে, হতাশায় নিমজ্জিত করে। সেটা কী?

এই আমরাই যখন আনন্দের আতিশয্যে আয়াতটি অন্য অনেককে বলি তখন দেখি তারা মোটেও আশ্চর্য হচ্ছে না। বা তাদের মনের জমাট অনুভুতি গুলো কেন যেন গলে যাচ্ছে না। অত্যন্ত আবেগের কাহিনি শুনেও কেন যেন চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে আসছে না। এর কারণটা কী?

IIRT Arabic Intensive

আপনি প্রায়ই দেখবেন যে আপনার অতি কাছের বন্ধু বা আপনার পরিবারের কেউ যার সাথে আপনি জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা সময় ব্যয় করেছেন, যার সাথে আপনার অনেক কিছুতেই মিল আছে বা যাকে আপনি অনেক কিছুই বলতে পারেন, তার কাছে যখন আপনি ইসলামের একটা সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরবেন তখন লক্ষ্য করবেন সে আপনার মত মজা পাচ্ছে না। আপনি যেভাবে বিষয়টা ফিল করছেন সে সেভাবে করছে না। আপনি যেটার সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন সে সেটা পারছে না।
আমার ক্ষেত্রে যেটা হয় আমি মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যাই। খুব কষ্ট লাগে, খুউব। আমার এত কাছের একজন মানুষ সত্য টা বুঝতে পারছেনা। কেন পারছেনা? আমার মনে হয় আমি কী তাকে ঠিকমত বিষয়টা তুলে ধরতে পারছিনা?  আসলে কিন্তু তা নয়।
আপনার দায়িত্ব শুধু ব্যাখ্যা করে যাওয়া যতবার আপনার দ্বারা সম্ভব হয়ে থাকে। আর ব্যাখ্যা টা অন্তরে ঢুকানোর দায়িত্ব আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ওয়াল জালাল তাঁর নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন। হেদায়াত আসে আল্লাহর কাছ থেকে। আমরা শুধুই সতর্ককারী। যেমনটি আল্লাহ কুরআনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলেছেন, “ নিশ্চয়ই আপনি সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা”।

আপনি হয়তো খুব আশা সহকারে আপনার এক বন্ধুর কাছে গিয়েছেন। আপনার মনে চিন্তা “আজ যেভাবেই হোক তোকে জন্মদিন পালন করার অসারতা ও ইসলামে এর নিষেধাজ্ঞার কথা বুঝিয়েই ছাড়ব”। অথচ কোনভাবেই তার বুঝে আসল না। এর কারণটা কী?

আপনি হয়তো ইসলামিক কালচারের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কিছুদিন যাবত বিস্তর স্টাডি করেছেন। আল্লাহ আপনাকে হেদায়াত দিয়েছেন, আলোর পথ দেখিয়েছেন। এখন আপনি ইসলামের যে বিষয়টাই পড়েন তা মানতে আপনার বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকে না। আপনি শুনেন আর মানেন। সামি’না ওয়া আত’না। তাই আপনি স্টাডি করামাত্রই আমল করা শুরু করে দিয়েছেন। মানে আপনি আপনার হার্ডডিস্ক এ কপি করার অব্যাবহিত পরেই ইন্সটল করে নিয়েছেন। কিন্তু আপনার মাথায় রাখতে হবে যে সবার হার্ডডিস্ক, র‍্যাম এগুলো সমান না। তাই আপনি যখন আপনার বন্ধুর কাছে সবকিছু বললেন, সে সবি কপি করল কিন্তু ইন্সটল করতে পারল না।
আমি আগে যখন কম্পিউটার গেমস খেলতাম তখন একটা সমস্যা প্রায়ই হয়তো। ফাইল মিসিং। কম্পিউটার বলত তোমার DirectX নামে একটা ফাইল নেই বা অমুক ফাইল মিসিং। সেরকমই আপনার ফ্রেন্ড এর বা আপনার ভাই বা বোনের যে ফাইল টা মিসিং তার নাম হেদায়াত। এই ফাইল যতক্ষন না আসছে ততক্ষন ঐ তত্ত্বটা ইন্সটল হবে না এখন আপনি তাকে যত ভালভাবেই বুঝান না কেন। আর সেই মিসড ফাইল আল্লাহ যাকে চান তাকেই দেন। ধৈর্য ধারণ করা ছাড়া আমাদের করার কিছুই নেই। তাই আমাদের হতাশ হবারও কিছু নেই যেখানে আমরা জানি আল্লাহ ওকে হেদায়াত নামক হীরার টুকরা দিয়ে ধন্য করেন নাই।

আর আল্লাহ যখন কারো মাঝে এই হেদায়াত এর সম্পদ দিয়ে দেন তখন তাকে জগতের বড় বড় শক্তি মিলেও বাধা দিতে পারে না। যে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ তার রণকৌশল দিয়ে মুসলিম দের যুদ্ধে বিপর্যস্ত করত সেই খালিদ হিদায়াত এর পর হয়ে গেল সাইফুল্লাহ মানে আল্লাহর তরবারি। সে আল্লাহর পথে কিতাল-এ বের হল আর একটার পর একটা জয় করেই গেল। হেদায়াতের নাম তো এটাই। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। এই জিনিসটা আমাদের মাথায় গেঁথে রাখতে হবে নতুবা আমরা আল্লাহর পথে ডাকতে গিয়ে হতাশ হয়ে যাব। অথচ একজন মু’মিন দায়ির তো হতাশ হওয়া সাজে না। সে থাকবে পাহাড়সম ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। ইস্পাতকঠিন হবে তার মনোবল। ব্যক্তিত্ব হবে তার বলিষ্ঠ। সে যখন একবার জেনে গেল সত্য কী জিনিষ তখন অন্য কারো মানা না মানা তাকে সত্যের প্রতিষ্ঠায় পিছপা করবে না এটাই তো ঈমানের দাবি।

এভাবে জীবনপথে চলতে গিয়ে ছোট্ট ছোট্ট বিষয়ে আপনি সচেতন থাকবেন কিন্তু আপনার সমাজ, আপনার পরিবার সে পরিমান সচেতন নাও থাকতে পারে। আপনি হয়তো সহজেই বুঝেন পেপসি খাওয়া মানে ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্ত খাওয়া কিন্তু আপনার ভাই নাও বুঝতে পারে। মিউজিক শোনা হারাম আপনি বুঝে ফেলবেন কিন্তু দেখবেন আপনার পাশের বন্ধুটি বুঝবে না। আপনি জানেন যে দাড়ি না রাখলে গুনাহ হবে কিন্তু সমাজ বলবে এত্ত অল্প বয়সে কিসের দাড়ি। বিশ্বজগতের সবচেয়ে স্মার্ট, সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাড়ি ছিল, আপনি জানেন শেভ করে তার চেয়ে বেশী স্মার্ট কেউ কোনকালেই হতে পারবে না। কিন্তু এটা আপনি যত সহজে বুঝে ফেললেন আপনার স্ত্রী হয়তোবা নাও বুঝতে পারে বা আপনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলতে পারে জামাইকে তো বয়স্ক দেখা যায়। এভাবে ইসলামের পথে থাকলে একটার পর একটা তীর এসে আপনার শরীরে লাগবে। আর আপনি হতাশ না হয়ে মনে মনে হাসবেন। আমিও মাঝে মাঝে হাসি। আমি দাবি করি না যে আমি অনেক ভাল মুসলিম কিন্তু আমি ইসলামের সৌন্দর্য অনুভব করেছি। তাই জানি আমি যতক্ষন ইসলামের পথে আছি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার সাথে আছেন। এই শক্তির স্বরূপ যে ব্যাক্তি জানে তাকে তো কোনকিছুই হতাশ করতে পারে না। সে একজন ইস্পাত কঠিন পুরুষ/নারী হয়ে যায়। এবং তার উদাহরণ সেই ব্যাক্তির মত যে পানিহীন সাহারার মাঝে তৃষ্ণার্ত বুকে দাড়িয়ে আপন মনে নিস্পৃহ হাসি হেসে বলে, I don’t care, Allah is with me!!

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive