এক আদরের মামুনিটা একদিন বায়না করে বসলো। পার্কে ঘুরতে যেতে চায় সে। রাকিব সাহেবের ছোট্ট মেয়ে খাদিজা। এমনিতেই রাকিব সাহেব তাঁর এই মেয়েকে অনেক পছন্দ করেন। বলা চলে নিজের জান বলতে তিনি তাঁর মেয়ে খাদিজাকেই বুঝেন। মেয়ের বায়না তো আর ফেলা যায় না। তাই রাকিব সাহেব সময় বুঝে বিকালে খাদিজাকে নিয়ে একটি পার্কে ঘুরতে বেরিয়ে গেলেন।
সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাবা এবং মেয়ে হাঁটছেন। পথিমধ্যে আপেলের একটি দোকান চোখে পড়লো। ছোট্ট খাদিজা এবার নতুন বায়না ধরলো আপেল কিনে দেবার জন্য। তাই রাকিব সাহেব দুইটা আপেল কিনে খাদিজার হাতে দিলেন। পরক্ষণেই রাকিব সাহেবের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেলো। তবে একে দুষ্টু বুদ্ধিও বলা যেতে পারে।
তিনি চিন্তা করলেন, “আমি খাদিজাকে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। কিন্তু ও আমাকে কেমন ভালোবাসে, তা তো আমি জানি না। আজকে এর একটা পরীক্ষা নেওয়া যাক।” তাই তিনি খাদিজাকে বললেন, “আম্মু, তুমি চাইলে তোমার দুই হাতে থাকা আপেল দুইটি থেকে যেকোনো একটি আপেল তোমার বাবাকে দিতে পারো।” বাবার এই কথা শুনার সাথে সাথেই খাদিজা তার ডান হাতের আপেলটিতে একটি কামড় বসিয়ে দিলো। বাবা হতচকিয়ে গেলেন। তিনি কিছু বলার আগেই খাদিজা তার বাম হাতের আপেলটিতেও একটি কামড় বসিয়ে দিলো। বাবা এবার মনে মনে বেশ রাগ করলেন। তিনি ভাবলেন, এতটুকু মেয়ে, তারপরেও কী লোভ তার!! যাকে তিনি এত আদর করেন, সে কি না তাঁকে একটি আপেল দেওয়ার কথা শুনে টপাটপ দুইটা আপেলেই কামড় বসিয়ে দিলো!! একটি আপেল দিতে সে এতটাই অপছন্দ করলো! খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি। তিনি ভাবলেন, তাঁর এই ছোট মেয়েটি একটি লোভী মেয়ে!! ভাবতে ভাবতে তিনি নিজের অজান্তেই মেয়ের হাতটি ছেড়ে দিয়ে একটু সামনে চলে আসলেন। মনের দুঃখে তাঁর পিছন ফিরে তাকাতেও মন চাচ্ছিলো না।
খানিক সময় পর খাদিজা দৌড়ে এসে বাবার হাতটা ধরলো। বাবা কিছু বলার আগেই সে তার বাবাকে বললো, “বাবা, তুমি একটা আপেল চেয়েছিলে। তাই আমি দুটো আপেলেই কামড় বসিয়ে দেখলাম কোন আপেলটা কেমন। আমার ডান হাতের আপেলটা বেশি জুসি আর মিষ্টি। তাই আমি চাই তুমি আমার ডান হাতের আপেলটাই নাও।” এই বলে ডান হাতের আপেলটি খাদিজা তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে মিষ্টি করে একটি হাসি দিলো।
রাকিব সাহেব এবার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। বাচ্চা মেয়েটা বলে কী!! ইতোমধ্যে তার সম্পর্কেই তিনি কি না আজেবাজে ধারণা করতে শুরু করেছিলেন। মেয়েটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি কতই না তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন। এটা ভাবতেই তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
দুই এই ছোট গল্পটিতে রাকিব সাহেব যেই ভুলটি করেছেন, তা সবারই চোখে পড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা অনেকেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই ভুলটি করে থাকি। কোনো কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা খুব বেশি তাড়াহুড়ো করি। ফলে অনেক সময়েই আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হই। মহান আল্লাহ সূরাহ আম্বিয়ার ৩৭ নং আয়াতে বলেছেন,
خُلِقَ الْإِنْسَانُ مِنْ عَجَلٍ
অর্থ: মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাড়াহুড়ো (করার প্রকৃতি) দিয়ে।
উল্লেখ্য, যেহেতু রাসূল ﷺ এর সাহাবীরাও মানুষ ছিলেন, তাই তাঁদের কেউ কেউ কিছু ব্যাপারে সামান্য তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে তা থেকে বিশুদ্ধ তাওবাহ করে নেন। নিচের একটি হাদীস এর প্রমাণ বহন করে,
উসামা ইবনু যায়িদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের এক সেনাভিযানে পাঠালেন। আমরা অতি প্রত্যুষে জুহায়ানা গোত্রের হুরাকা শাখার উপর হামলা করলাম। যুদ্ধে আমি এক ব্যক্তিকে মুখোমুখি পেয়ে গেলাম। সে لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ বলে উঠলো, আমি তাকে বর্শা দ্বারা আঘাত হানলাম। এতে আমার অন্তরে খটকা সৃষ্টি হলো। পরে আমি রাসূল ﷺ এর খেদমতে ঘটনাটি উল্লেখ করি। তিনি বললেন,
সে কি لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ বলেছিলো, আর তুমি তাকে হত্যা করে ফেললে?
আমি আরয করলাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! সে তো এ কথা আমার অস্ত্রের ভয়ে বলেছিলো।’
তিনি বললেন,
তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছো, যাতে তুমি জানতে পারলে যে সে এ কথাটি ভয়ে বলেছিলো?
তিনি বারবার এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করছিলেন। ফলে আমার মনে হচ্ছিলো যে, আজই যদি আমি ইসলাম কবুল করতাম! … ”
(সহীহ মুসলিম, অনুবাদ-ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং-১৭৯)
তবে এই হাদীস থেকে এও প্রমাণ হয় যে, ওই সাহাবী এই ঘটনার পরে অনেক আফসোস করেছেন। অর্থাৎ, তাড়াহুড়ো করার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তিনি পরে অবহিত হয়েছেন।
এক হাদীসে এসেছে,
ধীরস্থিরতা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর তাড়াহুড়ো আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। (হাসান সহীহ, সহীহ আল-জামি,৩০১১)
এছাড়াও অন্য একটি হাদীস অনুযায়ী,
… এমন দুটি গুণ রয়েছে, যা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। সে গুণ দুটি হচ্ছে সহিষ্ণুতা আর ধীরস্থিরতা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭)
তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেই আমাদের তাড়াহুড়ো পরিহার করা উচিত। উচিত ধীরতা অবলম্বন করা। তাহলে আমরা অনেক ভুল সিদ্ধান্ত থেকে বেঁচে থাকতে পারবো এবং মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা আমাদের জন্য সহজ হবে। আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ আমাদের দেওয়া তাঁর নি’য়ামাত আরো বাড়িয়ে দিবেন।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।