একভালোবাসা!

কিছু মানুষ সারা জীবন ধরে একে খোঁজে। কখনো দেয়ার মাঝে, কখনো নেয়ার মাঝে। কখনো পিছু ফেরার মাঝে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই, শুধুই অপেক্ষা করার মাঝে। তারা বিশ্বাস করে ভালোবাসা হচ্ছে দীর্ঘ পথের শেষে কোন গন্তব্যে পৌঁছানো। এবং সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তারা ব্যাকুল হয়ে থাকে। কারও হৃদয়ের আন্দোলনে তাদের হৃদয়ও আন্দোলিত হয়। কিছু আশাহীন আবেগপ্রবণতা, ভালোবাসার জন্য বোকা বনে যাওয়া অথবা সত্যিকার অনুরাগের কোনো নিখাদ অভিব্যক্তি। তাদের কাছে এই খুঁজে ফেরা যেন এক আমৃত্যু আবেশ। কিন্তু এই বিষাদময় অন্বেষণের যেমন মূল্য আছে, তেমন উপহারও আছে।

IIRT Arabic Intensive

এই আশা আর ‘ভালোবাসার প্রেমে পড়ার’ পথটা বেদনাদায়ক, কিন্তু এর শেখানোর আছে অনেক কিছু। এই প্রায়শই যন্ত্রণাদায়ক পথের মাঝে ভালোবাসার প্রকৃতি, এই পৃথিবী, মানুষ আর নিজের আপন হৃদয় সম্পর্কে অনেক অজানা বিষয় লুকিয়ে থাকে। সর্বোপরি, এই পথ ভালোবাসার স্রষ্টা সম্পর্কে অনেক শিক্ষা বহন করে।

এই পথের পথিকরা প্রায়ই এই উপলব্ধিতে এসে পৌঁছে যে, যে মানবীয় ভালোবাসা তারা খুঁজে ফিরছিল তা আসলে গন্তব্য ছিল না। সেই মানবীয় ভালোবাসার কিছু রূপ আমাদের জন্য উপহার হতে পারে। এটা নিমিত্ত হতে পারে। কিন্তু যখনই আপনি একে গন্তব্য বানিয়ে ফেলবেন, আপনার পতন হবে। এবং আপনি ভুল জিনিসকে কেন্দ্র করে পুরো জীবনটা পার করে দিবেন। আপনি পথের খাতিরে গন্তব্যকে বিসর্জন দিবেন। জাগতিক পরিপূর্ণতায় পূর্ণ এক ‘গন্তব্যে’ পৌঁছানোর জন্য জীবন দিয়ে দিবেন যার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই।

যে মরীচিকার পেছনে ছোটে সে কখনো সেখানে পৌঁছাতে পারে না; বরং ছুটতেই থাকে। তেমন আপনিও ছুটতে থাকবেন এবং এর জন্য নিজের ঘুম নষ্ট করবেন, কাঁদবেন, রক্তাক্ত হবেন। কখনো কখনো নিজের অতি মূল্যবান জিনিসও বিসর্জন দিবেন, এমনকি আত্মসম্মানবোধও। কিন্তু আপনি যা খুঁজছেন কখনোই এই জীবনে তার কাছে পৌঁছাতে পারবেন না, কারণ আপনি যা খুঁজছেন তা কোন পার্থিব গন্তব্য নয়। যে ধরণের পূর্ণতা আপনি খুঁজছেন তা বস্তুগত দুনিয়ায় পাওয়া যাবে না। তা শুধু স্রষ্টার মাঝেই পাওয়া যাবে।

যে মানবীয় ভালবাসার প্রতিমূর্তি আপনি খুঁজে ফিরছেন তা জীবনের মরুভূমিতে শুধুই এক মোহ। তাই এটা যদি আপনি খুঁজতে থাকেন তাহলে আপনি শুধু পিছু ছুটতেই থাকবেন। কিন্তু আপনি কোন মরীচিকার যত কাছেই যান না কেন, কখনোই তাকে ছুঁতে পারবেন না। আপনি কোন কল্পিত বিষয়কে অধিকার করতে পারবেন না। এমন কোন কিছুকে ধারণ করতে পারবেন না যা আপনার মনের তৈরী।

দুইতারপরও, আপনি এই ‘জায়গায়’ পৌঁছানোর জন্য আপনার সমস্ত জীবন দিয়ে দেন। কারণ রূপকথায় এখানেই গল্পের শেষ হয়। রূপকথা শেষ হয় খুঁজে পাওয়ায়, মিলনে, বিয়েতে। দুটি প্রাণের এক হয়ে যাওয়াতে। আপনার চারপাশের সবাই আপনাকে এমন মনে করাবে যে আপনার পথের শেষ সেখানেই যেখানে আপনার জীবনসঙ্গীর সাথে আপনার দেখা হবে – যখন আপনার বিয়ে হবে। শুধু তখনই সবাই আপনাকে বলবে যে অবশেষে আপনি পূর্ণতা পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা মিথ্যা কথা, কারণ স্রষ্টা ছাড়া আর কোন কিছুর মাঝেই পূর্ণতা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু একদম ছোট্ট থেকে প্রতিটা গল্প, গান, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, শুভাকাঙ্খী খালামণিরা আপনাকে শিখিয়েছে যে এমনটা না হলে আপনি পূর্ণতা পাবেন না। এবং যদি আল্লাহ না করুক অন্যথা হয় এবং আপনার বিয়ে না হয় অথবা আপনার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাহলে আপনাকে কোন না কোনভাবে ত্রুটিপূর্ণ বা অসম্পূর্ণ মনে করা হয়।

আপনাকে শেখানো হয় যে গল্পের শেষ হয় বিয়েতে এসে এবং তারপরই জান্নাতের সূচনা হয়। শুধু তখনই আপনি সুরক্ষিত হবেন, সম্পূর্ণ হবেন ও এক সময়ের ভগ্নচিত্র ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গল্পটা সেখানেই শেষ হয় না। বরং শুরু হয়। সেখানেই জীবনের গঠন শুরু হয়, আপনার চরিত্রের গঠন শুরু হয়, সবর, ধৈর্য, অধ্যাবসায় আর ত্যাগের নির্মাণ হয়। নিঃস্বার্থতা গড়ে ওঠে। ভালোবাসা গড়ে ওঠে।

এবং আপনার রবের দিকে ফিরতি পথের রচনা হয়।

কিন্তু আপনি যাকে বিয়ে করলেন সেই যদি আপনার অন্তিম লক্ষ্য হয় তাহলে আপনার সংগ্রাম মাত্র শুরু হলো। এখন আপনার জীবনসঙ্গীই হবে আপনার জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আপনার হৃদয়ের যে জায়গায় শুধু স্রষ্টার উপস্থিতি থাকা উচিৎ সে জায়গা থেকে সেই মানুষকে সরাতে পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আহত হতে থাকবেন। দুঃখজনকভাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি বুঝতে শিখবেন যে মানব হৃদয়ে এমন কিছু জায়গা আছে যা শুধুমাত্র স্রষ্টার দ্বারা স্রষ্টার জন্যই নির্মিত, এই তীব্র যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ার হাতিয়ার হবে আপনারই জীবনসঙ্গী।

এই দীর্ঘ লাভ, ক্ষতি, ব্যর্থতা, সফলতা ও অনেক ভুলভ্রান্তির পথের মাঝে আপনি আরও শিখবেন যে পৃথিবীতে অন্তত দুই রকমের ভালোবাসা আছে। এমন কিছু মানুষ থাকবে যাদের আপনি ভালোবাসবেন তারা আপনাকে যা দিবে ও যেমন অনুভব করাবে তার জন্য। খুব সম্ভবত বেশিরভাগ ভালোবাসা এই প্রকৃতির –- আর এই কারণেই বেশিরভাগ ভালোবাসা এত ঠুনকো। একজন মানুষের দেয়ার ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। আপনি যা গ্রহণ করেন তার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়াও সবসময় একরকম হয় না। তাই যদি এমন হয় যে আপনি একটা অনুভূতির পিছু ছুটছেন, তাহলে আপনি সবসময় ছুটতেই থাকবেন। কোন অনুভূতিই চিরস্থায়ী না। যদি ভালোবাসা এর উপর নির্ভর করে হয়, তাহলে তারও পরিবর্তন হয়। এবং পৃথিবীর আর সবকিছুর মতোই, আপনি যতই একে ধাওয়া করবেন এটা ততই আপনার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াবে।

কিন্তু কদাচিৎ এমন কিছু মানুষ জীবনে আসে যাদের থেকে আপনি কী পেলেন তার জন্য তাদের আপনি ভালোবাসেন না। বরং, তারা যেমন তেমনটার জন্যই আপনি তাদের ভালোবাসেন। তাদের মাঝে আপনি যে সৌন্দর্য দেখতে পান তা হচ্ছে স্রষ্টার প্রতিফলন, আর এই কারণে আপনি তাদের ভালোবাসেন। এখন হঠাৎ করেই বিষয়টা আর আপনি কী পাচ্ছেন তার উপর নির্ভর করছে না, বরং আপনি কী দিতে পারেন সেটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এটাই হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এই দ্বিতীয় প্রকারের ভালোবাসা খুব দুর্লভ। এবং এটা যদি স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার সাথে পাল্লা না দেয় বরং তার উপর ভিত্তি করে হয়, তাহলে এটাই সবচেয়ে বেশি সুখ এনে দিতে পারে। এটা ছাড়া আর সব ভালোবাসায় প্রয়োজন থাকে, নির্ভরশীলতা থাকে, আশা-আকাংখা থাকে, যার সবকিছুই কষ্ট আর হতাশা বয়ে আনে।

তিনতাই যারা ভালোবাসার খোঁজে জীবন পার করছেন তাদের জানা প্রয়োজন যে কোন কিছুর অনাবিলতা শুধু তার ‘উৎসের’ মাঝেই পাওয়া যায়। যদি আপনি ভালোবাসাই খুঁজেন, তাহলে তা স্রষ্টার মাধ্যমে খুঁজুন। আর যে সকল ধারা তাঁর ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে প্রবাহিত হয় না তা শুধু পানকারীকেই বিষাক্ত করে তোলে। এর পানকারী তা পান করতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না এর বিষ তার মৃত্যু ঘটাবে। সে ভেতরে ভেতরে বেশি থেকে বেশি ক্ষয় হতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে থেমে বিশুদ্ধ ‘উৎসকে’ খুঁজে নিবে।

যখন আপনি যা কিছু সুন্দর তাকে স্রষ্টার সৌন্দর্যের প্রতিফলন হিসাবে দেখতে শুরু করবেন তখন আপনি সঠিকভাবে ভালোবাসতে শিখবেন। আর তা হচ্ছে, স্রষ্টার জন্য ভালোবাসা! যে সকল কিছু আর যে সকল মানুষকে আপনি ভালোবাসেন তা হবে তাঁর জন্য, তাঁর মাধ্যমে এবং তাঁর কারণে। এমন ভালোবাসার বুনিয়াদ হচ্ছে স্রষ্টা। তাই আপনি যা ধারণ করবেন তা আর কোন পরিবর্তনশীল অনুভূতি বা ক্ষণস্থায়ী আবেগ হবে না। আপনি আর কোন সাময়িক আবেগের পিছু ছুটবেন না। আপনি যা ধারণ করবেন, যার পিছু ছুটবেন, যাকে ভালোবাসবেন সে হবে স্রষ্টা — একমাত্র স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় জিনিস। এরপর, বাকি সবকিছু হবে তাঁর মাধ্যমে। আপনার যা কিছু দেয়া-নেয়া, ভালোবাসা না-বাসা সবকিছু হবে তাঁর দ্বারা। আপনার নফসের দ্বারা না। তাঁর কারণে হবে। আপনার নফসের কারণে না।

এর অর্থ হচ্ছে আপনি তা-ই ভালোবাসবেন যা তিনি ভালোবাসেন আর যা কিছু তিনি ভালোবাসেন না সেসব কিছুকে আপনিও ভালোবাসবেন না। এমন যখন হবে তখন আপনি ভালোবেসে বিনিময়ের আশা না করে দিয়ে যেতে পারবেন। এবং ‘তিনি’ আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিবেন। আর যাকে স্রষ্টা সন্তুষ্ট করে দেন সে সমস্ত প্রেমিকের মাঝে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে মহৎ। আপনার ভালোবাসা হবে তাঁর দ্বারা, তাঁর জন্য এবং তাঁর কারণে। সেটা সৃষ্ট জীবের দাসত্ব থেকে নিজের মুক্তি লাভ। সেটা স্বাধীনতা। সেটা সুখ।

সেটা হচ্ছে ভালোবাসা!


উৎস: ইয়াসমিন মোজাহেদ.কম

অনুবাদ  : রাবেয়া রওশীন

 

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive